Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

ভুলের মাশুল

ভুলের মাশুল

5 mins
922


প্রবাদ আছে - Morning shows the day. জীবনের ক্ষেত্রে এটা বেশীর ভাগ সময় মিলে যায়, অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। মাকে হারিয়েছি সেই কোন ছোট বেলায়। এরপর বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। সৎ মায়ের সংসারে অন্যান্য ভাই বোনদের সাথে বেড়ে উঠি কিছুটা অযত্নে আর অবহেলায়। হয়ত মনে একটা ভালোবাসার অভাব বোধ ছিল বোধহয় , তাই হুট করেই প্রেম আসে আমার জীবনে। আমি ভালোবেসে ফেলি আমার বন্ধু রবিকে। আর পাঁচজন সাধারণ মেয়ের মত আমিও সুখের সংসার সাজাতে চেয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটার হাতটা আঁকড়ে ধরে। যেখানে প্রাচুর্য না থাকুক, অফুরন্ত ভালোবাসা থাকবে যা আমাদের সব দৈন্য দূর করে ভালোবাসার স্বর্গ তৈরী হবে।বিয়েও করেছিলাম সেই আমার ভালোবাসার মানুষটাকে।


ভালোবাসলে নাকি তাকে জীবনে পেতে হয়। আর না পেলেই শুরু হয়ে যায় ব্যর্থতার গল্প গুলো। কেউ কাউকে ছেড়ে চলে গেলে বা অন্যত্র বিয়ে করলে শুরু হয়ে যায় একপক্ষীয়ভাবে তাকে দোষারোপ করা। কিন্তু কেউ কারো অপারগতা মানতে বা বুঝতে রাজী নয়। আসলে ব্যাপারটা হল দুটো মানুষের ভিতরকার রসায়ন যদি একে অন্যের পরিপূরক না হয় তাহলে জীবনটা আর স্বর্গ হয়ে ওঠে না, বরং নরক হয়ে যায়।যাই হোক কথায় আছে ভালোবাসার মানুষটাকে জীবনে পেলে নাকি তখন ভালোবাসাটা আর থাকে না। থাকে শুধু সেই মানুষ টা। কি লাভ সেই মানুষটা থেকে। একসময় সেই ভালোবাসাহীন মানুষটা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠে। আমার জীবনে ও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। বড্ড ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম রবিকে। রবি একটা ভালো চাকরীও করে। তার পরিবারও মোটামুটি স্বচ্ছল। কিন্তু মা মরা দুর্ভাগা এই আমাকে তার পরিবার প্রথম থেকেই অবজ্ঞা করতে থাকে। নতুন বৌ হিসেবে রবি আমাকে তার মা বাবার কাছে রেখে সে তার কর্মস্থলে চলে যায়।


রবির মা বাবাকে কখনো পর ভাবিনি, হয়ত ছোট বেলার থেকে না পাওয়া স্নেহ ভালোবাসার অভাব পূরণ করার জন্য আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরতে গেছি । আপন ভেবে… সমস্ত সংসারের কাজ নিজ হাতে করতাম। কার কখন কি প্রয়োজন সব সামলে নিতাম। বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা একটা সংসারে কি এমন কাজ নেই সব নিজ হাতেই করতাম। কাজ করতে কোন ক্লান্তি আসতো না। ভাবতাম আমার নিজেরই তো সংসার। নিজের পরিবার। রবির মা বাবা কি আমার মা বাবা নয়। তাদেরকে আপন করে নিতে যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। তারা আমায় আপন ভাবতে পারে নি। পরের মেয়েকে আপন করে নিতে তাদের রাজ্যের দ্বিধা ছিলো। কারণে অকারণে, উঠতে বসতে খোঁটা দিতো। কি করে তাদের সোনার টুকরা ছেলেকে বশ করলাম।


কেনই বা তার গলায় ঝুলে পড়েছি। কেন আমার বাবা মোটা অংকের যৌতুক দেয় নি। ভরি ভরি অলংকার গড়িয়ে দেয় নি। বলতাম বাবার যা সামর্থ্য ছিলো তাইতো দিয়েছো। আরো অনেক কিছুই দেবে বলেছে আস্তে আস্তে। কিন্তু তারা সেসব কথায় কান না দিয়ে যা তা ব্যবহার করতো আমার সাথে। আমাকে খালি হাতে বিদায় করার জন্যই নাকি রবির পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। সব শুনতাম.. আর কান্নাকাটি করতাম। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। মনের কথা বলার মত কেউ ছিলো না। তাই নিজে কেঁদে আবার নিজেই উঠে গিয়ে সংসারের কাজে মন দিতাম। রবি যখন বাড়ীতে দুই একদিনের জন্য আসতো এসব বলে ঝামেলা বাড়াতে চাইতাম না। কিন্তু… যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। রবিকে সব বললাম।


রবি তার মা বাবাকে বুঝিয়ে বললো। তারা যেন এরকম ব্যবহার না করে আমার সাথে। রবি যতদিন বাড়ীতে থাকতো তারা আমার সাথে ভালো ব্যবহারই করতেন কিন্তু রবি চলে যাওয়ার পর তাদের পূর্বের আচরণ শুরু হতো। এর মাঝেই আমি গর্ভবতী হলাম। তাদের কাছে কখনোই ভালো ব্যবহার পাই নি। রবিটাও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মা বাবার সাথে সুর মিলিয়ে আমাকে কথা শোনায়। এতোদিন স্বামীর ভালোবাসা আমার মনের সব ক্ষতকে সারিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন রবির এসব আচরণ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত এসে হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করছে। রবি তো সব জেনে শুনেই আমাকে বিয়ে করেছে। তবে কেন এখন এসব কথা। এরপর প্রায়ই রবি আমার গায়ে হাত তুলতে থাকে। একজন মানুষকে যতটা শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা দেয়া যায়, ততটাই করতে থাকে সবাই মিলে।


অসুস্থ শরীর নিয়ে পুরো সংসারের কাজ করা তার উপর সবার কটু কথা জীবনটাকে যেন বিষিয়ে তুলেছিলো। তারপরও পেটের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছিলাম। আমার কোল জুড়ে আমার একটা ছোট্ট মা মনি এলো। এতেও সবাই অখুশি। ছেলে হলো না কেন? দায়টা যেন আমারই । মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। সংসারে খাচ্ছি, থাকছি এটাই যেন বিরাট কিছু। সবাই যেন আমাদের দুইজনের উপর করুণা করছে। রবিটা পুরোপুরি পালটে গেছে। ঠিকমত খোঁজ খবর নেয় না। নয় মাসে, ছয়মাসে একবার বাড়ী আসে। সে আসলেই তার বাবা মা রাজ্যের অভিযোগের ভান্ডার খুলে বসেন। রবির অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। রবির অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকে। হায়রে আমার ভালোবাসা!!!


দাম্পত্যের এই রূপ দেখলে ভালোবাসাও স্বয়ং লজ্জায় মুখ লুকোবে। কিছুদিন পর খবর পেলাম রবির কর্মস্থলে এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। বিয়েও করতে চলেছে। শুনে কাঁদলাম। ছোট্ট সোনামণিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাঁদলাম। বাবাকে ডেকে আগের অত্যাচার আর এখনকার ঘটনা সব কিছুই জানালাম। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। শত হোক বাবার প্রথম সন্তান ছিলাম। সেই হিসেবে কিছুটা টান, মায়া তখনো অবশিষ্ট ছিলো। একদিন খবর পেলাম। আমার স্বামী তার সেই প্রেমিকা নামের মেয়েটিকে বিয়ে করে সুখে সংসার শুরু করেছেন শহরে। এটাই দেখার বাকী ছিলো।


লাত্থি মারতে ইচ্ছে করলো সেই ভালোবাসাকে, যে ভালোবাসা সময়ের সাথে ফুরিয়ে গিয়ে প্রয়োজন হয়ে যায়। সেই প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। জলে চোখ ভিজে উঠলো। মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। অনেক সহ্য করেছি এই সংসারে। একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ভেবে সব অত্যাচার অবিচার মেনে নিয়েছিলাম। তার পরিণতি আজ এই হলো। বাবার সংসারে এসে উঠলাম। দুই দিন পর রবি এলো। তার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হলো। এক পর্যায়ে তেড়ে এসে আমাকে অনেক মারলো। বাবা এসে থামালেন। তিনি রবিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আমার মেয়ে আর তোমার সংসার করবে না। রবি ফিরে গেলো। কেউ বুঝিয়ে আর কোন লাভ হলো না আমাদের।


আমার আর রবির ডিভোর্স হয়ে গেলো। এর মাস ছয়েক পরে একদিন আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলো। তারা সব জেনে শুনেই এলো। আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে। বিয়েটাও হয়ে গেলো। আমি আর অমত করিনি। আমার আর আমার মেয়ের জন্য একজন অভিভাবকের খুব প্রয়োজন ছিলো। যা হয়েছে ভালোর জন্য ই হয়েছে হয়তো। এই লোকটা খুবই ভালো। সংসার, আমার আর আমার মেয়ের খুব খেয়াল রাখেন। আমার খুব যত্ন নেন। আমাদের একটা ছেলেও হয়েছে। কানায় কানায় সুখে পরিপূর্ণ আমার এই সংসার। শুনেছি… রবির সেই সংসারটা টেকেনি। তাদের একটা মেয়েও হয়েছিলো। মেয়েটাকে ফেলে রবির স্ত্রী চলে গেছে।


রবি আবার বিয়ে করেছে। তবে সারাক্ষণই সংসারে অশান্তি। আমরা কখনো কখনো মানুষ চিনতে ভুল করি। ভুল মানুষকে ভালোবাসি। তবে সেই ভুলের মাশুল সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে সেই জীবন থেকে বিদায় নেয়াই শ্রেয়। হয়তো আরো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মাঝে মাঝে আমার স্বামীকে দেখে মনে হয় মানুষ কি করে এতোটা ভালো হতে পারে। আরেকবার ভুল করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব এই মানুষটা কে….

আসলে যতই ঝড় ঝাপটা জীবনে আসুক না কেন, শেষ অবধি জয় হয় সত্যের।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational