Arijit Guha

Romance Crime

2.8  

Arijit Guha

Romance Crime

অান্ধেরা_রাত(শেষ পর্ব)

অান্ধেরা_রাত(শেষ পর্ব)

5 mins
15.3K


রামপ্রসাদ শর্মা তার 'দুকান' থেকে সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ফিরছিল।'সাইকিল'টার টায়ার পাংচার হয়ে গেছে বলে রাস্তা দিয়ে না ফিরে পুকুরের পাশ দিয়ে যে শর্টকাট রাস্তাটা আছে, যেটা দিয়ে কেউই প্রায় যাতায়াত করে না, সেটা দিয়েই ফিরছিল।হঠাৎ কানে একটা পরিচিত গলা আসাতে দাঁড়িয়ে পড়ল।বিন্দুর গলা মনে হচ্ছে না! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল 'রাজপুত কা বেটা' প্রকাশের সাথে বসে গল্প করছে বিন্দু! তার মানে গ্রামে অল্প আধটু কানাঘুষো যা শোনা যায়, তা তার মানে সত্যি! বিশ্বাস করত না রামপ্রসাদ।কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনকে দেখে গেল।রাগে তার শরীর জ্বলছে।অথচ বিন্দু বা প্রকাশ দুজনের কেউ খেয়ালই করছে না রামপ্রসাদকে। 'বত্তমিজ্ লেড়কি, তেরি ইতনি হিম্মত'? পুকুরপাড়ের রাগটাই বিন্দুর সামনে ফুটে বেরোচ্ছে ওর পিতাজি রামপ্রসাদের শরীর থেকে।'আজ সে তেরা বাহার নিকলনা বনধ'।টানতে টানতে বিন্দুকে নিয়ে গেল রামপ্রসাদ পিছনের ঘরে।আটকে রেখে বাইরে থেকে শিকল টেনে দিল দরজায়।

  চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে অনুরোধ করে যাওয়াও কোনো কাজে দিল না।রামপ্রসাদের পাথর হৃদয় মেয়ের ওই চিৎকারে একটুও গলল না। 'প্রকাশ ভাইয়া, প্রকাশ ভাইয়া' হাঁপাতে হাঁপাতে মংলু প্রকাশকে দাঁড় করালো ওর বাড়ির সামনে।'ক্যা হুয়া রে মংলুয়া, ইতনা জোর দৌড়কে কাঁহা সে আওবাত হো'?

  মংলু একসময়ে প্রকাশদের বাড়িতে ফাই ফরমাশ খাটার কাজ করত।এখন নানা ধরনের টুকটাক কাজ করে নিজের খোরাকি জুটিয়ে নেয়।ওর বাড়ি বিন্দুদের বাড়ির ঠিক পাশেই।

 'বিন্দুয়া বিন্দুয়া...'

 'কেয়া হুয়া বিন্দুয়া কো'?

 'ভাইয়া, বিন্দুয়া কো....'

 'হা হা বোল না? কা হুয়া বিন্দুয়া কো? চুপ কাহে হ্যায়, বোল না ক্যা হুয়া বিন্দুয়া কো?’

 একটু দম নিয়ে মংলু যা বলল তা শুনে রামপ্রসাদজির ওপর রাগে গা জ্বলতে লাগল প্রকাশের।কিন্তু এই মুহূর্তে ওর হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার কথা মাথায় এলো না।সেই সময়ে প্রকাশের পাশে মনোজ দাঁড়িয়ে ছিল।পুরোটা শুনে মনোজ প্রকাশকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল।দুজনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে খানিকক্ষণ তর্কাতর্কির পর প্রকাশ মনোজের কথাতেই শেষ অব্দি সায় দিল।

 মংলুকে বলল বিন্দুকে যেন যেভাবে পারে একটা চিরকুট পৌঁছে দেয়।আর তার সাথে কি কি করতে হবে সে ব্যাপারে বিশদে বুঝিয়ে বলে দিল।

