Baishakhir Golpo

Inspirational Others

4.0  

Baishakhir Golpo

Inspirational Others

একতা

একতা

9 mins
244


প্রিয়তোষ বাবুর ছেলে তাতাই।একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বেসরকারি স্কুল। প্রিয়তোষ বাবু সরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মচারী( ক্যাশ ডিপার্টমেন্ট এ আছেন)। নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য ছেলেকে সরকারি স্কুলে না দিয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করতে দিয়েছেন। এদিকে উনি নিজে একজন সরকারি ব্যাংকের কর্মচারী!! বিষয়টা কেমন যেন জটিল।


"সমাজে চলাফেরা করতে,ও নিজের সম্মান বজায় রাখতে স্ট্যাটাস ভীষন জরুরী।.....

এই স্ট্যাটাস ধরে রেখেছি বলেই; পাড়ার সকলে আমাকে মান্যগণ্য করে। বুঝলে অনুপমা"....

এই বলে হাতে কফি মাগ টা তুলে নিয়ে লম্বা চুমুক দিলেন প্রিয়তোষ মুখার্জি। অনুপমা বলল.." কিন্তু তোমার স্ট্যাটাসের চাপে পড়ে আমার ছেলেটা দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনার এত প্রেসার এত কম বয়সে ওকে দেওয়াটা উচিত হয়নি।"...


যদিও এসব কথা প্রিয়তোষ বাবুকে বলেও কোন লাভ নেই। উনি এক কান দিয়ে শুনবেন অন্য কান দিয়ে বার করে দেবেন।..

কিন্তু মায়ের মন কে বুঝবে???

ছোট্ট ছেলে তাতাই। মাত্র পাঁচ বছর বয়স। ও যখন আড়াই বছরের তখনই প্রিয়তোষ বাবু ওর কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন মস্ত বইয়ের বোঝা। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা অ্যাক্টিভিটিসের জন্য যা যা প্রয়োজন যেমন- সাঁতার শেখা, কুস্তি শেখা, বন্দুক চালানো, কম্পিউটার এবং এখন যেটা খুব প্রয়োজন ক্যারাটে, এই সমস্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছেলে কে ভর্তি করেছিলেন।...

ছোট্ট তাতাই এর যখন খেলা করে বেড়ানোর বয়স তখনই থেকেই ওর মাথায় এতগুলো বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তোষ বাবু।..

যার ফলস্বরূপ বছর খানেকের মধ্যেই ভোগ করেছেন তাতাইয়ের মা। ছেলের মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। অথচ বাবাকে এতটাই ভয় পায় যে কিছুই বলতে পারেনা। কিন্তু মায়ের কাছে মাথা যন্ত্রণার কথা বলা মাত্রই মা অনুপামা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার বলেছিলেন বেশি প্রেসার না দিতে। কিন্তু প্রিয়তোষ বাবুর সেই সব কথার ধার ধারেননি।

তাতাইয়ের চোখে মোটা কাচের ফ্রেমের চশমা। সব সময় ওকে চশমা পড়ে থাকতে হয়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা তাতাইয়ের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর অনেক ছোট বয়স থেকেই এত কিছুর প্রেসার নিতে নিতে ছেলেটা কেমন যেন একা হয়ে গেছে। প্রিয়তোষ বাবু সাংসারিক বিষয়ে ভীষণ কড়া। একটা বড় এপার্টমেন্টে 21 তলা বিল্ডিং এ থাকেন ওনারা। নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য ছেলেকে কোন বাইরের লোকের সাথে মেলামেশা করতে দেন না। ছোট তাতাই বিকেলবেলা ব্যালকনিতে এসে খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সব ছেলেমেয়েরা ঐক্যবদ্ধভাবে খেলাধুলা করে বেড়ায়। কিন্তু তাতাই সেই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতে পারেন না।

তাতাইয়ের স্কুলে টিফিন টাইম হয়েছে। সব বাচ্চারাই ক্লাসের বাইরে খেলাধুলা করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাতাইয়ের বাবার কড়া শাসনের জন্য বেচারা ক্লাস রুমে বসে টিফিন খাচ্ছিল। হঠাৎই স্কুলেরই একটা বাচ্চা তাতাইয়ের পিঠে দুটো চাবর মেরে তাতাইকে বলে.." তোমার নাম কি?"..

তাতাই ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ।

এই প্রথম স্কুলের অন্য কোন বাচ্চা তাতাইয়ের সাথে কথা বলার সাহস দেখিয়েছে।..

একটু ঘাবড়ে গিয়ে তাতাই বলে.." আমার নাম তুহিন মুখার্জি। ডাক নাম তাতাই। তুমি কে?".

মেয়েটি বলে.." আমি ফিরোজা খান। আমাকে সবাই চিনি বলে ডাকে। আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবে!"

তাতাই ভালো করে লক্ষ্য করে, ও দেখে..

" মেয়েটির স্কুলের পোশাক টা বেশ নোংরা। মাথার চুল গুলো এলোমেলো। ঠিকমতো শ্যাম্পু করে না হয়তো!!"..

তাতাইয়ের মনে পড়ে ওর বাবা বারবার বলে দিয়েছিলেন স্কুলে কারো সাথে ফ্রেন্ডশিপ না করতে। কিন্তু এই প্রথমবার একজন সহপাঠিনীর মুখে ফ্রেন্ডশিপ করার কথাটা শুনে তাতাই না করতে পারে না। ওর বন্ধুদের সাথে গল্প করতে, খেলাধুলা করতে ইচ্ছে করে। তাই মেয়েটার প্রস্তাব মেনে নেয় তাতাই।

চিনি বলে.." আমি তোমার পাশে সিটকায় বসে টিফিন খেতে পারি।"..

তাতাই এর কাছে সবকিছু নতুন লাগছে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

এরপর মেয়েটি বলে.." তুমি কি খাচ্ছ!".

তাতাই বলেই." স্যান্ডউইচ!".

ও বলে মেয়েটি নিজের টিফিন বক্স খোলে।

তাতাইয়ের নাকে আসে একটা সুন্দর গন্ধ ।ও বলে..

" তুমি এটা কি খাচ্ছ??"..

মেয়েটি বলে..." আমি! রুটি আর সোয়াবিনের তরকারি খাচ্ছি।"..

তাতাই বইয়ে পড়েছে রুটি,সয়াবিন, শাকসবজি তরিতরকারি নাম কিন্তু ওর বাবার স্ট্যাটাসের চাপে পড়ে কোনদিন এসব খাবার ও খাইনি। বাড়িত সবসময় ব্রেড টোস্ট, চিকেন স্টু, বার্গার, কেক, পিজ্জা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস.. এইসব ফাস্টফুড রান্না হয়।

একবার ফ্লাটে বাংলাদেশ থেকে তাতাই এর ঠাকুমা বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি তাতাইকে গরম গরম ফুলকো লুচি ও আলুর দম রান্না করে দিয়েছিলেন। বেচারা তাতাই! খাবার খাওয়ার পূর্বেই ওর বাবা বাড়ি এসে যাওয়ায় সেটাও খেতে পারেনি ও।

ঠাকুমার বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরে, একদিন মায়ের কাছে তাতাই এসব খাবার খাওয়ার আবদার রেখেছিল। মা তৈরি করেছিলেন, কিন্তু ;ওর বাবা সেই দিন ও খেতে দেয়নি।....

চিনির মুখে এই ধরনের খাবারের নাম শুনে তাতাই উৎসাহের সহিত বলে.." এইসব খাবার খেতে খুব সুস্বাদু হয় তাই না চিনি!"..

চিনি হাসে বলে.." আমি তো জানতাম স্যান্ডউইচ খুব সুস্বাদু হয়!! আমি তো কোনদিন স্যান্ডউইচ খাইনি। আমি ছোট থেকেই এসব খাবার খাই। তুমি আমার টিফিন টা খাবে!!"...

চিনির মুখ থেকে এই প্রস্তাব টাই তাতাই আসা করছিল। প্রতিদিন বাড়িতে এসব ফাস্টফুড খেতে ওর আর ভালো লাগেনা।

আজকে চিনি র মায়ের হাতে রান্না করা রুটি আর সোয়াবিন পরম তৃপ্তিতে খায় তাতাই। তাতাই এর খাওয়া দেখে চিনি হেসে ফেলে।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর এই তাতাইয়ের মা অনুপমা ওর টিফিন বক্স চেক করেন। প্রতিদিনই টিফিন বক্স ভর্তি থাকে। কারন তাতাই অর্ধেক টিফিন খায়। আর অর্ধেকটা বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু আজ এমন কি হলো??

প্রিয়তোষ বাড়ি আসার পর এই আনন্দের সহিত অনুপমা জানায়.." জানো তো আজকে তাতাই পুরো টিফিন বক্স খালি করে টিফিন খেয়েছে।"..

প্রিয়তোষ বাবু শুধু একটু হাসেন।

একটি একটি করে দিন কাটতে থাকে। দিন পেরিয়ে বছর গড়িয়ে যায় । ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছেড়ে এখন ওরা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে । ক্লাস 9 এপড়ে । দিন দিন চিনি এবং তাতাইয়ের বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে । তাতাই জাতিতে হিন্দু। আর চিনি মুসলিম। দুই সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বিভেদ ওদের বন্ধুত্বে এতোটুকু আঁচ ফেলতে পারেনি।

একদিন চিনি তাতাইকে বলে..' তাতাই আজকে আমার জন্মদিন। আমার বাড়ি যাবে তুমি!"...

তাতাই বলে." কিন্তু আজ আমার ক্যারাটে ক্লাস আছে।"

চিনির একটু অভিমান হয়.." কোন দিনই তো যাও না। রোজ ই তোমার কোন না কোন ক্লাস লেগেই থাকে। কি জানি !আমি বাড়ি ফেরার পরে আমার আব্বা আমার সাথে গল্প করে। আমি নাচ শিখি। ছোটবেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ করতাম বলে আব্বা বলেছিল আমায় নাচ শিখতে দেবে। কিন্তু আমরা খুব গরীব তো তাই পারেননি। এইতো গত সপ্তাহে আমাকে আমার আব্বা একটা নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।".

চিনির মুখে কথাগুলো শুনে তাতাইয়ের মনে মনে নিজের বাবার ওপর অভিমান হয়। বাড়িতে মা ছাড়া,আর কেউ ওর সাথে কথা বলে না।বাবার কাছে অনেকবার তাতাই বেড়াতে যাবার বায়না করতো;কিন্তু প্রিয়তোষ বাবু কোনোদিন ছেলেকে সাথে নিয়ে বেড়াতেও যায়নি।তাতাই ওর বাবার ঘরে এলে উনি বলতেন

."যাও গিয়ে পড়তে বসো!1st হতে হবে।ভুলে যেও না আমাদের একটা স্টেটাস আছে।".....

এই ভাবেই ও বড় হয়।কিন্তু আজ.....

যে তাতাই কোনদিনও বাড়িতে মিথ্যা কথা বলেনি সে মিথ্যা বলতে শেখে। কারাটে ক্লাসের নাম করে তাতাই;চিনির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

চিনির জন্মদিন পার্টিতে গিয়ে খুব খুশি হয় তাতাই। যে সমস্ত ছেলে মেয়ে গুলোকে ছোট্ট থেকে দূরের মাঠে খেলা করতে দেখতো! আজ তাদের মাঝখানে থেকে তাতাইয়ের মনে একাকীত্ব ভাব অনেকটাই কাটে।

এমনিতেই এত বছর ধরে চিনির সাথে মেলামেশা করতে করতে;তাতাই মানসিকভাবে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে ও কাউকে কিছুই বলেনা।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে তাতাই দেখে ওর বাবা ফোনে কার সাথে যেন খুব চিৎকার করছেন। এমনিতেই বাড়িতে বাবার সাথে ওর একেবারেই কথাবার্তা হয় না। যা কথা হয় ওর মায়ের সাথে। কিন্তু আজকে তাতাই ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে." বাপি কার সাথে কথা বলছ!!".

প্রিয়তোষ বাবু বলেন..

"কোম্পানিতে এক মুসলিম কেরানি এসে জুটেছে। ঐ সামনের বস্তিতে থাকে। আমাকে জ্ঞান দেয়। বলে কিনা এত বছর ধরে আমি ভুল হিসাব করেছি। আমার ভুল হিসাব এর পরিমাণ এতটাই বেশি যে ;কোম্পানিকে এর খেসারত দিতে হবে। একটা সামান্য দুই টাকার কেরানি হয়ে,কত বড় সাহস! তাই ম্যানেজারকে ফোন করেছিলাম। আজ রাতের মধ্যেই ওই ব্যাটাকে বার করে দেওয়া হবে ।"

তাতাইয়ের মাথার ভিতরটা কেমন করে ওঠে।চিনির birthday party তে গিয়ে ও জানতে পেরেছে যে ওর চিনির আব্বার নাকি একটা বড় কম্পানিতে চাকরি হয়েছে। ওর বাবা এমএসসি ডিগ্রীপ্রাপ্ত। কম্পিউটার ও জানেন স্বল্প।

এত বছর ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন। কিন্তু ভাগ্য লক্ষ্মী ভর করার আনন্দেই মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করছেন। তাতাই ওর বাবাকে বলে.

" হতেও তো পারে বাবা তোমার ভুল। তাই বলে তুমি একজন গরীব মানুষ কি চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবে।"

তাতাই এর কন্ঠে প্রতিবাদের সুর মেনে প্রিয়তোষ বাবুর মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

যে ছেলে কোন দিনও উনার চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি আজ সে প্রতিবাদ করছে!

ছেলেকে মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে তাতাইকে ফলো করার জন্য লোক ঠিক করে রাখেন।

দিন সাতেক পরে তাতাইয়ের ঘরে গিয়ে তিনি বলেন

" ছেলের আমার উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। শেষ পর্যন্ত একটা মুসলিম মেয়ের পাল্লায় পড়েছে।"..

তাতাই আগেই বুঝতে পেরেছিল যে ;ওর বাবা গোপনে লোক লাগিয়ে খবর নেবেন।

তাতাই এখন আর ভীত নয়। বুকে সাহস রেখে ও বলে

" মুসলিম হয়েছে তো কি হয়েছে!! তুমি ছোট থেকে বইয়ে পড়নি !

জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আমরা সকলেই সকলের। আমাদের ভারত বর্ষ একতার দেশ।"

প্রিয়তোষ বাবু জেগে ওঠেন গর্জন করে বলেন..

" একতা না ছাই। ওই যাত্রার জন্য আজও আমাকে বয়ে বেড়াতে হয় পিরালী ব্রাহ্মণ এই শব্দটা।"..

বাবার মুখে প্রথম এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয় তাতাই। ওর বাবা কেউ জিজ্ঞাসা করে "সেটা আবার কি??"...

প্রিয়তোষ বাবু বলেন.….

আমরা এদেশ ও ব্রাম্মন।কিন্তু ওদেশের লোকেরা পিরালি বলে।পিরালী ব্রাহ্মণ বা পীরালি ব্রাহ্মণ বাংলার ব্রাহ্মণসমাজের একটি উপসম্প্রদায়। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রেই এই থাকের ব্রাহ্মণদের বাস।

ঐতিহাসিক ভাবে "পিরালী" শব্দটি অপবাদমূলক ও নিন্দাসূচক অর্থদ্যোতক। 

আমরা পূর্বপুরুষরা ছিলাম বাংলাদেশ বাসিন্দা। একদিন আমার ঠাকুরদা এক পীর বাবার আশ্রম এ গিয়ে দেখেন উনারা রোজা পালন করছেন। ঠাকুরদা মাঝেমধ্যেই ওই পীর বাবার আশ্রম এ গিয়ে গল্প গুজব করতেন। আমরা সবাই জানি রোজা রাখলে সারাদিন অভুক্ত থাকতে হয়। উনি পীর বাবাকে উনি গন্ধরাজ লেবুর গন্ধ শুঁকেতে দেখে ফেলেছিলেন। তারপরই হয় যত বিপত্তি। পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে বলে বেড়ালেন.." এই পীর বাবা রোজা পালন করেননি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মধ্যে আছে "ঘ্রাণেণ অর্ধভোজনম্"।

অর্থাৎ গন্ধ শুকলে অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। রোজার সময় লেবুর গন্ধ শুঁকে রোজা নষ্ট করে ফেলেছেন।"

জনসমক্ষে এমন কথা প্রচার হয়ে যাওয়ায় পীর বাবা বেশ অপমানিত হন। মনে মনে প্রতিশোধ নেবার জন্য তৈরি হন।

একদিন মাংস রান্না করে ঠাকুরদা কে ডেকে পাঠান। ঠাকুরদা বাড়ি গিয়ে দেখেন সেখানে মাংস রান্না হচ্ছে। সাথে সাথে উনি হাত চাপা দেন নাকে। কিন্তু পীর বাবা সবাইকে ডেকে ডেকে বলে বেড়ান.." এই মুখার্জি ব্রাহ্মণের সব ধর্ম গেলরে গেল!!আরে উনি গন্ধ শুঁকে নিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে তো গন্ধ শুকলে অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়।"

সেই দিনের পর থেকে বাংলাদেশে হিন্দু সমাজ আমাদের পিরালী ব্রাহ্মণ বলেই ডাকতো। আমার বাবা এদেশে এই কারণেই চলে এসেছিলেন।"... তাতাই হো হো করে হেসে ওঠে। ও বলে." গন্ধ শুঁকেই তোমরা একে অপরের মধ্যে বিবাদ তৈরি করে ফেললে। কিন্তু বাবা এখন যুগ বদলেছে। যদি এমনি হয় তাহলে আমার জাত তো কবেই নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ সেই ছোটবেলা থেকেই চিনির মায়ের হাতে রান্না করা টিফিন খেয়ে , আমি ব্রাহ্মণ থেকে বিধর্মী হয়ে গেছি!! তাইনা।".

ছেলের কথায় তারস্বরে চিৎকার করে ওঠেন প্রিয়তোষ বাবু। তাতাই বলে..." নিজেদের কে যুগের সাথে পরিবর্তন করতে হবে। আমরা শিক্ষিত হয়েও যদি মূর্খের মতো কথা বলি তাহলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনদিনই বন্ধ হবে না। কিন্তু পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখলে কোন শত্রু পারবে না;আমাদের বন্ধুত্বের ছেদ ঘটাতে।"...

সেই দিনের পর থেকে প্রিয়তোষ বাবু কেমন যেন বদলে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার মিথ্যে স্ট্যাটাসের চাপে পড়ে স্ত্রী অনুপমা এবং ছেলে তাতাই সকলেই কষ্ট পাচ্ছে । কি হবে এই স্ট্যাটাস দিয়ে!! যদি মনুষ্যত্বই না থাকে !আর যেখানে মনুষ্যত্ব নেই সেখানে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ার কথা ভাবাই যায় না ।

নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনা টা ভীষণ জরুরী।

এরপর..

কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তাতাইয়ের আজ বিয়ে। পাত্রী ফিরোজা খান।মানে তাতাইয়ের ছোটবেলার বান্ধবী চিনি। প্রিয়তোষ বাবু নিজে চিনির বাড়ি গিয়ে ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে সবাই। বাংলাদেশ থেকেও প্রিয়তোষ বাবুর অনেক আত্মীয়রা এসেছেন। সকলে মিলে বলাবলি করছেন...

" হিন্দু হয়ে মুসলিম মেয়েকে ঘরে আনছে।"

তাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে প্রিয়তোষ বাবু বলেন

" আমরা সবাই এক,ঐক্যবদ্ধ। তাছাড়াও তাতাইয়ের মা একজন খ্রিস্টান এর মেয়ে। আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সেটা আমার মা বাবা সাদরে মেনে নিয়েছিলেন ।তাতাই যদি একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েকে ভালোবাসে; বাবা হয়ে আমার ও

উচিত সেটা মেনে নেওয়া।


ভবিষ্যতে এটাই হবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার...."....

(মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational