ছবিতে দেখা -গল্প-বন্ধন /কলমে য
ছবিতে দেখা -গল্প-বন্ধন /কলমে য


সকাল থেকেই কেমন হই হই রব ।পিসিঠাকুমা হাঁক দিলেন ,ওরে কচিকাঁচাদের দল একটি বার এই ঠাকুরদালানে আয় রে ,কার সাধ্যি সে ডাক এড়ায় ,সন্তু তো গায়ে জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে ছুটেছে ,নীলু পিকলু মুন্নি সব হাজির ।ওরে বাব্বা ঘি পোয়া রে তারপর সন্দেশ পিসিঠাকুমা বামুনঠাকুরকে বলল,হ্যাঁগা এদের মাথায় একটু শান্তির জল ছড়িয়ে দাও দেখি ,তারপর ওই গোপালের আবীরের থালাটা দাও ওই কাজটা আমিই করবো ।
যথারীতি পিসিঠাকুমা সোনা গৌর বলে সক্বলের কপালে আবীরের টিপ পরিয়ে দিলেন ,আর হাতে কত রকমের মিষ্টি ,তাদের আদর করে বললে ,তোরাই আমার গোঁরাচাদ ,বিষ্ণুপ্রিয়া ওই কেষ্ট রাধারই রূপ বাছা।
বাড়িটা বেশ বড় পুরনো দিনের তাতে এই মালিকানা পিসিমার সেই কোন ছোট্টবেলায় বেধবা হয়ে সেই যে শ্বশুর ঘর থেকে এখানে এসেছেন,এখনো পর্যন্ত এই বাড়ি আগলে রয়েছেন আর এদের আগলে রয়েছেন ।পিসিমার বাবা ছিলেন রাশভারী মানুষ তিনি এককথার মানুষ মেয়ে ওই এগারো বছরে বেধবা হয়েছে কি সোজা নিজের কাছে এনে যাবতীয় সব তার নামে করে গেছেন এমনকি ঘরে মাস্টার রেখে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন ।আত্মীয়স্বজন ছিল কালের নিয়মে কেউ চলে গেছে আবার কাজের সূত্রে কেউ বাইরে, কেউ তার পাওনা গন্ডা নিয়ে সম্পর্কের ল্যাটা চুকিয়ে দিয়েছে ।এখন এবাড়িতে তারা থাকে তারা বেশীরভাগই ভাড়াটিয়া কিন্ত সবাইকে পিপিমা বুকে করে রেখেছেন ,কেউ বুঝতেই পারবেনা এরা আলাদা রক্তের মানুষ ।পুজোপাল পার্বনে সবাই মিলেমিশে একাকার।
এ বাড়ির সদর দরজায় খিড়কি দেওয়া থাকে না ,সেই রাতের বেলায় ফটকে আসে সবার শেষে ওই বন্ধ করে ---তাই সারাদিন কেউ না কেউ বুকে পরে চেনা মানুষ আবার কত অচেনা মানুষ তৃষ্ণা মেটাতে আসে ,পিসিঠাকুমা এমনিতেই শক্ত কিন্ত তার ভেতরটা ভীষণ নরম ,দয়ার শরীর ,কারো দুঃখ কষ্ট দেখতে পারেন না তাই যেটুকুন আছে সকলকেই দিয়ে থুয়ে এতকাল এভাবেই কাটিয়ে এসেছেন।আজ ও তাই বাদ যায় কেন !দূর থেকে ভেসে আসছে খোল করতালের আওয়াজ মধুর স্বরের নাম ,দোল পূর্ণিমার উৎসব ।উড়ছে আবীর রঙের ছোঁয়া লেগেছে পলাশ , শিমুল , কৃষ্ণচূড়াতে , মানুষের মনেও আনন্দের সীমা নেই ,বছরে একটা দিন সবাই মেতেছে হরিতলার মন্দিরে তো বেশ লোকের সমাগম , ঠাকুরের পায়ে আবীর দিয়ে সকলের কপালে আবীর মাখানো । রাস্তার অলিগলিতে ছোটদের পিচকিরি নিয়ে ছোটাছুটি , আজ কোন কথা শুনবে না তারা আজ রঙ দেবেই পন করেছে ।এরই মধ্যে বাড়িতে এল স্কুল কলেজে পড়া কিছু ছেলেমেয়ে ।ওরা কারা!! একরা বাবু বলে ঠাম্মা ওরা সব আমার বন্ধু গো একসাথে ই পড়ি তোমাকে পায়ে আবীর দেবে ,বলতে বলতেই পিসিঠাকুমার পা নিয়ে কাড়াকাড়ি,ওরে ছাড় ছাড় আগে প্রসাদ নে তবে সব ।একরার কথা বলি ও মুসলিম--- পিসিঠাকুমার বাড়িতে মা হারা বাবার সাথে থাকে ,সেই ছোট্ট নিজামের ছেলেটা কত বড় হয়ে উঠেছে ।এতবড় বাড়ির পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়েছিল ,তাই বাড়িটা ঝকঝকে আর ফুলগাছের সারি সাথে সবাই হাত লাগায় । আদিবাসী থেকে হিন্দু মুসলিম ,বামুন সব একজায়গায় ।পিসিঠাকুমা বলল ওরে বামুন ঠাকুর দেখ এদের কাউকে চিনতে পারছো বল দেখি !!তার আবার জাত নিয়ে সব বড়াই ওসব জাতের নামে বজ্জাতি । মানুষ আজ বসন্ত উৎসবের আনন্দে সকলে একসাথে কেমন মেতেছে আহা এ না হলে রঙের উৎসব ।রঞ্জুলা ,রাজিয়া পুজোর বাসন ধুয়ে এনে রাখলো । বামুন ঠাকুর বলল মা এতদিন আপনার বাড়িতে পুজো করে কিছু মুখে দিয়ে তবে যাই ,কেউ এ নিয়ে বলে কিছু কথা তার আমি গায়ে মাখিনা ,এই তো সেবারে শরীরখারাপের সময় নিজাম ঘাড়ে করে আমাকে তবে রিক্সায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল ,তারপর ছোটাছুটি তো আছেই সবার ,সে যাত্রা ওর জন্যই বেঁচে গেলাম।ডাক্তার ও সুখ্যাতি করলে ।পিসিঠাকুমা দোতলায় ঝুল বারান্দা থেকে দেখতে পেলে বাড়ির নীচে রঙ খেলায় মেতেছে কাউকে চেনবার জো নেই ....ওই দূরে দেখা যাচ্ছে মেয়েটাকে ফর্সা থবথবে ওতো সেই খেস্টান মেয়ে তো ওমা কি সুন্দর গো !!কার কপালে আবীর দিচ্ছে ???একটু মন দিয়ে দেখে হেসে বলেই ফেলল ওই সাহেবের কপালে বাঙালীই নয় ,বিলেতি মেমরাও এপাড়ায় এসেছে ওই হরিতলার মন্দিরে গৌরের মন্দির যে এযে চৈতন্যপ্রেম লীলা ।গ্ৰাম বাংলার সব মানুষের সাথে এক হয়ে সবাই মেতেছে এই মিলনউৎসবে। পিসিমা কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছছেন ,আর মনে মনে হয়তো তার ভেতরের মনটা চলে গেছে সেই সে ছোটবেলায় ,ভাবছেন মনে মনে এক কাপড় ঘোমটার নীচে মেয়েদের দিন কাটাতে হতো ,রঙ খেলা তো দূরে থাক পুরুষের মুখ দেখাও বারন,চিকের আড়ালে থেকে সবকথা চলতো সত্যি আজ তার কত বদল হয়েছে। মহান মানুষেরা কত ঝক্কি সয়ে এসব করে গেছেন ,নিমাই এই দিনে জন্মেছিলেন ,এই ধরাধামে এই নামের প্রেম বিলিয়ে গেছেন কত কষ্ট করে ,তার কাছে যে জাতপাতের কোনো ভেদাভেদ ছিল না ,গড় করি গো তোমারে মহাপ্রভু । মানুষে মানুষের এই হৃদয়ের মধুর বন্ধন , ফাগুনে বসন্তের দোলউৎসব---- মহামিলনের উৎসব এইভাবেই সব ভুলে রঙ্গীন হয়ে বেঁচে থাকুক মানুষের মনে এ ধরাধামে ,মঙ্গল হোক সকলের।