পারবি তো? মংলুকে জিজ্ঞাসা করল প্রকাশ। মাথা নেড়ে মংলু সায় দিতে প্রকাশ বাড়ির ভিতর থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসে তার মধ্যে কিছু একটা লিখে মংলুর হাতে দিল।বারবার করে মংলুকে বলে দিল আর কারো হাতে যেন এই কাগজটা না যায়।শুধু বিন্দুকেই দিতে হবে কাগজটা।মংলু কাগজটা ভাঁজ করে ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে নিল।

 সেদিন অনেক রাতে বিন্দুর ঘরের খিড়কি জানলায় মংলু টোকা মারল।আস্তে করে বিন্দুকে ডাকতে প্রথমে মংলুর গলার স্বর শুনে একটু ঘাবড়ে গেল বিন্দু।কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।কোনোরকমে খিড়কির জানলা খুলতেই মংলু প্রথমেই কাগজের টুকরোটা বিন্দুর হাতে দিল।বিন্দু পড়ার পরই মংলু সেটা বিন্দুর হাত থেকে নিয়ে মুড়িয়ে রাস্তায় ফেলে দিল।তারপর প্রকাশ কি কি বলেছে মংলুকে সবিস্তারে সেটা বলে গেল।বিন্দু সব শুনে প্রথমে একটু ভয় পেল, তারপর চোখ মুখ শক্ত করে বলল 'আচ্ছা ঠিক আছে।তাই হবে।'

      প্রত্যেক দিন ভোরবেলা উঠে রামপ্রসাদ পূজা পাঠ করে বাড়ির চারদিকে একটু চক্কর মারে।এতে শরীর ও মন পবিত্র হয়।সেদিনও ভোরবেলা রামপ্রসাদ বাড়ির চারিদিকে চক্কর মারতে মারতে বিন্দুর ঘরের খিড়কি জানলার সামনে এসে একটু দাঁড়াল।রামপ্রাসাদের নির্দেশে গতকাল বিন্দুকে সারাদিন খেতে দেওয়া হয় নি।জানলার সামনে আসতে মেয়ের কথা ভেবে মনটা একটু আদ্র হয়ে এলো রামপ্রসাদের।মেয়ে হলেও যতটা পারতো আদর যত্ন করত বিন্দুর।বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে একটা ভালো সম্বন্ধও ঠিক করে রেখেছিল মেয়ের জন্য।পারলে আরো অনেক আগেই বিয়ে দিয়ে দিত মেয়ের, কিন্তু এখন আইন কানুন অনেক কড়া হয়েছে।যদিও দেশ দেহাতে সবাই এসব মানে না, কিন্তু আঠারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিলে যদি কাগজওয়ালাদের কেউ খবর দিয়ে দেয়, তাহলে পুলিশ অনেক ঝামেলা পাকায়।তাই রামপ্রসাদ ঠিক করে রেখেছে মেয়ের আঠেরো হলেই বিয়ে দেবে।আর কয়েক মাস মাত্র বাকি আছে বিয়ের উমর হতে।কিন্তু ওই রাজপুতের ব্যাটার সাথে মেলামেশা করতে দেখে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।নাহ, নিজেকে শক্ত করল রামপ্রসাদ।বেটিকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার।ফিরেই চলে আসছিল রামপ্রসাদ, হঠাৎ মাটিতে পরে থাকা একটা কাগজের টুকরোর দিকে চোখ পড়াতে থেমে গেল।নিচু হয়ে কাগজটা কুড়িয়ে খুলে দেখল কি লেখা আছে।তারপর সেটা ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে নিল।কান মাথা ঝাঁঝাঁ করতে শুরু করেছে রামপ্রসাদের।গতকালের রাগটা আবার ফিরে আসছে।

