Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

গুপ্তকথা

গুপ্তকথা

11 mins
193


সামনে খাবার নিয়ে অন্যমনস্ক তিতিরকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন সুপ্রভা দেবী, তারপর বললেন,

“কি রে মা ,তখন থেকে বসে আছিস খাবারটা নিয়ে? ক’টা বাজে খেয়াল আছে?”


“কি প্রবলেম মা? কতদিন পর বাড়ি ফিরলাম, ছুটির দিন, সবসময় এত তাড়া দাও কেন? একটু আমেজ করে খেতে দাও দেখি।”


সুপ্রভাদেবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আবার আপন মনে গান শুনতে শুনতে লুচির গ্রাসটা মুখে দিলো তিতির। বেশ কয়েক মাস পর কদিন হলো সুদূর গুজরাট থেকে বাড়ি ফিরেছে। কতদিন হয়ে গেলো এই লুচি, আলুরদম, চিংড়ি, ইলিশ, মা এর হাতের মটন কপালে জোটেনি ওর। আজ রোববারের সকাল, তার উপর নিজের বাড়িতে এতদিন পর, তার উপর আবার ওর প্রিয় লুচি আলুরদম। এটুকু ল্যাদ তো বনতাই হ্যায় ! মেয়ের কথায় খানিক হাসলেন সুপ্রভাদেবী, ছাদ থেকে তুলে আনা জামাকাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে বললেন, “আর তো ক’দিন। বিয়ের পর এসব চলবে তো? তখন দেখবো আমি কি করিস?”


কিছু বলল না তিতির, মোটামুটি একমাস হলো এই কথাগুলো শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে, যত তিতিরের বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে, এইসব কথাবার্তা রীতিমতো ক্রমবর্ধমান। প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দিতো না ও, এমনিও কাজে ব্যস্ত থাকত সারাদিন অফিসে, অফিস থেকে ফিরে রান্নাবান্না ঘরের কাজ, ভাবার সময় সুযোগ অবস্থা কোনটাই তেমন ছিল না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, সবে চাকরিটা ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে ও। না, না, বিয়ের জন্য চাকরি ছাড়া ওসব কোন গল্প এখানে নেই। ওখানে পোষাচ্ছিল না, চাকরি বদলাবে তাই স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে ও। আর ফেরার পর থেকেই মা বাবা পিসিঠাম্মির মুখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা। এই তো কালকেই চিৎকার করে ডাকছিল বাবাকে, হ্যাঁ ও জানে চিৎকার করে কথা বলা উচিত নয়। তখন মাথাটা একটু গরম হয়ে গেছিল তাই আর কি… কিন্তু তার সাথে বিয়ের তো কোন সম্পর্ক নেই, বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, সবার ক্ষেত্রেই তো এটা প্রযোজ্য। কিন্তু বাবা মা সেই সবসময় সমস্ত কিছুর সাথে ওর বিয়ের লিংকটা ঠিক মিলিয়েই ফেলে এখন। “এইরকম চিৎকার করাটা বন্ধ কর। তারপর ওদের বাড়ি গিয়ে চিৎকার করবি। ওরা কি বলবে? মা বাবা কি শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে মেয়েকে! এটাই বলবে তো? আমাদের কি ভাববে? এই স্বভাবগুলো কিন্তু পাল্টা তিতির। ভালো কথা বলছি। ওখানে এসব চলবে না।” গম্ভীর গলায় কথা গুলো বলে চলে গেছিল বাপি সামনের দোকানটায় তেলেভাজা কিনতে। কিছু বলতে পারেনি আর ও। নিজের ভাবনায় আবার হারিয়ে গেছিল তিতলি, মার ধাক্কায় আর ফোনের আওয়াজে টনক নড়ল ওর। ফোনের দিকে দেখল, সূর্য ফোন করছে।

**********************

“হ্যাঁ রে ফিরবি কখন?” তিতির আয়নার সামনে রেডি হচ্ছিল, একটু বাদেই বেরোবে সূর্য আর ও, একসাথেই যাচ্ছে আজ। এবার তো ধীরে ধীরে কেনাকাটাটা সারতে হবে, খুব একটা সময় ও নেই। আজ সূর্যকে সঙ্গে নেওয়ার আইডিয়াটা অবশ্য ওরই। বরের পাঞ্জাবি বর নিজেই পছন্দ করে নিক বাবা, সূর্য একটু গাইগুই করছিল বটে, কিন্তু শেষমেশ যাচ্ছে ওরা। চোখের কোণের কাজলের টানটা টেনে মায়ের দিকে তাকাল তিতির । “বলছি তুমিও চলো, তুমি গেলে ভরসা পেতাম। “


“না বাবা তোমরাই যাও, আমার এদিকে অনেক কাজ আছে। যাক গে ,কখন ফিরবি? বেশি রাত করিস না মোড়ের মাথা থেকে অটো বন্ধ হয়ে যায় এখন ৯টার পর, খেয়াল আছে তো? সেটা মাথায় রেখো। ”  


কানে ঝুমকোটা পরে নিয়ে মার দিকে তাকিয়ে হাসল তিতির , ছোট থেকেই এটা ওর অভ্যাস। রেডি হয়ে মার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় একবার জেনে নেওয়া, “আমায় ঠিক লাগছে তো?”


সুপ্রভাদেবীও চোখের নিমেষে কিছু অদলবদল দরকার হলে সেটা করে দিয়ে চোখে চোখেই মেয়েকে উত্তর দিয়ে দিতেন, এবার ঠিক আছে। আর সেই ছোট থেকে আজ অবধি একমাত্র মেয়ের আঙ্গুল কেটে দিতে ভুল হয় না মায়ের। হ্যাঁ অনেকের কাছেই আদিখ্যেতা মনে হবে, কিছু মানুষের কাছে অযৌক্তিক, কুসংস্কার ছাড়া আর কোন গুরুত্ব নেই মুহূর্তটার, তিতির যে এসব মানে তাও নয়, কিন্তু এটা ওদের মা মেয়ের একান্ত নিজস্ব এক বোঝাপড়া যেন, ভালোবাসারই এক রূপ। নিজের মতো করে একটু আদর দেওয়া, একটু ভালোবাসা যেন। ভালোবাসা আর কবেই বা যুক্তি তর্কের ধার ধারে। এও তাই। আজ এত বয়স অবধিও তিতির বেরোবার সময় মা কে টাটা বলে যেতে ভোলে না, সেই স্কুলের থেকে আজ এতবছরের অভ্যাস, এখনও এতটুকু বদলায়নি। মা মেয়ের আদর আহ্লাদ শেষে তিতির ঘড়িটা দেখে ব্যাগটা নিয়ে বেরোতে যেতেই আটকাল পিসিঠাম্মি। না, না, সেই দজ্জাল মুখরা বা প্রচন্ড রাগী কোন চরিত্রের সাথে তিতিরের পিসিঠাম্মির কোন মিল নেই। ইনফ্যাক্ট ছোট্ট থেকেই এই মানুষটার সাথে অনেক সুন্দর সুন্দর দুষ্টু মিষ্টি মুহূর্ত আছে তিতির। মহামায়া দেবীর বয়স এখন প্রায় ৮০, দুধ সাদা গায়ের রং, বয়সের ভারে এখন একটু কুঁজো হয়ে গেছেন, দাঁত পড়ে গাল তুবড়ে চুল পেকে রীতিমতো কিউট ঠাম্মি যেমন হয় ঠিক তেমনি।   


তিতির ঠাম্মির গালটা টিপে বলল, “আবার কি হলো সুন্দরী? ও আচ্ছা তোমার চকলেট তো? আমি নিয়ে আসব। একদম মনে আছে আমার। এবার বেরোতে দাও নয়তো দেরি হয়ে যাবে সিরিয়াসলি।”


তিতিরদের বাড়িটা পুরানো আমলের। সার সার ঘর, মাঝে লম্বা টানা বারান্দা। তিতিরের ঘরটা আর ঠাম্মির ঘরটা সামনে সামনিই। ঠাম্মিকে হাত ধরে বারান্দা থেকে নিজের ঘরে টেনে খাটে বসাল তিতির । ঠাম্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “সাজুগুজু ঠিক আছে তো বল?”


“এই কপালে একটা ছোট্ট টিপ পর, ভাল লাগবে। ” পিছন থেকে বলে উঠলেন সুপ্রভাদেবী।  


“ওহ, হ্যাঁ, দাও তো মা একটা নীল টিপ।”


“সবই তো ঠিক আছে তিতির বুড়ি, কিন্তু তোমায় তো এবার একটু শাড়ী পরা অভ্যাস করতে হবে মা। বৌমা, তুমিও তো বলবে কিছু। এখনও যদি ও অভ্যাস না করে, বিয়ের পর তো সমস্যায় পড়বে। “

 

সুপ্রভাদেবী কিছু বলার আগেই তিতির বলে উঠল এবার, “প্লিজ ঠাম্মি, তোমরা সবসময় সবাই মিলে সমস্ত কিছুর সাথে বিয়ের এই লিংকটা বন্ধ কর। সবসময় ভাল লাগে না। “


“ভাল লাগে না, বললেই তো হবে না, যেগুলো বাস্তব সেগুলোও তো মানতে হবে। এখনও তুই ঠিক মত শাড়ী পরতে শিখলি না, বিয়ে ক’দিন পর, কি করবি তখন? উঠতে বসতে তো নাজেহাল হবি। তার থেকে এখন থেকেই একটু একটু অভ্যাস করলে তোরই তো কষ্ট কম হবে। “


“মা তুমি খুব ভাল করে জান, আমি শাড়ী পরতে একেবারেই comfortable নই। তাও কেন বলছ? আমি যে জিনিসটায় অসুবিধা বোধ করি, সেটা নিয়ে জোর করার কি মানে?”


“আশ্চর্য কথা বলছিস! আজ নয়তো কাল তোকে তো এই অভ্যাসগুলো বদলাতেই হবে। বিয়ের পরদিন কি কুর্তি পরে ঘুরবি? ঐ কটাদিন তো পড়তেই হবে শাড়ী, তখন তো তোরই প্রব্লেম হবে। “


অসহ্য লাগছিল তিতিরের, বিগত কিছুদিন ওর সমস্ত কাজে, সমস্ত পছন্দ অপছন্দে, সমস্ত ব্যাপারে এই মানুষগুলো একটা প্রশ্নচিহ্ন বসিয়েই চলেছে। ভালো লাগছে না আর। না, শাড়ী যে ওর খারাপ লাগে তা নয়। কিন্তু অনভ্যাসের কারণে একেবারেই এই পোশাকটায় সাবলীল নয় ও। পরতেই পারে, কিন্তু ঠিক স্বস্তি হয় না। আজকালকার দিনে প্রায় সমস্ত মেয়ের ক্ষেত্রেই এটা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। সব জেনে বুঝেও সবাই মিলে যেন ওকে আরো অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বাড়ি থেকে মাথা গরম করে তিতির যখন বেরল, তখন প্রায় আধ ঘন্টা লেট হয়ে গেছে।  


******************

সূর্য আর তিতিরের সম্পর্ক প্রায় বছর সাত আট। কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে এখন অবশ্য চাকরিসূত্রে দুজন দুই প্রান্তে। দুজনেই তাই চেষ্টা করছে এক জায়গায় যদি কিছু করা যায়। শপিং সেরে অল্প কিছু খেতে ঢুকল সামনের রেস্টুরেন্টটায়। ছোটখাটোর মধ্যে ভাল বেশ। এখানে ওরা সেই কলেজ থেকেই আসে। তাই এই জায়গাটার প্রতি একটা আলাদা টান আছে যেন। চিরপরিচিত টেবিলটায় বসে ওয়েটারকে ইশারা করে তিতিরের দিকে তাকাল সূর্য । সূর্যকে আজ সাদা শার্টে রীতিমত হ্যান্ডসাম লাগছে। আজ এতদিন পর দেখা, তিতিরের পছন্দ মতোই রেডি হয়ে এসেছিল ও। হাতের ঘড়িটা, এই শার্টটা, চশমা সবই তিতিরের পছন্দের। অন্যসময় তিতির বরাবর সূর্যকে কমপ্লিমেন্ট দেয়। তিতিরের এই জিনিসটা বরাবর সূর্যর খুব ভাল লাগে। মন খুলে প্রশংসা করতে জানে মানুষটা। কিন্তু আজ কিছুই বলল না যে, বরং আজ যেন সারাক্ষণ কেমন অন্যমনস্ক ছিল ও। তিতিরের চোখের দিকে তাকাল কিছুক্ষণ সূর্য , না কোন প্রত্যুত্তর নেই ওদিক থেকে। অগত্যা তিতিরের আঙুলে টোকা মেরে ডাকল ও।  


” কি হয়েছে বল তো তোর?”


