দৌড়
দৌড়


সেদিন ছিল দোলপূর্ণিমা। বাড়ি থেকে নায়িকা অনেক দূরে, হোস্টেলে। দোলে মোটে একদিনই ছুটি, বাড়ি যাতায়াতের জন্য যথেষ্ট নয়। অগত্যা, হোস্টেলেই ছুটি কাবার।
.
নায়িকা খুবই অন্তর্মুখী। বন্ধুবান্ধব হাতেগোনা। আর বেশিরভাগ সময় পড়াশুনায় কাটে বলে আড্ডার অভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। ফাঁকা সময়গুলো ছবি এঁকে, নিজের মনে গান গেয়ে, বই পড়ে, ল্যাপটপ এ সিনেমা দেখে বেশ চলে যায় নায়িকার। আর ইদানীং একটা নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সে - দৌড়ানো। হোস্টেল এর উল্টোদিকেই বড় মাঠ, তরতাজা সবুজ ঘাসের মখমল বিছানো। সকালে ল্যাবে যাওয়ার আগে আর সন্ধ্যায় ফিরার পর নায়িকা নিয়ম করে পাঁচ পাক দৌড়ায়। কষ্ট হয়, ঘাম ঝরে, শ্বাস ফুলে উঠে। আর দৌড় শেষে যখন ক্লান্ত পায়ে আস্তে আস্তে ফিরে আসে, মনে হয় কিছু একটা করল। গবেষণার ছাত্রী সে, সবদিন কাজে সমান সাফল্য আসেনা। হতাশ হওয়ার দিন গুলোয় দৌড়ানোটাই যেন একমাত্র সার্থকতা। একলা জীবনে ওটাই এখন রোজকার উৎসাহ।
যখন সে দৌড়ায়, প্রতিটা পা ফেলার সাথে, প্রতিটা প্রশ্বাস নেওয়ার সাথে নায়িকার মনে মনে আত্মবিশ্বাস বাড়ে একটু একটু করে। এড্রেনালিনের রেশ তাকে আস্তে আস্তে করে তোলে হঠাৎ রাজা! যখন মনে হয় আর সে পারবে না, এবার দম শেষ, পা টনটন করছে, তখন মাটির দিকে তাকিয়ে জোর করে মনে করে আর একটা পা, আর দু পা, আর দশ গুনব সেই অব্দি, ওই সামনের দাগটা অব্দি - এই করে করে রোজ সে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে যে করেই হোক পাঁচ পাক শেষ করে। মাঠে আরো অনেকে আসে দৌড়াতে। নায়িকা মনে মনে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, চেষ্টা করে একে একে তাদের পেরিয়ে যেতে। যখন সত্যিই কাউকে পেরিয়ে যায় গতিতে, তখন নিজেকে বাহবা দেয় বেশ। তার বড়োই আনন্দ হয়- নাহ, দিনে দিনে বেশ ভালোই দৌড়াচ্ছি!
.
দোলের দিনটা বড়োই একা। আশেপাশের রুমগুলো ফাঁকা, কাছে বাড়ি সবার, তাই। বন্ধুদের কেউ রং খেলছে না। জানলা দিয়ে খানিকক্ষণ সে দেখল রাস্তার রং মাখা ভীড়। বাঁদর রং ছুঁড়াছুড়ি, ডিমিডিমি বাজনা, গলা চেরা হইহই। অনেক ছেলেপিলে জামা ধরে টানাটানি করছে, ছিঁড়েও ফেলেছে কয়েকজনের। ওদের দেখতে দেখতে কখন নায়িকা নিজেই হাসতে শুরু করেছে নিজেই জানেনা। খেয়াল হতে সে সরে এলো জানলা থেকে। এদিক ওদিক করে সময় কাটালো খানিক। স্নান, খাওয়া,ঘুম। আজ আর ল্যাপটপ খুলতেই ইচ্ছে হচ্ছেনা। ছবি আঁকবে? - নাহ, বড় পরিশ্রম! কি করবে তাহলে নায়িকা? কিছু না করেই কি দিন শেষ হয়ে যাবে? তাও আবার দোলের দিন?
.
আজ মেসের স্টাফ সবাই তাড়াতাড়ি চলে যাবে, দোল না! রাতের খাওয়া তাই শেষ ৮টার মধ্যে। এরপর কি? বই নিয়ে বসতে ভালো লাগছে না। মা তো ফোনে ধরলো না, বাড়িতে লোকজন নিয়ে ব্যস্ত বোধহয়। তাহলে? পরের দিনের কাজ কিছু এগিয়ে রাখবে মনে হতেই আবার ভাবলো - আজ তো ছুটি! আজ সে কেন কিছু করবে? ভেবে ভেবে নায়িকা বেশ বিরক্ত হয়ে পড়লো নিজের ওপর। দোলের দিনটাকে এই ভাবে মাঠে মারার কোনো মানে হয়?
.
রাত ১টা। নায়িকার চোখে ঘুম নেই। কি করবে সে বুঝে পাচ্ছেনা। সারাটা দিন ঘরে বসে কেটে গেল, কি বোকামি! আজ বিকেলে সে দৌড়াতেও যায়নি, আলসেমি করে। হয়তো ওই জন্যই মাথা গজগজ করছে, ঘুম আসছে না! এভাবে চললে সকালে ল্যাবে গিয়ে ঘুম পাবে তো! নাহ, এভাবে হয়না - ভেবেই নায়িকা হুট করে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে।
.
রাত ১.৩০। বড়ো মাঠের গেট বন্ধ। মাঠের সব আলো নেভানো। নিয়মমতো রাত ১০টায় এইসব করে গেছে সিকিউরিটি গার্ড। রাস্তায়ও তেমন লোকজন নেই, হোলি খেলে আজ সবাই ক্লান্ত। নাহলে আশেপাশের ক্যান্টিনে ভিড় থাকে কিছু। আজ সব অন্ধকার। নায়িকা বন্ধ গেটের তালাচাবির দিকে তাকিয়ে ভাবলো খানিক্ষণ। আজ অব্দি মাঠে এসে না দৌড়িয়ে সে ফিরে যায়নি কখনও। ডান দিকের তারজালির মধ্যে বেশ খানিকটা ছেড়া। খুব আস্তে আস্তে সাবধানে গেলে জামাকাপড়ে লাগবেনা মনে হয়। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!
.
চাঁদের আলোয় মাঠ ভেসে যাচ্ছে। রানিং ট্র্যাক গুলোর সাদা চুনের দাগ যেন চিকচিক করছে সব স্পষ্ট। ঘাসে ঘাসে শিশির, আলো পড়ে মোহনীয় জেল্লা দিচ্ছে। আকাশের ওই জ্বলজ্বলে থালাটা মাঠ টাকে পুরো রুপোলি আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। কে বলে রাত অন্ধকার? হালকা হালকা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আলোছায়া করে। নায়িকা এখন রূপকথার রাজ্যে! জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিল সে, খালি পা রাখলো মাটিতে।
শিহরণ! ঠান্ডা, ভেজা, নরম। আরাম! আরো এক পা, আর দু পা, এই আর দশ পা, ওই সামনে যে ফ্লাড লাইটের পোস্ট, ওই অব্দি - নায়িকা চলছে। একটু একটু করে গতি বাড়ালো, আরেকটু, আরো একটু, শুরু হলো পুরোদমে দৌড়। নিজের ছায়া তার পিছু নিয়েছে, আর সে দৌড়াচ্ছে প্রানভরে, অন্ধকারে, আলোতে। শ্বাস ফুলছে, হাঁপ ধরছে। তো কি? আজ তো ছুটি, তাই ভালোলাগার মতো করে সময় কাটানো। তাই আরো জোরে, চাঁদের সাথে সাথে। নায়িকার কোনো নায়ক নেই। দরকারও পড়েনা। দোকা হলে রাত কাটতো ঘরের মধ্যে। বরং সে একা। দোলপূর্ণিমার রাত কাটছে জোছনার আঙিনায়, ঝড়ের বেগে, সীমাহীন উল্লাসে।।