বৃষ্টিভেজা অচেনা পথ
বৃষ্টিভেজা অচেনা পথ
বর্ষশেষের দিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ কোথার থেকে কালবৈশাখীর শুরু, প্রচন্ড একটা ঝোড়ো হাওয়া সব যেন লন্ডভন্ড করে দেবে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে আজ হাওয়া বইছে খুব। পরমা কাঠের চেয়ারটা বারান্দার মাঝ বরাবর টেনে এনে বসলেন। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন তিনি। কিন্তু সহসা পবনদেবের এইরূপ চঞ্চল আত্মপ্রকাশ এবং তাতে তার বিশ্বস্ত জানলা গুলির এমন প্রশ্রয় দান দেখে কিছুটা ব্যস্ত হয়েই তিনি জানলার কাছে উঠে এলেন। না, আজ আর তিনি জানলা বন্ধ করতে পারলেন না। বরং আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ যেন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। ক্ষনিকের মধ্যেই এই ব্যস্ত প্রাণচঞ্চল শহর যেন তার স্মৃতির দরজায় এসে থমকে গেল। তিনি ফিরে গেলেন খামে মোড়া কিছু স্মৃতির জানলায়, যা বহু প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে সেই কবে থেকে।
বৃষ্টি প্রায় নামবে বলেই স্থির। ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে। তবে আজ তিনি আর বড় লাইটটি জ্বালালেন না। আজ ডেস্কে রাখা মোমবাতিটাকেই হাতে তুলে নিলেন। দেশলাই বাক্সটা খুঁজতে গিয়ে তার হাতে এলো একটা চিরকুট। খুব চেনা একটা স্পর্শ পেল সে। তার মনের মধ্যে উঠতে থাকা ঢেউগুলোর কাছেও যেন মুহূর্তে পৌঁছে গেল সেই স্পর্শের অনুভূতি। এরপর ডেক্সের একটু বাঁ দিকে হাত দিতেই দেশলাইয়ের বাক্সের সন্ধান পাওয়া গেল। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় মোমবাতিটি জ্বালানোর পর তিলোত্তমা চেয়ারে বসে মেঘলা চোখে চিরকুটটা খুললেন। চিরকুটটায় বিশেষ কিছু লেখা ছিল না, ছিল একটা ফোন নম্বর। কুয়াশায় যেন ভরে গেল তার চারপাশ। স্মৃতির রোমন্থন করতে করতে তিলোত্তমা পৌঁছে গেলেন আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে। বৃষ্টির দিন থেকে শরতের আকাশে এক ট্রেনে বাড়ি ফেরা, কখনও উত্তাল হৃদয়ে তাকে খুঁজে যাওয়া, কখনওবা চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নেওয়া। এই সকল স্মৃতি পরমাকে এতটাই গভীরে নিয়ে চলে গেল যে সে বুঝতেই পারলো না যে ঘড়ির কাঁটা কখন নয়ের ঘর অতিক্রম করে গেছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল বৃষ্টিও, দুই শহরেই। তার চোখও যেন আজ তাকে পর করে দিয়েছে, চোখ বয়ে যেতে লাগলো সেই মানুষটার জন্য যার সাথে সাক্ষাত নেই আজ প্রায় দু বছর হয়ে গেল।
আবেগের সমুদ্রে যখন এমন উথাল পাথাল হচ্ছে তখন সেই বা আর চুপ থাকে কি ভাবে ? পাগলের মতো খাটের পাশে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তার একমাত্র সঙ্গী পাশ বালিশটিকে। পরমা যেন বুঝে উঠতেই পারলেন না কি করবেন । কিছু প্রশ্ন তাকে বারবার উতলা করতে লাগলো যা সে করে উঠতে পারেনি সেই সাক্ষাতের শেষ দিন, কাকতালীয় ভাবে যেটা ছিল আরেকটা নূতন বছরের প্রথম দিন, । অনেক কথাই পরমা তাকে বলেছিল কিন্তু এই একটা কথাই আর বলা হয়ে ওঠেনি। অন্ধকার ঘরের মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। তবে আজ পরমা যেন নিশ্চিত, সে তার প্রশ্নের উত্তর নেবেই। এবং তার বিশ্বাস যে তার হিমাদ্রি হয়তো উদগ্রীব তাকে উত্তর দেবার জন্য। পরমা বলে উঠলেন, “আজ এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে হিমাদ্রি ! আমি জানি আমার চোখের ভাষা তুমি ঠিক বুঝে নিয়েছিল, তাই না হিমাদ্রি ?… না না, শুধু হিমাদ্রি নয়, পরমা আর হিমাদ্রি।” এই ঘোর বর্ষণের মাঝেই যেন এক চিলতে বসন্ত তাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল।
জানলার রড টাকে হালকা করে ধরে উজ্জ্বল চোখে পরমা বলে উঠলেন, ” মনে আছে হিমাদ্রি সে বারের কনফারেন্সে আমি তোমার ওপর কিভাবে রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি, তুমি ঠিক আমাকে সামলে নিয়েছিলে । আসলে তোমাকে দেখা মাত্রই আমি আর পারিনি রেগে থাকতে। বারবার আমি এভাবেই হেরেছি তোমার কাছে। আর এই হারের অনুভূতিতে যে সুখ লুকিয়ে আছে, তা কোনো প্রেমে পাগল ছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় কেউ হয়তো বুঝবেন না, তা তিনি যতই বিদ্বান হন না কেন !”
” না, আজ আর অপেক্ষা নয়। আজই, আজই আমি তোমায় সব জানিয়ে দিতে চাই হিমাদ্রি “। এই বলে সে দৌড়ে এলো টেবিলে রাখা টেলিফোনটার সামনে আর চিরকুটটাকে ধরল মোমবাতির আলোয়। এক একটা ডিজিট ডায়াল করতে গিয়ে তার আঙ্গুল কেঁপে উঠল অজানা অনুভূতিতে। অবশেষে রিং হল, পরমার হৃদয়ের গতি তখন চরমে। তার আজকের এই অনুভূতি একদম আলাদা। সবকিছু কেমন যেন অগোছালো হয়ে যেতে লাগলো, অদ্ভুত এক শিহরণ শরীরে সে অনুভব করল। অবশেষে কলটা রিসিভ হল । সকল শিহরণ যা সে কিছুক্ষণ আগে অব্দি অনুভব করছিল সেই সব যেন হঠাৎ করে থেমে গেল, সারা পৃথিবী যেন থমকে গেল কিছুক্ষনের জন্য। টেলিফোনের অপর দিক থেকে ভেসে এলো এক মহিলা কণ্ঠস্বর, “হ্যালো!”
তিলোত্তমা অস্থির হয়ে বললেন, ” হ্যালো, হি …. হিমাদ্রি আছে?”
অপর দিক থেকে উত্তর এলো, “উনি এখন একটু ব্যস্ত আছেন, আপনি আমায় বলুন কি দরকার ছিল।”
পরমা উদগ্রীব হয়ে বললেন, ” আ…আসলে… আসলে আমার হিমাদ্রির সাথে খুব জরুরী একটা কথা ছিল…”
কথা শেষ হবার আগেই উত্তর এলো, ” আপনি কিন্তু আমায় নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আমি সোমা, সোমা গাঙ্গুলী, ওনার স্ত্রী।”
এতটা শোনামাত্রই পরমা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যেন সহসা আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথায়। পাঁচ বছর ধরে তৈরি করা তার পৃথিবীকে যেন কেউ এক মুহূর্তে আছাড় মেরে তছনছ করে দিল। তাসের বাড়ির মত গুঁড়িয়ে গেল তার অপেক্ষার তাজমহল। চোখ বন্ধ করে নিল সে। যেন দেখতে পেল তার স্বপ্ন মহলের এক একটা ইট খসে খসে পড়ছে।
…… কিছুক্ষণ পর সোমা বললেন, “আচ্ছা দাঁড়ান আমি হিমাদ্রিকে দিচ্ছি।” এই বলে তিনি হিমাদ্রিকে ডাকলেন।
পরমা ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু পারলেন না। প্রাণের টান এত সহজেই কি ছিন্ন হয়ে যায়! আর এই না হওয়ার নামই তো হলো প্রেম ! পরমা ভাবলেন, যেখানে এতদিন অপেক্ষা করেছি তাকে পাওয়ার জন্য, সেখানে না হয় আর দু মিনিট, আর দু মিনিট অপেক্ষা করে গেলাম তাকে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলার জন্য।
ইতিমধ্যেই উল্টোদিক থেকে ভেসে এলো সেই অতিপরিচিত কণ্ঠস্বরটা, “হ্যালো!”
পরমা ভেবে পেলেন না কি উত্তর দেবেন। সে চুপ করেই রইল।
অপর দিক থেকে কোন উত্তর না আসায় হিমাদ্রি আবার বললেন, “হ্যালো, কে বলছেন?”
পরমা তার দু’চোখ আবার বন্ধ করে নিলেন। হিমাদ্রির কণ্ঠস্বর সে কেবল শোনার চেষ্টা করলো তাই নয়, বরং যেন চেষ্টা করলেন সারা জীবনের জন্য এই কণ্ঠস্বরটা তার মাথায় ও মনে গেঁথে নিতে। কারণ এটাই তাদের শেষ কথা।
কিছুক্ষণ পর পরমা নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন, ” সরি , রং নাম্বার!“
সঙ্গে সঙ্গে হিমাদ্রি বললেন, ” আপনার গলাটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে…” কথা শেষ হবার আগেই পরমা আবার উত্তর করলেন, ” না, এটা রং নাম্বার“।
হিমাদ্রিও বললেন, ” ইয়া, রং নাম্বার ”।
..… সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সাক্ষী থেকে গেল রাতের ওই মোমবাতিটা। থমকে যাওয়া পৃথিবী আবার নিজের ছন্দে ফিরল। উত্তাল হাওয়ার সাথে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি, দুই শহরেই, দুই তিলোত্তমাতেই…। নূতন বছরে নূতন ভাবে শুরু হতে চলল দুটি চেনা মনের অন্য অচেনা পথ ধরে চলা।