    সেদিনই গভীর রাতে খিড়কির জানলা ভেঙে বিন্দুকে বের করে আনল মংলু আর প্রকাশ।প্রকাশের সাথে ওর কলেজের বন্ধুরাও ছিল।কাজটা খুব সহজ ছিল না।গ্রীল কাটার জোগাড় করাটাই প্রথম সমস্যা ছিল।সেটা জোগাড় করে ধীরে সুস্থে কেউ যাতে টের না পায় সেরকমভাবে খিড়কি জানলার গ্রীল কাটতে হয়েছে।এরপর মংলুকে বিদায় জানিয়ে প্রকাশদের মোটর গাড়িতে উঠেছিল সবাই মিলে।স্টিয়ারিং এ মনোজ। পুরো প্ল্যানটা অবশ্য মনোজেরই।প্রকাশকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মনোজ সেদিন বলেছিল বিন্দুকে নিয়ে শহরে চলে যেতে।ওখানে ওদের কোনো বন্ধুর বাড়িতে কয়েকমাস কাটিয়ে বিন্দুর আঠারো হলেই রেজিস্ট্রি করে ফেললে আর কারো কিছু করার থাকবে না।আস্তে আস্তে প্রকাশের বাড়িতেও মেনে নেবে সব কিছু।কতদিনই বা আর রাগ করে থাকা যায় নিজেদের ছেলের ওপর!

    গ্রামের রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে এসে হাইওয়ের ওপর উঠতেই চাকায় কিছু একটা ফেঁসে গিয়ে গাড়ির টিউব পাংকচার হয়ে গেল।মনোজ গাড়ি থেকে নেমে কি হয়েছে দেখতে গিয়ে পাশ থেকে মাথায় জোরে একটা লাঠির বাড়ি খেয়ে রাস্তাতেই পড়ে গেল।সাথে সাথে চারদিক থেকে কারা যেন গাড়িটা ঘিরে ধরল।টানাহেঁচড়া করে ছয়জন মিলে বিন্দুকে বের করে আনল গাড়ি থেকে।বাকিরা সবাই বাধা দিতে গেলেও কোনো লাভ হল না।বিন্দুর চিৎকার আকাশ ছুঁয়েছে সেই সময়।কিন্তু ফাঁকা হাইওয়েতে সেই চিৎকারে সাড়া দেওয়ার মত কেউ ছিল না।ছজনের শক্তির কাছে পরাস্ত হল বিন্দু।

     একটু দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা রামপ্রসাদের চোখ আর মাথা তখনও জ্বলে যাচ্ছে।ভোরবেলা চিরকূটটা হাতে আসার পর সেই যে জ্বলা শুরু হয়েছিল, সেই আগুন এখনো নেভে নি।পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল পুরো ঘটনাটা।প্রকাশের বাবা গিরিধারি সিং। কাগজটা হাতে পাওয়ার পরই রাগে সর্বশরীর জ্বলতে শুরু করেছিল রামপ্রাসাদের।কিন্তু মাথায় কিছু আসছিল না।কিছুক্ষণ বাদে সকাল হতে গিরধারি সিং কে গিয়ে সব কথা খুলে বলেছিল।হাতে সময় কম, রাতের মধ্যেই দুজনে পালানোর প্ল্যান করেছে দেখে গিরিধারি নিজের জাতের বাছাই করা কিছু লোককে খবর পাঠিয়ছিল।রামপ্রসাদও পিছিয়ে থাকে নি।সেও যোগাযোগ করেছিল পাশের গ্রামের তার বেরাদরির লোকেদের সাথে।এরপর যা যা করার প্ল্যান হয়, তা মিলিতভাবেই হয়েছিল।রাজপুত আর ভূমিহার মিলিতভাবেই বিন্দুকে কড়া শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেছিল।তবে সেটা গ্রামের মধ্যে নয়।দোষ করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।

    

 রাস্তার পাশের নিচু জমিতে তখন বিন্দুর যোনি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল দুই জাতের মিলিত সংগ্রামে।এই লড়াই নিজের জাত রক্ষা করার লড়াই।এই লড়াইতে একফোঁটা ঢিলে দিলে চলবে না।

    রামপ্রসাদের চোখে মুখে আগুনের সাথে এক দৃঢ় প্রত্যয় দেখা দিল।গ্রামের সবাই আস্তে আস্তে জানতেও পারছিল ওদের দুজনের ব্যাপারে। ওই মেয়েকে কেউই ঘরে তুলত না।কিন্তু আজ নিজের জাত রক্ষা করতে পেরে একটু গর্বও হচ্ছে তার।দোষ করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance