বন্ধু গাছ
বন্ধু গাছ


©সিলভিয়া ঘোষ
আজকাল ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলোকে যখন গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি, শীতের ছুটিতে এমন কি যে কোন ছোট খাট আনন্দ অনুষ্ঠানেও পিঠে ব্যাগ নিয়ে হয় পড়তে যায় নয়তো নাচ, গান , আঁকা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন বার বার আমাদের ছোটবেলার কথা খুব মনে হয়।
আমাদের ছোটবেলায় পুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটি খেলা, পিট্টু, লাংচা, হা-ডু -ডু , নাম পাতাপাতি, কাবাডি খেলা যেমন ছিল, তেমন আড়ি-ভাব দল পাকানোও ছিল খেলাধুলোর একটা অঙ্গ। তখন অবশ্য পল্ট্রির মুরগীর মতোন দু-কামরায় বন্দী জীবন আমাদের ছিল না। দৌড়াদৌড়ি করার খেলার মাঠ অথবা বাড়ির উঠোন ছিল। যেটা এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে প্রায় অবাস্তব কল্পনামাত্র। আমাদের ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে খেলাধুলোর সময় মনোমালিন্য রাগারাগি হলেই আড়ি করে চলে আসতাম আমরা আর কোনদিন খেলবো না ওদের সাথে এই সব প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু সে সব প্রতিজ্ঞা থাকতো বড়জোড় দুই তিনদিন। তারপর একবার ডাক দিলেই চলে যেতাম বন্ধুদের সাথে খেলতে তখন ঐ প্রতিজ্ঞা টতিজ্ঞার কথা আর মাথায় থাকতই না।
আমরা যেহেতু ভাড়া থাকতাম কাছাকাছি পিসিরবাড়ি থাকায় সেখানেই বেশীরভাগ সময় কাটাতাম। যদিও পিসি কে আমরা চোখেই দেখিনি কারণ আমার জন্মের সাত বছর আগেই তিনি গত হয়েছিলেন । কিন্তু পিসেমশাইয় ছিলেন আমাদের মাথার ছাতা। সারাদিনের বেশীরভাগ সময় ওখানেই কাটতো আমাদের। পিসির বাড়ির সামনে ছিল বন্ধু মান্তাদের বাড়ি । ওদের বাড়ির উঠোনেই চলতো আমাদের বিভিন্ন খেলা। এদিকে পিসতুতো দিদিদের ছেলেমেয়েরা আমাদের দুই বোনের পিঠোপিঠি হওয়ায় যখন গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন ওরা আসতো তখন আমাদের আর পায় কে! বন্ধু মান্তাকে তখন পাত্তাই আমরা দিতাম না। পিসির বাড়িতে ছিল বাতাবী লেবু গাছ। গাছটা কটা বাতাবী লেবুর জন্ম দিয়েছিল তা আমার মনে নেই তবে রকে বসে বা কালভার্টে বসে আড্ডা দেওয়ার মতোন পরিবেশ সৃষ্টি করতে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষম হয়েছিল। গাছটার গায়ে কাঁটা ছিল তাকে আমরা পাত্তাই দিতাম না।ওখানে বসেই আমরা নিজেদের সমস্ত প্রাইভেট টক করতাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ঐ গাছই ছিল আমাদের
সব গোপন কথার সাক্ষী। গাছে চড়া নিয়েও আমাদের একটা প্রতিযোগিতা চলতো। মেজদির ছেলে রাজা ছিল গেছো ভূতের মতোন। মানে পিসির বাড়িতে তার এন্ট্রিই হতো আগে পাঁচিলটা টপকে কার্নিশ তারপর ছাদ অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে নীচে। তাহলে বুঝতেই পারছ বন্ধুরা আমরা কেমন টীম ছিলাম ! আমার বোন চেহারা ও আকৃতিতে যতই 'পাটার তলায় মরিচ'(মায়ের ডায়লগ অনুযায়ী) হোক না কেন সে ছিল নাম্বার ওয়ান বিচ্ছু। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিত সে। মাঝে আমি আর আমার বড়দির দুই মেয়ে একটু শান্ত প্রকৃতির ছিলাম তা বলে গাছে চড়ায় আমরা পিছিয়ে ছিলাম না, সেখানে আমরা ওস্তাদ। বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো। সকলেই ব্যস্ত। ভোগ তৈরী থেকে প্রসাদ বিতরণীতে । আমরা কিন্তু ঐ গাছেই ফল প্রসাদ খাচ্ছি আর প্লান করছি কটা নাড়ু, আখ, শাঁকালু, আপেল খাওয়া হবে। এই রকম ভাবে বোনপো বোনঝিরা যে কবে ভাই বোনের মতোন হয়ে গেল আমরা তারও হিসেব কষে দেখিনি। আজও বোনঝি বোনপোদের কাছে আমার হাবি দাদা হয়ে আছেন। মানে মেসো হয়ে যায় দাদা। দিন পর দিন ঐ গাছটা যে কত অত্যাচার সহ্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ওর বয়স যাই হোকনা কেন, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে গাছটা আজও যেন রয়ে গেছে। গাছটার অভাব বোধহয় আজকাল। অভাব বোধকরি সেই দামাল শৈশবের যেখানে সরলতা ছিল, আবেগ ছিল, স্পর্শ ছিল, নির্ভেজাল খেলাধুলোর আনন্দ ছিল আর ছিল বন্ধু গাছের মায়া।