লাভ_ক্ষতি(শেষ পর্ব)
লাভ_ক্ষতি(শেষ পর্ব)
"বাহ,কফিটাতো বেশ ভালোই বানালে।" 'হ্যাঁ,এখন ভালোই বানাই।শর্মি থাকলে অবশ্য ওই করত।ও চলে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে সব কিছু করতে হয় বলে এখন অনেক কিছুই বানাতে শিখে গেছি।ও চলে যাওয়ার পর প্রথমদিকে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগত।এখন অনেকটা মানিয়ে নিয়েছি।'
"একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?"
' কি?'
"ও কি তোমার কাছে এসেও পুরোপুরি ওর ভালোবাসাকে ধরতে পেরেছিল?"
(দীর্ঘশ্বাস)'হয়ত হ্যাঁ,বা হয়ত না।আমি ঠিক জানি না।তোমাকে প্রথমেই একটা কথা বললাম না,জীবনটা লাভ ক্ষতির পাতি হিসেব নয় যে সব সময় ডানদিক আর বাঁদিক মিলে যাবে।শর্মি তোমাকে এত ভালোবাসত,তারপরও ও তোমাকে ছেড়ে চলে আসতে পেরেছিল আমার কাছে।তোমার সাথে সম্পর্কটা ও চাইলেই মিটিয়ে দিতে পারত আমার কাছে আসার পরই।সেটাই যদি হত তাহলে অঙ্কের হিসেবে ঠিক মিলে যেত।আসলে পরে বুঝেছিলাম ও আমার কাছে এসেছিল তোমার প্রতি একটা তীব্র ক্ষোভ নিয়ে।আমার প্রতি যতটা না ভালোবাসা ওর মধ্যে জন্মেছিল তার থেকেও বেশি ছিল তোমার প্রতি ক্ষোভ।তোমার রিজেকশনের প্রতি ক্ষোভ।এটা একটা ঈর্ষার ব্যাপার ছিল।তুমি বা শর্মি এটা বোঝো নি,কিন্তু আমি ঠিকই বুঝেছিলাম।ও তোমার রিজেকশনটাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল।'
"নাহ,এটা আমি বুঝি নি।যখন আমি প্রথম তোমাদের ব্যাপারে জানতে পেরেছিলাম আমি টলে গেছিলাম।আমার মাথা ঘুরে গেছিল।আমি ভাবতেও পারি নি ও আমার থেকে কোনওদিনও সরে যাবে যে।হ্যাঁ ওর সাথে অনেক ঝগড়া হত,সেটা অনেক বড়ও হয়েছে অনেক সময়,একেক সময় আমাদের দুজনেরই মনে হত আর না অনেক হয়েছে,এবার দুজনের রাস্তা আলাদা হওয়াই উচিত,কিন্তু কয়েকদিন যাওয়ার পরই আমরা দুজন দুজনকে আর ভালো না বেসে থাকতে পারি নি।তখন দুজনেই অনেক কেঁদেছি আমাদের ছেলেমানুষির জন্য এবং প্রমিস করেছি ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার।তাই ও যে আমার থেকে কোনোদিন সরে যেতে পারে এই ব্যাপারটা মাথাতেই আসেনি।হ্যাঁ তুমি যে বলছ রিজেকশন,আমি কিন্তু কখনোই ওকে রিজেক্ট করিনি।আমরা দুজনেই একটা ভিসিয়াস সার্কেলের মধ্যে পড়ে গেছিলাম।"
'দেখো আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না।আজকে তোমাকে অভিযোগ জানানোর জন্য ডাকি নি।আমাদের দুজনেরই কিছু কথা দুজনকে জানানো দরকার ছিল তাই তোমাকে ডেকেছিলাম।এর আগে অনেক কথা কাটাকাটি হয়ত তোমার সাথে আমার হয়েছে।তুমিও আমাকে শত্রু ভেবে এসেছ আর আমিও শর্মির ওই অবস্থার জন্য তোমাকে দায়ী করে এসেছি।কিন্তু যার জন্য এত লড়াই আজ সেই যখন নেই তখন আর অভিযোগের ডালি খুলে লাভ কি?আমরা দুজনেই তো একই মানুষকে ভালোবেসেছিলাম,হয়ত এখনো ভালোবাসি।তাই ওকে নিয়েই কিছুটা সময় নাহয় কাটাই।'
"না না,আমি সেরকম ভাবে বলতে চাই নি।আসলে দোষারোপ আর অভিযোগের পালা চুকিয়ে দিয়েছি অনেকদিন আগেই।তোমার প্রতিও আমার এখন আর কোন ক্ষোভ নেই।প্রথমদিকে অবশ্য সব কিছুর জন্য তোমাকে দায়ী করেছিলাম।মনে হত আমাকে নিঃস্ব করে সব কিছু কেড়ে নেওয়ার পিছনে তুমি, একমাত্র তুমিই দায়ী।কিন্তু আজ এতদিন পরে এসে সেই অভিযোগ আমার আর নেই।হয়ত এটাই আমাদের দুজনের,বা বলা ভালো তিনজনের নিয়তি নির্দিষ্ট ছিল।প্রথমদিকে অনেক বিনিদ্র রাত আমি কাটিয়েছি ও পাকাপাকি ভাবে চলে আসার পর।তারপর আস্তে আস্তে মেনে নিই সব কিছু।সময় তো একজন বড় ডাক্তার।কিন্তু মাঝে মাঝে যখন বুঝতে পারতাম যে ও ফোনগুলো করছে তখন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারতাম না।একটা অসহ্য জ্বালাপোড়া শরীর কে ছারখার করে দিত।মাঝে মাঝে মনে হত যাই গিয়ে শর্মিকে,আমার শর্মিকে নিয়ে আসি তোমার কবল থেকে জোর করে।মনে হত, মনে হত ও হয়ত আমার কাছে ফিরে আসতে চায়,কিন্তু তুমি জোর করে আটকে রেখেছো।ও হয়ত আমাকে বলছে না ওর অভিমানের জন্য,ওর ইগোর জন্য,কিন্তু একবার আমি গিয়ে ওর কাছে দাঁড়ালেই ও আর আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।ওকে আমার কাছেই চলে আসতে হবে।কিন্তু তারপরই ভাবতাম যখন আমার কাছে ছিল তখন তোমার প্রতি ওর তীব্র পাগলামিগুলোর কথা।তখনই আমি পিছিয়ে আসতাম।ও আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিল।ভাবতাম তোমার কাছে গিয়ে ও হয়ত সুখেই আছে।তাই কি দরকার আবার ওকে অসুখী করে।আমি নিজে নাহয় রাতগুলো জেগে কাটিয়ে দিতে পারব।এরকম অনেক রাত তো জেগে কাটিয়েছি এর আগে।একদিনের একটা ঘটনা তোমাকে বলি শোনো।সেই সময় তোমাদের ব্যাপারে আমি জানতে পেরে গেছি।আমি বুঝতেও পারতাম ও তোমার সাথে ঘুরতে বেরোয়,এই নিয়ে অনেক ঝগড়া ঝাঁটি আমাদের মধ্যে হচ্ছে তখন।আমি বুঝতে পারছি আমরা ধীরে ধীরে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছি। একদিন দেখলাম ও অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলো।আমি বুঝলাম তোমার সাথেই বেরিয়েছিল।আমার শরীরে একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল।ভেবেছিলাম ওর সাথে একসাথে বসে রাতের খাওয়াটা খাব,কিন্তু ও যথারীতি খেয়ে ফিরেছিল।আমি কিছু বলি নি।রাতে যখন ও ঘুমোচ্ছে ওর চোখে দেখলাম একটা পরম শান্তি নেমে এসেছে।আমি সারা রাত ওর পাশে বসেই জেগে জেগে কাটিয়ে দিলাম।ওর ঘুম ভাঙালাম না।সেদিনই আমি বুঝে যাই ও আমার থেকেও তোমার কাছে থেকে বেশি সুখী হবে।"
' ভুল ভেবেছিলে।ও আমার কাছে এসে হয়ত একজন কাছের মানুষ পেয়েছিল কিন্তু মনের মানুষ পায়নি।আমি তখন সামনে থেকে ওকে দেখেছিলাম।ওর মনের মানুষের জন্য ওর সে কি তীব্র আকুতি ছিল তুমি ভাবতেও পারবে না।জানি না সেই মনের মানুষটা তুমি ছিলে কিনা।হয়ত সারাজীবন ও একজন মনের মানুষ খুঁজে গেছিল কিন্তু আমরা দুজনের কেউই ওর মনের মানুষ হতে পারিনি।আমার কাছে আসার পরও ও সারাক্ষণ গুমরে থাকত,যে হাসি খুশি শর্মিকে আমি দেখেছিলাম,এমনকি যাকে আমার কাছে নিয়েও এসেছিলাম,আমার কাছে আসার পর সেই শর্মিকে আমি আর পাইনি।