কোড
কোড
প্যাস্টেলের বাক্সটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না তুতান। অথচ আজ বিকালে আঁকার ক্লাস। বাবাকে বলতেই ওর বাবা বললেন, আগে বলতে পারতিস তো। এইমাত্র বাজার থেকে এলাম। একবারে নিয়ে আসতে পারতাম।
তুতান চুপ।
সপ্তাহে দু'দিন বাজার করেন ওর বাবা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে। অফিস থেকে ফিরে। আর এই রবিবার সকালে। একসঙ্গে তিন-চার দিনের শাক সবজি, মাছ, মাংস নিয়ে আসেন। আর বাজার থেকে ফিরেই তার এক কাপ গরম গরম চা চাই। সে শীতকালই হোক বা গ্ৰীষ্ম। চা খেলেই তার বাবা একদম দিলখুশ। এটা যেমন ওর মা জানেন, তুতান ও জানে।
বাবার চা খাওয়া শেষ হতেই তুতান বলল, বাবা, চলো না রং নিয়ে আসি ।বিকেলে আঁকার ক্লাস আছে।
--- দাঁড়া দাঁড়া, নিয়ে আসছি। বাবা বলতেই ও বলল, আমিও যাব।
--- তুই আবার কি করতে যাবি?
ভেতরের ঘর থেকে ওর মা বলে উঠলেন, ও যখন যেতে চাইছে নিয়ে যাও না। থাকলেই তো হয় পোগো, না হয় কাটুন নিয়ে বসবে।
ওর বাবা বললেন, ঠিক আছে।
দোকানটা একটু দূরে। বাবার হাত ধরে যেতে যেতে রাস্তার এক ধারে লোকজনের একটা জটলা দেখে তুতান বলল, বাবা আমি বাঁদর খেলা দেখব।
--- বাঁদর খেলা?
--- ওই তো ওখানে। ক’দিন আগে ছুটির সময় ওদের স্কুলের সামনে বাঁদর খেলা বসেছিল। সেখানেই এ রকম ভিড় হয়েছিল। আর ওই একই রকম ভিড় দেখে ওর মনে হয়েছে, এখানে বুঝি বাঁদর খেলা হচ্ছে।
ওর বাবা বললেন, বাঁদর খেলা না রে, আমার মনে হচ্ছে অন্য কিছু হবে।
ও নাছোড়বান্দার।
--- চলো না, গিয়ে দেখি, বলেই বাবাকে টানতে টানতে ও নিয়ে গেল সেখানে। গিয়েই বাবার হাত ছেড়ে সবাইকে ঠেলেঠুলে একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল। না। বাঁদর খেলা নয়। রাস্তার উপরে একটা প্লাস্টিক সিট বেছানো। তার উপরে কতগুলো কৌটো-টোটো, গাছের শিকড়-বাকড়, হাড়গোড় আর মানুষের মাথার একটা খুলি। সেখানে একটা ছেলে বসে আছে। কালো পুরু কাপড় দিয়ে তার চোখ বাঁধা ।তাদের ঘিরে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে। তার মধ্যে তুতানও আছে। সেখানে নীল জামা পরা একটা লোক গোল করে জটলা হাওয়া লোকগুলোর কাছে যাচ্ছে, তাদের এক একটা জিনিস ধরছে আর জিজ্ঞাসা করছে, এটা কী? ওটা কী? সেটা কী? আর চোখ বাঁধা ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে তা বলে দিচ্ছে।
নীল-জামা পরা লোকটা তখন বলে যাচ্ছে টনির ভাই...
--- হ্যাঁ ভাই... উত্তর দিল চোখ বাঁধা ছেলেটা।
লোকটা বলল, আমার সঙ্গে ঘুরতে যাবে?
--- কোথায় কোথায় যাবে?
--- সব জায়গা যাব।
--- এখানে এসো ।ভিড়ের সামনে ঘুরতে ঘুরতে একবার এ দিকে একবার ও দিকে যাচ্ছে লোকটা।
ছেলেটা বলল যাচ্ছি।
লোকটা সামনে একটা লোকের চশমা দেখিয়ে বলল, কি দেখছ?
ছেলেটা বলল, চশমা।
অবাক হয়ে গেল তুতান। লোকটার তো চোখ বাঁধা। কী করে বলল!
তার পাশেই অন্য আর একটা লোকের কাছে গিয়ে তার জামা দেখিয়ে লোকটা বলল, গায়ে কি ?
ছেলেটা বলল, জামা।
--- না বলতে পারলে কিন্তু দাদা রেগে যাবে। জামার রংটা কী বলো...
ছেলেটা বলল, লাল।
তুতান চমকে গেল। অদ্ভুত তো! স্কুলের টিফিনের সময় যখন কোনও মেয়ে পিছন দিক থেকে তার চোখ টিপে ধরে, সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, কে ধরেছে। আর, ওই ছেলেটা, চোখ বাঁধা অবস্থায় অত দূর থেকে জামার রং বলে দিচ্ছে!
ওই লোকটার পাশেই একটা টাক মাথা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তার মাথায় হাত রেখে সে বলল, আমি কোথায় হাত দিলাম ?
ছেলেটা বলল, টাকে।
লোকটা ঘুরে ঘুরে ভিড়ে দাঁড়ানো লোকগুলোর এক একটা জিনিস দেখানো মাত্রই চোখ বাঁধা ছেলেটা মুহূর্তের মধ্যে পটাপট বলে দিচ্ছে। লোকটা ফের আর একটা লোকের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুক পকেটে থাকা কলম দেখিয়ে বলল, এটা কি?
ছেলেটা বলল, পেন।
যার কলম, সে পকেট থেকে কলমটা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, এটায় কী রঙের কালি আছে, ও বলতে পারবে?
লোকটা বলল, কেন পারবে না! আলবাত পারবে। বলেই, কলমটার খাপ খুলে সে নিজের হাতের তালুতে খচখচ করে দু'-তিন বার ঘষেই বলল, ও টনি ভাই, বলো তো এই পেনের কালি টা কী রঙের?
ছেলেটা বলল, নীল। যার পেন তার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল। একটা ছেলের হাতে ছিল মোবাইল। ওই মোবাইলটা হাতে নিয়ে নীল জামা লোকটা বলল, আরে মাথামোটা ভাই, বল তো এটা কোন কোম্পানির মোবাইল?
ছেলেটা বলল, মোটোরোলা।
যার মোবাইল, তার হাতের দিকে তাকাতে লাগল আশেপাশের লোকেরা। একজন পকেট থেকে তার হ্যান্ডসেটটা দেখিয়ে বলল, এটা কোন কোম্পানির হ্যান্ডসেট ও বলতে পারবে?
কেন পারবে না?লোকটা এক ঝলক সেটা দেখে নিয়ে বলল, এটা কী কোম্পানির বলতে পারবে?
সে বলল ।নোকিয়া।
তুতান যত দেখছে ততই চমকে চমকে উঠছে। সে যখন বিকাল বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কানামাছি খেলে, চোখ বেঁধে দিলে সে তো কিছুই দেখতে পারে না। আন্দাজে আন্দাজে কোনও রকমে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে একবার এ দিকে একবার ও দিকে যায়। যে দিকে যাচ্ছে ভাবে, চোখ খুলে দেখে, সে একবারে অন্য দিকে চলে এসেছে। ছেলেটা এত দূরে যে, চোখ খোলা থাকলেও লোকটা কি দেখাচ্ছে, ওখান থেকে বোঝা মুশকিল। আর ওই ছেলেটার চোখ তো মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা, তবু ও দেখছে কী করে? না দেখলে কি কেউ এ ভাবে একেবারে প্রতিটা জিনিস নির্ভুল ভাবে বলতে পারে? তা হলে কি কোনও মন্ত্রটন্ত্র জানে!
নীল-জামা পরা লোকটা ততক্ষণে আর একজনের কাছে গিয়ে তার হাত ঘড়ি দেখে বলল, টনির ভাই, এ দিকে এসো ।টাইমে টাইমে বলো, দাদার হাতের ঘড়িটা কোন কোম্পানির ?
