হারানো সুর
হারানো সুর




"কী রাজকন্যা, কি ভাবছো?"
চেনা কন্ঠস্বর শুনে মিলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ব্যক্তিটির দিকে। তারপর মিষ্টি করে হাসলো। কিন্তু কোনো উওর করলো না।
সাজিদ তাকালো দুর প্রান্তরের দিকে। যেখানে আকাশ আর মাটি এক সমান্তরালে মিশে গেছে। মিলি কিছু দুর হেঁটে গিয়ে নদীর পাড়ের উপর বসল। আর সুন্দর পা দুখানি জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিল। তারপর পা নাড়তে শুরু করলো। ছলাৎ ,ছলাৎ শব্দ হল জলের। বাচ্চাদের মত মিলির জল খেলা দেখে সাজিদ হেসে ফেললো। তারপর, হঠাৎ করুন সুরে বললো- "রাজকন্যা পারবে গরীবের ঘরে সংসার করতে"? মিলি এবারও সাজিদের কথায় কোন কর্ণপাত করলো না। সে নিজের মনে জলে পা ডুবিয়ে শেষ বিকেলের লাল হয়ে যাওয়া সুর্যটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। এক সুন্দর লাল আভায় যেন পুরো আকাশটা ছেয়ে আছে। এক অপূর্ব মায়াভরা বিষন্ন আকাশ। যেন কত কথা, কত দুঃখ, কত আবেগ, কত অভিমান, কত রাগ, আর কত ভালোবাসা সবকিছুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিশাল বড় ক্যানভাসে কেউ যেন সব রং গুলি একসাথে ঢেলে চলে গেছে।
মিলির নিরুওর দেখে সাজিদ বাঁকা হাসি হাসলো। তারপর নদীর তীরের সবুজ ঘাসের উপর রাখা ব্যাগটি আর একটি মোটা ডায়েরি তুলে নিল কাঁধে। মিলিকে পিছনে রেখে হাঁটা শুরু করবে ,এমন সময় মিলি বলে উঠলো-" থামুন মহাশয়। আমাকে মাফ করুন। এতক্ষণ যাবৎ আপনার কথার উওর না করার জন্য। সাজিদ মিলির কথা শুনে থেমে গেল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিলির দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল-" রাজকন্যা যা হবার নয় আর যা পাবার নয়, এই দুইটি জিনিসই বড়ই মারাত্মক। তাই সবসময় ইহা হইতে নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে হয়। নইলে হয় পাগল হতে হয়, আর নাহলে বেঘোরে মারা পড়তে হয়। " মিলি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। সাজিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। মিলির হাসি দেখে, সাজিদ এবার ভয়ানক রেগে গেল। তারপর বলল-"সত্যিই নারীরা বড়ই মারাত্মক এক প্রাণী। এদের ফেলে রাখা যায় না। আবার কাছে রাখলেও মহা বিপদ। " মিলি এবার দ্বিগুণ স্বরে হাসতে লাগলো। হাসির চোটে ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।
পড়ন্ত বিকেল। গোধূলি বেলা। লাল সুর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে অস্ত্ যাচ্ছে। পাখিরা দল বেঁধে ঘরে ফিরছে। মাঝিরা নৌকা ভিড়াচ্ছে পাড়ে। চারিদিকে আস্তে, আস্তে অন্ধকার নামছে। মিলির মুখটাও যেন মলিন হয়ে পড়েছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এবার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে বেচারীর। মন বলছে যেন শব্দ করে কাঁদে। কারণ সময় আর সুযোগ কিছুই যে তার হাতে নেই। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা যিনি, সেই অন্তর্যামী, শুধু তিনিই জানেন ঐ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি অন্তরের ব্যাকুলতা।
মিলি, অনিয়ন্ত্রিত চোখ জল মুছে নিল আড়ালে। নিজেকে অনেক দৃঢ় করে এগিয়ে গেল সাজিদের দিকে। তারপর কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই মিলি বলল- পাপাকে আমি তোমার ব্যাপারে বলেছি। তিনি হ্যাঁ কিংবা না কোন উওর করেননি। আমি যখন তুলে ধরলাম তোমার অসাধারণ পান্ডিত্যের কথা, তোমার অতুলনীয় বিচারবুদ্ধি, তোমার মনমুগ্ধকর পড়ানো, যা সবসময় ছাএ,ছাএীদের জানার আর পড়ার আগ্রহকে কয়েক গুণে বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বাস করো, পাপা আগ্রহী হয়ে তোমার ছবি দেখতে চেয়েছিলেন। " সাজিদ উৎসুক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে ছিল। মিলি থামলো , তারপর পিছনে ফিরে আবার শুরু করলো বলতে- " তোমার ব্যক্তিও পূর্ণ , সুন্দর অবয়বটা যে কারওরই পছন্দ হবে। তাই আমার পাপার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তোমাকে দেখে পাপা জানতে চাইলেন ,তোমার জীবিকা নিয়ে। আমি বললাম, পাপা একজন ছেলে ন্যায় পরায়ণ , আর শিক্ষিত, এটাই কি যথেষ্ট নয়। পাপা আমার কথা শুনে মৃদু হাসলেন।হয়ত মিলির কথাগুলো অনেক বেশি যুক্তিহীন, অবুঝ মনে হয়েছিল উনার কাছে। মিলি তার পাপার সঙ্গে কোনোদিনই তর্ক করেনি। মিলিকেও তার পাপা শৃঙ্খলাবদ্ধ কোনোদিনই করেননি। উনি মিলিকে বোঝান মিলি বোঝে। কিন্তু সেদিন পাপার চুপ থাকায়, মিলি ব্যকুল হয়ে বলেছিল, "পাপা, সাজিদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমাদের মত নয়। সাজিদ হ্যাজ কমপ্লিকেটেড হিজ হায়ার এডুকেশন ইন সায়েন্স। বাট আনফরচুনেটলি হী ক্যান নট গেট এনি গভর্নমেন্ট জব, বিকজ কোরাপসান আর দেয়ার,বাট দিস ইজ নট হিজ ফল্ট। হোয়াই গভর্নমেন্ট ডু নট টেক এনি রেসপনসিব্লিটিজ এগেন্সট দ্য কোরাপসান। পাপা সামাজিক দুর্নীতি গুলোকে শাসন ব্যবস্থা যদি শক্ত হাতে দমন না করে,থাকে তবে এটা কি শিক্ষার্থীদের দোষ। দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা অনেক কস্ট করে পড়াশোনা করে, সম্মানজনক ভালো কাজের আশায়। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত নিজেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার কাজে তারা দিন রাত অতিবাহিত করে।কতশত ভালো লাগা, আলসি, আয়েশ,ঘুম ত্যাগ করে শুধুমাত্র পড়াশোনায় মন নিবেষ করে। এক অসীম জ্ঞানের সাগরে পাড়ি দেয়। নীরবে নিভৃতে চলতে থাকে এই পথ চলা। শেষ যখন তরী তীরে এসে ভিড়ার চেস্টা করে তখনই সামনে আসে সমাজের ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। উওাল ঢেউ এর মতো বিদীর্ণ করে দেয় সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষাকে। যেন বারবার বোঝাতে চাই, স্বপ্নপূরণ সবার জন্য নয়।"
কিন্তু সাজিদ হার মানেনি। সে নিজের একাডেমি খুলেছে যেখানে অনেক ছাএ ছাএী পড়ে। মিলি আবার বোঝাতে চেষ্টা করে ," পাপা একজনের সবদিকই যে ভালো হবে,এটা ভাবাও তো অর্থ হীন তাই না"।তারপর করুনভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, " পাপা, সাজিদ এখনই হয়ত , স্বপ্ল আয়ে অনেক বড়, মার্বেল পাথর বসানো ঝাঁ চকচকে বাড়ি করতে পারবেনা, প্রতিদিনের খাবারে হয়ত আমিষ থাকবেনা, কিন্তু অফুরন্ত ভালোবাসা তো থাকবে। মনমুগ্ধকর দুটি চাহনি থাকবে। এক মন, এক প্রাণ একটি মাত্র ভালোবাসা চাদরে জড়ানো থাকবে। "
জানো সাজিদ, পাপা স্নেহের পরশে মাথাই হাত রেখে বলেছিল-" পাগলি মেয়ে আমার, শুধু আবেগ দিয়ে সংসার করা যায় না। বিয়ে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সবদিক বিবেচনা করে তবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। "
কথাগুলো বলে নিচের দিকে তাকিয়ে, মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো- "পাপাকে অনেক ভালোবাসি। আর বুড়ো মানুষটারও নিজের মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাই, ছোটো থেকে মা হারা মেয়েটিকে যিনি নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন,তার মতের বিরুদ্ধাচারণ করাটাও তো অন্যায়"।
সাজিদ আর কোনো কথা বাড়ালো না। মিলির দিকে একবার চোরা চাহনিতে চেয়ে ছিল। মনে, মনে
মেয়েটিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন হয়ত, কিংবা বুকভরা অভিমান। কিন্তু তার চেহারায় কোনো রকম রাগ ছিল না। গুঁটি, গুঁটি পায়ে হাঁটাতে লাগলো গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে। ধীরে , ধীরে মিশিয়ে গেলো অন্ধকারে। মিলি ছলছলে চোখে ,চেয়ে, চেয়ে দেখল সাজিদের চলে যাওয়া। তার কিছুক্ষণ পর, মিলি চারপাশটা একবার চেয়ে দেখল। কালো চাদরে মোড়া আকাশটা যেন আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।প্রকৃতি আজ যতই সুন্দর লাগুক,যাদের জন্য এতকিছু সেই মানুষগুলিই আজ বিচ্ছিন্ন। কালো আকাশের রং যেন কালিমালিপ্ত হয়েছে দুটি মনেও।ক্ষনিকের নীরবতা, তারপর মিলি হেঁটে গিয়ে পাশেই দাঁড় করানো গাড়িটায় উঠে বসল । স্পন্দনহীন হাতে, ফোন করল ড্রাইভার চাচাকে। কিছুক্ষণ পর রহিম চাচা এসে, চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়িতে চাবি লাগিয়ে, স্টেয়ারিং ঘোরালেন মেইন রাস্তার দিকে। সাঁই ,সাঁই করে গাড়ি ছুটে চললো, তার গন্তব্য স্থলের দিকে।
আজ আকাশে অনেক তারা। চাঁদের আলোতে নদীর জলধারা ঝিকিমিকি করছে। দুরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কোনো মাঝির গলার সুর। "তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো/ ছেড়ে দেব না। / ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌর/ ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় / আমরা আর পাবনা। / তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না। "