ভেবেছিলাম যখন ও আমার কাছে এলো তখন একটা শান্তির জীবন পেলো ও।কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল।ওকে আমি বারেবারে জিজ্ঞাসা করতাম তুমি কি আগের জীবনে ফিরে যাবে?তখন ও বলত না, আমি আর ওখানে যেতে রাজি নই।তখন আমার তোমার প্রতি খুব রাগ হতো।ভাবতাম ভালো যখন বাসতে পারবেই না, তখন ওকে প্রথমেই সেটা জানিয়ে দিতে পারতে।নিজেকে ঠকে যাওয়া, হেরে যাওয়া মানুষ বলে মনে হত।শেষ পর্যন্ত তুমিই জিতে গেলে এটাই ভাবতাম।তোমার থেকে কেড়ে নিয়েও আমি জিততে পারলাম না।'
"জেতা হারাটা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার।জীবনের অঙ্ক মনে হয় কেউই মেলাতে পারে না।তাই এখানে হার জিতও হয়না।কেউই জেতে না আবার কেউই হারে না।"
'তোমার রাত জাগাগুলো এখন আমি প্রত্যক্ষ করতে পারছি।আমিও অনেক রাত জেগেছি এরকম।জেগে জেগে চুপ করে বসে থাকতাম।মাঝে মাঝে হিংস্র হয়ে উঠতাম।তার ফলটা শর্মিকে ভোগ করতে হত।হ্যাঁ আমাদের মধ্যেও প্রচুর ঝগড়া হত।বলতে গেলে ওর সাথে আমার থাকাটা পুরোটাই ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে কেটেছে।আমি বলতামও ওকে, যখন আগের জীবন তুমি ভুলতেই পারবে না, তখন আমার কাছে এলে কেন।ও শুধু নির্বাক হয়ে কাঁদতো।বলত তোমরা কেউই আমার ব্যাপারটা বুঝবে না।আসলে জীবনকে তোমরা দুজনেই খুব সহজ সরল ভাবে দেখতে চাও।আমি বলতাম তোমার মত জটিল মানসিকতার নই বলেই আমি সহজ ভাবে ভাবতে চাই জীবনকে।আজ বুঝি আসলে আমরাই দুজনে জটিল মনের,জটিল মানসিকতার।শর্মি ছিল সরল মানসিকতার।তাই ও এতটা কষ্ট পেয়ে গেছে জীবনে।ওর মৃত্যুটাও এর জন্যই এত তাড়াতাড়ি হল বলে মনে হয়।যে অমানুষিক চাপের মধ্যে ও থাকত তাতে বার্ধক্যটা অনেক আগেই ওকে গ্রাস করে।তার ওপর ব্লাড ক্যান্সার ওকে নিয়ে যাচ্ছিল আরো তাড়াতাড়ি মৃত্যুর দিকে।ওহ্, শেষের দিকে সে কি যন্ত্রণা ওর।আমি চোখের সামনে দেখতে পারতাম না।মাঝে মাঝে অন্য ঘরে গিয়ে আমি কাঁদতাম।ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতাম ওকে যাতে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায়।তুমি সেই সময় না এসে ভালোই করেছিলে।হাঁ,এখন বলছি ভালোই করেছিলে।তুমি ওকে ওই অবস্থায় দেখতে পারতে না।আসলে ও এসেইছিল জীবনের অঙ্কগুলোকে ওলোট পালট করে দেওয়ার জন্য।ও চলে যাওয়ার পরই একমাত্র নিজের জীবনের হিসেবটা মেলাতে পারল।বদলে আমাদের, আমরা যারা নিজেদের স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে করি তাদের জীবনটা উলটে পালটে দিয়ে গেল।ওর একটা ডায়রি তুমি রেখে দাও।ও বলেছিল এটা তোমাকে দেওয়ার জন্য।এখানে ও নিজের কিছু কথা লিখে রেখে গেছে।আমি অবশ্য পড়ি নি।কি লাভ পড়ে।হয়ত তোমার ব্যাপারেই লিখে গেছে।রেখে দাও এটা।সময় করে পড়ে দেখো।
(বিশাল ড্রয়িংরুমটায় চল্লিশোর্ধ দুই পুরুষ আর এক ফ্রেমে এক নারী তিনজনেই তিনজনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।একটা লাল ডায়েরী শুুধু পড়ে রইল টেবিলে)