Sreyashee Roy

Drama

3  

Sreyashee Roy

Drama

ভূমি

ভূমি

3 mins
6.5K


আমার একটা ভীষণ উজ্জ্বল বাস্তব ছিল;তবে আমার এই কঠিন অস্তিত্বটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে যদি কোনোদিন বিপন্ন হয় আমিই হয়তো তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো জানেন...ধরার বুকে প্রকৃতিপ্রদত্ত আর পাঁচটা প্রাণ যেমন স্বানন্দে বসবাস করে আমিও ঠিক তেমনি প্রাণবন্ত ছিলাম...

জানেন বাবু এককালে কত ফুলগাছকে আশ্রয় দিয়েছি;গঙ্গা আর পদ্মার পবিত্র জলের মতো এখনো আমার কাছে সবটুকু ভীষণ স্পষ্ট...প্রতিদিন ভোরে আমি চোখ মেলে দেখতাম ফাজহারের ধ্বনি আর গীতার স্তোত্রপাঠের সমাগম ঘটছে আকাশে;আমার এত শান্তি দেখে সূর্যদেবও অলক্ষ্যে হাসতেন হয়তো... আমি শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম রহিম চাচাজান আর নিবারণ কাকার লাঙ্গলদুটো কিভাবে প্রতিবার একই মুহূর্তে ভূমি স্পর্শ করে;নবান্ন উৎসবে ভীষণ আনন্দ করতাম আমরা সবাই আবার অতিবৃষ্টিতে ধান পঁচে যাওয়ায় সবার মুখে চিন্তার ছায়াটাও একই ভঙ্গীতে ফুঁটে উঠতো...প্রতিদিন যেমন ঘোষবাবুদের গরুর দুধ না খেলে বিশু পালোয়ানের শরীরে শক্তি আসতো না তেমনি ঘুড়ির লড়াইয়ে রায়বাড়ির ছেলে সুধীরের ঘুড়িগুলো তার আব্দুল ভাইয়ের দেওয়া মাঞ্জা আর লাটাই ছাড়া অসুম্পর্ণ ছিল;জমিদারবাড়ির দুর্গাদালানে অষ্টমীর দিন ডাক্তারের বোন সুহাসীনিকে দেখে চোখ ফেরাতে না পেরে অঞ্জলীর মন্ত্রে ভুল করে ফেলছিলো বারেবারে গ্রামের তরুণ মাষ্টারমশাই অনিমেষ চাটুজ্জে;আমি দেখে মিটিমিটি হেসেছিলাম শুধু...কোনো এক এরকম গোধূলি লগ্নে হয়তো যখন আজানের সুর এসে বিশ্বনাথ মন্দিরের ঘন্টা স্পর্শ করেছিল দীঘির পাড়ে তখন নায়েবের ছোটোছেলে দেবেন্দ্র আর দর্জি রহমত খলিফার মেয়ে সাহেনাজ পরস্পরকে ভালোবেসে আজীবন একসাথে বাঁচার প্রতিজ্ঞা করেছিল;ছোট্ট মানিক তার প্রাণের বন্ধু ইমরানকে নিজে হাতে নাড়ু না খাওয়ানো পর্যন্ত লক্ষ্মী পুজোর একটা নাড়ুও মুখে তুলতো না কোনোদিন;আর আমি?...আমি এভাবেই সকলকে স্মৃতিতে জড়িয়ে রাখতে আর নতুন স্মৃতি নির্মাণের অপেক্ষায় থাকতে বড়ো ভালোবাসতাম;তখন তো জানতামই না একটা কোনো ঝড় আমার রূপ সম্পূর্ণ বদলে দেবে;আসলে ভীষণ সাদাসিধে ছিলাম তো তাই হয়তো আর আমাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোও সরল ছিল বড্ডো;ঝড়ের পূর্বাভাসটাও পায়নি অথবা আমাকে অক্ষত রাখার জন্য কী করা দরকার সে বিবেচনা ঠিক করে উঠতে পারেনি হয়তো...

হঠাৎ একদিন কোটপ্যান্ট পরা কতগুলো বাবু এসে খাতাকলমে কী ভীষণ শলাপরামর্শ করলো তারপর থেকেই দেখতাম দীঘি আবীররঙা লালে সাজতো প্রতিদিন;জমিদার বাড়ির বেতার যন্ত্র থেকে মাঝে মধ্যেই উড়ো ভাষণ আসতো...অনেকে বলতো 'দেশটা এবার স্বাধীন হবে';দেশটা বদলালো বটে বাবু ভীষণ বদলে গেলো...ঘুড়ির লড়াই ছেড়ে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই তখন রক্তের লড়াইয়ে মাতলো;কিন্তু তাজ্জবের ব্যাপার এই যে আমার গায়ে যে সকল মানুষের রক্তের ছিঁটে ছিটকে পড়েছিল তার শুধু একটাই রং দেখেছিলাম যে আমি-'লাল'...কেউ বোঝলো না সেটা বুঝবে কীকরে তখন তাদের শরীরে বদলে যাওয়ার পিপাসা ভর করেছিল যে;কিছু মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল আমাকে বাঁচানোর...শেষ রক্ষা হয়নি আমার...ওই নরমাংসলোলুপ পিশাচগুলো গিলে খেতে এলো আমায়...একটা একটা করে কাঁটাতারের ব্যাড়া বিঁধলো;মৃত্যুশয্যা সাজালো আমার...

আমি শুধু ফুঁসে উঠতে পারিনি বাবু আগুন হতে পারিনি সেদিন...

তারপর একদিন সবাই মাটি থেকে স্বাধীনতার মোহময় গন্ধ পেয়েছিলো নাকি কিন্তু আমি নিজের ক্ষত বিক্ষত শরীরটার থেকে শুধুই গোড়া চামড়ার বিদ্রুপাত্মক হাসির দুর্গন্ধ পেয়েছিলাম...আমার আপন বলতে শুধুই পড়ে রইলো চোখের জল আর ছিন্ন ভিন্ন একটা দুঃস্বপ্নময় বাস্তব...আমি কোথায় আর বাঁচার মতো করে বাঁচতে পারলাম বাবু!আমি মহাভারতের পিতামা ভীস্মর মতো ইচ্ছামৃত্যুর আশীর্বাদ পায়নি;পেলে হয়তো মন্দ হতো না অন্তত শান্তি পেতাম একটু...আমি যে তিলে তিলে মরছি প্রতিদিন;অশ্বত্থামার মতো অভিশপ্ত লাগে নিজেকে...

এখনের 'আমি'কে চিনতে পারিনা আর... ও পোষাক পরা বন্দুকধারী বাবুগুলো একটা আরজি রাখবেন আমার?কাঁটাতারের এপার আর ওপারে দাঁড়িয়ে যে সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছেন একবার পরস্পরের চোখের দিকে তাকান না;আপনারা যে আলাদা নন আপনারা এক আর আপনাদের মালিকদেরকে বলেন একটা ফুলগাছ শুধু পুঁতে দিয়ে যেতে এখানে এই কাঁটাতারগুলোর মাঝে;আমি আগলে রাখবো তাকে...আমি যে আবার আঁকড়ে থাকতে চাই;আমার সবটুকু ভীষণ আগলে রাখতে চাই...

আমার নাম জানতে চাইছেন?

আমার পরিচয়-

"আল্লাহ আমার প্রাণ

কৃষ্ণ আমাতে বিরাজমান

খ্রিষ্ট হৃদয়ে মোর

আমাতে সাধনা করে

তথাগত হয়েছিলেন অমর

সবই হয়তো ইতিহাস

যা আছে শুধুই বারুদ আর রক্তে লেখা কিছু দীর্ঘশ্বাস"

(সত্যিই কী মাটির কোনো ভাষা নেই;তার প্রাণ আছে!সুখ-দুঃখ,ভালোবাসা-মন্দবাসা, স্মৃতি, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন সবকিছুই আছে...আমরা মানবজাতি আর বুঝলাম কোথায় তার আবেগগুলো!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama