STORYMIRROR

Ahana Pradhan

Children Stories Romance Tragedy

3  

Ahana Pradhan

Children Stories Romance Tragedy

রেনি ডে

রেনি ডে

6 mins
299

বৃষ্টির দিনগুলো নায়িকার খুব প্রিয়। জানলার ধারে বসে বসে সময় কেটে যায় বেশ। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া, ঝিরঝির জলের ছাঁট, মধ্যে মধ্যে বাজ পড়ার কড়কড়ে আওয়াজ আর তার আগে চোখ ধাঁধানো আলোর ছ্বটা। সবে মিলে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ তৈরি হয়। এমন সময় পথে ঘাটে কেউ থাকেনা। হাওয়ার দাপটে বুড়ো বট গাছের ঝুরি গুলো ভৌতিকভাবে দুলতে থাকে এলোমেলো। কয়েকবার সে দেখেছে ডালও ভেঙে পড়তে। 


একবার একটা রিক্সা পড়েছিল মাঝ রাস্তায়। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি আসায় রিকশাওয়ালা সময়ই পায়নি কোনো ছাদের তলায় ঢোকার। বৃষ্টিতে চারিদিক সাদা হয়ে ওঠার আগে নায়িকা দেখতে পেয়েছিল , লোকটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্যাডেল করে এগিয়ে যাওয়ার। ঝড়ের বাতাস উল্টোদিকে এমন জোরে বইছিল, যে রিকশাটা একই জায়গায় আটকে গেছিলো। বৃষ্টি থামার পর অবশ্য রাস্তায় ওখানে আর কাউকে দেখতে পায়নি সে। 


তখন বাড়ির সামনে অনেক জল জমে। ছোটো ছোটো ডোবা বনে যায় গর্ত গুলো। বিকেলে খেলতে গেলে সে কাগজের নৌকা বানিয়ে ওই ডোবায় ভাসায়। অনেক ব্যাঙের বাচ্চা থাকে ওই জলে। টুপটুপ করে লাফায়। দাদা বারণ করেছে ওগুলো ধরতে। হাতে লাগলে নাকি ঘা হয়। 


এই সময় মাটি খুব নরম থাকে। সোঁদা গন্ধ নায়িকার খুব প্রিয়। সব কিছু খুব তাজা মনে হয়। তাদের বারান্দার অপরাজিতা গাছটা যেমন, জল পেলে যেন তরবরিয়ে নেচে ওঠে, খুব তরতাজা লাগে তখন।


বৃষ্টির দিন ভালো লাগার আসল কারণ অবশ্য "রেনি ডে"। অসময়ে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার মতো আনন্দের আর কিছু বোধহয় পৃথিবীতে আর হয়না।


নায়িকার স্কুল বাড়ি থেকে বেশ দূরে। সে অটোমামুর অটোয় স্কুল যায়। অটোমামু সকাল নয়টায় তাকে বাড়ি থেকে নিতে আসেন। ছুটি বেলা তিনটার সময়, অটোমামু তার আগেই পৌঁছে যান স্কুলের গেটে। আজ অবধি কোনোদিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি, অটোমামুর কখনো দেরি হয়না। তার অটোতে মোট সাতজন যায়। তার স্কুলের চারজন, বাকিরা দাদার স্কুলের। দাদা অবশ্য সাইকেল শেখার পর থেকে মামুর অটোয় আর যায়না, সাইকেলে নিজেই যাতায়াত করে।


তবে যেদিন রেনি ডে, সেদিন অটোমামুর দেরি হয়। কারণ উনি তো জানতে পারেননা যে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। খুব বৃষ্টি হলে উনি মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যান যে ছুটি দেবে কিনা, তবে সেটা সবসময় কাঁটায় কাঁটায় হয়না। এইসব রেনি ডে তে যতক্ষণ না অটোমামু আসছেন, নায়িকারা স্কুলেই থাকে। কোনো না কোনো দিদিমণি এসে জিজ্ঞেস করেন, কাদের কাদের নিতে এখনো আসেনি। নাম গুলো লিস্ট করে নেন, আর বলে যান যে গার্জেন এলে টিচার্স রুমে জানিয়ে তারপর যেতে।


নায়িকা কয়েকবার একা ছিল ক্লাসে। একবার সে টিচার্স রুমের বারান্দায় চলে গেছিলো। ওখানের বড়ো বেঞ্চিতে বসে বসে টিফিনটা শেষ করতে করতেই অটোমামু চলে এসেছিলেন। আরেকবার সে লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করতে করতে একটা বই পুরো শেষ করে দিয়েছিল। বইটার নাম "বুবুন"। তবে সবচেয়ে মজা হয়েছিল সেদিন, যেদিন সে বৃষ্টিতে ভিজেছিলো।


সুপর্ণাকেও তখন নিতে আসেনি। সুপর্ণা ওদের ক্লাসের লাস্ট গার্ল, আর নায়িকা ফার্স্ট। স্কুলের অনেক অনুষ্ঠানে সুপর্ণা আর ও একসাথে গান করেছে। মেয়েটার গলা খুব সুরেলা। ও গান শেখেনা, কিন্তু শুনে শুনে খুব সুন্দর গান গায়। তবে মেয়েটা বিশ্ব পাকা। প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখে! 


প্রথমে সুপর্ণার সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ও টিফিন খেলো। দিদিমণি নাম নিয়ে গেলেন তারপর। বৃষ্টি খুব বেশি জোরে হচ্ছিলোনা তখন। সুপর্ণা বললো, "চল ভিজি"। নায়িকা এর আগে কখনো বৃষ্টিতে ভেজেনি তা নয়, তবে শখ করে ভেজেনি। যতবার ভিজেছে, ভিজে গেছে। জল কাদা, ঠান্ডা ভেজা জামা, মায়ের তাড়া এইসব নিয়ে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি বৃষ্টিতে ভেজা। তাই সুপর্ণার কথায় সে না বললো। 

"তুই কি রে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভয় পাচ্ছিস? আরে দারুন লাগে, চ না" বলে হাত ধরে টেনেই নিয়ে গেল তাকে।


ক্লাসরুমের বারান্দা নিচু, এক লাফে মাটিতে নামা যায় সহজেই। লাফ দিয়ে দুজনের একসাথে পা পড়লো একটা নতুন জমা জলে তৈরি ডোবায়! ছলাৎ করে জল লাফিয়ে স্কার্ট ভিজিয়ে দিলো দুজনেরই। নায়িকার এখন খুব ভয়, মা বকবে যে! সুপর্ণা টা কি, বলে কিনা মা রা নাকি এমনিই বকে, ওটা নাকি মা'দের কাজ! তাই ওসব ভেবে লাভ নেই!


 যাইহোক, প্রাথমিক ভয়ের রেশ কাটতে ওরা হাতে নিলো লাঠি। সামনের কৃষ্ণচূড়ার অনেক ছোট বড় ডাল পড়েছে ঝড়ে, তার থেকেই জোগাড় করলো পছন্দ মতো। একটু শক্ত, খুব বড় নয়। নরম মাটিতে বেশ সহজে দাগ কাটে! আর ডোবার জলে ছপাত ছপাত মারলে জল ছিটায়! সুপর্ণা আবার একটা সেগুনপাতা কুড়িয়েছে এর মধ্যেই। ওর লাঠির মাথায় ফুটো করে লাগাচ্ছে, ওটা নাকি ওর ছাতা! লাগলো না, ছিঁড়েই গেল। 


কাগজের নৌকা বানাবার কথা হতেই সুপর্ণা ছুটে চলে গেল ক্লাসরুমের মধ্যে। অঙ্ক খাতার পাতা ছিঁড়েছে, কি সব্বনাশ! নায়িকা তো পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে নৌকা বানায়। আর নয়তো পুরনো খাতার পাতা। স্কুলের খাতার পাতা ছিঁড়লে তো বাবা পিটিয়ে শেষ করে দেবে! এই মেয়েটা কি রে বাবা! 


নায়িকার মজা লাগে নৌকা যখন ভাসে। হাত দিয়ে একটু একটু জল ঠেলে সে, জল তরঙ্গ হয়ে হয়ে নৌকা গুলো এগিয়ে যায় এদিক ওদিক একটু একটু। আর সুপর্ণাটা এমন অদ্ভুত, জলে নৌকা ছেড়ে কাঠি দিয়ে এমন জল ছিটাচ্ছে যে নৌকা গুলো ডুবে যাচ্ছে! আরে এরকম করে খেলা হয় নাকি! নায়িকা রেগে গেলো। "না হয় তো খেলিস না, আমার নৌকা, আমার খাতার পাতা, আমি যেমন ইচ্ছা করবো" - খুবই গা ছাড়া ভাবে বললো সুপর্ণা। পা দপদপিয়ে নায়িকা চলে এলো ক্লাসরুমে। বসে পড়লো থপ করে বেঞ্চে। ভেজা স্কার্টে বেঞ্চও ভিজে গেল। এরকম গুন্ডা মেয়ের সাথে ও খেলবেই না! 


"এই নায়িকা, চ মেহগনি তলায় যাই। ওখানে না গায়ে বৃষ্টি লাগেনা।" ডাকতে এসেছে দস্যি মেয়ে! নায়িকা তো গেল ফুলিয়ে বসে আছে। তবে তার মন গলতে বেশি সময় লাগলো না। 


মেহগনি গাছটা ওদের স্কুলের প্রাণ। বিশাল প্রাচীন এক গাছ, ইয়া মোটা গুঁড়ি, আর ঘন পাতার জাল তলায় একটুও রোদ পড়তে দেয়না। একবার নায়িকা পা দিয়ে গুনে গুনে গাছটার বেড় মেপেছিলো। ১০৬ পা হয়েছিল! এই গাছের তলায় রোজ ওরা প্রার্থনা করে। 


মেহগনি তলায় সত্যিই গায়ে বৃষ্টি লাগছেনা একদম! কখনো একটু ছিটেফোঁটা পড়ছে মাথায়, খুবই অল্প। তাহলে তো বৃষ্টির সময় এই গাছতলায় বেশ থাকা যায়। তারপরই নায়িকার মনে পড়লো ভৌতবিজ্ঞান বইয়ে পড়েছে ঝড়ের সময় বাজ পড়লে গাছতলায় কেন থাকতে নেই। বেরিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। 


সুপর্ণা ততক্ষনে অনেকগুলো শুকনো পাতা জোগাড় করে জড়ো করে ফেলেছে। জল পড়লেও পাতা গুলো বেজান। এগুলোকে ওরা বলে "মহব্বতে" পাতা। আসলে একটা গাছ আছে সামনে, নাম জানেনা ওরা, পাতাটা দেখতে একদম সেই 'মহব্বতে' সিনেমায় যেমন দেখিয়েছিল, তেমন। "এত পাতা দিয়ে কি করবি রে?"

"দেখ না কেমন মজা", বলেই এক লাথি মারলো পাতার ঢিপিটায়। ছেতরে গিয়ে পড়লো একটু এগিয়ে, জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল যেখানে। এখন পাতাগুলো যেন লাইন দিয়ে ভেসে যাচ্ছে! "বাহ, বেশ মজা তো!"

তবে মেয়েটার ওতে শান্তি নেই। সেই আবার পা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছপাত ছপাত। কাদা জল পাতা সব কিছু একসাথে ছিটাচ্ছে!


বৃষ্টির বেগ বাড়ছে একটু। এখন জলের ফোঁটা একটু বড় বড়, গায়ে লাগছে ভালো মতোই। আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, চোখে জল পড়ছে খুব বেশি। সুপর্ণা বলে, "চ আমরা গোলগোল ঘুরি"। "গোলগোল কিরকম?" দুই হাত টানটান জোড় করে আর দুই হাত ধরলো। তারপর হাতের জটলাকে মধ্যিখানে রেখে চরকি ঘুরা! উফফ, মেয়েটা কি জোরে ঘুরতে পারে! নায়িকার তো মাথা ঘুরতে লেগেছে। সুপর্ণা থামছেই না! নায়িকার চারপাশের গাছ পালা মাটি সব কিছু গোলগোল ঘুরতে লেগেছে খুব জোরে, সে শেষমেশ চোখ বন্ধই করে দিলো। আর তারপরই পা পিছলে গেল, ফলে দুজনেই পড়লো ধপাস! ভেজা মাটি তাই লাগেনি। তবে দুজনেই এখন পুরো কাদামাখা পেত্নী! প্রাণখুলে হাসির সেই যে শুরু, শেষ কখন সে আর খেয়াল নেই!


"কি রে, রেন কোটটা তো ব্যাগে ছিল, পরিসনি কেন?" মা জিজ্ঞেস করলো। "বারে, রেন কোট পরলে ভিজবো কি করে?" 


নায়িকার জ্বর সারতে তিনদিন লেগেছিল। স্কুল কামাই। তিনদিন পরে স্কুলে গিয়ে দেখলো সুপর্ণা আসেনি।


সাত দিন পরেও এলোনা।


সাতদিনের জ্বরে মেয়েটা মারা গেল। একদমই আচমকা! নায়িকা কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। যেদিন চন্দনা মিস এসে বললেন খবরটা, নায়িকার চোখের সামনে সব যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এসেছিল।

.

.

.

আজ নায়িকা তিরিশ বছরের যুবতী। অন্য শহরে অন্য জীবন। বৃষ্টি তার এখনো ভালো লাগে খুব। জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা আগের মতোই রোমাঞ্চকর। কিন্তু এই তিরিশ বছরে বৃষ্টিতে ওই একবারই সে ভিজেছিলো শখ করে।


Rate this content
Log in