“কি আবার হবে? কিছুই হয়নি। অর্ডার করলি?”


“না করিনি, করছি। কিন্তু কি হয়েছে বল আগে। এত অন্যমনস্ক তো তোর আজ থাকার কথা নয়। কবে থেকে শপিং করার জন্য লাফাচ্ছিল, দেখা হচ্ছে না বলে লাফাচ্ছিল, আর আজ ছটফটে পাগলীটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? কি রে, বল না কি হয়েছে?”


সূর্যর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকাল তিতির । চোখের ইশারায় সূর্য আরও একবার জিজ্ঞাসা করল এই ঔদাসীন্যের কারণ। কিছু বলতে পারছে না তিতির । আসলে কিছু কিছু অনুভূতি একবারে নিজস্ব হয়। না কাউকে বলা যায়, না কেউ বুঝতে পারে, না কাউকে বোঝানো যায়। না, এটা তাদের দোষ নয়। কিন্তু…যাই হোক।  


“জানিস তো যখন আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল হল, তুই আমি দুজন দুই প্রান্তে, যেদিন ফোনে বলল মা সব গল্প, কি ভীষণ আনন্দ যে হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না। আর আমাদের মধ্যে এই দূরত্বটা থাকবে না ! আর তোর সাথে দেখা না হওয়ার মনখারাপের মেঘলা আকাশটা থাকবে না! তোর সাথে রাত্রের ফোন কলটা থাকবে না। সেটা একটু মিস করব যদিও, কিন্তু তুই সামনে থাকবি, আমার সবটুকু সময় জুড়ে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? ভীষণ ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে একলা ঘরে আমার নিঃসঙ্গতা, আমার একাকীত্ব, রুটিন ধরে মুখ বুজে ঘরের একটার পর একটা কাজ, আবার পরদিন সেই একই অফিসের ডেস্ক, একই সিস্টেম, একই কলিগস, বস, পিএনপিসি – এইরকম একটা ধূসর বিবর্ণ জীবনও রঙিন লাগতে শুরু করেছিল আমার ! ভাবতে পারিস? মাথায় খালি একটা জিনিসই ঘুরত, আর তো ক’টা দিন, ব্যস। হ্যাঁ, সত্যিই সেই ক’টা দিন কেটেও গেল, যাচ্ছেও, আর হাতে গোনা কটা মাস। কিন্তু এখন এই সব কিছুর উর্ধ্বে মনে অন্য একটা জিনিস চলছে জানিস তো। আমার রিয়েলি নার্ভাস লাগছে এখন মাঝে মাঝে। ভয়ও করছে একটু একটু। সব কিছু কি কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে? এরকম কিছু তো আমার মাথাতেও আসেনি। আগে আমার ভাবনায়, আমার স্বপ্নে শুধু তুই থাকতিস, শুধুই তুই। কিন্তু এখন চারপাশে, এবাড়ি, ওবাড়ি সব কিছু এত দ্রুত হারে এগোচ্ছে, এত কিছু ওলটপালট হচ্ছে, ‘তুই’টা আবছা হয়ে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো যেন প্রকট হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। তোকে ছাপিয়ে দুটো পরিবার, দুই বাড়ির লোকজন, আত্মীয় স্বজন, তাদের মতামত, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের কথা-বার্তা আচার-আচরণ যেন বড় বেশী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে আমার মধ্যে। বিয়েটা তো তোর আর আমার, মানে আমি বোকার মত এতদিন তাই-ই ভাবতাম। কিন্তু বিগত ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে আমি কতটা বোকা ছিলাম। বিয়েতে সব থেকে লিস্ট ইম্পরট্যান্ট বোধ হয় আমরা দুজন, বাকী সব কিছু মনে হয় তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোর আমার স্বপ্নপূরণের থেকেও যেন বড়, দুই পরিবারের মানুষগুলোর ইচ্ছে পূরণ। বড্ড জটিল হয়ে যাচ্ছে যেন সবটা, আমি হয়তো ঠিক বোঝাতে পারছি না, কিন্তু এই ভাবনাগুলো আমার মধ্যে চলছে, ভীষণভাবে চলছে। জানি না শুধু আমার সাথেই এটা হচ্ছে কি না, আর কারও সাথে হয় কি না আমি সত্যিই কিছু জানি না। কিন্তু… “


“আরে কি রে? তখন থেকে আমিই বকে যাচ্ছি, কি এত ভাবছিস বল তো? “


সূর্যর কথায় যেন জেগে উঠল তিতির । এতক্ষণ ধরে কথাগুলো… না, বলা হয়নি সূর্যকে , মনের অগোছালো কথাগুলো আর বলা হল না মনের মানুষটাকেও, আসলে ও নিজেই বুঝতে পারছে না ঠিক মতো। সব ঠিক হয়ে যাবে তো? বিয়ের আগে তো মানুষের আনন্দ হওয়ার কথা, ওর যে কেন এরকম নার্ভাস লাগছে? সূর্যর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হাসল শুধু তিতির, ততক্ষণে ওদের প্রিয় বিরিয়ানি এসে গেছে।  

********************* 

(দিন কয়েক পর)


কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না আজ তিতিরের, বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ করে পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে টাইমটা দেখল একবার ,রাত তিনটে প্রায়। এত চিৎকার চেঁচামেচির জন্য মাথাটায় অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল ওর, এখন একটু ঠিক হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। আজ কি একটু বেশিই রিয়াক্ট করে ফেলল ও? কে জানে। আচ্ছা ও কি একটু বেশিই ভাবছে? হয়তো তাই। এই মুহূর্তটা তো সব মেয়ের জীবনেই আসে। ও তো একা নয়। তাহলে এইগুলো সহজভাবে কেন মেনে নিতে পারছে না ও কে জানে? নাকি সবারই ওর মতন…


উঠে পড়ল তিতির। স্টাডি টেবিলের পাশের জানলাটা খুলে দিল। বাইরে বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছু আগে। রাস্তা ঘাট ভিজে। নাকে মাটির সোঁদা গন্ধটা এল, মন ভরে সেই ঘ্রাণ নিল তিতির । আকাশটা এখন পরিষ্কার, আর মেঘ নেই। চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে, জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ওর খাট আর স্টাডি টেবিলের মেঝেটায়। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ওর ডায়েরি আর পেনটা নিয়ে বসল ও। কিছু কথা কাউকে বলা যায় না, সেগুলো একান্তই নিজস্ব হয়। আর কেউ শুনলেও হয়তো বুঝবে না। তখন এই ডায়েরিই সঙ্গী। পেনটা হাতে নিয়ে আর কিছু ভাবতে হলো না তিতিরকে। যে কথাগুলো বলতে পারছিল না ও কাউকে সেগুলো যেন ঝরে পড়তে লাগল ওর ডায়েরির পাতায়।  


ছোট্ট থেকেই মা বাবার ভীষণ আদুরে , আর ভীষণ কাছেরও। সারাদিনের ইতিবৃত্ত স্কুল, কলেজ থেকে ফিরে মাকে বলতাম, আর বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবার কাছে সারাদিনের গল্প শুনতে চাইতাম।  


সেই মা বাবাকে ছেড়ে যখন চাকরি করতে বাড়ির বাইরে গেলাম, না আমি একটুও কাঁদিনি, পাছে আমার কান্না দেখে মা বাবার কষ্ট হয়। প্রথমে কষ্ট হলেও খুব তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিয়েছিলাম, অভ্যাস হয়ে গেছিল ঝটপট একা থাকা। তখন তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় এই আলোচনাটাই করতাম, মা বাবাকে ছেড়ে থাকাটা তো অভ্যাস হয়েই গেল, বিয়ের সময় আর তেমন কষ্ট হবে না। এতদিন এটাই ঠিক ভাবতাম। আজ ভুলটা ভাঙল। আজ মা বলল, মা বাবাকে ছেড়ে থাকা আর বিয়ের পরের থাকা দুটো নাকি আলাদা। এবারে তো আমি অন্যের বাড়ির হয়ে যাব। প্রথমে শুনে হজম করতে পারিনি কথাটা। সময় লাগছিল, সেই জন্যই হয়তো আজ খাবার টেবিলে ঐভাবে react করে ফেললাম। মা তুমি জান তো আমি কোনটা খেতে পছন্দ করি কোনটা নয়। এখন আমাকে সেটাও বদলাতে হবে? আমি অন্য বাড়ির সদস্য হয়ে যাব বলে? মাকে উত্তর দিয়েছি আমি আজ, এসব আগেকার দিনে হতো। এখনকার দিনে এসব হয় না। পুরানো ধ্যান ধারণাগুলো ছাড়ো । কিন্তু তাও মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মা শুধু উত্তর দিল, “কিছু জিনিস কখনোই বদলায় না। “


আমি তো এই দিকগুলো কোনদিন ভেবে দেখিনি। বিয়ে তো দুজন মানুষের মধ্যে হয়, সূর্য আর আমার ভাবনাটাও শুধু ঐটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, আমরা দুজন একসাথে থাকব, অনেক ঘুরব, আনন্দ করব, সুখে থাকব। নিজেদের জীবনটা একসাথে ঠিক গুছিয়ে নেব। কিন্তু না, এগুলোর থেকেও বেশি জরুরী যেন অন্য কিছু। আমার পছন্দ, অপছন্দ, অভ্যাস, সবটুকু ‘আমি’কে কি বদলে ফেলা এই জন্যই এত জরুরী মা, আমি অন্য বাড়ির হবু সদস্য বলে? আমি তো বদলাতে চাই না মা, আমি অন্য বাড়িতে গেলেও এই বাড়িরই থাকতে চাই, তোমাদেরই থাকতে চাই। আমি ‘আমি’ই থাকতে চাই। আমার তো এবার ভীষণ ভয় করছে। বিয়ে নিয়ে যে এক্সাইটমেন্টটা ছিল, সেটা উবে গিয়ে যেন অনেকখানি ভয় দানা বাঁধছে মনে। হয়তো ঐ বাড়ির মানুষগুলোও বুঝবে আমার দিকটা, আমার সুবিধে অসুবিধেগুলো, কিন্তু তাও…আমি যে বদলাতে চাই না সূর্য । আমরা কি আগের মতন থাকতে পারি না? আগের মতন পাগলামো, একসাথে আড্ডা, ঘোরা, সব একেবারে আগের মতো, হয় না সেটা বল? তুই আমি আগের মতন… হয় না, না? বিয়ে করতে গেলে এই পরিবর্তনগুলো কি খুব দরকার? বিশ্বাস কর, এখন মনে হচ্ছে এত জটিলতা আগে বুঝলে… যাক গে ছাড়।  


আমি আমার এই ঘর, এই বেড, এই জানলাটা, মায়ের গলা খাঁকারি শুনে দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাটা, রোববারের মায়ের হাতের লুচিটা, মায়ের হাতের ঝাল ঝাল কষা মাংস আর নিজের বিছানায় ভাত ঘুমটা, বাপির সাথে দুস্টু-মিষ্টি ঝগড়াটা, ঠাম্মির সাথে বদমায়েশিটা, আমার প্রিয় নরম টেডি বিয়ার ছাপ পাজামাটা, ছুটির দিনে শুয়ে শুয়ে ল্যাদ খাওয়াটা, নিজের ইচ্ছে মত জিন্স-টপ পরে বন্ধুদের সাথে হৈহুল্লোড়টা, এই সবকিছু বড্ড মিস করব রে। আমি তোকেও বদলাতে চাই না সূর্য , আমরা দুজনেই একটু একটু করে ম্যানেজ করে নেব না হয়। আচ্ছা সূর্য , আমার মধ্যে যা চলছে তোর মধ্যেও কি তাই চলছে? সবারই কি এমনটা হয়? নাকি শুধু আমারই এরকমটা মনে হচ্ছে? আমি কি অযৌক্তিক কথা বলছি রে? জানি না, কিন্তু হঠাৎ করে জীবনের সবকিছুর এই আমূল পরিবর্তন আমি সত্যিই মানতে পারছি না রে। আমি পারব তো? —

 

ডায়েরিটা বন্ধ করে দিল তিতির। এবার যেন একটু হালকা লাগছে। ওর কথাগুলো শোনার, বোঝার, অনুভব করার জন্য এই ডায়েরীর পাতাগুলোই যথেষ্ট। কিছু কথা এরকম চুপিচুপিই বলা ভাল। নিজের মত করে। নিজের সাথে। বাইরে পাখির কিচির মিচির হালকা হালকা শুরু হয়ে গেছে। ঘড়িটা একবার দেখল তিতির। বাইরে আঁধার মুছে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে।তিতিরও প্রাণভরে নূতন ভোরকে স্বাগত জানিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমের জগতে হারিয়ে গেল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance