বিপ্লব
বিপ্লব
প্রতি বছর নিয়ম করে মা আসেন তার পিত্রালয়ে, দেখতে চান সবাই এখানে যারা আছেন ভালো আছেন, সুখে আছেন। মা তো কোন ভেদাভেদ করেন না তার নিজের সন্তানের মধ্যে, তাহলে এত লড়াই ঝগড়া কী নিয়ে? উৎসবের মূল লক্ষ্য তো মানুষের সাথে মানুষের মিলন। তাহলে লড়াই কী নিয়ে? যা কিছু বিভেদ টা সবই আমাদের নিজেদের সৃষ্ট, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা এবং নিজের ক্ষমতার প্রদর্শনের জন্য এই বিভেদ তৈরী। কারণ মানুষ সবাই তো অমৃতের সন্তান, তাহলে বিভেদ কেন? কিছু মানুষের মৌলবাদী চিন্তাধারার ফল এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্ম হল মানব ধর্ম - একে অপরের সাথে যেখানে ভালোবাসার বন্ধনে থাকা উচিত, তারাই আজ একে অন্যের রক্তের পিপাসু। মনীষীরা বলে গেছেন, এক বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু মুসলমান। স্বামীজী বলেছিলেন, জীবে প্ৰেম করে যেই জন সেই সেবিছে ঈশ্বর।কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এসব আজ মিথ্যা হয়ে যেতে চলেছে। তাই মৃন্ময়ী মাকে চিন্ময়ী করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার।
এমনই এক বছর পুজোর সময়ে চারিদিক মাতিয়ে ঢাক বাজছে আর সেই বাজনা সকালের মনে পুজোর আনন্দ ছড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু কিছু মানুষের মনে এই ঢাকের আওয়াজ অন্য দাগ কেটে রেখেছে, তাদের মনে হচ্ছে আবার বাজছে! আবার শুরু হয়েছে সেই কুড়কুড় শব্দ.…
ঘুম জড়ানো চোখে চেনা সুরে ঢাকের বোলটা কানে যেতেই বুকটা সেই পুরনো চেনা সুরে হু হু করে উঠল সুচিত্রার! উফ, এরা এতদিন ধরে ঢাক বাজাচ্ছে, তা-ও একটা নতুন বোল তুলতে পারে না ঢাকে? প্রতিবার সেই এক সুরে ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ, ঠাকুর যাবি বিসর্জন…শুনলেই তার মনে পরে যায় বছর পনেরো আগের সেই দিনটা…না, না, সেই দিনটা একটুও মনে করতে চান না তিনি!
মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণামটা সেরে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন সুচিত্রা । আজ তাঁর অনেক কাজ। নারকেল কুরিয়ে রেখেছেন কাল রাতেই, আজ পাক দিয়ে ছাপ তৈরি করবেন। সেই সঙ্গে নিমকি ভাজতে হবে, বোঁদে রসে ফেলতে হবে, ঘুগনির মটর ভেজানো আছে, কিমাও তৈরি, সেটাও ফাইনাল করে ফেলতে হবে…দেওয়ালে ঝোলানো জগদীশের দিকে একবার তাকালেন তিনি…ছোট একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক চিরে! মনে-মনে বললেন, তুমি তো চলে গেলে, প্রতিবার এই বছরকার দিনে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাসটা পৌঁছয় কি, তোমার কাছে সেই স্বর্গ অবধি?
তাদের অঞ্চলের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য এই পাড়ার ঠাকুর এখনও কাঁধে চড়ে ভাসান যায়। জগদীশও নিয়ে যেতেন এক কালে। সুচিত্রা দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে দেখতেন, পাশে থাকত…। না, মনে পড়লে ওই আবার, আবার সেই চাপা কষ্টটা…নাঃ, জোর করে কাজে মন দিতে হবে দেখছি…জোর করে কানে অদৃশ্য তুলো গোঁজেন সুচিত্রা , শব্দটা কানে না ঢুকলেই বাঁচা যায়!
দূর থেকে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল সোনম খাতুন । পুজোটা তার ভীষণ চেনা, সঙ্গে ঐ বাড়িটাও। ছোটবেলায় ওই বাড়ির ঝুলবারান্দা থেকে নীচে ঝুঁকে দেখলেই তার মাথা ঘুরে যেত! এখনও কি ঘুরবে? বাঁশের সঙ্গে ঠাকুর বাঁধা হচ্ছে, দুই হেঁচকা টানে মা উঠে পড়বেন বহনকারীদের বলিষ্ঠ কাঁধে। আবার পাড়ি দেবেন শ্বশুরবাড়ির দিকে…সোনমও কি ঘরে ফিরবে এবার? নাকি প্রতিবারের মতো এবারও ওড়নার আড়াল থেকে মা দুর্গাকে প্রণাম করেই ফিরে যাবে? শুভেন্দু বলেছে, এবার ঘরে না ফিরলে পরের বার নাকি এখানে আসতেই দেবে না! মা দুর্গা কেন, জগদীশকেও তো দূর থেকেই বিদায় জানিয়েছে সোনম, কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি! যদি মানুষটা হঠাৎ সেই গুরুগম্ভীর গলায় আবার তিরস্কার করেন! হঠাৎ কে যেন সোনমের হাতটা এসে ধরে…চমকে উঠে তাকায় সোনম, লাল-সাদা ফ্রক পরা একটা ছোট্ট মেয়ে ফিকফিক করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে…
তুমি কোন বাড়িতে থাক সোনা?
এক গাল হেসে, আঙুল উঁচিয়ে মণ্ডপের পিছনের দিকের বাড়িটা দেখায় মেয়েটি, তারপর সোনমের হাত ধরে টেনে এগিয়ে যেতে থাকে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে…সোনম শত চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারে না! তার ওড়নার আড়াল সরে গিয়েছে…আশপাশের চেনা লোকেরা তাকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে! সে বিবাহসূত্রে, বা বলা ভাল স্বেচ্ছায় সোনম মুস্তাফি, জন্মসূত্রে স্বর্ণালী …পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের ড্যাবড্যাবে দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অদৃশ্য টানে…
ঘুগনিটার উপর গরমমশলা ছড়িয়ে ঢাকনাটা দিয়ে সবে ঢাকা দিয়েছিলেন সুচিত্রা । হঠাৎই তার বহু পুরনো ঝি ময়নার গলা পেলেন নীচ থেকে…কী বলছে সে বুঝতে না পেরে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেই হৃদপিণ্ডটা এক লাফে তাঁর গলার কাছে চলে এল যেন! ঢাকনা ফেলে কোনওমতে নীচে নামলেন। দেওয়ালে ঝুলন্ত জগদীশের প্রখর দৃষ্টি উপেক্ষা করেই…যে এসেছে, সে সোনম খাতুন নয়, সে স্বর্ণালী চক্রবর্তী , সুচিত্রা চক্রবর্তীর নাড়ি ছেঁড়া ধন, একটি মুসলমান ছেলেকে মেয়ে ভালবেসেছিল বলে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন জগদীশ । পনেরো বছর আগে এই বিজয়া দশমীর দিন এই মেয়েটিই সেই ছেলেটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলেছিল, সে মুসলমান হয়েছে কলমা পড়ে আর ছেলেটি গোমূত্র পান করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে! স্বর্ণালী হয়েছে সোনম, আর শোয়েব হয়েছে শুভেন্দু ! সুচিত্রার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল মেয়ের দৃঢ়তা দেখে! কিন্তু জগদীশের রক্তচক্ষুর সামনে কোন কথা বলতে পারেননি। তবে তারপর থেকে আর মাকে বরণ করেননি কোনওদিন!
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখের জল ভিতরে ঠেলে ময়নাকে দৃঢ় স্বরে বললেন,
বড় পিতলের থালাটা বের কর ময়না , আর মোড়ের দোকান থেকে একটু মিষ্টি আর একটা সিঁদুর কৌটো নিয়ে আয়। আজ মায়ে-ঝিয়ে বরণ করতে যাব মাকে!
ঢাকের আওয়াজটা বেশ ভাল লাগছে তাঁর এখন! কোলে মুখ গুঁজে থাকা মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিতে-দিতে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটির জন্য মনে-মনে তৈরি হতে থাকলেন সোনম খাতুনের মা আর জগদীশ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী সুচিত্রা !
কঠিন নিয়মের বাঁধন দিয়ে ভালোবাসার মুক্ত বিহঙ্গদের কোন সমাজ কখন বাঁধতে পারেনি, আজও পারলো না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুজোর অর্ঘ্য হল ভালবাসা, এই ভালো বাসাই মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণের সঞ্চার করে তাকে চিন্ময়ী করে তোলেন। তাই এই সর্বশক্তিমান ভালোবাসা দীর্ঘজীবী হোক এটাই হোক পূজার প্রার্থনা।

