গল্প - মায়াঘর
গল্প - মায়াঘর
(বন্ধ পড়ে থাকা আমার পিত্রালয়ের জন্য আমার যে বিপুল মায়া সেই ঘটনাকে আশ্রয় করেই এই গল্প নির্মাণ হয়েছে। মায়া যে মানুষকে খারাপ দিকেও টেনে নিয়ে যায় নিজেকেই বোঝাতে চেয়েছি আমি। তাই গল্পের প্রয়োজনে কাহিনির শেষে কল্পনার আশ্রয়ে এক বীভৎস পরিণতি দেখিয়ে শেষ করেছি।)
জবা ওর বাবার বাড়িটা এবার বিক্রি করে দেবে ঠিক করেছে। দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর হল সেটা বন্ধ পড়ে আছে। বিয়ের পর থেকে সে বরের চাকরির সূত্রে দেশের নানা জায়গায় ঘুরছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া এক যাযাবর জীবন উপহার পেয়েছে তারা। বিয়ের পর প্রথম দিকে বাবার বাড়িতে আসলে অনেক দিনই কাটিয়ে যেত সে। তারপর ছেলে বড় হতে ও তার স্কুল চালু হতে নিজের শহরে আসাটা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। এই শহরেই জবার শ্বশুর বাড়িও আছে। তবুও তার সেখানে আসার চেয়ে নিজের পিতৃগৃহে আসার টান অনেক বেশি। বহু বছর পর এবারে লোকালে একাই এসেছে সে। আর সবার প্রথম ছুটেছে বাপের বাড়ি। জবা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সে জানে পাড়ার সকল শুভাকাঙ্খীরা যেন বহুদিন ধরে মুখিয়ে আছে বুদ্ধি পরামর্শ দেবার জন্য। সেই প্রথম ও শেষ পরামর্শ হল বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার কথা। ফাঁকা পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এমন অনেক বন্ধ বাড়ি চারিদিকে দখল হয়ে গেছে, কোনো প্রমোটার দেখে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে ফেলা উচিত, নইলে ও বাড়ি পোড়োবাড়িতে পরিণত হবে, আশেপাশে লোকজন বাস করতে ভয় পাবে, পরে এই বাড়ির দামও কিছুই মিলবে না। এমন সকল প্রশ্ন এড়িয়ে চলার ইচ্ছায় সে তাই ওড়না দিয়ে মুখ আড়াল করে বাড়িতে এসে ঢোকে। রক্ষে ভর দুপুরে রাস্তায় কোন লোক চলাচল নেই। বিরাট বড় বাড়ি বানিয়ে ছিল তার বাবা। এই বাড়ির ভিত, মাটি, দেয়ালে বাবার ব্যবসার জমানো সব টাকা, মায়ের সোনার সীতা হার, শঙ্খমুখী এক ভরির বালা, দিদার মাকে দেওয়া হাতের বাজু আর খুব ভারী নেকলেসটাও আছে। সেই যে গয়নাগুলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল আর ফেরেনি। তাদের অনুপস্থিতি পূরণ করেছিল দু'তলার সিঁড়ি, ছাদের মেঝে, সেগুন কাঠের জানলা দরজা আরো কত কী! তাই তো কান গলা হাত খালি এক টুকরো সোনাহীন শরীর দুলিয়ে মা বলত 'এ বাড়ি সোনার চেয়ে দামী'। রাস্তার গেট থেকে মেন বাড়ির দরজা অনেক দূরে। অনেক বাগান বাড়িটাকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে। বাগান না বলে এখন জঙ্গল বলা ভালো। বহুদিন না কাটা সাপখোপের জঙ্গল। দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই এক তীব্র ধুলোর গন্ধে জবার শরীর খারাপ করে ওঠে। হাঁচি শুরু হয় তার। বৈঠকখানার আলো জ্বালতেই মুখ খুশিতে ভরে ওঠে আবার। যাক বাড়ি তাহলে বিদ্যুৎহীন হয়নি। শেষবার এসে ও অ্যাডভান্স বেশ কিছু টাকা বেশি বিল জমা দিয়ে গিয়েছিল। তাই হয়ত ইলেকট্রিক অফিস লাইন কাটে নি। ঝুল সরিয়ে সে তাকিয়ে দ্যাখে চারিদিক। একে একে সব ঘরে ঢোকে। পাঁচ পাঁচটা ঘর তাদের।
মা বাবার বিয়ের খাটটাতে উঁই ধরেছে। আলমারির ভিতরে রাখা মা বাবার পোশাকের রঙগুলো মলিন। ঘরের দেওয়ালের আয়নার কাঁচটায় তার মুখটা খুব ঝাপসা বিমর্ষ দেখায়। বড় ঘড়ির কাঁটা দুটো বহুকাল আগের এক সময়ে থমকে আটকে আছে। তার পড়ার টেবিলে ধুলোর উঁচু আস্তরণ। হাত বোলাতে ভিতর থেকে উঁকি মারে এম. এ ক্লাসের 'টিনের তলোয়ার', 'সধবার একাদশী', 'নীল দর্পণ', 'কপালকুন্ডলা'রা। দেওয়ালের পেরেকে টাঙানো বাবার ছবির পিছনে একটা টিকটিকি জ্বলজ্বলে চোখে যেন তাকেই দেখছে। চারিদিকে মাকড়সারা যেভাবে জাল বানিয়ে রেখেছে মনে হয় যেন সেখানে কোনদিন কোনকালেই মানুষ বাস করে নি। এ ঘর চিরকাল পোকামাকড়ের ছিল, পোকামাকড়েরই আছে। জবার মনে পড়ে রান্নাঘরে যাওয়ার বারান্দায় দরজার পিছনে রাখা থাকত ঝাঁটাটা, ঠিক তাই আজও শক্ত হয়ে যাওয়া বহু পুরনো একটা ঝাঁটা সেখান থেকে উদ্ধার করে সে। তাই দিয়েই ধুলো ঝুল ঝাড়তে শুরু করে। ঘরের জানলায়, দরজার গোড়ায় পিঁপড়েতে মাটি তুলেছে প্রচুর, বিছানা জুড়ে টিকটিকির কালো সাদা গু। চেয়ার টেবিল আসবাব সবকিছু থেকে ঝেড়ে পুরু ধুলোর চাদর সরায়। ঘরের অবস্থা দেখে জবার চোখে জল চলে আসে, সে কাঁদতে কাঁদতে হাতের ঝাঁটা ফেলে বসে পড়ে। তারপর আলমারি থেকে ছবির অ্যালবামটা বের করে খুলে নিয়ে বসে। পুরনো ছবিগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে ফুঁপিয়ে ওঠে। মায়ের বাবার বিয়ের ছবি, তার শৈশবের জন্মদিনের ছবি, বাবার বাইকটায় হেলান দিয়ে মায়ের অল্প বয়সের ছবি পরপর সাজানো। কোন ছবিতে মায়ের কোলে, কোনটায় বাবার কাঁধে সে চড়ে থাকার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে।
বাবার গানের ফাংশনের কত সব ছবি সুন্দর করে সাজানো। এমনকি বাবার বন্ধু, মায়ের কলিগ, জবার স্কুলফ্রেন্ডের ছবিও অ্যালবামে বাঁধানো আছে। জবা গোটা ঘর ঘুরে বহু দিন পর দেখতে থাকে ড্রয়ারে রাখা মায়ের চুড়ি, চশমা, সিঁদুর কৌটো, বাবার আঙটি, হাতঘড়ি, পকেট চিরুনি। ওর চোখে ভেসে ওঠে বাবা মায়ের হাসিমুখটা। যেন সদ্য স্নান সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পরছে মা। বাবা লুঙ্গি পরে খাটে বসে হারমনিয়ামটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে গান গাইছে। জবা স্পষ্ট শুনতে পায় তার বাবার কন্ঠ- 'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে'। গানের সাথে ঘরের কোণে একলা দাঁড়িয়ে থাকা তানপুরাটা থেকে মিষ্টি তান বেরুতে থাকে। কতদিন তাকে কেউ কোলে টেনে তারে আঙুল ছোঁয়ায় নি। জবা এগিয়ে যায় তানপুরাটার দিকে, তার উপর থেকে ঢাকা চাপাটা সরিয়ে টুং টুং ক'রে তারে শব্দ সৃষ্টি করে। এরাই তার অতীত, এরাই তার বন্ধু। চারিদিকে তার সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলোর সঙ্গীরা ভিড় করে আছে। সবাই যেন তাকে বহুদিন পর দেখে জড়িয়ে ধরতে চায়। সবাই তারই মতো মনখারাপ নিয়ে বসে আছে দিনের পর দিন। ঘরের প্রতিটা আসবাব, বই খাতা ফাইল, এমনকি তার রোজ ভাত খাওয়ার থালাটার পর্যন্ত মুখ ভার। জবাকে যে বাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে একদিন, সেই খবর বাড়ির চামচটাও জেনে গেছে। জবা কী করবে ভেবে পায় না! তার ইচ্ছা করে না এইসব ছেড়ে আর কোথাও যেতে। কিন্তু কীভাবে থাকবে সে এখানে এসে? তার যে পিছনেও অনেক টান। বন্ধ বাড়ি নিয়ে দুশ্চিন্তা তার অনেক কালের। কোথা থেকে ফোন নম্বর পেয়ে বেশ কয়েকবার দালালও তাকে ফোন করেছিল। কিন্তু সে তাদের কথার কোন আমল দেয় নি। দিশেহারা হয়ে ওঠে সে, বহুদিন পর তার শৈশব, বাল্য ও যৌবনে পড়ার বয়স তাকে চেপে ধরে বুকে পুরে নিতে চায়। তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় তাদের কাছে। জবা আলমারি থেকে মায়ের লেখা পুরনো ডায়েরিটা খুলে বসে-
'জলের মধ্যে মাছটা তখন খুব ছটফট করছে। সমানে এদিক ওদিক সেদিক। ঘুরে ঘুরে জলে ফেনা তুলছে বারবার। দীর্ঘ সময় পার করে ফেলেছে ওই জলে। জলজ জীবন কারই-বা বেশি ভাল লাগে! শ্যাওলা জমে ওঠে হাতে পায়ে গায়ে বুকে মনে। পিচ্ছিল শরীর তখন ডাঙা খুঁজে চলে। জলের আশ্রয় একদিন হিমালয়ও মেনে নেয়নি, মাথা তুলে উঠে এসেছিল অনেক অনেক উপরে। পরাশ্রয়ী জীবন কারুর ভালো লাগে না। মাছের যতই বাড়ে ছটফটানি ততই যেন অনুভূত হতে থাকে বেদনা। সেদিন ছিল রবিবার বেলা বারোটায় ঊর্ধ্বাকাশে সূর্যদেবতা যখন ভুবন ভোলানো হাসি ছড়াচ্ছে, নদী নালা খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে একটু করে। তখন এই মাতৃপুকুর কেটে হস্তজালে জল থেকে ডাঙায় জন্ম নিল মাছটা।'
মায়ের ডায়েরির পাতার এতখানি পড়ে থামে জবা। এই সবই তার জন্ম নিয়ে লেখা। মা খুব ডায়েরি লিখতে ভালোবাসতো। আলমারির তাকে অমন বহু ডায়েরি আছে। আগে জবা কখনো সে'সবে হাত দেয়নি। এখন কয়েকটা টেনে নিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে তার আর যে কোন ভয় নেই। আর যে মা এসে নিষেধ করবে না। কোনদিন সামনে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে বলবে না 'বড়দের জিনিসে হাত দেবে না জবা, বহুদিন বলেছি।' মা চলে যাওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর অসুস্থ ছিল। ব্রেনের একটা একটা করে শিরা শুকিয়ে যাচ্ছিল মায়ের আর একটু একটু করে অন্য মানুষে পরিণত হচ্ছিল সেই মানুষটা। প্রথমে মায়ের হাঁটা চলা বন্ধ হয়। তারপর কথা বলা। বুঝত সবই, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত আর কখনো কখনো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। ডাক্তার কোন রকমের উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছিলেন। তাই আত্মীয়রা মাকে দেখতে এসে যখন বলত 'কী যে অসুখ বাঁধল তোমার' কিংবা কেউ কেউ কাঁদত মায়ের হাত ধরে জবা তাদের পত্রপাঠ বিদায় করে দিত। তার জন্য তাকে অনেক কঠিন হতে হয়েছিল। মুখের সামনে আত্মীয়দের থামতে বলতে পারার মতো কঠিন। সব রকম উত্তেজনার বাইরে মায়ের বেঁচে থাকাকে খুব আগলে সেই বাচ্চা হয়ে যাওয়া মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল জবা। "আর এক চামচ নাও মা, আর একটু খাও" মায়ের মুখের সামনে সে চামচ ধরে থাকত। মা ঐটুকু তরল খাবারকেও মুখের মধ্যে পুরে বহু সময় ধরে এদিক ওদিক ঘোরাত, তবু গিলতে পারত না। চোখ দুটো যেন বিস্ফারিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইত। মাঝে মধ্যে সেও যে বিরক্ত হয়ে ওঠেনি তাও নয়। জবার মনে পড়ে যায় একবার বিরক্ত হয়ে সে একবেলা খাওয়াতেই পারে নি মাকে। হাল ছেড়ে দিয়েছিল কত সহজেই। ভাবতেই জবার বুকটা হু হু করে ওঠে। মায়ের ছবির উপর আছড়ে পড়ে কান্নায়। অসীম ধৈর্য কি শুধু মায়ের বুকেই পুরে রাখা থাকে? মেয়ের বুকে নয়? চোখের জল মুছে জবা আবার ডায়েরির পাতায় চোখ দেয়।
'আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে জোনাকি ঢুকেছিল। পড়ার বই ফেলে একটানা মেয়েটা ওই জোনাকির পিছনে দৌড়ল। জোনাকিরা যেমন অজান্তেই আলো দেয়, এই মেয়েও আমায় অনেক আলোয় ভাসায়। ওর শৈশব, ওর প্রথম হাঁটা, প্রথম কথা বলা সবই তো এক একটা আলো যা দপদপিয়ে জ্বলে আর আনন্দ দেয়' মায়ের লেখা লাইনগুলো পড়ে জবার বুকের আগুন জোনাকির মতো দপদপ করতে থাকে। তার মা তাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছে কিন্তু সে কী করেছে প্রতিদানে? কিচ্ছু না। ভিতরটা জ্বালা করতে থাকে জবার।
আলমারি থেকে মায়ের একটা শাড়ি বের করে জবা পরতে শুরু করে। তারপর এক এক করে মায়ের মতো করে সাজতে থাকে সে। মায়ের ব্রোঞ্জের চুরি, লাল টিপ, কালো হয়ে যাওয়া রূপোর হার সব গলিয়ে নেয় এক এক ক'রে। মা কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করত না। মায়ের একটা নিজের গন্ধ ছিল, একদম নিজস্ব গন্ধ, সেই গন্ধটা নিজের মধ্যে কিছুতেই খুঁজে পায় না সে। হঠাৎ দরজায় কারুর আঘাত দেওয়ার শব্দ হয়। জবা তড়িঘড়ি সব কিছু খুলে একটা নাইটি গলিয়ে নিয়ে দরজা খোলে। না! কেউ নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ, অঘোরে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। হয়ত বাগানের নারকেল গাছ থেকে বড় পাতা কিংবা নারকেল পড়েছে, তারই শব্দ। তাই তো! জবার টনক নড়ে তাদের বাড়িতে কেই-বা আসবে। এই বাড়ি বহু বছর বন্ধ থাকায় মানুষের পায়ের ধুলো পড়েনি। তার বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ যাওয়ার সময় আর ফিরেও তাকায় না, দ্যাখে না মরচে পড়া তালাটা বাইরে ঝুলছে নাকি বাড়ি ভিতর থেকে বন্ধ। জবার খুব মনখারাপ হয়। বাড়িটা আগে কত সরগরম থাকত। বাবার কাছে গান শিখতে আসা ছেলেমেয়েদের ভিড় লেগে থাকত। উঠোনে সর্বদা ছড়ানো জুতো। কত কথা কত গান ছড়িয়ে থাকত ঘরের বাতাসে। মায়ের কাছে কত মানুষ আসত হিন্দিতে চিঠি লেখাতে, পড়াতে। তার মা যে উত্তরপ্রদেশের লখ্নৌয়ে বড় হয়েছিল, মায়ের পড়াশোনা ছিল হিন্দি মিডিয়ামে। তারপর পশ্চিমবঙ্গে এসে মায়ের হিন্দি শিক্ষাটা সকলের কাছে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে ছিল। তখন ছিল গুটি কয়েক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল আর নইলে সব বাংলা মিডিয়াম। ইংরেজি মিডিয়ামেও এখনকার মতো হিন্দিকে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ নিত না কেউ, বাংলাই ছিল সবার জ্ঞানের ভাষা। দূরদূরান্তের মানুষ জানতে পেরে গিয়েছিল তার মা হিন্দি জানে। মা হাসি মুখে অবসর সময়ে বসত তাদের হিন্দি চিঠিপত্র হাতে নিয়ে। কারুর প্রেমের চিঠি, কারুর ব্যবসার, কারুর অশিক্ষিত মায়ের কাছে পড়ে শোনাত শিক্ষিত ছেলের চাকরির উন্নতির খবর। মা ছিল তাদের সকলের ঘরের লোক।
জবা জানলাটা একটুখানি ফাঁক করে দেখতে থাকে কোথায় আওয়াজ হল। সে ভাবতে থাকে সে যে শৈশবটাকে যাপন করে এসেছে সেই শৈশব তার ছেলের নেই। এমনিতেই এখনকার বাচ্চাদের জীবনে আছে শুধু ব্যাগ বোঝাই বই, রুটিন,পড়াশোনা আর মাপের খেলা। আজকের ছেলেমেয়েরা হল এক একটা চারাগাছ, যাদেরকে নিয়মিত সার দিতে হয়। যত সার তত ফল। কোন মা-ই পারে না শিশুকে লেখাপড়ার চাপ না দিয়ে থাকতে। সকলেই সেই পথ অনুসরণ করে ফেলে। জবার মনে পড়ে না সে ছোটবেলায় কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছে কিনা! শুধু একবার সে ঘুম থেকে উঠে শুনেছিল মধ্যরাতে নাকি ভূমিকম্প হয়েছে কিন্তু তার অনুভূতি কেমন তা সে জানে নি। অথচ এখনকার বাচ্চারা ছোট থেকে দেখছে অতিমারী, লকডাউন, বুলবুল, ফণি, আমফান, ঘনঘন ভূমিকম্প, বন্যা, দাবানল, পৃথিবীর চৌম্বকত্ব হারানোর খবর আরো কত সব প্রকৃতির রাগী মুখ। ফাঁকা ঘরে একা একা ঘুরে বেড়ায় জবা। মনে পড়ে ছেলের এবার দশ বছর হল, ছেলেকে নিজের দশ বছরের ছেলেবেলাটা উপহার দিতে ইচ্ছা জাগে ওর। ও যখন ছোট ছিল তখন সেভাবে নিজেকে দেখেনি। খেয়াল করে নি মা বাবার দিকে। এখন দূর থেকে দেখতে পায় নিজের সেই জীবনটাকে, জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীকে। তারা তো বহু আগেই তারা হয়ে গেছে, তাদের দু'জনের ত্যাগ, লড়াই, স্বপ্নগুলো আলাদা করে পরিষ্কার দেখতে পায় সে। বাবা-মায়েরা হল পরশপাথরের মতো। ছুঁয়ে থাকলে টের পাওয়া যায় না, হারালে স্বরূপ বোঝা যায় আর এটাও হল জগতের নিয়ম দূর থেকেই মানুষকে স্পষ্ট দেখা যায়। যেমন একটা গোটা পাহাড়, জঙ্গল, নদী কিংবা বাড়িকেও দূর থেকেই সম্পূর্ণ পরিষ্কার দেখা যায়, তার ভিতরে বা পাশে দাঁড়িয়ে নয়। সে স্মৃতি খুঁড়ে দেখতে পায় কীভাবে শৈশবে সারাটা দুপুর ছোট ছাদটাতে তে দাঁড়িয়ে টিয়া পাখির সাথে লড়াই ক'রে আগে আগে পাকা পেয়ারাগুলো পেড়ে নেবার চেষ্টা করত। কোথাকার কোন্ দূর দেশ থেকে উড়ে আসা টিয়াগুলো খুব দুষ্টু ছিল।
টি টি করে উড়ে এসে সব পাকা পেয়ারাগুলো ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে মাটিতে ফেলে দিত। অত উঁচু গাছ থেকে হলুদ পেয়ারাগুলো মাটিতে পড়তেই ফেটে যেত। মা বলত 'ঐ ফল মুখে দিস না যেন'। ঝাপসা ছবির মত তার মনে ভাসে কোন কোনদিন সুপুরি গাছের নৌকার মত পাতায় বসে থাকত সে আর পাড়ার বন্ধুরা কেউ সেটা টেনে টেনে তাকে রূপকথার জগতে নিয়ে যেত, গোটা বাগান ঘুরে তাদের সেই খেলা চলত, দু'পাশের গাছগুলো তখন দৌড়াদৌড়ি করত। একলা দুপুরগুলোয় বাগান থেকে বাবার সখের চাষ করা ছোট ছোট কচি গাজরগুলো তুলে মাটি ঝেড়ে বাগানেরই কলে ধুয়ে ঘুরঘুর করতে করতে আত্মসাৎ করা হয়ে যেত। শিউলি ফুল গাছটার শুঁয়োপোকা, পেঁপে গাছের লম্বা লম্বা ফুল, জবাফুলের কুড়ি, অকালে ঝরে পড়া ছোট ছোট নারকোলের বাচ্চাগুলোর কাছে বাঁধা থাকত মনটা। ঘাসের বন্ধু কী যেন নাম যাকে ডাকত লুচি পাতা বলে, কত খেলনা বাটি খেলত সেইসব নিয়ে সারা বেলা ধরে। বিকেলে ব্রতচারী করতে যেত পাড়ার মাঠে। দল বেঁধে পাড়ার বন্ধুরা মিলে মাঠে খেলত। আর শীতের দিনগুলোয় খুব তাড়াতাড়ি ঝুপ করে যখন অন্ধকার নেমে আসত তখন খেলার মাঠের পিছন বাড়ির ঝুঁকে পড়া বড় কুলগাছ থেকে কুল চুরি করে আনত পরের কোন নির্জন দুপুরে নুন তেল দিয়ে সেটার সদ্ব্যবহার করব ব'লে। ছুটির দিনে সারাটা দুপুর বিকাল চোখে ঘুম আসত না। শুধু এই একটা জায়গায় সে মিল দেখতে পায় তার ছেলের সাথে। সেও সারা দুপুর-বিকাল একটু ঘুমোয় না, টিভি দ্যাখে কিংবা ঘুরে ঘুরে একা কথা বলে। তবে জবার ছেলে জবার মতো গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া শেখেনি। সে শুধু জানে ফল গাছে নয় বাজারে পাওয়া যায়। পেয়ারা আশি টাকা কিলো, কুল চল্লিশ টাকা। প্রকৃতির জিনিস নিয়ে কীভাবে খেলতে হয় সে জানে না। গাড়ি, বন্দুক, টকিংটম, বেবলেট এমন অজস্র খেলনা থাকতেও সেই রবিঠাকুরের কথা মতো জবার ছেলেরও যেন আসল খেলাটাই মাটি হয়ে গেছে। জবা বসে বসে ভাবতে থাকে সে সন্ধ্যায় ছোট হাত দুটো নিয়ে বড় হারমোনিয়ামটাকে কব্জা করতে চেষ্টা করত, ঐ যন্ত্রটাতে মন দিতে দিতে সুর কথারা বদলে যেত। আর তখনই পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়ে বাবা যখন চিৎকার করত, ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠত তার। এত বছর পরও সেকথা ভাবতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার। গানের শেষে কিছু খেয়ে পড়তে বসত সে। পড়াশোনা নষ্ট হবে বলে তার বাবা শৈশবে টিভি কী জিনিস চেনায় নি। প্রথম যখন বাড়িতে টিভি এল ছাদে টাঙানো অ্যান্টেনা সমেত, তখন ক্লাস সেভেন ছেড়ে এইটে উঠেছে। সন্ধ্যায় পড়া হয়ে গেলে ছাদে উঠে যেত হাঁটতে। পশ্চিমের নিমগাছটায় তখন আকাশের ছোট ছোট তারারা নেমে এসে সাদা ফুল হয়ে ঝাঁক হয়ে থাকত। আর সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুক ভরে তার হাল্কা মিষ্টি গন্ধ নিত। রাতে শুয়ে মা তাকে আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের গল্প বলত। সবাইকে ছেড়ে শুধু মোস্তফার কথা শুনতে চাইত জবা। তাই মাও সুর ক'রে ক'রে জবাকে ডাকত 'বা...বা মোস্তাফা'। জবা নোংরা বিছানাতেই শুয়ে থাকে তার শৈশবকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁট দুটো একটু একটু করে নড়তে থাকে তার। ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়ায় ডাক 'বা বা মো.. স্তা.. ফা'....
পাড়ার লোকজন এক বিকট বিশ্রী গন্ধে টিকতে পারে না। তারা বোঝে জবাদের বন্ধ বাড়ি থেকেই সেই গন্ধ ভেসে আসছে। কীভাবে যোগাযোগ করবে জবার সাথে ভেবে পায় না। অন্যদিকে তার বর ফোন করে নিজের ভাইকে পাঠিয়ে ছিল জবার বাড়িতে তার খোঁজে। বহু দিন যোগাযোগ বন্ধ জবার সাথে। দরজা জানলা খোলা না দেখে জবার দেওর ফিরে যায়। পাড়ার লোক শেষে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে জবার বাড়ির দরজা ভেঙে ঢোকে। ভিতর থেকে উদ্ধার হয় বেশ কয়েক দিনের বাসি জবার পচা গলা মৃতদেহ। শবদেহ তুলে নিয়ে যেতেই জবাকে ঘিরে থাকা পোকাগুলো তাড়াতাড়ি খাটের তলায়, দরজার পিছনে আলমারিতে গিয়ে লুকোয়।।