ছেলেটা বলল, টাইমেক্স।
শুধু তুতান নয়, অবাক হয়ে যাচ্ছে সবাই। একজনের বুঝি সন্দেহ হয়েছিল, সে ভিড় ঠেলে সামনে এসে তার আংটিটা দেখিয়ে বলল, দাদা এই পাথরটা কী রং ওকে বলতে বলুন দেখি...
নীল-জামা পরা লোকটা বলল, আরে এ দিকে এসো। আরো সামনে। ভাল করে দ্যাখো, দাদার আংটিটার পাথরের রং কী?
ছেলেটা বলল, সাদা।
নীল-জামা পরা লোকটা এ বার একজনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা, আপনি তো খুব পেটের রোগে ভোগেন। ভাল করে চিকিৎসা করান।
লোকটা হা হয়ে গেল। সত্যিই তো, তার পেটের রোগ আছে। আর একজনের সামনে গিয়ে সে বলল, একবার তো এক্সিডেন্ট হতে হতে খুব জোর বেঁচে গেছেন। একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।
তুতান বিস্মিতর পর বিস্মিত। যাকে চেনে না, জানে না, তার কী অসুখ আছে, সে কবে এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেছে, উনি জানলেন কী করে! এমনিতে ও পড়াশোনায় ভাল। একবার শুনলেই মনে রাখতে পারে। ও প্রতিটা প্রশ্ন তার উত্তর মন দিয়ে শুনতে লাগল। হঠাৎ নীল-জামা পরা লোকটা ওর কাছে এসে বলল, টনির ভাই, বলো তো এটা ছেলে না মেয়ে?
ছেলেটা বলল, মেয়ে।
তুতানের পাশে ছিল একটা লোক। সে হঠাৎ বলল, দাদা, আমার পকেটে কত টাকা আছে ও কি বলতে পারবে?
নীল-জামা পরা লোকটা বলল, না। কারও নাম, কে কোথায় থাকে, বা কে কোথায় কাজ করে, কিংবা কার পকেটে কত পয়সা আছে, এ সব উত্তর ও দেবে না। এ ছাড়া যদি অন্য কোনও প্রশ্ন থাকে তো বলুন...
ওই লোকটার পাশেই যে লোকটা ছিল, সে পকেট থেকে ছোট্ট একটা তালা, সঙ্গে সুতো লাগানো চাবি দেখিয়ে বলল, এটা কী বলতে বলুন তো... লোকটা দেখল, তালাটা একবারে নতুন। বুঝতে পারল, লোকটা এখনই কিনে নিয়ে আসছে।
নীল-জামা পরা লোকটা বলল, টনির ভাই, এ দিকে এসো। দাদা কী দেখাচ্ছে বলো।
চোখ বাঁধা ছেলেটা বলল, সাদা।
নীল-জামা বলে উঠল, তোমার মাদুলি কাজ করছে না। ঠিক করে বলো। তার পরেই গোল করে ঘিরে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা হাতগুলো ছেড়ে দিন। হাত বাঁধা থাকলে ওর অসুবিধা হয়। এ কথা শোনা মাত্র যারা বিবেকানন্দের মতো দাঁড়িয়েছিল বা যারা এক হাত দিয়ে অন্য হাত ধরেছিল কিংবা মুঠো করে ছিল, তারা সবাই যে যার হাত ছেড়ে দিল। নীল-জামা ফের তালার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাল করে দেখে নাও, এখানে যে ভাইবোনেরা আছে, তারা জানতে চায়, সবাই যা দেখছে, সেটা কী, সেটা বলো। এ বার ‘কী’ শব্দটার উপরে জোর দিল সে।
অমনি চোখ বাঁধা ছেলেটা বলল, আরে বাবা, তালা, তালা।
তুতান অবাক। কী করে বলল ছেলেটা!
লোকটা তখন ও বলে যাচ্ছে, এটা এমন কিছু না। আপনারাও বলতে পারবেন। শুধু একটা মাদুলি। ব্যস। শিকড় বাকড়, কৌটা-টৌটো আর মানুষের খুলি যেখানে ছিল, সেখান থেকে একটা বড় মতো ডিবে তুলে নিয়ে এসে বলল, এই কৌটোয় কয়েকটা শিকড় আছে। মহামূল্যবান শিকড়। এটা যাতে শুকিয়ে পড়ে না যায়, সে জন্য মাদুলির মধ্যে ভরা আছে। এই মাদুলি সঙ্গে থাকলে,একুশ দিনের পর থেকে আপনি ও চোখ বন্ধ করে সব বলে দিতে পারবেন। যেমন ও পারছে।
শিকড়! চকচক করে উঠল তুতানের চোখ। লোকটা বলে যাচ্ছে যার যার লাগবে হাত তুলুন। হুড়োহুড়ি করবেন না। সবাই পাবেন। আমি প্রত্যেককেই দেব। এর জন্য কোনও পয়সাকড়ি লাগবে না। আমার গুরু, কামাখ্যা-কামরূপে সাধনা করে এই শিকড়টার সন্ধান পেয়েছেন। উনি বলে গিয়েছেন, এটা তোকে দিয়ে গেলাম বেটা। তুই লোককে দিবি। লোকের ভালো করবি। তাই এই শিকড় দেবার জন্যই আমি এখানে এসেছি।
তুতান পিছনে তাকাল। তার বাবা বোধধায় একদম পিছন দিকে রয়েছে। বাবা কি হাত তুলেছে! অনেকেই হাত তুলেছে। তুতান ও হাত তুলল।
হঠাৎ সে তার বাবার গলা শুনতে পেল, তুতান, তুতান...
পেছন ফিরে এসে বলল, হ্যাঁ বাবা...
--- এ দিকে আয়।
--- শিকড়টা নিয়ে নিই...
--- এ দিকে আয়, এ দিকে আয়...
কী করবে বুঝতে পারছে না তুতান। তার পর ভাবল, অত বড় একটা ডিবে ভর্তি মাদুলি, মাদুলি তো এইটুকু-টুকু হয়, ওখা
নে কি আর চার পাঁচশোটা হবে না? সেই তুলনায় তো লোক অনেক কম! সবার শেষে গেলেও সে একটা পাবে। তাই ভিড় ঠেলে ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে এল সে। --- কী বলছ ?
--- চল, রং নিবি না
--- আগে শিকড়টা নিয়ে নিই।
--- শিকড়?
--- হ্যাঁ, বিনে পয়সায় দিচ্ছে গো...
--- ধ্যাত, যত্তসব। চল। প্রায় ধমকের সুরেই কথাটা বলল ওর বাবা।
--- আরে, শিকড় নিলে একুশ দিনের পর থেকে আমিও চোখ বন্ধ করে সব বলতে পারব। লোকটা বলল, শুনলে না!
--- তুই ওই লোকটার কথা বিশ্বাস করেছিস? ওগুলো সব বাজে কথা।
--- বাজে কথা! তা হলে ওই চোখ বাঁধা ছেলেটা সব বলছে কী করে?
--- এটাকে বলে সাংকেতিক ভাষা। এটা কেবল ওরা দুজনেই বুঝতে পারবে। অন্যরা হাজার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবে না। ওই নীল-জামা পরা লোকটা যা যা প্রশ্ন করছিল, সেই প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর দেওয়া ছিল। সেই উত্তরটা চোখ বাঁধা ছেলেটা বলে যাচ্ছিল।
--- কী করে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল তুতান।
ওর বাবা বললেন, এই খেলা দেখাবার আগে অন্তত পঞ্চাশ বার ওরা প্র্যাকটিস করেছে। আর সেখানেই ওরা ঠিক করে নিয়েছে কোন সংকেত দিলে কী উত্তর দিতে হবে। যেমন লোকটা প্রথমে বলল কী দেখছ? লোক কী দিয়ে দেখে? চশমা দিয়ে। তাই তো? তাই ‘দেখা’ মানেই চশমা। ফলে ছেলেটা বলল, চশমা। তার পর বলল গায়ে কী? ছেলেটা বলল, জামা। গায়ে তো প্যান্ট থাকবে না। জামাই থাকবে।
--- যদি শাড়ি পড়ে থাকত? তুতান জানতে চাইল।
--- তখন প্রশ্নটা আর ‘গায়ে কী’ হত না। হত ‘পরনে কী’?
--- কিন্তু জামার রংটা বলল কী করে?
--- প্রশ্নটা মনে আছে? জামার রং জিজ্ঞাসা করার আগে লোকটা বলেছিল, ‘না বলতে পারলে কিন্তু দাদা রেগে যাবে।’ ওই 'রাগ'টাই হচ্ছে কোড। আমরা যেমন অনেক সময় বলি, রেগে লাল। তার মানে রাগের রং লাল। লোকটা যখনই রাগ শব্দটা বলেছে, ছেলেটা বুঝে গেছে, আমাকে লাল বলতে হবে।
--- মাথায় হাত দিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় হাত দিলাম, তখন ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে তা বলে দিল কী করে?
--- সেটা আগে থেকেই ঠিক করা আছে। বেশির ভাগ লোকেরই তো চুল আছে। তাই ভিড়ের মধ্যে যদি টাক মাথা কাউকে দেখা যায়, তা হলে তার মাথায় হাত রেখে এই প্রশ্নটা করলেই ও বলে দেবে,টাক।
--- কলমটা কী করে বলল?
--- এটাও আগে থেকে ঠিক করা আছে। বুক পকেটে তো কেউ আর ট্রানজিস্টার নিয়ে ঘুরবে না। ঘুরলেও তাকে দেখিয়ে ও জিজ্ঞাসা করবে না। যার পকেটে কলম আছে, একমাত্র তাকে দেখিয়েই ও প্রশ্ন করবে, পকেটে কী? ফলে ওই লোকটা প্রশ্নটা করতেই ছেলেটা বলল, কলম।
--- কালির রংটা বলল কী করে?
--- এটা আরও সোজা। কারণ বেশির ভাগ লোকই নীল রঙের কালি ব্যবহার করে। তাই...
--- যদি কালো রং হত?
--- তখন অন্য কোড দিত।
--- ঠিক আছে, এটা নয় হল। কিন্তু মোবাইলটা কোন কোম্পানির সেটা বলল কী করে?
--- তার আগে কী বলেছে মনে আছে?
--- হ্যাঁ, ওরে মাথামোটা...
--- এই ‘মাথামোটা’টাই হচ্ছে কোড। মাথামোটা মানে 'ম'। আর 'ম' মানেই মোটোরোলা।
--- তা হলে পরেরটা বলল কী করে?
---ও বলেছিল, ‘এটা কী কোম্পানি?’ নোকিয়ার মাঝের অক্ষরটা ‘কী’। ফলে 'কী' মানেই নোকিয়া।
--- যদি মোটোরোলা বা নোকিয়া না হয়ে অন্য কোনও কোম্পানির হত?
--- তা হলে তার কোড অন্য হত। যেমন আমারটা স্যামসুং। আমারটার ক্ষেত্রে হয়তো বলত, দাদার মোবাইলটা বেশ সুন্দর। এই সুন্দরের ‘সু’ দেখেই চোখ বাঁধা ছেলেটা স্যামসুঙের তৃতীয় অক্ষর ‘সু’য়ের সঙ্গে মিলিয়ে স্যামসুং বলে দিত।
--- আচ্ছা ঘড়িটা কোন কোম্পানির, সেটা বলল কী করে?
--- ওই কোড অনুযায়ী। কোন কোম্পানি জিজ্ঞেস করার আগেই কিন্তু লোকটা বলে দিয়েছিল, টাইমে টাইমে বলো। এই ‘টাইমে টাইমে’টাই হচ্ছে কোড। 'টাইমে টাইমে' মানেই টাইমেক্স।
--- আচ্ছা, নীল-জামা পরা লোকটা ওই লোকটাকে কী করে বলল, আপনি পেটের রোগে ভোগেন?
--- ওটা কমন সেন্স। নব্বুই ভাগ লোকই কম-বেশি পেটের রোগে ভোগে। তাই তার ওপর ভিত্তি করেই ওটা আন্দাজে বলা।
--- যারা পেটের রোগে ভোগে না। না বুঝে তেমন কাউকে যদি ভুল করে এই কথা বলে দিত?
--- কোন অসুবিধা হত না। কারণ, এতগুলো ঠিক বলছে তো... তখন ওই লোকটাই ধন্দে পড়ে যেত, তা হলে কী আমি এত দিন বুঝতে পারিনি যে, আমার পেটের রোগ আছে! মনে মনে বলত, ঠিক আছে বাবা, একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেব।
--- আর অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা?
--- ওই একই ব্যাপার। শহরে ঘুরবে আর একবারও অ্যাক্সিডেন্টের মুখোমুখি হবে না, এমন লোক কি একটাও আছে নাকি? ফলে মিলে যাচ্ছে। আবার এই খেলাটা যদি এরা গ্রামের দিকে গিয়ে দেখাত, তখন অ্যাক্সিডেন্টের ধরণটা পাল্টে যেত। হয়তো বলত, আপনি ছোটবেলায় একবার পুকুরে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গিয়েছিলেন না...
আমাকে দেখিয়ে যখন জিজ্ঞেস করল, ছেলে না মেয়ে, তখন কী করে বলল, মেয়ে?
--- কী বলেছিল মনে আছে? ছেলে না মেয়ে? প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু উত্তর আছে। ভাল করে শোন। উনি বলেছেন, ছেলে না মেয়ে? তার মানে প্রথমেই বলে দিচ্ছে ‘ছেলে না।’ আবার তার পরেই বলছে ‘মেয়ে।’ ফলে ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলছে মেয়ে। মনে রাখবি, নীল-জামা পরা লোকটা যা দেখছে, চোখ-বাঁধা ছেলেটা কেবল যেটুকুই বলতে পারবে, তার বাইরে কিছু বলতে পারবে না। দেখলি না, ওই লোকটা বলল, কারও নাম-ধাম, কোথায় কাজ করে, বা পকেটে কত টাকা আছে, সেটা বলা যাবে না। আসলে 'বলা যাবে না' না। বলতে পারবে না। বলা সম্ভব নয়।
--- ও, আচ্ছা প্রশ্নের মধ্যেই যদি উত্তর থাকে, তা হলে তালার ক্ষেত্রে প্রথমেই ঠিক করে বলতে পারল না কেন?
--- কারণ, লোকটা ওকে কোড দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ছেলেটা বুঝতে পারেনি। তোর মনে আছে, একটা লোকের আংটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, পাথরের রংটা কী? ছেলেটা বলেছিল, সাদা। এই ‘কী’ হচ্ছে সাদার সংকেত। তাই লোকটা যখন বলল, দাদা কী দেখাচ্ছে বলো। ছেলেটা ওই ‘কী’র উপর ভরসা করে বলে ফেলেছিল সাদা। আর সেই উত্তর শুনেই নীল-জামা লোকটা বুঝতে পেরেছিল, ও তার কোড বুঝতে পারেনি। তাই সঙ্গে সঙ্গে লোকের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই ও বলেছিল, তোর মাদুলি কাজ করছে না। তার মানে, তুই আমার কথা বুঝতে পারিসনি। নতুন কোড দিচ্ছি। আর দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, আপনারা আপনাদের হাতগুলো ছেড়ে দিন। এমন করে কথাটা বলেছিল, যেন ওই হাত বাঁধা থাকার জন্যই ছেলেটা ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারছে না।
--- তার পরে তো ঠিক বলল ।
--- হ্যাঁ, তখন লোকটা অন্য কোড দিল। বলল, ‘এখানে যে ভাইবোনেরা আছে, তারা জানতে চায় সবাই যা দেখছে, সেটা কী, সেটা বলো।’ এই ‘কী’টার উপরে জোর দিল সে। 'কী' মানেই চাবি। আর 'চাবি' মানেই তালা। তালাচাবি।
--- কিন্তু তুমি যে একটু আগে বললে ‘কী’ হচ্ছে ‘সাদা’র সংকেত।
--- হ্যাঁ, ‘কী’ হচ্ছে সাদার সংকেত। কিন্তু সেই ‘কী’ উচ্চারণের আবার তারতম্য আছে। মনে করে দ্যাখ, উচ্চারণের সময় এই ‘কী’টার ওপরে একটু বেশিই জোর দিয়েছিল লোকটা। আর তার আগে বলে দিয়েছিল ‘ভাইবোনে’রা। অর্থাৎ একজনের সঙ্গে অন্য জনের ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। ফলে চাবি যদি ভাই হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই বোন হবে তালা। সেটা বুঝে নিয়েই ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছিল, তালা।
--- তা হলে এই শিকড়-বাকড় কিছু না?
--- না। বাবা বেশ জোরের সঙ্গেই কথাটা বলল।
--- কিন্তু বিনে পয়সায় দিচ্ছে যে...
--- বিনে পয়সায় বলছে, এর পরে বলবে, শিকড়টা বিনে পয়সায় দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মাদুলিটার তো দাম আছে। তা ছাড়া, প্রণামী না দিলে কোনও কাজ হয় না। বাবার পুজোর জন্য যে যা পারেন দিন । বেশি না পারলেও, অন্তত একুশ টাকা দিন। যদি দশটা লোক দেয়, তা হলে কত হয়? দুশো দশ টাকা। তার পর বলবে, যাদের একুশ টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাদের জন্য বাবা বলেছেন, যদি এগারো টাকাও দেয় দিয়ে দিবি। এই ভাবে ধাপে ধাপে ওরা পাঁচ টাকাতে নেমে আসবে। শেষে, শুধু শিকড় পাঁচ সিকিতে। এই ভাবে একবার খেলা দেখিয়ে ওদের কত রোজগার হয় জানিস? কম করেও তিন থেকে চারশো টাকা। দিনে যদি চারটে জায়গাতেও খেলা দেখায়, কত হয় একবার ভাব...
--- কিন্তু এ সব তুমি জানলে কী করে?
রংয়ের দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাবা বললেন, আমার এক বন্ধু আছে, অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী।
--- ও, যে কাকুটা গণশক্তিতে কাজ করে?
--- না না, এটা সেই কাকু না। এ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্য। এই সব তুকতাক, তন্ত্রমন্ত্র, ভূতে ধরা, ভর হওয়ার মতো নানা বাজরুকি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য ও বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেয়, শো করে। ওই কথায় কথায় আমাকে একদিন বলেছিল, মাদারি কা খেল যারা দেখায়, তারা কী ভাবে নিজেদের মধ্যে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে...
--- তাই? বাবা, তুমি আমাকে ওই কাকুটার বাড়িতে একদিন নিয়ে যাবে?
--- কেন যাব না? নিশ্চয় নিয়ে যাব। ওর বাড়ি তো হরিশ মুখার্জি রোডে, বলরাম বসু ঘাটের পাশেই...
কথা বলতে বলতে ওরা এসে দাঁড়াল বইখাতার দোকানের সামনে। আর ক’পা গেলেই কাউন্টার। তুতান রং কিনবে। প্যাস্টেল। ও সাধারণত ক্যামেল কোম্পানির রংই কেনে। কিন্তু ক্যামেল না বলেও দোকানদারকে কী বললে দোকানদার ওকে ওই কোম্পানির রংটাই দেবে, ও ভাবতে লাগল। কী বলবে ও! কী! উট মার্কা বললে কী দোকানদার বুঝতে পারবে? ওটা তো ওই কোম্পানির সিম্বল। নাকি অন্য কিছু বলতে হবে? অন্য কিছু। একটা ভাল কোড তার চাই। অন্তত একটা ভাল কোড...