Ahana Pradhan

Children Stories Comedy Children

4.0  

Ahana Pradhan

Children Stories Comedy Children

পিকনিক

পিকনিক

6 mins
384


পাশের বাড়ির গুড্ডি বলেছে ওরা নাকি নদীর ধারে পিকনিক করতে যাবে। ওদের নাচের স্কুল থেকে। স্কুল বলতে ওই সানিদের বাড়িতে জনা দশেক বাচ্চা জড়ো হয় রবিবার বিকালবেলায়। মাস্টারমশাই আসেন। কথথক, ভারত নাট্যাম, রবীন্দ্র নৃত্য।

সেদিন বিকেলে খেলতে গিয়ে নায়িকা শুনলো ওদের স্যার বলেছেন নিয়ে যাবেন, সবার বাড়ি থেকেও হ্যাঁ বলেছে। তার এখন খুবই দুঃখ। সে তো আর নাচ শেখেনা, নাহলে ওদের সাথে যেতে পারতো। গোটা পাড়ার মধ্যে সেই খালি নাচ শেখেনা। গান শেখে। মা বলে গান নাচ সব একসাথে নাকি হয়না। যেকোনো একটা মন দিয়ে করতে হয়। বললেই হলো? ওই যে গুড্ডি ওরা, গান, নাচ, আঁকা, আবৃত্তি আরো কত কি শেখে! অবশ্য কি শেখে ওরাই জানে। আর নায়িকা তো গেল বছরেই স্কুল থেকে অল বেঙ্গল টিচার্স এসোসিয়েশনের আয়োজিত রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগীতায় জেলায় ফার্স্ট হয়েছে। তা হলেও! নাচটা শিখলে, মানে ওই গুড্ডিদের সাথে আর কি, বেশ পিকনিক যাওয়া যেত!


নদী বলতে দ্বারকেশ্বর। ছেলে নদী, নদ। বাড়ি থেকে ওই দুই কি তিন কিলোমিটার হবে। নায়িকা আগে অনেকবার গেছে। বাবার সাথে, দাদু আর দাদা কে নিয়ে, বুজুকাকু আর দাদার সাথে, ছোটমামু-মামিমা কে নিয়ে। বাড়িতে কেউ এলেই একবার নদী ঘুরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেই যাওয়া আর এই যাওয়া কি একই নাকি? এ বেশ বন্ধুদের সাথে যাওয়া, কোনো গার্জেন নেই, মজাটাই আলাদা! আর পিকনিক তো, মানে একেবারেই অন্যরকম! উফফ, নায়িকার যে কি আফসোস হচ্ছে! সে ক্লাস ফোরে পড়ে, এর আগে কখনো পিকনিকে যায়নি। দাদা গেছে, টিউশনের বন্ধুদের সাথে গাংদুয়া ড্যামে। ওদের নাকি খুব মজা হয়েছিল। নায়িকা তো টিউশনও পড়েনা, ছোট ক্লাসে নাকি ওসব লাগে না! ধুর বাবা, ভাল্লাগেনা! তারও কি পিকনিক যেতে টেতে ইচ্ছে করেনা নাকি?

.


"মা, ও মা, গুড্ডি রা না পিকনিক যাবে নদী তে। আমাকেও নিয়ে যাবে? বলো না গো? আমাকেও নিয়ে চলো না গো...ও মা, মা"


"যাবে তো চলে যাবে!"


"সত্যিই যাবো গো?"


"ঘ্যানঘ্যান না করে খাওয়া শেষ করে ওঠো। আজ মাসি আসবেনা, বাসন ধুতে হবে, অনেক কাজ বাকি আছে। আবার কখন জল চলে যাবে! এই এক জ্বালা হয়েছে! এই তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠ তো!"


নায়িকা গপাগপ খেতে শুরু করলো। মা বলেছে নদী যেতে! তাহলে তো তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে হবে, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে। আজ পাটুকেও তাড়াতাড়ি ডাকতে যাবে বিকেলে। ৪ টায় বেরোবে তাহলে। তারপর নদী! সে আর পাটু মিলে নদী যাবে। বেশ পিকনিক পিকনিক ভাব! খুব মজা!

.


রাস্তাটা সে আর পাটু দুজনেই খুব ভালোভাবে চেনে। বাড়ির পিছন দিকে প্রথমে কায়স্থ পাড়া, ওখানে গম ভাঙাতে আর রেশনে কেরোসিন নিতে এক দুবার কাজের মাসির সাথে এসেছে। তারপর দুর্গাবাড়ি পড়বে। পুরোনো দিনের মন্দির। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। মন্দিরের দালান বেশ চওড়া। প্রায় শ'খানেক লোক পাত পেড়ে একসাথে খেতে পারবে। কাজের মাসির বাড়ি তারই পাশের গলিতে। গলিতে না ঢুকে সোজা এগিয়ে দুর্গাবাড়ি ছাড়িয়ে আরেকটু গেলেই লোকপুর। ওখানে আগে ওরা ভাড়া থাকতো। নায়িকা তখন খুবই ছোট, তার খালি মনে আছে বাড়িটার সামনে বিকেলে আঁচের উনুন জ্বলত। ওই বাড়িটা নদী যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে। বাড়িটার সামনে থেকে বাম দিক নিলে বড় রাস্তা। সেটা ধরে এগিয়ে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর ডান দিক নিলেই নদী চোখে পড়বে। দূর থেকেই চিকচিকে বালি, কাশবন এইসব দেখা যায়। পৌঁছাতে মিনিট দুয়েক লাগে। 


দ্বারকেশ্বরে খালি বর্ষাকালে জল থাকে। অন্যসময় বালি বেশি। জায়গায় জায়গায় বালি শক্ত হয়ে প্রায় মাটির মতো হয়ে গেছে, কাশ ছাড়াও আরো অনেক ঝোপ ঝোপ গাছ হয়ে থাকে তার উপর। জলও থাকে, তবে অন্যদিকে। রাঙ্গাকাকুকে প্রথমবার যখন নদী দেখাতে নিয়ে এসেছিল, কি অপমান কি অপমান! রাঙ্গাকাকু বলেছিল "এটা নদী না ফুটবল মাঠ?" নায়িকার খুব রাগ ধরেছিল। এ কিরকম কথা? যতদূর দেখা যায় বালি। ফুটবল মাঠ এতবড় হয় কখনো? অলিম্পিকের মাঠ ও এতো বড় হয়না। বালি তুলতে আসার ট্রাক গুলো কত ছোটছোট দেখায়। আর বালিতে নেমে মিনিট দশেক হাঁটলে রাজগ্রামের ব্রিজটা চোখে পড়ে, তার ওপাশেই তো জল!


ছোটমামুদের নিয়ে যখন এসেছিল, ব্রিজের উপর উঠেছিল। ওপাশটায় ঘন কালো জল, মধ্যে মধ্যে বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই। মামু মামিমার নতুন বিয়ে তখন। মামু বলছিল, তোয়ালে নিয়ে এলে বেশ হতো, জলে পা ডুবিয়ে চান পাথরের উপর বসে অনেকক্ষণ কাটানো যেত। 


সেজকাকিমাকে নিয়ে দাদার সাথে যেবারে এসেছিল, সেবারে নায়িকা অনেক বালি তুলেছিল। পুরো এক প্যাকেট ভর্তি। নদীর বালি খুব মিহি। স্কুলে আঁকার স্যার বলেছিলেন নদীর বালিতে খুব ভালো বালির কাজ হয়। সে আর দাদা মিলে ওই বালিতে জলরং চটকে রোদে শুকিয়েছিলো। তারপর বালির কাজ। ফুলদানি বানিয়েছিল। নায়িকা একটা, আর একটা দাদা। ওরটা মা বাঁধিয়ে ঘরে টাঙিয়েছে, আর দাদারটা দিদু দাদু কে দিয়ে এসেছে। সেটা দাদুর পড়ার ঘরে টাঙানো আছে।


কাশবন গুলো খুব ঘন। সেই অপু দুর্গা যেমন ছোটে কাশবনের মধ্যে দিয়ে, পুরো সেইরকম। ও কখনো কাছে গিয়ে ধরেনি। মা বলেছে জামায় ফুটবে, তাই। ট্রেনে করে দিদুর বাড়ি থেকে যখন ওরা ফেরে, নদীটা দেখা যায়। 'চিকচিক করে বালি কোথা নেই কাদা, তার ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা'। তবে দ্বারকেশ্বর মোটেই ছোট নদী না! বিশাল নদ।


নদীর পাড়ে শ্মশান। এই একটা জায়গায় নায়িকার একটু ভয় করে। মানে ঠিক ভয় নয়, তবে একটু গা ছমছম করে আর কি। রাস্তা থেকে নদীতে নামার বাম দিকেই শ্মশানের গেট। একটা কালী ঠাকুর আছে ওখানে। কালো রঙের ঠাকুর। শ্মশানকালী। জিভটা টকটকে লাল। নায়িকা যতবার নদীতে এসেছে, কখনোই কোনো আগুন, ধোঁয়া, লোকজন, বা কিছুই দেখেনি। ফাঁকা সব। খালি ওই ঠাকুরটা চোখে পড়ে, আর ওর গা ছমছম করে। এই জন্যই ও নদীতে একা আসতে সাহস পায়নি। পিকনিক করতে পাটুর সাথে এসেছে!

.


আসার রাস্তায় তেমন কিছু বিপদ ঘটেনি। চেনা রাস্তা তো, কি আর হবে! তবে একটা বুড়ো দাদু হঠাৎ সাইকেল থামিয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "এই দুটো বাচ্চা খুকি, শ্মশানের দিকে কোথায় যাচ্ছ?" নায়িকা উত্তর দিয়েছিল যে ওদের নাচের স্কুল থেকে সবাই পিকনিকে এসেছে নদীতে। বন্ধুরা ওখানেই আছে, মাস্টারমশাইও। ওরা দুজন খালি একটু পিছিয়ে পড়েছে। 


দাদুটা ওদের খানিক্ষণ দেখলো, তারপর নাম জিজ্ঞেস করলো। নায়িকা নাম বললো। "তা ভালো নায়িকা নও তো তুমি, মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলতে পারো না।" 

"আমি নায়িকা না, আমার নাম নায়িকা। N-Y-K-A-A" বানান করে নাম বললো এবার। দাদুটা তারপর পাটুর নাম জানতে চাইল। ওদের বাড়ি কোথায় সেটাও জেনে নিলো। বাড়ি কাছে বলেই বোধহয় আর কথা না বাড়িয়ে ওদের রাস্তা ছেড়ে দিলো।

.


নদীতে নেমে ওরা বেশিদূর গেল না। পাশেই শ্মশান, সেটা একটা ভয়ের ব্যাপার। আর তাছাড়া তেমন কিছু করারও নেই দুজন মিলে। ওরা দুজন বিকেলে কিৎকিৎ খেলে। কিন্তু নদীতে খেলতে শুরু করলে দেরি হয়ে যাবে ফিরতে। বরং ওরা ফিরে তারপর খেলবে বাড়ির সামনে, রোজ যেমন খেলে।


মিনিট দশেক এদিক ওদিক করেই ওরা ফিরার পথে এগোলো। পিকনিক শেষ!

.


ওটা দাদা না! কায়স্থ পাড়া পৌঁছে মনে হলো একটু সামনে দাদা যাচ্ছে। বাবাও আছেন সাথে। কোথায় গেছিলো ওরা এদিকে? "দাদা-আ-আ" ডাক পাড়লো নায়িকা। কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে শুনতেই পেলো না। নায়িকারা হাঁটার গতি বাড়াল। ধরতে পারলে এখনই বেশ বলা যাবে যে ওরা পিকনিকে গেছিলো, বেশ মজা হয়েছে! কিন্তু দাদারা খুব জোরে হাঁটছে, যেন খুব তাড়া। একদম বাড়ির কাছে এসে দূরত্ব কমল।


হঠাৎ দাদা পেছন ফিরলো। চোখ দেখে মনে হলো যেন অবাক হয়েছে। চিৎকার করে বললো "এই তোরা কোথায় ছিলি এতক্ষন?" নায়িকা লাফাতে লাফাতে কাছে এসে বললো "বাবা, জানো, আমরা নদী গেছিলাম! পিকনিক করতে!"

"ঘরে চ, মা কে বলবি কোথায় গেছিলি। তোর পিঠ আর আস্ত থাকবেনা আজ। রোজ ঘরের সামনে খেলিস, আজ নেই, কোথায় গেলি কেউ দেখেনি। পাটুর ঘরেও কেউ জানেনা। আমরা খুঁজতে বেরোলাম শেষে। মেয়ে গুলো গেল কোথায়!"


"কেন, আমি তো মাকে আজ বলেছি নদী যাবো পিকনিকে। মা তো বললো যেতে। তাই তো গেছিলাম!"


মা ততক্ষনে দরজা খুলেছে। কড়া গলা, গরম মেজাজ "আমি বলেছি নদী যেতে? ধান বললে কান শোনো তুমি? অতদুর রাস্তায় দুটো বাচ্চা, যদি কিছু হয়ে যেত?" 


"বা রে, তুমিই তো দুপুরে খাওয়ার সময় বললে যাবি তো চলে যাবি, আর সেজন্য তো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে বললে!" অবাক কান্ড!

.


পাটু মার খেয়েছে কিনা নায়িকা এখনো খোঁজ নেয়নি। ওর পিঠে হালকা পড়েছে। দাদা খুব বকেছে। মাত্র ৫ বছরের বড়, অথচ হাবেভাবে পুরো গার্জেন!

.


পরদিন সকালে মায়ের মেজাজ নরম। আদর করে বললো, বড়দের সাথে না নিয়ে অত দূরে যেতে নেই।

 

কিন্তু ওরা যে আসলে পিকনিকে গেছিলো, সেখানে বড়দের নিয়ে গেলে যে মজাটাই নষ্ট, সে কথাটা মা বুঝলই না!


Rate this content
Log in