একটি অন্যরকম প্ৰেম
একটি অন্যরকম প্ৰেম
বোঝার বয়স হবার পর থেকেই ও বুঝতে পারে যে ও অন্য মেয়েদের থেকে মানসিক ভাবে একটু আলাদা। বিয়ের বহু বছর পর যখন তার বাবা ও মায়ের সংসারে ও প্রথম সন্তান হয়ে এল তখন সবার মুখগুলো খুশিতে ভরে ওঠে। কন্যা সন্তান হয়েছে তো কি? সন্তান তো! আর এখন তো আর মেয়েরা ছেলেদের থেকে কোন অংশেই কম যায়না। তাই বহু জাঁকজমক করে অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান করা হয়। মা - বাবা মেয়ের নাম রেখে ছিলেন কামনা ।
কামনা পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তাই যথেষ্ট স্বচ্ছলতা আদর যত্নের সাথে মানুষ হতে লাগলো। বাড়িতে বাবা মা ছাড়াও দাদু ঠাকুমার সান্নিধ্যে ভালোই দিন কাটে। কামনার বাবা একটি কোম্পানীতে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন।অর্থের অভাব নেই,স্বচ্ছল সংসার। তাই কোন কিছুই অভাব হয়না।
ছোট বেলা থেকেই দেখা যায় কামনা যথেষ্ট সুন্দর ও মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কেমন যেন একটু রিজার্ভ প্রকৃতির অর্থাৎ নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করে। সে একটু গম্ভীর ও রাগী প্রকৃতির এবং কোন কিছু একটা টেনশন সবসময় ওর মধ্যে কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই কামনার সেরকম কোন ঘনিষ্ট বন্ধু নেই। একমাত্র পড়াশুনাকেই নিজের ধ্যান-জ্ঞান হিসাবে ধরে ছিলো, তাই কোন বন্ধুর প্রতিই সেরকম আকর্ষণ বোধ করেনি। যদিও স্কুলে পড়াকালীন কিছু ছেলে কামনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ও খুব একটা পাত্তা দেয়নি। ছেলেদের নিজেকে অতিরিক্ত স্মার্ট হিসাবে তুলে ধরা ও সব সময় সুযোগ পেলেই শারীরিক সম্পর্ক স্হাপনের চেষ্টা কামনাকে ছেলেদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।
ধীরে ধীরে স্কুলের গন্ডী পার করে মেধাবী কামনাকে স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাড়ীর থেকে দূরে একটি গার্লস কলেজে। সেখানে কামনা একটি হোস্টেলে থাকতে শুরু করে। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দেয় কামনা একটু রাগী ও রিজার্ভ প্রকৃতির হওয়ার জন্য অন্যান্য সহপাঠীরা তার সঙ্গে মিশতে চায়না। তাছাড়া ওর বেশিরভাগ সহপাঠীরাই ক্লাসের শেষে এমনকি হোস্টেলে নিজেদের বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে আলোচনা করতো। যা কামনার মোটেও পছন্দ ছিলো না। তাই তারা বিভিন্ন সময়ই কামনাকে এড়িয়ে চলতো ও নানা অছিলায় ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।
এরমধ্যে দুদিন শরীর খারাপ হওয়াতে ক্লাসে যেতে পারেনি কামনা। তাই ক্লাস নোটের জন্য ওকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে হয়। যেহেতু অন্যদের সাথে ওর বেশী হৃদ্যতা ছিল না, তাই সে সময় ওকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। এমন সময় কামনার পাশে এসে দাঁড়ায় এক বান্ধবী । নাম তৃপ্তি । পাশের পাড়াতেই ওর বাড়ি। তৃপ্তি নিজেকে সবসময় সাধাসিধে রাখার চেষ্টা করে। কোনরকম সাজগোজ ওর পছন্দ নয়। ক্লাস বাদ দিয়ে বেশিরভাগ সময়ই জিন্স আর টি শার্ট পড়ে থাকে। চুল সবসময় ছোট রাখে অর্থাৎ বয়কাটই ওর পছন্দ। তৃপ্তি দুদিনের সমস্ত নোট কামনাকে দিলো, আর মজা করে মুচকি হেঁসে বললো, এই নোটের বদলে তুমি আমাকে কি দেবে? কামনা বললো, তুমি কি চাও? তৃপ্তি বললো, এখন নয় পরে চেয়ে নেবো। এভাবেই দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। ওরা প্রতিদিন একে অপরের পাশে বসতো। এমনকি একসাথে টিফিনও করতো। এরপর থেকে একে অপরের হোস্টেলের ঘরে যাতায়াত শুরু হয়। প্রথম প্রথম দুজন বন্ধু হওয়ায় দুই পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওরা মাঝে মাঝে একে অপরের বাড়িতেও থাকতো।
মাস কয়েক পর কামনা হোস্টেলে ঘটা করে নিজের জন্মদিন পালন করে। অন্যান্য জনা দশেক সহপাঠীর সাথে সেদিন তৃপ্তিকে আমন্ত্রন জানানো হয়। সন্ধ্যের পর অন্যান্য সব বন্ধু চলে যাওয়ার পর তৃপ্তি কামনাকে বলে, মনে আছে সেদিন তোর থেকে একটা জিনিস চেয়েছিলাম। তুই আজ ওটা আমায় দিবি? কামনা বলে কি চাস বল? তৃপ্তি তখন সব শক্তি দিয়ে কামনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে, ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, তুই বুঝিসনা আমি তোকে ভালোবাসি? কামনা বলে, এ তুই কি বলছিস? সে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তৃপ্তির শরীরি ভালোবাসায় কামনা নিজেকে নূতন করে চিনতে পারে। সে নিজেকে তৃপ্তির কাছে উজার করে দেয়। তৃপ্তির ঠোঁটের স্পর্শে ওর রক্তে উন্মাদনার ঢেউ উঠেছে। তাই নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেনা। দুই বন্ধু ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তৃপ্তি ততক্ষণে উত্তেজনায় কামনার কুর্তির বুকের কাছটা ছিঁড়ে ফেলেছে। পাগলের মতো ওর গোটা শরীরে হাত বোলাচ্ছে। তৃপ্তি কামনার কুর্তি খুলে স্তনবৃন্তে ঠোঁট রাখলে কামনা ভালোবাসায় মরে যায়। কামনা বুঝতে পারে, তার প্রস্ফুটিত যৌবন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আজ সে প্রকৃত ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজে পেয়েছে। একই অবস্হা হয় তৃপ্তিরও । ও বুঝতে পারে শারীরিক চাহিদার কথা। বুঝতে পারে কামনাকে ছাড়া একটা দিনও ওর পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গতা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
কিন্তু ওদের দুজনের এই সম্পর্ক খুব বেশি দিন স্হায়ী হলোনা, কারণ এ জিনিস বেশিদিন চাপা থাকে না । একদিন হোস্টেল ওয়ার্ডেন সন্দেহ বশত দরজা ঠেলা দিতে সবকিছু দেখে ফেলে। ওদের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। এরপর থেকে দুজনকে সবসময় চোখে চোখে রাখা হয়। কলেজ শেষ হলে কামনার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়ে যায়। কামনাকে দেখতে সুন্দর হওয়ার জন্য একদিন ছেলের বাড়ি থেকে কামনাকে পছন্দ করে গেলো। কামনার বাড়ি থেকেও ছেলেকে পছন্দ করলো। চোখের পলকে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলো। তৃপ্তি কামনার বিয়ের কথা শুনে কষ্ট পেলো, ও কাঁদতে লাগলো। কামনাও প্রথমে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু বাড়ির চাপে পড়ে ও মা দিব্যি দেওয়ায় বিয়েটা করতে বাধ্য হলো। কয়েকদিন পর কামনা বিয়ে করে দূরে চলে যায়। এরপর থেকে তৃপ্তিও নিজেকে মনমরা ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করলো।
সুমনা স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য লোকজনদের নিয়ে সংসারে ঠিক মতো মানিয়ে নিতে পারছিলনা। আসলে প্রথম দিনের সেই চুম্বনের কথা, ঠোঁটের সেই সিক্ত উষ্ণতা সে এখনও অনুভব করতে পারে। একদিন রাতে তার স্বামী শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলে, সে সমস্ত কথা স্বামীকে খুলে বলে। আসলে সে যে সমকামী, তাই কোন পুরুষের সংস্পর্শে আসতে অস্বস্তি ও ঘেন্না বোধ করে। সে কোন পুরুষকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনা। সব কথা শোনার পরেও ওর স্বামী কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। বরং সম্পূর্ণ বন্ধু সুলভ ব্যবহার করে সবকিছু বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে কামনার মতো মেয়েরা কখনও মানসিক ভাবে দূর্বল নয়। ওরা সমাজের ধরা বাঁধা চেনা রাস্তা দিয়ে চলেনা বলে সমাজ ওদেরকে আলাদা চোখে দেখে। অন্যের কাছ থেকে তারা যে সুস্থ নয় বা অস্বাভাবিক এটা শোনার পর অনেক সময়ই তাদের নিজেদের সাথে লড়াই করতে হয়। কামনার এই লড়াইয়ে ওর স্বামী পাশে দাঁড়ায় ও মনোবল বাড়াতে থাকে। ওর স্বামী বাড়িতে বাবা মাকে সবকথা খুলে বলে এবং কামনাকে এই বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে চায় । এর কিছুদিনের মধ্যে সুমনার সাথে ওর স্বামীর মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে যায়।
এরপর প্রায় বছর দুয়েক পর সাউথ সিটি মলে শপিং করতে গিয়ে একদিন হঠাৎ করে কামনা তৃপ্তিকে দেখতে পায়। দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে খানিক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর কামনা তৃপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বলে, কিরে, কেমন আছিস? কতদিন পর দেখা। পরস্পর পরস্পরের সম্বন্ধে জানতে পারে। তৃপ্তি বর্তমানে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে। কাছাকাছি কোন ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে অবন্তি কামনাকে আসতে আমন্ত্রন জানায়। পরের দিন সন্ধ্যের সময় কামনা তৃপ্তির ফ্ল্যাটে চলে আসে। তৃপ্তি আবার নিজের হারানো সবকিছু খুঁজে পায় কামনার মধ্যে। কামনার ডিপ কাজল, কোঁকড়ানো চুল, চুরি আর মেহেন্দীতে এতোটাই মোহিত হয় যে কামনাকে আর হারাতে চায়না। সত্যিই কামনার মধ্যে একটা শারীরিক টান আছে, এমনকি প্রবল মানসিক টানও। এটা বোঝার পরে সমাজকে দূরে সরিয়ে কামনা ও তৃপ্তি লিভটুগেদার করে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রায় মাস খানেক এভাবেই চলতে থাকে দুজনের সুখের জীবন। এরপর কামনার বাবা থানায় গিয়ে তৃপ্তির বিরুদ্ধে তাদের মেয়েকে অপহরনের অভিযোগ দায়ের করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয় যে, পুরো ব্যাপারটাই সাজানো ও কামনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ওখানে রাখা হয়েছে। এরপর তৃপ্তিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসা হয়, আর কামনাকে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। থানায় থাকাকালীন নারী পুলিশ সদস্যরা তৃপ্তিকে পরীক্ষা করে। সারা শরীর হাত দিয়ে দেখা হয় সে ছেলে না মেয়ে। এরপর সমাজ ও পরিবারের কাছে দুজনকেই বিভিন্ন রকম বিদ্রুপ ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বলা হয়, একজন ছেলে একজন মেয়েকে ভালোবাসে, আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুজন মেয়ে এক বিছানায় কি করতে পারে? আদপে এগুলো জিনগত সমস্যা। এরপর কোর্টে নিয়ে আসা হলে দুজনকে বিভিন্ন রকম লজ্জাজনক পরিস্হিতির সম্মুখীন হতে হয়। কামনার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টা আসলে একটি অপহরন। কিন্তু তৃপ্তি জানায় যে, 'সে প্রকৃতই একজন নারী ও একজন নারী হিসাবেই আরেকজন নারীকে ভালোবাসে'। কামনা বলে, 'একটি ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালোবাসতে পারে, তাহলে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে ভালোবাসতে দোষ কোথায়'? ভারতে ৩৭৭ ধারা লাগু থাকায় ও দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়াতে সমস্ত কিছু শোনার পর বিচারক তৃপ্তিকে বেকসুর খালাস দেয়।
আইন ও বিচার ব্যবস্হার হাত থেকে দুজন মুক্তি পায়। কিন্তু এসব কিছুর পরেও সমাজ ও পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চলে কটুক্তি ও হাসাহাসি। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ না হলে তারা আত্মহত্যা করলে তো তাদের অধিকার, তাদের ভালোবাসা - এই সব হেরে যাবে । তারা তো কোন অন্যায় করেনি, একে অপরকে ভালোবেসেছে, আর তাদের এই মন সেও তো সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্টি।তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করেই ভ্যালেন্টাইন ডের আগের দিন রাতে দুজন সিদ্ধান্ত নেয় না আর কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব নয়, সমাজ বা কারোর বলায় ওদের কোন কিছু আসে যায় না। ওরা ভালো থাকতে চায় এবং লড়াই করে ওরা ভালো থাকবে।
ভালোবাসার কোন জাত-ধর্ম হয়না। এমনকি লিঙ্গভেদ। পশ্চিমী দেশগুলোর মতো ভারতেও সমকামী প্রেমকে সুপ্রীম কোর্ট স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কেন সমকামী জুটিরা এখনও সমাজে মুক্ত ভাবে শ্বাস নিতে পারেনা। সমাজ তথা পারিবারিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মধ্যে তাদের পড়তে হয়। পরিবর্তন কি শুধু এসেছে কাগজে কলমে, পরিবর্তন তো অধরাই থেকে গেছে আমাদের মনে। তাই এই শেষ যুদ্ধটা লড়তেই হবে, এই অন্ধকার রাত্রির পরে ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে একটা সুন্দর সকাল যার আকাশ জুড়ে আছে উজ্জ্বল এক রঙধনু। ঐ আকাশটা ওদের জিততেই হবে - যেকোনো মূল্যে। যে জয় ওদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই নির্যাতন, মানসিক কষ্টের থেকে মুক্ত একটা সুন্দর পৃথিবী দেবে। ওরা হাত ধরাধরি করে ভ্যালেন্টাইন ডের অর্থাৎ প্ৰেম দিবসের দিন থেকে লড়াই শুরু করলো তাদের রঙধনুর স্বপ্ন সফল করার জন্য। আমরাও ওদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাই।

