Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

দ্রৌপদী

দ্রৌপদী

12 mins
417


মহাভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা চরিত্র। পুরোপুরি রহস্যময়, জীবন থেকে মরণ অব্দি তিনি আগুনের মতোই তিনি জ্বলন্ত।

নিঃসন্দেহে দ্রৌপদী যে নিজের কর্তব্য সচেতন, নিজের সম্বন্ধে সচেতন এক স্বাভিমানি মহিলা। প্রয়োজনে তিনি নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলার ক্ষমতাও রাখেন। অন্যায়কে যে কোন পরিস্থিতি তে অন্যায় বলার ক্ষমতাও রাখেন। আবার তিনি নিজের সমস্ত কাজ নিষ্ঠা ভরে করে গেছেন বনবাসকালে। স্বামীদের সঙ্গ করেননি ত্যাগ। রান্না করেছেন ঘর সামলেছেন জঙ্গলের মধ্যে থেকে রাজসুখের হাতছানি ত্যাগ করে। 

আদর্শ কর্তব্য পরায়ন গৃহকর্ম নিপুনা সাথে নিজের অধিকার সচেতনতার মেলবন্ধনে এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী তিনি। 

তবে এটাও ঠিক "সুতপুত্র" বলে কর্ণকে অভিহিত করা, দুর্যোধনকে "অন্ধের পুত্র অন্ধ" অভিহিত করা কিংবা পুত্রসম ঘটৎকচকে তুচ্ছ করা ইত্যাদি তার মত এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে ঠিক মেল খায় না যেন... 


এই সব কথাগুলোই কিন্তু তার নিজের বংশের নাশের সাথে তার নিজের যাবতীয় দুর্ভোগের কারনও হয়েছিল।

"জিভ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা" আর "ধনুক থেকে ছিটকে যাওয়া তীর" কাকে কিভাবে আঘাত করবে কে বলতে পারে... তাই বলার আগে ভাবা উচিৎ আর করার আগেও তাই। 

কোন কর্ম কিভাবে ফিরে আসবে কে বলতে পারে... 


ওনার পিতা রাজা দ্রূপদ, দুই ভাই বোন দ্রৌপদ আর শিখন্ডী। এছাড়াও রয়েছে আরো 4 ভাই। পাঁচ ভাই আর বোন শিখন্ডী ওনার অগ্রজ।

পিতার নামে পরিচিত হন দ্রৌপদী নামে।

অন্যান্য জনপ্রিয় নাম-

যজ্ঞ থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন তাই নাম যাজ্ঞসেনী 

গায়ের রঙ কালো তাই নাম কৃষ্ণা 

পাঞ্চাল প্রদেশের রাজকুমারী তাই নাম পাঞ্চালী। 


পূর্বকথন:


কাহিনীর শুরু হচ্ছে যখন দ্রূপদ ছিলেন রাজকুমার, শিক্ষার্থী ছিলেন আশ্রমে। সাথী ছিলেন দ্রোনাচার্য্য। দুই জনই ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। বন্ধুত্ব দিন দিন বাড়ে। আশ্রম শিক্ষার শেষের দিনে বন্ধুকে কথা দেন, দ্রূপদ রাজা হলে বন্ধুকে দেবেন অর্ধেক রাজত্ব। 


বেশকিছু দিন পরে রাজা হন দ্রূপদ। এদিকে দ্রোনাচার্য্য খুব গরীব। দ্রূপদ রাজা হতে অনেক আশা নিয়ে যান দ্রোনাচার্য্য দ্রূপদের কাছে। কিন্তু ততদিনে রাজা হয়ে দ্রূপদ অনেক বদলে গেছেন, প্রথমে দ্রোনাচার্য্যকে সেরকম সম্মান দেখান নি। দ্রোনাচার্য্য তখন বন্ধুর দেওয়া কথা মনে করান। দ্রূপদ শুনে খুব রুষ্ট ভাবে অপমান করেন। বন্ধুত্বের সম্মানটুকু রাখেন না। দ্রোনাচার্য্যকে একরকম তাড়িয়ে দেওয়া হয় রাজসভা থেকে। 


বিতাড়িত দ্রোনাচার্য্য মনে মনে শপথ করেন এই অপমানের প্রতিশোধ নেবেন, অর্ধেক রাজত্ব তিনি নিয়েই ছাড়বেন। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি হস্তিনাপুরের সেরা অস্ত্রশিক্ষাবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার ভার নেন। 

তবে নিজের কাজে কোন খামতি রাখেন না। ভীমকে সেরা করে তোলেন গদাযুদ্ধ শিক্ষা দিয়ে, অর্জুনকে সেরা ধনুর্ধর করে তোলেন। যুধিষ্ঠির ছিলেন বল্লম তরোয়াল চালনায় পারদর্শী। নকুল সহদেব ও ছিলেন বড় তরোয়াল বীর। 

শিক্ষা শেষে গুরুদক্ষিণা হিসেবে পাণ্ডবদের বলেন রাজা দ্রূপদকে বন্দি করে আনতে। 


পঞ্চপান্ডবের সামনে রাজা দ্রূপদের বাহিনী খড়কুটোর মত উড়ে যায়। বন্দি হন রাজা দ্রূপদ। 

দ্রোনাচার্য্য'র সামনে এনে উপস্থিত করা হয় বন্দি দ্রূপদকে। বন্দী দ্রূপদকে সেই অপমানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন দ্রোনাচার্য্য। 

তারপর নিজে নিয়ে নেন দ্রূপদের অর্ধেক রাজত্ব আর বাকিটা ফিরিয়ে দেন দ্রূপদকে। 


দ্রৌপদীর জন্ম:


অপমানিত দ্রূপদ কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন না। তিনি ফিরে গিয়ে রাজ্যের জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠান আর তাদের মত অনুযায়ী করেন অগ্নিকে সাক্ষী রেখে পুত্রেষ্টি-যজ্ঞ। 

বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বেরিলি নামক স্থানে আয়োজিত হয়েছিল সেই বিশাল যজ্ঞের। যজ্ঞ পরিচালনা করেন দুই মহাঋষি যজ আর উপযজ। এই দুই মহাঋষি ছিলেন দুই ভাই।

কিছুক্ষনের মধ্যেই আগুন থেকে উঠে আসেন ধৃষ্ট্যাদুমন্য। আগুনের মতোই তার রূপ ছিল আর জন্ম থেকেই তিনি চিরযুবক। হাতে তার অগ্নি প্রদত্ত ধনুক আর খড়্গ। 

খুব আনন্দিত হন দ্রূপদ। তার অপমানের বদলা নেবার স্বপ্ন তার হাতের মুঠোয় চলে আসতে দেখে। 

এরপরে কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে আসেন আগুন থেকে আরেক চিরযৌবনা দ্রৌপদী। 

কিন্তু রাজা দ্রূপদ এতটুকু খুশি হন না দ্রৌপদীকে দেখে, তিনি কন্যা চান নি তাই দ্রৌপদীকে গ্রহনও করতে চান নি। 

তখন অগ্নিদেব বলেন- এই কন্যা তোমার কাজে সহযোগিতা করবে। শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর নাম অমর হয়ে থাকবে। পূজিত হবেন ইনি বহু বহু বছর ধরে আর সর্বোপরি একটা সময় আসবে তুমি পরিচিত হবে এই কন্যার পিতৃদেব হিসেবে। 


তখন হৃষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন দ্রূপদ রাজা দ্রৌপদীকে। 

আগুন থেকে বেরিয়ে এলেন অগ্নিরূপা কৃষ্ণবর্ণা কিন্তু অপূর্ব রূপসী চিরযুবতী। তার রূপের ছটায় সমস্ত সমসাময়িক সুন্দরীরা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন।

রাজা দ্রূপদ এরপরে অবশ্য দ্রৌপদীর খুব যত্ন নিয়েছিলেন, কন্যাকে সমসাময়িক সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছিলেন। তবে অবশ্য দ্রৌপদীর মধ্যেও ছিল সমস্ত বিদ্যা আয়ত্ত্ব করার সহজাত শক্তি। 


দ্রৌপদীর বিবাহ:


রাজা দ্রূপদ কন্যার বিবাহের জন্য আয়োজন করেন এক স্বয়ম্বর সভা। সেখানে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হবে স্বয়ম্বর ক্রিয়া। উপরে থাকবে ঘুরন্ত একটি চক্র। সেই চক্রে লাগানো থাকবে একটি মাছ। আর নীচে থাকবে জল। সেই জলে প্রতিবিম্ব দেখে তাক করে তীর লাগাতে হবে মাছের চোখে।

বেশ জটিল প্রক্রিয়া। সমস্ত মহারথী সেখানে হাজির। হাজির কর্ণ দুর্যোধন হাজির অর্জুন সেখানে তবে তারা তখন বনবাসে তাই অর্জুন নিয়েছেন এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ।

শ্রীকৃষ্ণ খবর দেন পাণ্ডবদের এই স্বয়ম্বর এর ব্যাপারে। এবং অর্জুন কে বলেন অনুশীলন করতে। তখন অর্জুন বলেন- আপনি ভগবান আপনি থাকতে আমার চিন্তা কি? তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেন- তোমার কর্ম তোমাকেই করতে হবে যা তুমি পারবে সেটুকু তোমার কাজ। বাকী আমার উপর ছেড়ে দাও। শুনে বলেন অর্জুন- সবই যদি করি আমি তাহলে করবেন আপনি আর কি? শুনে শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে বলেন- তুমি যা পারবে না তা করব আমি অর্থাৎ তোমার কাজ মাছের চোখে তীর লাগানো আর আমি সহায়তা করব যাতে নীচে জলে তরঙ্গ না খেলে, জল স্থির থাকে। 

শুনে অর্জুন চুপচাপ চলে যান তীরন্দাজি অনুশীলনে। 


স্বয়ম্বর সভায়:


মহাবীর কর্ণ যখন লক্ষ্যভেদ করার জন্য উঠেন তখন দ্রৌপদী বলেন তিনি সুত পুত্র কে করবেন না বিবাহ। শুনে কর্ণর মনে জ্বলে উঠে প্রতিহিংসার আগুন। 

সেই মুহুর্তে অপমানিত কর্ণ ফিরে যেতে চাইলে দুর্যোধন কর্ণের সাথে আলাপ করেন আর অঙ্গ দেশের রাজা করে দেন। রাজা কর্ণকে তখন আবার তীরন্দাজি করার জন্য পাঠানোর কথা বললে দ্রৌপদী আবার বলেন- জন্ম পরিচয়হীন কাউকে বিয়ে করবেন না তিনি। 

এরপর দ্রৌপদীর সেই কথাগুলো প্রতিশোধের আগুন হয়ে চির জ্বলন্ত হয়ে রয়ে যায় কর্ণের মনে। চিরকালের মত দ্রৌপদীর বিপক্ষে করে নেন নিজেকে। 

এই অপমানের মুহুর্তে দুর্যোধন তার জ্বালা প্রশমিত করার চেষ্টা যেটুকু করেন সেটুকু সৌহার্দ্য কর্ণ আর দুর্যোধনের মধ্যে এক চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব তৈরি করেছিল যা পরে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে এক সমীকরণ তৈরি করেছিল। 


এরপরে অনেক রথী মহারথী চেষ্টা করে বিফল হলে পরে শেষে আসেন সন্ন্যাসী বেশী অর্জুন। তিনি সফলভাবে তীর নিক্ষেপ করে দ্রৌপদীকে জিতে নেন। 


দ্রৌপদীকে নিয়ে ওনারা নিজেদের কুটিরে ফিরে গেলে সেখানে মাতা কুন্তীকে বলেন- দেখ মা তোমার জন্য কি এনেছি। ব্যস্ত কুন্তীদেবী খেয়াল না করেই বলেন- যা এনেছ পাঁচজন ভাগ করে নাও। 

মায়ের কথা রাখার জন্য এরপরে দ্রৌপদীর বিবাহ হয় পাঁচ ভাইয়ের সাথে।

ভুল হয়ে গেছে দেখে কুন্তীদেবী আশীর্বাদ দেন 

দ্রৌপদী থাকবেন চির কুমারী অর্থাৎ প্রতিবার স্বামীসঙ্গ শেষে তার সতীপর্দা আবার জুড়ে যাবে।

এরপরে পাঁচ ভাইয়ের ঔরসে পঞ্চ সন্তানের জন্ম দেন দ্রৌপদী। তারা হলেন প্রতিবিন্ধ্য শতনিকা সুতসোম শ্রুতকর্ম শ্রুতসেনা। এনারা উপপাণ্ডব নামে ছিলেন পরিচিত। 


দ্রৌপদীর রাজকার্য্য:


এরপরে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের ফিরিয়ে নিয়ে আসেন হস্তিনাপুরে। হস্তিনাপুর আর খান্ডব প্রস্থে। জঙ্গলে ভরা খান্ডব বন দহন করে সেখানে ময়দানবের সহায়তায় বানানো হয় ইন্দ্রপ্রস্থ। ইন্দ্রপ্রস্থ ছিল দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভার মতোই এক স্বর্গীয় জায়গা। সেখানে মায়ার দ্বারা তৈরি হয় বিভিন্ন কক্ষ। 

এর পরে ইন্দ্রপ্রস্থ সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তার লাভ করে। 

আর এই রাজকার্য্য পরিচালনা করতে সহায়তা করতেন দ্রৌপদী। তিনি ছিলেন রাজকোষের হিসেব রক্ষক। 


দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ:


এরপরে রাজসূয় যজ্ঞ করেন যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সাথে।

সেই অনুযায়ী কৌরবপক্ষকে নিমন্ত্রণ দেওয়া হলে তারা আসেন ইন্দ্রপ্রস্থ। সেই মায়া মহল ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন কারুকাজ দেখে তাক লেগে যায় দুর্যোধনের। শেষে এক মায়া কক্ষের ভেতরে এক মায়া মেঝের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে বুঝতে না পেরে পড়ে যান জলের মধ্যে দুর্যোধন। আসলে সেটি ছিল সুইমিং পুল। 

সেখানে উপস্থিত ছিলেন দ্রৌপদী। দুর্যোধনের দুরবস্থা দেখে তিনি খুব হাসাহাসি করেন সাথে ছিল দাসীরাও। আর ছিলেন যুধিষ্ঠির বাদ দিয়ে বাকি পাণ্ডব ভাইয়েরা। দ্রৌপদী বলেন- অন্ধের পুত্র অন্ধ। ভীম সেই কথায় সহমত প্রকাশ করে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করলে দুর্যোধনের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে।

লজ্জিত অপমানিত দুর্যোধন সেই মুহুর্তে ইন্দ্রপ্রস্থ ত্যাগ করে ফিরে আসেন হস্তিনাপুর। 


ভুলতে পারেন না সেই অপমানের কথা। ভুলতে পারেন না দ্রৌপদী আর ভীমের সেই উপহাস। তির্যক মন্তব্য গুলি তার কানে অনুরণন তুলতে থাকে। প্রতিদিন তিনি সেই অপমানের বোঝা বইতে থাকেন। 

অপমানের সেই জ্বালায় মলম লাগাবার জন্য আসেন মামা শকুনি তার দুষ্টবুদ্ধি নিয়ে। মামা শকুনির সহায়তায় একটি ষড়যন্ত্র করা হয়। পাণ্ডবদের ডাক দেওয়া হয় পাশা খেলার জন্য। যুধিষ্ঠির ছিলেন পাশা খেলায় উৎসাহী । সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে শকুনি বানান এক অদ্ভুত পাশা। পাশাটি বানানো হয়েছিল শকুনির পিতার শরীরের হাড় দিয়ে। সেই পাশার দানের মধ্যে লুকোনো হয় একটি টিকটিকি। যখনই পাশার দান ফেলা হবে সেই টিকটিকি সোজা হয়ে পাশা দান দেবে পাল্টে। 

বলাবাহুল্য পান্ডবেরা সেই পাশা খেলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।

নির্দিষ্ট দিনে পাশা খেলা শুরু হয় ভরা রাজসভার মাঝে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন ভীষ্ম বিদুর দ্রোনাচার্য্য ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখ ব্যাক্তি গন। খেলা শুরু হলে একে একে সব হারাতে থাকেন যুধিষ্ঠির। নিজের রাজত্ব নিজের সবকিছু এমনকি নিজের ভাইদের হারানোর পরে নিজেকে হারান। হারাতে থাকেন পর পর সবকিছুই। সব হেরে বাজি রাখেন দ্রৌপদীকে। আবার হারেন।

এরপরে পাণ্ডবদল পরিণত হয় কৌরবদের দাসে। সেই দাসদের রাজসভায় মাথা নত করে বসে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। হেরে যাওয়া পাণ্ডবদল তাই করে। 


এরপরে ডাক পাঠানো হয় দ্রৌপদীকে।

দ্রৌপদী তখন নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি তখন ছিলেন রজস্বলা।  

তিনি পাশা খেলায় হেরে এখন দুর্যোধনের দাসীতে পরিণত হয়েছেন শুনে খবর পাঠান যে তিনি রানী তাকে কি করে যুধিষ্ঠির বাজী ধরতে পারেন যখন তিনি নিজে হেরে আগেই দাসে পরিণত হয়েছেন। 

দুতের কথা শুনেও দুর্যোধন আবার ডেকে পাঠান দ্রৌপদীকে। আসতে অরাজি হলে দ্রৌপদী, এবারে দুর্যোধন পাঠান দুঃশাসনকে। দুঃশাসন গিয়ে বিশ্রামরত দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসেন রাজসভায়।

সেই দৃশ্য দেখে ভীম আর স্থির থাকতে পারেন না বলেন- দুঃশাসনের দুই হাত তিনি উপড়ে ফেলবেন। 

শুনে অবজ্ঞা করেন দুর্যোধন। বলেন দাসের মুখে এসব কথা পায় না শোভা। এরপরে আদেশ দেন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করার। দুঃশাসন দ্রৌপদীর দিকে এগুলে দ্রৌপদী ছুটে যান ভীষ্মর কাছে। তিনি পিতামহ। তাকে বলেন এটা অন্যায় কখনো কোন মহিলাকে বাজী রাখতে পারেন না কেউ। শাস্ত্র অসম্মত এটা। 

কিন্তু ভীষ্ম বলেন তিনি পিতামহ হলেও তিনি দুর্যোধনের সেবক মাত্র। তাই তিনি দুর্যোধনকে আদেশ দিতে পারেন না। 

শুনে কর্ণ তার পুরনো  অপমানের খোঁচা দিতে ভুলেন না। বলেন- যখন যুধিষ্ঠির সব হেরেছেন আর নিজেকে হেরেছেন তখন তিনি সব কিছুর সাথে তখনই হেরেছেন দ্রৌপদীকেও।

দ্রোনাচার্য্য ধৃতরাষ্ট্র ইত্যাদি সবার কাছে ছুটে যান দ্রৌপদী, কিন্তু সবাই চুপ থাকেন। তাদের চুপ থাকা মানে তাদের সম্মতি মনে করেন দুর্যোধন।

বিকর্ণ আর যুযুৎসু দুই কৌরব ভাই বারবার প্রশ্ন তোলেন রাজ্যের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে- যে দ্রৌপদীর কথায় যুক্তি রয়েছে। দ্রৌপদী নন দাসী। 

কিন্তু তাদের কথা কেউ কানে তোলে না। 


এরপরে দুর্যোধনের পুনরায় আদেশে দুঃশাসন দ্রৌপদীর শাড়ি ধরে টান দেন। দুর্যোধন সব দেখতে দেখতে ভরা রাজসভায় নিজের ঊরুর কাপড় সরিয়ে দ্রৌপদীকে বলেন- বাঁচতে হলে আমার জঙ্ঘায় কর উপবেশন। 

ভীম তখন আবার প্রতিজ্ঞা করেন তিনি ভঙ্গ করবেন দুর্যোধনের জঙ্ঘা।

অনন্যোপায় হয়ে দ্রৌপদী তখন সাহায্য চান তার বন্ধু শ্রীকৃষ্ণর। শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় দ্রৌপদীর বস্ত্র আর শেষ হয় না, কমও পড়ে না। দেখতে দেখতে দ্রৌপদীর শাড়ি সেখানে ছোটখাটো পাহাড়ের মত চেহারা ধারণ করে। দুঃশাসন ঘেমে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে যান। 

তখন এই দৃশ্য দেখে আবার শপথ করেন ভীম- দুঃশাসনের বুক চিরে করবেন রক্তপান।

দ্রৌপদী তখন বলেন- তার চুল ধরে টেনে এনেছেন দুঃশাসন। দুঃশাসনের বুকের রক্ত চুলে লাগিয়ে তিনি বাঁধবেন চুল। ততদিন অব্দি তার এই চুল থাকবে খোলা। 


এরপরে কর্ণ বলেন দুঃশাসনকে দাসদের ঘরে নিয়ে যেতে দ্রৌপদীকে। সেখানে দ্রৌপদীর সাথে কোন এক দাসের বিবাহ দেওয়া হবে এই পঞ্চপাণ্ডব ব্যতিরেকে। 


তখন বিদুর রুষ্ট হন দুর্যোধন আর কর্ণর উপরে। এই দুইজনকে বলেন রাক্ষস আর সাপ। এদের দুইজনের জন্য আজ হস্তিনাপুরের রাজসভায় কুলবধুর সম্মানহানি হল। এই অন্যায় পুরো সাম্রাজ্যের পতন ডাকবে অচিরেই।

ঠিক সেই মুহুর্তে রাজ্যের সমস্ত শেয়ালের কান্না শুরু হল একযোগে। অমঙ্গলের সেই ডাক ভরিয়ে দিল সারা পরিবেশ। 


রাজমাতা গান্ধারী এদিকে সমস্ত কিছু শুনে প্রবেশ করলেন রাজসভায়। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি দায়ী করেন এইসব অনাচারের জন্য। তিনি বলেন তোমার এই অন্যায়ে মদত দেওয়া তোমার সন্তানদের দুর্ভোগের কারন হবে। 

পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র তখন দ্রৌপদীর ক্ষোভ প্রশমনের জন্য তাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। তখন দ্রৌপদী চান পঞ্চপান্ডবের দাসত্ব মুক্তি।

দ্বিতীয়বার বর প্রার্থনা করার কথায় দ্রৌপদী বলেন- পঞ্চপাণ্ডব যেন মুক্তি পান তাদের অস্ত্র সস্ত্র সমেত। 

তৃতীয়বার বর প্রার্থনার কথা বললে দ্রৌপদী বলেন- ক্ষত্রিয় স্ত্রী দুটি বরই প্রার্থনা করে কারন তৃতীয় বর নেওয়া লোভের লক্ষণ। আর যদি ধৃতরাষ্ট্র বলেন দ্রৌপদীর নিজের মুক্তির কথা তাহলে দ্রৌপদী কোন সম্পদ নয় যে কেউ তাকে বাজী রাখতে পারেন। অন্যায় পাশা খেলায় হয়েছে তার সাথে অন্যায়। 

দ্রৌপদীর সেই দীপ্ত ঘোষণা সেইদিনই হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত দিয়েই দিয়েছিল। 


এরপরে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হলে তারা চলে যান ইন্দ্রপ্রস্থ। 


এর কিছুদিন পরে আবার একটি পাশা খেলার আয়োজন করা হয়। সেই পাশা খেলায় হেরে গিয়ে পঞ্চ পাণ্ডব আর দ্রৌপদীকে যেতে হয় ১২ বছর বনবাসের শেষে এক বছর অজ্ঞাতবাসে। এই অজ্ঞাতবাসে যদি কেউ তাদের চিনতে পারে তাহলে পুনরায় পাণ্ডবদের 12 বছর বনবাস শেষে এক বছর অজ্ঞাতবাসে যেতে হবে, এই ছিল শর্ত। 


দ্রৌপদীর বনবাস:

বনবাস কালে দ্রৌপদী যখন একলা ছিলেন আশ্রমে। তখন সেখানে জয়দ্রথ আসেন আর হরণ করেন দ্রৌপদী কে। শিকার শেষে ফিরে আসেন পাণ্ডব দল। তারা ধরে ফেলেন জয়দ্রথকে। দ্রৌপদী অবশ্য মুক্তি দেন জয়দ্রথকে কারন কৌরবকুলের একমাত্র বোন দুঃশলার স্বামী ছিলেন জয়দ্রথ। 


বনবাসকালে বিভিন্ন সময়ে তিনি সাধু সন্তদের রান্না করে খাইয়েছেন বিভিন্ন সুস্বাদু রান্না।

এমনকি তার হাতের স্বাদু রান্নার স্বাদ নেবার জন্য মাঝে মাঝেই আসতেন শ্রীকৃষ্ণ তখন তিনি দেখাও করে যেতেন পাণ্ডব ভাইদের সাথে। 

সূর্য্যদেব খুশি হয়ে দান করেছিলেন আশ্চর্য্য পাত্র। এই পাত্রের রান্না কখনো শেষ হত না। অর্থাৎ রান্না শেষে এই পাত্র থেকে যত খুশি খাবার পরিবেশন করা হোক না কেন, শেষে থাকবে দ্রৌপদীর নিজের খাবার মত খাদ্য। সূর্যদেবের দেওয়া সেই পাত্রে রান্না করা খাবারের স্বাদ ছিল অসাধারণ। 

সেই আশ্চর্য রান্নার পাত্রটি ছিল দ্রৌপদীর ভরসা। কারন বনবাসকালে সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পাওয়া যাবে এরকম কিছু ঠিক থাকতো না।

একদিন সবার খাবার শেষে খেয়ে নিয়েছেন দ্রৌপদী নিজেও। বিশ্রাম নিচ্ছেন এমন সময় হাজির রগচটা মুনি দুর্বাসা তার বহু শিষ্য নিয়ে। এসে তারা দ্রৌপদীকে বলেন স্নান সেরে এসে তারা খাবেন, খুবই ক্ষুধার্ত তারা। এদিকে কিছু নেই বেঁচে খাবার আর। দ্রৌপদী নিজেও খেয়ে নিয়েছেন। এখন উপায় কি। ডাক পড়ল শ্রীকৃষ্ণর। উপস্থিত তিনি। সমস্ত কিছু শুনে বলেন- যাও খাবার পাত্রটা নিয়ে এস। পাত্রে তখনও লেগে রয়েছে এক দানা অন্ন।

সেই অন্ন মুখে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ প্রার্থনা করেন- আমার এই অন্ন গ্রহণের সাথে সাথে আজকের দিনের জন্য সমস্ত জীব জগতের ক্ষিদে হোক প্রশমিত। 

সেই মুহুর্তে জগৎ তার ক্ষিদে গেল ভুলে। দুর্বাসা মুনি ও যার শিষ্য দল ভরপেট অনুভব করতে লাগলেন। ভরপেটের ঢেঁকুর তুলতে তুলতে তারা ফিরে গেলেন যে যার গন্তব্যে। 

দ্রৌপদীর ভালোবাসা

বনবাসকালে একবার যখন তিনি যুধিষ্ঠিরের সাথে অন্দর মহলে তখন সেখানে উপস্থিত হন অর্জুন তার অস্ত্র নেবার জন্য। 

কথা ছিল যখন কোন ভাই দ্রৌপদীর সাথে থাকবেন তার জুতোজোড়া থাকবে ঘরের বাইরে। সেই জুতো জোড়া থাকলে পরে কেউ ঢুকবে না সেই ঘরে। 

কিন্তু কুকুরের দল সেই জুতো জোড়া চুরি করলে অর্জুন কোন জুতো না দেখতে পেয়ে প্রবেশ করেন সেই ঘরে। 

দ্রৌপদী তারপর কুকুরদের দেন অভিশাপ- 

কুকুরেরা এরপরে যৌনকর্ম করবে মাঝ রাস্তায় আর সবার উপহাসের পাত্র হবে তারা। 

সেই অভিশাপ কতটা ফলপ্রসূ তা আজো আমরা দেখতে পাই। 


বনবাসকাল শেষ হলে অজ্ঞাতবাসের সময়ে মৎস্য রাজ্যের বিরাট রানীর খাস চাকরানী হিসেবে দ্রৌপদী করেন কাজ এক বছর। সেই বিরাট রাজার সভায় পাচক হিসেবে থাকেন ভীম। একদিন রানীর ভাই কীচক দ্রৌপদীকে একলা পেয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে দ্রৌপদী চলে যান রাজসভায়। সেখানে কীচক সবার সামনে দ্রৌপদীকে মারেন লাথি। এরপরে বিরাট রাজা কীচককে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে আদেশ দেন।

কীচক কয়েকদিন থেকে যাবার অনুমতি চাইলে সেই অনুমতি পান, তবে দ্রৌপদীর সাথে আর কোন অন্যায় যেন না হয় সেই ব্যাপারে সতর্কতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। 

এরপরে দ্রৌপদী আর ভীম একটি পরিকল্পনা করেন কীচক বধের। সেই অনুযায়ী দ্রৌপদী ডাকেন কীচককে নাট মহলে সেইদিন রাত্রে। সেখানে দ্রৌপদীর বেশে উপস্থিত ছিলেন ভীম। রাত্রে কিচক সেখানে পৌঁছলে বধ হন ভীমের হাতে। 


কুরুক্ষেত্রে:

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের 16 তম দিনে ভীমের হাতে বধ হন দুঃশাসন। তার দুই হাত উপড়িয়ে বুক চিরে ফেলেন ভীম। বুকের রক্ত পান করে পূরণ করেন তার প্রতিজ্ঞা। দুই হাত নিয়ে গিয়ে দেন দ্রৌপদীকে। বুকের রক্ত দিয়ে চুল বাঁধেন দ্রৌপদী। পূরণ করেন তার প্রতিজ্ঞা। 


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অষ্টদশ দিনে, অশ্বত্থামার হাতে ঘুমন্ত দ্রৌপদী সন্তানদের মৃত্যু হয়। 

বলা হয় যে দ্রৌপদী পছন্দ করতেন না ঘটৎকচকে যেহেতু তার মা ছিলেন রাক্ষসী হিড়িম্বা। ঘটৎকচকে সেই নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাতে হিড়িম্বাও অভিশাপ দেন আমার সন্তানের অমঙ্গল যেভাবে কামনা করলে ঠিক সেরূপ অমঙ্গলই কামনা করলাম তোমার সন্তানের জন্যেও। 

ফলাফলে সেই অমঙ্গলের দৃষ্টি পুরো পাণ্ডববংশ কেই পুড়িয়ে দেয়। কেউ বাঁচে না। যুদ্ধ শেষে বাঁচে শুধু অভিমন্যুর সন্তান পরীক্ষিত যদিও তখনও তিনি মাতৃ গর্ভে। 


স্বর্গযাত্রা:

শেষের দিনে যখন পাণ্ডবদল যাত্রা করেন স্বর্গের দিকে। পথে সবার আগে মারা পড়েন দ্রৌপদী। কারন জিজ্ঞেস করলে বলেন যুধিষ্ঠির- ভীম সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন দ্রৌপদীকে সবচেয়ে বেশি সেই দাঁড়িয়েছে দ্রৌপদীর পক্ষে। কিন্তু ভীম নয়, অর্জুনের প্রতি ছিল দ্রৌপদীর ভালোবাসা বেশি। এই পাপে সবার আগে পতন হল দ্রৌপদীর। 


পরে অবশ্য যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে গিয়ে দেখেন সেখানে রয়েছেন দ্রৌপদী শ্রীমহাকালী রূপে। 


বলা হয় দ্রৌপদী নিজে ছিলেন ইন্দ্রানী শচীর অবতার মতান্তরে শ্রীমহাকালীর অবতার। কলি যুগ আসার আগে তিনি দেখিয়ে দিতে এসেছিলেন তার মায়ার প্রভাব। শিক্ষা দিতে এসেছিলেন মানবকুলকে। মহিলাদের সম্মান করতে। মহিলার চুল বা বস্ত্র আকর্ষণ মহা ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মৃত্যু ডেকে আনবে আর সবংশে ধ্বংস করে দেবে সবাইকে, যারা এসব দেখেও থাকবে নিশ্চুপ। 

পাশাপাশি দ্রৌপদীর আশীর্বাদে অর্জুন উলুপির পুত্র ইরাবন পেয়েছেন নবজীবন।

আজও অন্ধ্রপ্রদেশ অঞ্চলে 400 এর উপরে মন্দির রয়েছে যেখানে পুজো হয় দ্রৌপদীর। 

রয়েছে 32 টি মন্দির যেখানে পুজো হয় ইরাবনের, সেই মন্দিরগুলিতেও পুজো হয় দ্রৌপদীর।

জৈনদের মধ্যেও দ্রৌপদীর পুজোর রীতি রয়েছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational