বিবি'র উড়ান
বিবি'র উড়ান


মালিনী, শালিনী আর অভিনিবেশ তিনজনেই একেবারে তৈরী হয়ে নীচে নামলো। মলি, শালু আর অভি...... ওরা জ্যেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন। আজও সবাই এক বাড়ীতে, এক পরিবারে, এমনকি এক অন্নে। আজ ওদের তিন ভাইবোনের ব্যস্ততা একেবারে তুঙ্গে।
সকালের চা-জলখাবার ওরা সকালে একসাথেই খায়। টেবিলের একপ্রান্তে ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন ওদের ঠাম্মি। ঠাম্মি নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটি টেনে বসবার আগেই মলি, শালু, অভি তিনজনই ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে হামি খেলো ঠাম্মির দু'গালে.... সেই একদম ছোট্টবেলার মতো। ঠাম্মি স্মৃতিরেখা দেবীর চোখের জল আজ বাঁধভাঙা। মলি যত্ন করে ঠাম্মির দু'চোখ মুছিয়ে ঠাম্মির মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে কপট রাগের গলায় বললো, "ঠাম্মি, আবার? তুমি এমনি করলে আমাদের কষ্ট হয় না বুঝি?" এবার সমস্বরে শালু আর অভি, "হ্যাঁ তো, ঠাম্মি, প্লিজ এরকম কোরো না। আমরা আছি তো!"
এতক্ষণ ওদের তিনজনের মা নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে চা-জলখাবার সাজাচ্ছিলো। এবার প্রায় একসঙ্গেই দু'জনেই বলে উঠলো, "দেরী হয়ে যাচ্ছে তো, চাটাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, নে নে বাবা, চট করে শুরু কর তো এবার!" বিভা শাশুড়ির সামনে চায়ের কাপটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "মা, মিষ্টি ঠিক আছে তো? নাকি বেশী হোলো? দেখুন না মা, একচুমুক দিয়ে!" বিম্ব ততক্ষণে মলি, শালু অভিকে চা দিয়ে দিয়েছে। তিনজনই এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, "এই রে, লেট লেট", করে খাওয়া শুরু করলো। এমনিতেই টেনশন, এতোবড়ো একটা প্রজেক্ট লঞ্চিং, তার ওপর আবার লেট হয়ে গেলো। শালু ফোন করে ড্রাইভারকে বলে দিলো, গাড়ি বের করে ফুলট্যাঙ্ক করে নিতে।
কোনোরকমে তাড়াহুড়োয় খাওয়া শেষ করে তিনজনই স্মৃতিরেখা দেবীর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে আর বিভা বিম্বকে জড়িয়ে তারপর প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো, অফিসের উদ্দেশ্যে। আসলে আজ ওরা যাবে অফিস ছুঁয়েই সোজা একেবারে সাইটে। পুরো টিম ওখানে পৌঁছে যাবে আগেই, ওরা গিয়ে পৌঁছলে পাইলট প্রজেক্ট অ্যানালিসিস শুরু হবে। এটা ওদের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আর বৃহত্তম প্রজেক্ট হতে চলেছে...... ওদের বিবি গ্রুপ অফ কোম্পানিজের মুকুটে নতুন পালক...... ফাইভ স্টার হোটেল "শুভক্ষণ"।
অফিসে ছোট্ট একটা মিটিং সেরে তিন ভাইবোন বেরিয়ে পড়েছে। ওদের গাড়িতে ওরা তিনজন ছাড়া আছে প্রজেক্ট ইনচার্জ আর্কিটেক্ট সুহানী শ্রীবাস্তব। জন্ম কর্ম কোলকাতাতেই মেয়েটির, তাছাড়া সুহানী অভির ক্লাসমেটও বটে। ঝরঝরে বাংলা বলে। কাজের কথার মাঝেই, সুহানীই মনে করালো, "দুর্গা পুজোর আর ঠিক দশদিন, তিনদিন পরে মহালয়া।"
শালু, মলি, অভি তিন ভাইবোনের বুকের ভেতরটাই যেন মুচড়ে উঠলো। কতবছর, সত্যিই অনেকগুলো বছর ওদের আর দুর্গাপুজোর আনন্দ উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। ওদের বাড়ীর ঠিক লাগোয়া মাঠটায় অনেক অনেক বছর আগে খুব ধূমধাম করে দুর্গাপুজো হোতো, এখন আর হয় না পুজোটা, এমনকি ওদের পাড়ায় ওই একটাই পুজো হোতো। এখন পাড়ার সবাই ওদের পাশের পাড়ার পুজোটায় যায়। পাড়ার পুজোটা বন্ধ হওয়ায় জন্যই পুজোর তরঙ্গটা ওদের মধ্যে আর তেমন করে কোনো অনুভূতি জাগায় না। যদিও কোলকাতা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভুলে থাকতে চাইলেও ঠিক দুর্গাপুজোকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়, তবুও ওরা কাজের চাপেই থাকে। বহুবছর ধরে পুজোর ছুটিটায় ঘরেই, বা কখনো কাছেপিঠে কোথাও কাটাতে যায় সপরিবারে। পুজোর কথাটা বলে ফেলেই সুহানী একদম চুপ করে গেলো, ভাবলো এই কাজের চাপের মাঝখানে কথাটা এখন এভাবে বলা বোধহয় ঠিক হয় নি।
******
সাইটের কাজকর্ম ঠিকঠাক মিটেছে খুব সুন্দর ভাবে। তিন ভাইবোনই ভীষণ খুশী। ফেরার পথে সুহানী ওদের সাথে নেই, ও অফিসের টিমের সাথে অন্য গাড়িটাতে ফিরেছে। সুতরাং ওদের তিন ভাইবোনের মধ্যে খোলামেলা কথা বলায় কোনো জড়তা নেই। প্রজেক্ট, হোটেলের ফিউচার ব্রাঞ্চ এইসব নিয়ে কথা বলতে বলতে, হঠাৎই অভি বলে উঠলো, "আচ্ছা দিদিভাই, পাড়ার পুজোটা আবার শুরু করলে কেমন হয় রে?" মলি শালু দু'জনেই প্রায় একসাথে, "না না, মা আর ঠাম্মি....." ওদের শেষ করতে দিলো না অভি, "দিদিভাই, আর কেউ কখনো বিবি'র উড়ান থামাতে পারবে না রে, আমরা আছি কি করতে? হাতে দশটা দিন সময় যথেষ্ট!"
অভি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো, "কুমোরটুলি চলো।"
********
রাত প্রায় সাড়ে দশটা, এখনো তিন ভাইবোন ফেরে নি, এমনকি ফোনও করে নি। বাড়িতে বলা আছে কাজের চাপে কোথায় কিভাবে থাকে না থাকে, তাই খুব প্রয়োজন হলে যেন শুধু হোয়াটসঅ্যাপেই মেসেজ করে রাখে। ফোন রিসিভ করা সবসময় সব পরিস্থিতিতে সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু আজ সন্ধ্যের পর থেকেই সব ক'টা মেসেজই আনসিন হয়ে পড়ে রয়েছে। বিভা বিম্বর বুকের ভেতরটা কেমন যেন থম ধরে রয়েছে। নতুন প্রজেক্ট নতুন জায়গায়, সব ঠিকঠাক আছে তো?
স্মৃতিরেখাদেবী দশমিনিট পরপরই জানতে চাইছেন, নাতি-নাতনিরা মেসেজ করেছে কিনা, ফিরতে দেরী হচ্ছে কেন? ইত্যাদি। এবার পরিবারটির সাথে একটু কয়েক বছর পিছনে গিয়ে পরিচয় করা যাক।
বিনয়ভূষণ চৌধুরী, ভাগ্যান্বেষণে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ব্যস্ত সমস্ত শহর কোলকাতায় এসেছিলেন বছর ষোলো বয়সে। সঙ্গে সম্বল বলতে আসার সময় বিধবা মায়ের দেওয়া দু'গাছি সোনার সরু বালা আর একছড়া সোনার বিছেহার। শত অভাবেও বিনয়ভূষণের মা ঐ গয়নাগুলি হাতছাড়া করেন নি, বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ছেলের বৌয়ের আর নাতি পুতিদের মুখ দেখে আশীর্বাদ করবেন বলে। কিন্তু আর তো দিন কাটে না, এবার তো কিছু করতেই হয়। চোখভরা জল নিয়ে ছেলের হাতে ঐ গয়নাগুলি তুলে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, "তুমি রোজগার করে এগুলো আবার গড়িয়ে নিও, তোমার বৌ ছেলেপুলের জন্য। আপাতত এগুলি দিয়ে কিছু রোজগারের বন্দোবস্ত করো, কোলকাতা যাও। শুনেছি ওখানে টাকা ওড়ে, শুধু ধরতে জানতে হয়!" সেই মায়ের আশীর্বাদ মাথায় করে বিনয়ভূষণের কোলকাতা শহরটার বুকে পা রাখা। তারপর এগলি সেগলি, ভালো মন্দ, চড়াই উৎরাই, আলো অন্ধকার অনেক পথ পেরিয়ে, ধীরেধীরে থিতু হলেন জমি-বাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায়। অল্প দিনেই বিনয়ভূষণের পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের জোরে দু'টো পয়সার মুখ দেখতে পেলেন, কিন্তু সেই সুখের দিনটুকু দেখার জন্য তাঁর মা আর ছিলেন না। একমাত্র ছেলেকে একেবারে একলা করে দিয়ে তিনি চোখ বুজেছিলেন ততদিনে, চিরকালের জন্য।
এর কয়েক বছর পরে বিনয়ভূষণ বন্ধু দু-একজনের সহায়তায় সংসারী হলেন, গরীব বিধবা মায়ের মেয়ে বছর বিশের স্মৃতিরেখাকে বিয়ে করে। তখন অবশ্য বিনয়ভূষণ নিজে ছিলেন চল্লিশের কাছাকাছি। তবুও সংসার করতে কোনো অসুবিধা হয় নি। বিয়ের বছর দুইয়ের মাথায় বিনয়ভূষণ ও স্মৃতিরেখা প্রথমবার বাবা মা হলেন, যমজ দুই ছেলে..... বিমলেন্দু ও বিকাশেন্দু জন্মালো তাঁদের ঘরে। এরপরে তাঁদের আর কোনো সন্তানাদি হয় নি। আর ছেলেদের জন্মের পরে বিনয়ভূষণের ব্যবসা আরো ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো। নিজের নতুন কোম্পানি হোলো জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের, ছেলেদের নামে.... "বিবি ডেভেলপিং অ্যান্ড প্রোমোটিং কোম্পানি"। রমরমা ব্যবসা, মেধাবী দুই ছেলে, লক্ষ্মীমন্ত বৌ নিয়ে সুন্দর সুখী ভরা সংসার বিনয়ভূষণের। ছেলেরা দু'জনেই আর্কিটেকচার পড়ে বাবার ব্যবসা "বিবি ডেভেলপিং অ্যান্ড প্রোমোটিং কোম্পানিকে" অনেক বড়ো করে তুললো আর গড়ে উঠলো, "বিবি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ"।
এরপর ছেলেদের বিয়ে। বিয়েতে দাবিদাওয়া কিছু নেই বিনয়ভূষণবাবু এবং স্মৃতিরেখা দেবীর। কেবল যমজ বোনেরাই পাত্রী হতে পারবে, আর তাদের নামের আদ্যক্ষরও "ব" মানে ইংরেজি "বি" দিয়ে হতে হবে। অনেক সন্ধানের পর মিললো তেমন পাত্রীই। বিভাবতী ও বিম্ববতী, যমজ দুই বোন, বিয়ে হয়ে যমজ দুই ভাই বিমলেন্দু ও বিকাশেন্দুর ঘরণী হয়ে এলো। বিমলেন্দু ও বিভার যমজ দুই মেয়ে মালিনী ও শালিনী, আর বিকাশেন্দু ও বিম্ববতীর একটিই মাত্র ছেলে অভিনিবেশ। ভরভরন্ত সংসার রেখে মারা যাবার সময় বিনয়ভূষণ অভিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "তুমি আমার নিয়ম ভাঙা দাদুভাই, কখনো কোনো বাধায় পড়লে ভেঙে এগিয়ে যেও।"
তারপর কালের গতিতে স্মৃতিরেখাদেবীকে জড়িয়ে সংসার চলতে লাগলো উর্দ্ধমুখী। ছেলেরা কোম্পানি আরো বড়ো করেছে, হোটেল ব্যবসায় ঢুকতে চাইছে তখন, সব ফাইনাল হয়ে গেছে। কোজাগরী পূর্ণিমায় "বিবি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ" উদ্বোধন করবে নতুন প্রজেক্ট..... ফাইভস্টার হোটেল "শুভক্ষণ"! কিন্তু বিধি বাম হোলো। ওহ্, কী মর্মান্তিক! কোজাগরী পূর্ণিমার ঠিক সাতদিন আগে স্মৃতিরেখাদেবীর জীবনে ঘটে গেলো ভূমিকম্প। সব ভেঙে চুরমার।
মলি, শালু, অভি.... তখনো দশ পেরোয় নি। একটা ভয়ঙ্কর ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিলো ওদের জীবন, ওদের মায়েদের জীবন, ওদের আদরের ঠাম্মি স্মৃতিরেখাদেবীর জীবন।
জমি-বাড়ি ডেভেলপিং প্রোমোটিং, এইসব ব্যবসায় বরাবরই বড়ো রেষারেষি, মারামারি, রক্তারক্তি.... শেষ পর্যন্ত খুনোখুনি লেগেই আছে। স্মৃতিরেখাদেবী এসব দেখেছেন স্বামীর সময় থেকেই, তবে স্বামী বিনয়ভূষণ অত্যন্ত নির্বিবাদী ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ছিলেন। এসব ঝঞ্ঝাটের আভাস পাওয়া মাত্র তিনি সরে আসতেন সেই জায়গা থেকে। ছেলেদেরকেও সেই উপদেশই দিয়ে গেছেন। ছেলেরা মেনেও চলে বাবার কথা, তবু এই হোটেলটা তৈরীর জন্য দুই ভাই একদম উঠে পড়ে লেগেছিলো, আর প্রচুর শত্রুও তৈরী হয়ে গেলো তার ফলে। প্রচুর চাপ, হুমকি সব সামলে যখন প্রজেক্ট "হোটেল শুভক্ষণ" লঞ্চ হবার ঠিক মুখে, তখনই ঘটলো ঐ ভয়াবহ দুর্বিপাক।
বিমলেন্দু ও বিকাশেন্দু, দুই ভাই সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিচ্ছে। বাড়ির পাশেই লাগোয়া দুর্গাপুজো, সমস্ত আর্থিক দায়ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছিলো বিমলেন্দু ও বিকাশেন্দু। মাদুর্গার কাছে তাদের প্রার্থণা ছিলো, "মাগো, আমাদের সংসার এমনিই ভরিয়ে রেখো, যেন আগামীদিনে আরো ভালো করে তোমার পূজার্চনা করতে পারি।" অঞ্জলি দেওয়া আর শেষ হোলো না। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে দুইভাই খুন হয়ে গেলো। দিনে দুপুরে, দুর্গাপুজো চলাকালীন মায়ের মহাষ্টমীর অঞ্জলি প্রদানের সময়। গুলির কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় নি, সাইলেন্সার লাগানো ছিলো গুলি করার সময়। চোখ বন্ধ করে সবাই মায়ের আরাধনা করছে। হঠাৎই বিমলেন্দু আর বিকাশেন্দুর দেহ কাটা কলাগাছের মতো ধড়াস করে পড়লো মুখ থুবড়ে। সাদা পাঞ্জাবি লালে ছুপিয়ে উঠেছে, স্ত্রীদের ঘিয়ে গরদে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের ছিট। হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। কতকদূরে গিয়েই দুই ভাড়াটে খুনি ধরাও পড়েছে। কিন্তু চিরকালের মতো স্মৃতিরেখাদেবীর কোল খালি হয়েছে, বিভা-বিম্বর সিঁথি খালি হয়েছে আর মলি, শালু, অভির বুকে বাবার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটা খালি হয়ে গেছে। আর এর পর থেকে পাড়ার একমাত্র দুর্গাপুজোর মণ্ডপটিও খালি পড়ে থেকেছে শারদোৎসবে।
*********
আর ভাবতে পারছেন না স্মৃতিরেখা দেবী। অধৈর্য্য হয়ে ছটফট করছেন। দেওয়াল ঘড়িটায় ঢঙঢঙ করে এগারোটা বাজলো, আর গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকার আওয়াজ পেলেন স্মৃতিরেখাদেবী। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নাতি-নাতনিদের মুখ দেখে তবে স্বস্তি শান্তি স্মৃতিরেখাদেবীর। এই এতোগুলো বছর ধরে আতঙ্কিত থাকেন। ছেলেরা যাবার পরে কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েই কোনোরকমে ব্যবসা চালিয়েছেন স্মৃতিরেখাদেবী, বিভা বিম্ব দুইবৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে, ঘরে বসেই। নাতি-নাতনিরাও আর্কিটেকচার পড়েই নিজেদের ব্যবসার হাল নিজেদের হাতে ধরেছে, তাও বেশ ক'বছর হোলো।
*********
বিভা ও বিম্ব সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেরাও বসলো। সারাদিনের কাজের টুকিটাকি দু-চারটে মামুলি কথাবার্তার পরেই অভি বললো, "ঠাম্মি, এবার থেকে আবার পাড়ার দুর্গাপুজোটা শুরু করছি।" "না-আ-আ-আ" করে আর্তনাদ করে উঠলেন স্মৃতিরেখাদেবী। ওনার দু'চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে। অভি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে, ঠাম্মির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, "কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে ঠাম্মি, তোমার কষ্ট আমরা জানি। তাহলে ঠাম্মি, আমরা তোমার কেউ নই বলো? কুড়ি বছর আগে যারা চলে গেছে দুর্ঘটনায়, তাদের জন্য আমাদের কষ্ট হয় না?"
নাতির বুকে মাথা রেখে ডুকরে উঠলেন আবার স্মৃতিরেখাদেবী। অভি ঠাম্মিকে বুকে জড়িয়ে রেখেই বললো, "সারা দেশ আনন্দ করে পুজোয়, আর আমরা শোকপালন করি, কারণ আমাদের পরিবারে এটা শোকেরই দিন। তবু একবার ভাবো, যারা দোষী তারা শাস্তি পেয়েছে। একবার এইভাবে ভাবো, হয়তো মাদুর্গার পুজো চলাকালীন মায়ের সামনে ওই ঘটনা ঘটার জন্যই হয়তো খুনি দু'টো হাতেনাতে ধরা পড়েছে, বিচারে চরম শাস্তিও পেয়েছে! বাবা জ্যেঠু সবসময় বাইরে বাইরেই কাজের জন্য কত রাত বিরাতে ঘুরে বেড়াতো, কত দূরে দূরে যেতো। যদি অন্য কোথাও খুন হয়ে পড়ে থাকতো, তবে কী করার ছিলো বলো? কেউ হয়তো জানতেই পেতো না, গুম হয়ে যেতো ডেডবডি। খুনিরা হয়তো ধরাই পড়তো না। তবে তোমার রাগ মা দুর্গার ওপরে কেন ঠাম্মি? একটু ভাবো তো ঠাম্মি!"
স্মৃতিরেখাদেবীর কান্নার বেগ কমেছে, আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, "অভির দাদুভাইয়ের কথা মনে পড়ছে রে, দাদুভাই বলেই গেছিলেন, নাতি আমাদের নিয়ম ভাঙবে, সব বাধা ভাঙবে।" অভি তখনো জড়িয়ে রয়েছে ঠাম্মিকে, তারপর আস্তে আস্তে বললো, "ঠাম্মি, আরেকটু নিয়ম ভাঙি? দিদিরা বিয়ে করবে কিনা ওরা জানে, আমি আমার ব্যাপারটা ফিক্স করে নিই। একটা অবাঙালী নাতবৌ আনবো তোমার জন্য, আসলে আমি ভেবে দেখেছি যে তোমার নিরামিষ রান্না তো মাঝে মাঝেই বাড়তি হয়ে যায়। তা সেটা খাওয়ার জন্য একটা পার্মানেন্ট লোক আনছি, সুহানী শ্রীবাস্তব নিরামিষভোজীকে।"
মলি আর শালু হাই-ফাইভ করে হাতে হাতে তালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "মা, মাম্মাম, ঠাম্মি, বলেছিলাম কিনা?" অভি এবার মাথা চুলকোতে চুলকোতে অপ্রস্তুতের একশেষ। মলি শালু হাসতে হাসতেই বললো, "ইয়ে সব মামলে মে আভি তুম বহোত কাচ্চা হো, বাচ্চু!"
হাসিতে মজায়, পুজো পরিকল্পনায় "বিবি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ"এর মালিক চৌধুরী বাড়িতে অনেক অনেকদিন পরে খুশির ঢল নেমেছে।
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পাড়ার দুর্গাপুজোর আয়োজন সম্পূর্ণ, কুড়ি বছর বাদে পাড়ায় আবার দুর্গাপুজো। পাড়ার সবাই খুব খুশি, অভির বিচার বুদ্ধির ওপর নতুন করে জন্মেছে সবার বাড়তি ভরসা।
মহাষ্টমীর অঞ্জলি দেবার সময়ে অভি ঠাম্মিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে দুর্গামায়ের পুজোর প্যান্ডেলে। খানিকক্ষণ পরে বিভা আর বিম্ব ধরে ধরে তিনজন কলাবউয়ের মতোই শাড়ি জড়ানো মেয়েকে নিয়ে আসছে.... মলি, শালু আর সুহানী জীবনে প্রথম শাড়ি পরে হোঁচট খেতে খেতে আসছে অঞ্জলি দিতে। বিভা বিম্ব এতোক্ষণ অতি কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলো, কিন্তু বহুকাল বাদে স্মৃতিরেখাদেবী ওদের তিনজনের অবস্থা দেখে হা হা করে হেসে ফেললেন।
পুরোহিত মশাই এসে স্মৃতিরেখাদেবীকে ডেকে নিয়ে গেলেন মায়ের মূর্তির সামনে, "আসুন মা, আপনার নাতি বলেছে যে ঠাম্মির নামে পুজোর সঙ্কল্পটা করে ওদের মা-মেয়ের মান-অভিমানটা মিটিয়ে দিন তো ঠাকুরমশাই।" ঢাকের বোলে আর কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে সব আওয়াজ চাপা পড়েছে তখন। শোনা যাচ্ছে কেবল চণ্ডীপাঠের স্তোত্র, "যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ............"
ভোগারতির পরে ঘোষণা সকলের ভোগগ্রহণের, আর তার সঙ্গে স্লোগান, "বিবি'র উড়ান থামে নি, থামবে না...." পাড়ার সবাই গলা মিলিয়েছে তখন একসাথে।