Partha Pratim Guha Neogy

Romance

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance

মানবতা

মানবতা

4 mins
351


শারদীয়ার সময় চারিদিক দেবীর আগমনীর সুরে মুখর। দোকান বাজার সর্বত্র মানুষের ভীড়, পাগলের মত মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে বাৎসরিক এই শারদ উৎসব উদযাপনে। মানুষে মানুষে চলছে নানা পরিকল্পনা কিভাবে এই কয়েকটা দিনকে 

আনন্দে মুখরিত করে তোলা যায়। শোনা যায় আমাদের নাকি অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় - কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন মানুষের হাতে পয়সার অভাব আছে দেখলে মনে হবে না। সমস্ত হোটেল রেস্টুরেন্ট সব জনাকীর্ণ, কোথায় বিনা কিউতে জায়গা পাবেন না। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন রূপকথার দেশে আছেন, যেখানে সব পাওয়া যায়। দুর্গাপুজোর মণ্ডপে চলেছে খরচ আর থিম পুজোর লড়াই। যার যত বেশী প্রভাব তার পুজোর খরচ তত বেশী আর তত জন সমাগম। এত বিলাসবহুল পুজোতে মায়ের স্থান কতটুকু? - এতো আত্মপ্রচারের নিদর্শন! এর থেকে কিছুদুরে এই শহরেই কিছু মানুষ তাদের জীবিকার জন্য দেড় বছরের উপর চোখে জল নিয়ে লড়াই করছে, এই পুজো কী ওদের নয়!


শহর থেকে খানিকটা দূরে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আজও এই উৎসবের দিনে পেটের দায়ে সেজেগুজে দাঁড়ানো মেয়েগুলোও দাঁড়িয়ে জীবনের মানে খুঁজচ্ছে।স্টেশনের মিটমিট করা লাইটপোস্টের নীচে আধোআধো আলোতে সস্তা কিন্তু ভারি মেকআপ করা দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরীকে এক কিশোর জিজ্ঞেস করলো,কত হলে যাবি।কিশোরী আঙুলের ইশারায় জানিয়ে দিল তার দাবী । তারপর তারা চলে গেল তাদের জায়গায়। 

  এরা দুজনে - ব্যক্তিজীবনে ছেলেটি একজন ছিনতাইকারী,সমাজের উচ্ছন্নে যাওয়া, মাদকাসক্ত। বস্তিতে জন্ম।বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। প্রেম-ভালোবাসাহীন জীবন তার। হাসতে হাসতে ছুরি ঢুকিয়ে দিতে পারে যে কোন কাউকেই। অনেকবার পুলিশের হাতে জনতার হাতে ধোলাই খেয়েছিল। তার কাছে এগুলো জীবনেরই অংশ। 

অন্যদিকে মেয়েটির রয়েছে এক করুণ ইতিহাস। শান্ত, স্নিগ্ধ ও নম্র স্বভাবের ছিল সে। স্কুলের ভালো ছাত্রী হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম ছিল। সে যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী হঠাৎ একদিন ট্রাক ড্রাইভার বাবা মারা গেলেন রোড এক্সিডেন্টে। বাবার মৃত্যুর পর মা আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। এরপর মেয়েটির ভরণপোষণের জন্য আর কেউ রইলো না।এলাকার এক দুষ্টুলোক চাকুরি দেওয়ার নাম করে কৌশলে ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল পতিতালয়ে। এদিকে পতিতালয়টিও একসময় উচ্ছেদের কারনে পৃথিবী নামক বিশাল এ গ্রহে তার আর কোথাও কোন জায়গা হলো না। অনেক চেষ্টা করেছিল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কিন্তু পূর্ব পরিচয় তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। অবশেষে আজ সে ভাসমান।


জীবনের গল্পে প্রেম,ভালোবাসা,মমতা এ দু’জনার কাউকেই কোনদিন স্পর্শ করেনি।জীবনের কঠিন কষাঘাত, তাচ্ছিল্য,ঘৃনা বিদ্বেষ,শ্রেনী ভেদাভেদ নিয়ে এদের জীবন। 

– কিন্তু কথায় আছে ঈশ্বর চাইলে কী না পারেন!

-চলুন আমরা ওদের জীবনের গল্পে ফিরে যাই ।

এবার ছেলেটি চলে আসার আগে মেয়েটিকে বললো,কিছু টাকা কম দেই আজ ।মেয়েটি বললো, কেন?ছেলেটি বললো,আজ যদি কোন খেপ না পাই তাহলে রাতে কিছু খাওয়ার পয়সা নাই। মানুষের মারের আঘাতে মেরুদণ্ডের হাড়ের ব্যথার কারনে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়,তোকে যদি সব দিয়ে দিই আমার হাতে আর কিছু থাকে না। ছেলেটি আরও বললো, যদি কোনরকমে একটা খেপ জোগাড় করতে পারি তোকে কম দেওয়া টাকা এসে আবার ফেরৎ দিয়ে দেব।

মেয়েটির কেন যেন মায়া হলো। সে কম নিল।মনুষ্যত্ব বলে কথা। মানব হৃদয় এমন এক বিস্মৃত বিষ্ময়কর যার পরিধি অসীম। সহায় সম্বলহীন এই মানুষগুলোর মধ্যে এই বিশ্বাসটুকু আজও আছে। আবার এই টাকা কম নেওয়া বিশ্বাস করা এই ব্যাপারটি ছেলেটিকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছিলো। সেদিন সে জানতে পারল তাকেও হয়ত কেউ বিশ্বাস করে। সেদিন একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছেলেটাকে গ্রাস করল।ছেলেটি এরপর থেকে সিদ্ধান্ত নিল প্রতিটি ছিনতাই এর পর তার টাকাগুলো মেয়েটির কাছে জমা রাখবে কেননা পাবলিকের হাতে ধরা পড়লে তার সব টাকা খোয়া যায়। তারপর যা চিন্তা তা-ই করতে লাগলো। প্রতিদিন লাইটপোস্টের নীচে এসে দেখা করে টাকাগুলো মেয়েটির কাছে জমা রেখে যায় রুটিন করে। মেয়েটিও তার টাকাগুলো আমানত হিসেবে নিলো।


 – এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে লাগলো। 

মেয়েটির বিশাল এক ভুল হয়ে গেছে এদিকে। তার নিজের উপার্জন আর ছেলেটির উপার্জন একসাথে জমা রাখতে গিয়ে গণ্ডগোল করে ফেললো।

এরমধ্যে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো। ছেলেটি বেশ কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। মেয়েটি চিন্তায় উদগ্রীব হয়ে গেল। খোঁজ নিতে শুরু করল চতুর্দিক। অবশেষে খোঁজ মিললো এক জনাকীর্ণ জায়গায় মুমূর্ষ অবস্থায় পাবলিকের গণপিটুনি খেয়ে পড়ে আছে। মেয়েটি তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সুস্থ হওয়ার পর কোনও একদিন হঠাৎ এক মায়াভরা মুহূর্তে ভালোবাসা জড়ানো কন্ঠে মেয়েটি ছেলেটিকে বললো,এভাবে আর কতদিন চলবি, জোয়ান মর্দ ছেলে;একটা রিক্সাওতো চালাতে পারিস। ছেলেটি বললো,আমি রিক্সা পাবো কোথায়! তখন মেয়েটি জানাল,তোর আর আমার ইনকামের টাকা আমি হিসেব করে আলাদা করে রাখতে পারিনি,ওগুলো একসাথে আছে। ওখানে তোর আর আমার জমানো যা আছে তা দিয়ে একটা রিক্সা কেনা হয়ে যাবে ।ছেলেটি আজ-ই যেন প্রথম আবেগে অশ্রুজলে সিক্ত হলো। মনের অজান্তেই কখন যে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বুঝতেই পারল না। তার মনে হল এই পৃথিবীতে ওরও কেউ আছে যে ওর জন্য ভাবে, ওর ভালো চায় - সব মিলিয়ে এক কথায় বলতে গেলে ওকে ভালোবাসে।এবার ছেলেটি সোজাসাপ্টা কিছু না ভেবে বলেই ফেললো, তুই যদি কোনদিন আমাকে ছেড়ে না যাস তবেই আমি তোর টাকা নিতে রাজি।


ভগবানের কাছ থেকে এক করুনমাখা বৃষ্টি অসীম প্রেমধারা হয়ে তাদের উপর বর্ষিত হলো - পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান উপহারই তো মানুষের মানুষকে ভালোবাসা । তারা প্রমাণ করে দিল প্রেম শ্বাশত,প্রেম চিরন্তন। প্রেমের কাছে কে পতিতা কে ছিনতাইকারী এসব গৌণ,মূখ্য বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, আর আস্থাবোধ।

হাতে মেহেদী লাল টিপ, লাল শাড়ি ও বাহারি রঙের চুড়ি আর ছেলেটির পাগড়ি শেরওয়ানির স্বপ্ন আজ যেন বাস্তবতা। তারা আজ পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিল প্রেম এমন এক অমোঘ অস্ত্র যা দিয়ে জয় করা যায় মানবহৃদয়, অন্য আর কিছুতেই নয়। তারা আরও শিখিয়ে গেল “পাপকে ঘৃণা করো,পাপীকে নয়”।তারপর তারা দুজনেই সুখে শান্তিতে সৎ উপার্জনে বসবাস করতে লাগলো। তাদের ঘরে কিছুদিন পর জন্ম নিল ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। 

দম্পতি তার নাম রেখেছে অমৃতা,কারণ পবিত্র ভালোবাসার অমৃতের ফলই তো এই মেয়েটি ।

তাদের এই ভালোবাসাই তো মানবতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন - প্রমান করে দিল এই পুজোর থিম একটাই মানবতা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance