ভীষ্ম
ভীষ্ম
"পৃথিবী তার সুগন্ধ ত্যাগ করতে পারেন
জল তার মিষ্টতা ত্যাগ করতে পারেন
সূর্য্য তার উজ্জ্বলতা ত্যাগ করতে পারেন
চন্দ্রমা তার নমনীয়তা ত্যাগ করতে পারেন
এমনকি যমও তার ন্যায় ভুলতে পারেন
কিন্তু ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করতে পারেন না"
এমনই ছিল তার প্রতিজ্ঞার জোর। তার ভীষন প্রতিজ্ঞা। তাই তার আরেক নাম ভীষ্ম।
কর্তব্য প্রতিজ্ঞা আর বীরত্ব সাথে ক্ষত্রিয় ধর্ম রক্ষার এমন মেলবন্ধন আর কোথায় পাওয়া যাবে
নিঃসন্দেহে ভীষ্মর জীবন তার এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
ভীষন এক প্রতিজ্ঞা তাকে ভীষ্ম নাম দিয়েছিল।
সেই ভীষন প্রতিজ্ঞা তিনি সারাটা জীবন ভীষন ভাবেই পালন করেছিলেন
সন্দেহের অবকাশ কি...
মাতার পরিচয়েই তার পরিচিতি। তিনি বিখ্যাত আরেক নামে- গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম।
যে সে নন ভারতের পবিত্র পুন্যতোয়া পতিত পাবনী নদী গঙ্গাই হলেন ওনার মাতা।
ওনার জন্মের কাহিনীটিও বেশ রহস্যময়।
ভীষ্ম জন্ম কাহিনী:
**********************
একবার হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু দেখেন এক সুন্দরী কন্যাকে, তিনি সেই কন্যাকে স্ত্রী রূপে পেতে চাইলে সেই স্ত্রী বলেন তার কিছু শর্ত রয়েছে-
এক : তার পরিচয় জানার চেষ্টা করা যাবে না,
দুই :তার কোন কাজে বাধানিষেধ বা প্রশ্ন করা যাবে না।
সেই মুহুর্তে রাজা শান্তনু ছিলেন কন্যার প্রেমে অন্ধ
অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে তিনি সাথে সাথে কথা দেন, এরপরে তাদের বিবাহ হয়।
বিবাহের পরে একের পর এক সন্তানের জন্ম হয়
আর সেই কন্যা তার সন্তানকে নিয়ে কোথায় যেন চলে যান কিছুক্ষণ পরে ফেরেন কিন্তু সাথে তার থাকে না সন্তান।
শান্তনু খুব অবাক হন কন্যার এই অদ্ভুত ব্যবহারে।
কিন্তু শর্ত অনুযায়ী তিনি থাকেন চুপ।
এইভাবে পর পর বেশ কয়েকটি সন্তানের জন্ম হলে একদিন রাত্রে পিছু নেন শান্তনু দেখেন সেই কন্যা তার সন্তানকে নিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন
খুব মনকষ্টে রইলেন শান্তনু।
কিছু বলতেও পারছেন না। করা তো দূরের কথা।
শেষে যখন অষ্টম সন্তানের জন্ম হল সেই কন্যা আবার সন্তানকে নিয়ে প্রাসাদের বাইরে চললেন।
রাস্তায় পথ আটকালেন শান্তনু, বাধা দিলেন তিনি।
তখন সেই কন্যা পরিচয় দিলেন তিনি মানবী নন দেবী গঙ্গা। তিনি স্বয়ম বিষ্ণুর শরীর থেকে জন্ম নিয়েছেন
এই পৃথিবীতে তিনি বইছেন নদীরূপে।
আর এই সন্তানেরা হল অষ্টবসু অর্থাৎ আট দিকের অধিপতি।
অস্টবসুর কাহিনী:
অস্টবসুদের সবাই সস্ত্রীক নিমন্ত্রিত ছিলেন ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে। সেখানে ঋষি বশিষ্ঠ সবার যত্ন নেন তার নিজের কামধেনুর দ্বারা।
কামধেনু অর্থাৎ ইচ্ছে পূরণের গাভী। যা ইচ্ছে সাথে সাথে পূরণ করার ক্ষমতা রয়েছে এমন একটি সর্বলক্ষন যুক্ত সুন্দর গাভীকে বলা হয় কামধেনু।
সেখানে প্রভাস নামে এক অস্টবসুর স্ত্রীর খুব ভালো লেগে যায় কামধেনুটিকে। সে প্রভাসের কাছে অনুরূপ এক কামধেনুর বায়না করে।
প্রভাস তার বায়না পূর্ন করতে না পারলে বলেন তার স্ত্রী এই কামধেনুটিকে চুরি করার জন্য।
শেষে স্ত্রীর বায়না রাখতে প্রভাস বাকি সব বসুদের সাথে মিলে চুরি করেন কামধেনুটিকে।
কিন্তু বশিষ্ঠের কাছে কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে যায় তার কামধেনু কে চুরি করেছে...
ক্ষুব্ধ বশিষ্ঠ অভিশাপ দেন অস্টবসুর সবাইকে পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে আর প্রভাসকে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আসতে হবে।
অস্টবসু তখন তাদের জন্য উপযুক্ত গর্ভের সন্ধান করতে থাকেন শেষে দেখেন একমাত্র পতিত পাবনী গঙ্গা রয়েছেন তাদের জন্য উপযুক্ত, সেই অনুযায়ী গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করলে সম্মত হন গঙ্গা।
গঙ্গা তখন রাজা সুনন্দর কাছে তার স্ত্রী হবার আর্জি জানান। সুনন্দ বলেন তার সন্তানের স্ত্রী হবার জন্য। এরপরে শান্তনুর জন্ম হয়।
তারপর কি হল তা আগেই বলেছি....
এরপরে গঙ্গাদেবী তার কোলের সন্তানটিকে রাজা শান্তনুর হাতে তুলে দিয়ে বলেন-
এই সেই প্রভাস এখন যদিও আপনার সন্তান।
নিন আপনি পালন করুন। আমার কাজ ছিল এদের গর্ভে ধারণ করা। আমার কাজ শেষ আমি মুক্ত।
তবে অদৃশ্য হয়ে আমি সন্তানের রক্ষা পালন করব। প্রয়োজনে করব সহায়তা।
এরপর তিনি অদৃশ্য হলেন।
শান্তনু শিশুপুত্রটিকে কোলে নিয়ে ফেরেন প্রাসাদে।
পুত্র পালনে মন দেন তবে গঙ্গাদেবীকে পারেন না ভুলতে। রাজা পুত্রের নাম দিলেন দেবব্রত।
দেবব্রত'র শিক্ষা:
*******************
দেবব্রত একটু বড় হতেই একদিন এলেন গঙ্গাদেবী রাজার সামনে। তিনি নিয়ে গেলেন ছেলেকে, করলেন তার শিক্ষার ব্যবস্থা।
গঙ্গাদেবীর ব্যবস্থাপনায় শুরু হল দেবব্রত'র শিক্ষার্থী জীবন।
-প্রথমে তিনি শিখলেন দেবগুরু #বৃহস্পতি'র কাছে রাজার কর্তব্য ও আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ।
সাথে শিখলেন কিছু শাস্ত্র।
এরপরে
-এলেন বশিষ্ঠ তিনি শেখালেন বেদ
আর
-ঋষি চ্যাবন শেখালেন বেদাঙ্গ
-ব্রহ্মাদেবের পুত্র সনতকুমারের কাছে শিখলেন মনোবিজ্ঞান ও দৈববিজ্ঞান।
-ঋষি মার্কণ্ডেয় শেখালেন জাতির কর্তব্য ও শৈব বিজ্ঞান
-শিখলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য'র কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শাস্ত্র।
-বিষ্ণু অবতার পরশুরামের কাছে শিখলেন রুদ্রাস্ত্র প্রয়োগ সমেত অন্যান্য অস্ত্রশিক্ষা।
-দেবরাজ ইন্দ্র শেখালেন বিভিন্ন দৈব অস্ত্রের প্রয়োগ ও শিক্ষা।
সমস্ত শাস্ত্র অস্ত্র সস্ত্র শিক্ষা শেষ হলে গঙ্গাদেবী ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন দেবব্রত'কে তার পিতার কাছে।
তিনি হলেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ।
তার শৌর্য্যে বীর্য্যে খুব তাড়াতাড়ি তিনি প্রজাদের খুব কাছের পছন্দের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন।
ভীষন প্রতিজ্ঞা গ্রহন:
***********************
এদিকে রাজা শান্তনু প্রেমে পড়েছেন সত্যবতী'র। সত্যবতী ছিলেন জেলে কন্যা। শান্তনু রাজা সত্যবতী'র পিতা দাসরাজের কাছে পাঠালেন দূত।
কিন্তু দাসরাজ বলে পাঠালেন যদি তার কন্যার পুত্রেরা রাজা হন তবেই দেবেন কন্যার বিয়ে।
এদিকে দেবব্রত হয়ে আছেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ।
সমস্ত শুনে দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করেন-
না তিনি বসবেন সিংহাসনে, না তিনি বিবাহ করবেন উপরন্তু সারাজীবন ব্রহ্মচারী হয়ে তিনি হস্তিনাপুরের দেখভালের দায়িত্ব নেবেন।
তার সেই ভীষন প্রতিজ্ঞা গ্রহণের পর তার নাম হয় ভীষ্ম।
এরপরে দাসরাজ সম্মত হন বিয়ের জন্য।
বিয়ে হয় শান্তনু আর সত্যবতীর।
রাজা শান্তনু তার পুত্রকে আশীর্বাদ দেন ইচ্ছামৃত্যুর। অর্থাৎ ইচ্ছে মতো মৃত্যুর দিন ঠিক করতে পারবেন ভীষ্ম অথবা তিনি চাইলে চিরজীবী হয়েও থাকতে পারেন তার গুরু পরশুরামের মতোই...
সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর ঔরসে জন্ম হয় চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য, দুই পুত্রের।
উল্লেখ্য সত্যবতীর সাথে শান্তনুর বিবাহ হবার আগে ঋষি পরাসরের ঔরসে জন্ম হয়েছিল ঋষি ব্যাসের।
ব্যাসদেব অর্থাৎ মহাভারতের রচয়িতা তিনি নিজেই...
হস্তিনাপুরের সেবক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন:
***************************************
চিত্রাঙ্গদ পরে মারা যান যুদ্ধে তখন বিচিত্রবীর্য হন রাজা। বিচিত্রবীর্যর বিবাহের জন্য কাশীর রাজার তিনকন্যা- অম্বা অম্বিকা অম্বলিকাকে হরণ করেন ভীষ্ম।
অম্বা ছিলেন শাল্বরাজের বাগদত্তা। এরপরে শাল্ব যখন ফিরিয়ে নিতে রাজি হন না অম্বাকে তখন অম্বা ভীষ্মকে বলেন বিবাহ করতে।
ভীষ্ম অপারগ হলে অম্বা পরশুরামের কাছে নালিশ করলে যুদ্ধ বাধে ভীষ্ম আর পরশুরামের মধ্যে।
গুরুর সাথে যুদ্ধ:
************************
ভীষ্ম ছিলেন রথে আর পরশুরাম মাটিতে। ভীষ্ম অনুরোধ করেন পরশুরাম'কে রথ গ্রহণের জন্য।
তখন স্মিত হেসে পরশুরাম দিব্যদৃষ্টি নিবেদন করেন ভীষ্মকে। দিব্যদৃষ্টির ফলে ভীষ্ম দেখতে পান-
স্বয়ং পৃথিবী পরশুরাম এর রথ। পবনদেব তার সারথি। চারবেদ হল চারটি ঘোড়া আর উপনিষদ হল সেই ঘোড়ার রশি। আর পরশুরাম এর বর্ম রূপে রয়েছেন দেবী সরস্বতী সাবিত্রী আর গায়ত্রী।
ভীষ্মর বুঝতে সময় লাগলো না কেন পরশুরাম রয়েছেন এই পৃথিবীতে সমস্ত অবতারের অস্ত্রগুরু হয়ে শ্রীরাম থেকে কল্কি অব্দি সবার।
ভীষ্ম সৌভাগ্যবান তিনি এমন একজনের কাছে শিখতে পেরেছেন।
তিনি নীচে নেমে প্রণাম করলেন গুরুকে।
অতঃপর শুরু হল যুদ্ধ।
চলল 23 দিন ধরে।
22 তম দিনে ভীষ্ম প্রার্থনা করলেন তার পূর্বপুরুষদের কাছে তারা যেন পরশুরামকে পরাস্ত করতে তাকে সহায়তা করেন। ভীষ্মর পূর্বপুরুষেরা এসে তাকে একটি অস্ত্র প্রদান করেন নাম প্রশ্বপস্ত্র।
পরেরদিন অর্থাৎ 23 দিনের দিন ভীষ্ম এই অস্ত্র সংযোজন করলে ভীষ্মর পূর্বপুরুষ এসে রাস্তা আটকান পরশুরামের। তার রথ নিষ্ক্রিয় করে দেন সেই আত্মার দল।
সেই মুহুর্তে সেখানে উপস্থিত হন নারদ সমেত অন্যান্য দেবতারা। তারা ভীষ্মকে এই অস্ত্র চালনা করতে বাধা দেন। বলেন এই অস্ত্র আসলে পরশুরামের নিজের তৈরি অস্ত্র। মারন ক্ষমতা ভয়ানক বলে এই অস্ত্র পরশুরাম নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এরপরে এই অস্ত্র চালনা করলে গুরুকেই অবজ্ঞা করা হবে।
গঙ্গাদেবী আসেন সেখানে। তিনি এসে ভীষ্মকে নির্দেশ দেন গুরুকে প্রণাম করে যুদ্ধ সমাপ্ত করতে।
যুদ্ধ অসমাপ্ত হলে পরশুরাম চলে যান...
শিখন্ডীর জন্ম:
**********************
এরপরে
অম্বা ভীষ্ম প্রাণনাশের প্রতিজ্ঞা করে আগুনে নিজেকে সমাপ্ত করেন কিন্তু এরপরই তিনি পুনর্জন্ম নেন শিখন্ডী রূপে রাজা দ্রূপদের ঘরে দ্রৌপদীর বড় বোন/ভাই হয়ে ...
আর অম্বিকা ও অম্বলিকার বিবাহ হয় বিচিত্রবীর্য'র সাথে
কিন্তু এতসব করেও বেশিদিন স্থায়ী হয় না শান্তি অচিরেই দুর্বল বিচিত্রবীর্য মারা যান তখন সত্যবতী বলেন ভীষ্মকে অম্বিকা ও অম্বলিকা'কে বিবাহ করার জন্য। কিন্তু ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞায় থাকেন অটল।
তখন নিয়োগ প্রথার জন্য ডেকে পাঠান সত্যবতী তার বড় পুত্র ঋষি ব্যাসকে।
ব্যাসের ঔরসে জন্ম হয় অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রর আর অম্বলিকার গর্ভে পাণ্ডুর সাথে দাসী পৃষ্মনির গর্ভে জন্ম হয় বিদুরের।
ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। বয়স কালে তার বিবাহের জন্য ভীষ্ম আবার অপহরণ করেন গান্ধার রাজ্যের কন্যা গান্ধারী কে। সাথে আসেন শকুনি। শকুনি কোনদিন মেনে নেন নি তার বোনের এরকম বিবাহ। তিনি মনে মনে ভীষ্মকে শত্রু হিসেবেই গণ্য করতে থাকেন। এছাড়া ভীষ্ম তার পিতা ও তার একশত ভাইদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন।
পাণ্ডুর সাথে কুন্তী ও মাদ্রি দুই রাজকন্যার বিবাহ দেওয়া হল ভীষ্মর সহযোগীতায়।
এরপরে পাণ্ডব ও কৌরবদের জন্ম হলে তিনি দ্রোনাচার্য্য কে নিয়োগ করেন এদের অস্ত্রগুরু হিসেবে।
বস্ত্রহরণ দ্রৌপদীর:
***********************
এরপরে কৌরব পাণ্ডবদের মধ্যে বৈরিতা বাড়তে থাকলে এক অন্যায় পাশা খেলায় হেরে যায় পাণ্ডবভাইরা তারপর দ্রৌপদীর বস্ত্র হরনের চেষ্টা হলে শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় দ্রৌপদীর সম্ভ্রম রক্ষা হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন অনেকের সাথে ভীষ্ম।
কিন্তু তিনি সেবক হিসেবে থাকেন চুপ
কিন্তু দ্রৌপদী তাকে মনে করিয়ে দেন- তিনি এই বংশের রক্ষাকর্তা। তাই কুলবধুর রক্ষাকর্তাও তিনি। আজ তিনি চুপ থেকে নিজের দ্বায়িত্ব থেকে সরে গেছেন, তিনি ব্যর্থ হয়েছেন হস্তিনাপুরের রক্ষাকারী হিসেবে...
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে:
***********************
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি ছিলেন কৌরবদের সেনাপতি হিসেবে।
যুদ্ধের শুরুতে যুধিষ্ঠির এলেন ভীষ্মর সামনে প্রণাম করলেন তখন আশীর্বাদ করলেন ভীষ্ম বললেন-
আমি হস্তিনাপুরের অন্ন গ্রহন করেছি প্রতিজ্ঞা করেছি এর রক্ষা করার সেই অন্ন গ্রহনের ভার আমার উপরে রয়েছে আর প্রতিজ্ঞার বাঁধনে আমি বাঁধা।।।
তবে তিনি খুব ভালবাসতেন পাণ্ডবদের। তার নাতি ছিলেন পাণ্ডবরা। তিনি যুদ্ধে তাদের হত্যা করতে চান নি।
যুদ্ধে প্রতিদিন দশহাজার সেনা আর হাজার রথ ধ্বংস করেছেন পান্ডবপক্ষর কিন্তু পাণ্ডবদের কোন ক্ষতি করেন নি। পাশাপাশি তিনি কৌরবদের কোন ক্ষতি হতে দেন নি। উভয়েই ছিল তার স্নেহের পাত্র।
দুর্যোধনের অনেক আশা ছিল ভীষ্ম'র উপরে।
কিন্তু তিনি পাণ্ডবদের কোন ক্ষতি হতে দিতে চান না বুঝে একদিন দুর্যোধন তার পিতামহ ভীষ্মকে ভৎসর্না করেন যে পিতামহ মন দিয়ে যুদ্ধ করছেন না।
তিনি পাণ্ডবদের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছেন...
যুদ্ধের নবম দিনে:
**********************
পরেরদিন যুদ্ধে ভীষ্ম ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেন।
তিনি খড়কুটোর মত পান্ডবপক্ষ সেনাদের শেষ করতে থাকেন।
ওদিকে অলম্বুশ আর উপপাণ্ডবদের মধ্যে লাগে যুদ্ধ। উপপাণ্ডবদের রথের ঘোড়া নষ্ট করেন অলম্বুশ। তখন সহায়তায় আসেন অভিমন্যু। অভিমন্যুর সাথে সম্মুখ সমরে পেরে না উঠে অলম্বুশ মায়া যুদ্ধ শুরু করেন। শেষে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র দিয়ে অলম্বুশের মায়াযুদ্ধ নিষ্ক্রিয় করতে সমর্থ হন অভিমন্যু। এরপরে অলম্বুশকে সামনে পেয়ে তীরের দ্বারা তার বর্ম নষ্ট করলে অলম্বুশ সেখান থেকে চলে যান। অলম্বুশও নষ্ট করে দেন অভিমন্যুর ঘোড়া। অভিমন্যু এরপর নীচে নেমে যুদ্ধ শুরু করেন। অলম্বুশ এর সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন ভীষ্ম।
অভিমন্যুর সহায়তায় এগিয়ে আসেন অর্জুন।
এরপরে
ভীষ্ম আক্রমন করেন অর্জুনকে। পরপর এত তীর ভীষ্ম সংযোজন করেন যে অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ রথ তিনি তির দিয়ে ঘিরে দেন। এরপরে অর্জুন তির মেরে পিতামহের ধনুক ভেঙে দেন। ভীষ্ম এরপর আরেকটি ধনুক নিলেও ভেঙে দেন সেটিও।
এরপরের ধনুকটি নিয়ে ভীষ্ম আর দেরি করলেন না। তিনি অর্জুনের সহায়তায় আসা সমস্ত সেনানীদের ধ্বংস করলেন কয়েক মুহুর্তেই।
ক্রমশঃ তিনি ধারণ করছেন রুদ্র মূর্তি। আর অর্জুন হচ্ছেন দুর্বল। এরপরে তার তিরে আহত হন অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ।
এটা ঠিক অর্জুনও সামনে পিতামহকে দেখে যুদ্ধে মনোনিবেশ করব উঠতে পারছেন না।
ওদিকে ক্রমশঃ একলা হচ্ছেন অর্জুন। শুধু শুধু প্রাণ দিচ্ছেন সহায়তা করতে আসা সেনানীরা...
বেশ কয়েকবার ভীষ্মর তিরে আহত হবার পরেও যখন অর্জুন সঠিকভাবে তির সংযোজন করে উঠতে পারলেন না এবারে শ্রীকৃষ্ণ নামলেন রথ থেকে।
শ্রীকৃষ্ণের ভীষ্ম আক্রমন:
*******************************
একটি ভাঙা রথের চাকা তুলে নিয়ে দৌড়লেন ভীষ্মর দিকে। ভীষ্ম তার অস্ত্র সংবরন করলেন বললেন- আপনার হাতে আমি প্রাণ দেওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত আপনি ভগবান আপনার হাতে মৃত্যু তো সৌভাগ্যের...
ততক্ষনে অর্জুন নেমে পড়েছেন রথ থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুর পা। থামালেন শ্রীকৃষ্ণকে। বললেন আপনি সারথি আপনার অস্ত্রধারন শোভা পায়না। আসুন ফিরে যাই রথে। আমি মনে দিয়ে যুদ্ধ করব।
আপনি এই যুদ্ধে অস্ত্রধারন করবেন না শপথ করেছিলেন। এইভাবে নিজের শপথ ভাঙবেন না। চলুন করব যুদ্ধ...
শ্রীকৃষ্ণ কোন উত্তর না দিয়ে রথের চাকা ফেলে দিয়ে ফিরে এলেন অর্জুনের রথে। ওদিকে ভীষ্ম সংযোজন করে চলেছেন একের পর এক বান। আর ক্রমশঃ বাড়ছে লাশের পাহাড়। সবই পাণ্ডব সেনাদের। হাতি ঘোড়া আর সেনা। সারা আকাশ তীরে তীরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে...
ঠিক সেই মুহুর্তেই সন্ধ্যে নামল
সেদিনের মত ইতি ঘটল যুদ্ধের...
সেইদিন সন্ধ্যায়
যুধিষ্ঠির বেরুলেন যুদ্ধ পরিস্থিতি পরিদর্শনে, দেখলেন তছনছ হয়ে গেছে বাহিনী। যা রয়েছে তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। ভীষ্ম একদম যেন খড়কুটোর মত উড়িয়ে দিয়েছেন পাণ্ডবদের।
ভেঙে পড়লেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে। পরিস্কার বোঝাই যাচ্ছিল ভীষ্ম একলাই শেষ করে দেবেন সম্পূর্ণ বাহিনী। রয়ে যাবেন শুধু পাণ্ডব শিবিরের কয়েকজন...
অতঃপর গেলেন তারা ভীষ্মর সম্মুখে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন- কি করা যায়...
ভীষ্ম নিজেই বললেন- তিনি বেঁচে থাকতে কোন আশা নেই পাণ্ডবদের।
তিনি যখন ধনুক নেবেন হাতে স্বয়ং ইন্দ্র তার দেব বাহিনী নিয়েও পারবে না তাকে হারাতে। তাই তার অস্ত্র সম্বরন করা প্রয়োজন।
ভীষ্মর মৃত্যু রহস্য:
************************
তিনি একমাত্র অস্ত্র ধরবেন না মহিলার বিরুদ্ধে। রাজা দ্রূপদের কন্যা শিখন্ডী ছিলেন মহিলা জন্মসূত্রে পরে পুরুষ হয়েছেন যক্ষ আশীর্বাদে। শিখন্ডী যদি অর্জুনের রথে চড়ে থাকেন তবে ভীষ্ম অস্ত্র চালাবেন না কিন্তু অস্ত্র তিনি ছাড়বেন না। এই সময়ে ভীষ্মকে যুদ্ধে পরাস্ত করা সম্ভব হতে পারে...
শ্রীকৃষ্ণ আর যুধিষ্ঠির এরপর গেলেন শিখন্ডীর কাছে। পরেরদিন যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হল। ঠিক হল যুদ্ধের সময়ে সুযোগ বুঝে শিখন্ডী চলে আসবেন অর্জুনের রথে।
কৌরব শিবিরও বসে নেই, ঠিক হল শকুনি, দুর্যোধন,অশ্বত্থামা সমেত আরো কয়েকজন থাকবেন ভীষ্ম'র চারপাশে যাতে অর্জুনকে আটকানো যায়।
কুরুক্ষেত্রের দশম দিনে:
***************************
দশম দিনের ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করছে দুই পক্ষ কুরুক্ষেত্রের বুকে। ভীষ্ম ভোরের সূর্য্যের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছেন-
হস্তিনাপুরের অনেক নুন খেয়েছি আজ সেই নুন পরিশোধের পাশাপাশি আমি আমার প্রতিজ্ঞা আর কর্তব্য মুক্ত হব। অনেক অন্যায় করেছি অনেক অন্যায় সয়েছি হস্তিনাপুরের মুখ চেয়ে। আজ সব থেকে হব মুক্ত।
আলো ফোটার সাথে সাথে শঙ্খধ্বনি করে শুরু হল যুদ্ধ। ভীষ্ম তুলে নিলেন তার ধনুর্বান। ব্রতী হলেন তার ক্ষত্রিয় ধর্ম রক্ষায়।
শিখন্ডী পিছু নিলেন তার কিন্তু ভীষ্ম তাকে উপেক্ষা করে গেলেন। অর্জুন যখন এগুলেন শিখন্ডীর সহায়তায় বাধা পেলেন দুর্যোধনের কাছে। এগিয়ে এলেন একে একে অশ্বত্থামা,শকুনি। ভীষ্ম সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দুপুরের মধ্যে তিনি লাশের পাহাড় বানিয়ে ফেললেন নিজের চারপাশে আর রাখলেন খোলা শুধু একদিকেই। শিখন্ডী আর অর্জুন যতবার প্রবেশ করতে চান ততবারই বাধা পেলেন বাকিদের কাছে।
বিকেলের মধ্যেই ভীষ্মর হাতে বধ হলেন প্রায় এক অক্ষুহিনী পান্ডবসেনা। শকুনি আর দুর্যোধন মিলে ঘিরে ধরলেন শিখন্ডীকে। শকুনির তরোয়াল আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েন শিখন্ডী। দুর্যোধন বধ করতে যাবেন শিখন্ডীকে সেই সময়ে অভিমন্যু বাঁচিয়ে নিতে সমর্থ হলেন শিখন্ডীকে।
এরপরে শিখন্ডীকে তুলে দেওয়া হল অর্জুনের রথে। ভীষ্ম এরপরে অস্ত্র চালাচ্ছেন দেখে শুনে যাতে শিখন্ডীর আঘাত না লাগে। এই সুযোগে অর্জুন দুটি ধনুক নষ্ট করে দেন। ভীষ্ম এবারে ভাঙা ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আর পান্ডবপক্ষ তার শরীরে মারতে থাকে তীর। শিখন্ডীর তীর নষ্ট করে দেয় ভীষ্মর বর্ম। বর্মহীন শরীরে পর পর তীর গাঁথা হচ্ছে। কিন্তু ভীষ্ম দাঁড়িয়েই রয়েছেন।
শেষে শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন সংযোজন করলেন বিশেষ তীর তার গাণ্ডীবে। তীরগুলি একসাথে ভীষ্মর বুকে ঢুকে পিঠের বর্ম ভেদ করে বেরিয়ে গেল আর সেই তিরের সম্মিলিত আঘাতে ভীষ্ম পড়ে গেলেন রথ থেকে।
তার পড়ে যাবার সাথে সাথে কৌরব পাণ্ডব দুই পক্ষই তাদের অস্ত্র সম্বরন করল। দুই পক্ষই ছুটে এল তাদের পিতামহের কাছে...
পরবর্তী জীবন:
********************
ভীষ্মর শরীর সেই তীর গুলির উপরেই রইল, মাটি স্পর্শ করল না। শুধু মাথাটা ঝুলছিল। সেই মাথার যত্ন নিতে দুর্যোধন নিয়ে এলেন বহুমূল্য বালিশ, কিন্তু ভীষ্ম সেগুলি নিতে অস্বীকার করলেন।
এরপরে ভীষ্ম ডাকলেন অর্জুনকে। বললেন-
তার জন্য বালিশের ব্যবস্থা করতে। অর্জুন একটি তীর তার মাথায় গেঁথে উপযুক্ত বালিশের ব্যবস্থা করলেন।
এরপরে
পিতামহের জলের পিপাসা মেটাবার জন্য মাটিতে তির মেরে গঙ্গাদেবীকে আহ্বান করলেন।
মাটি ফুঁড়ে উঠে এলেন গঙ্গা, মেটালেন পুত্রের পিপাসা। তারপর পুত্রের অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়ে অভিশাপ দিলেন অর্জুনকে-
যেভাবে তার পুত্র আজ মৃত্যুকষ্ট অনুভব করছে ঠিক সেভাবেই অর্জুনও অনুভব করবে মৃত্যুকষ্ট।
ভীষ্ম পিতামহের দেহ যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটি ঘিরে ফেলা হয় তারপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলতে থাকে পরেরদিন থেকে।
তবে প্রতিদিন রাতে যুদ্ধ শেষে দুই পক্ষ এসে দেখা করতেন পিতামহের সাথে। শুনতেন নানা উপদেশ।
এইভাবে চলতে থাকে দিন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে যুধিষ্ঠির রাজা হলে পরে পিতামহের আশীর্বাদ নিয়ে যান। তিনি বিভিন্ন উপদেশ ও পরামর্শ দেন যুধিষ্ঠিরকে যা পরে রাজকার্যে খুব সাহায্য করেছিল পাণ্ডবদের।
তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ উল্লেখ করছি-
"রাজা আর শিক্ষকের এক হাতে থাকবে ক্ষমা
আরেক হাতে থাকবে দন্ড,তবেই সেই রাজা অথবা শিক্ষক হবেন সবার আদর্শ"।
ভীষ্মর মৃত্যু:
******************
অবশেষে এইভাবে 58 দিন অতিক্রান্ত হলে সূর্য্যের উত্তরায়ন শুরু হয় আর ভীষ্ম পিতামহ তার প্রাণত্যাগ করেন।
অবশেষে অষ্ট বসুর বাকি একজন ফিরে যান তার নিজের রাজ্যে। প্রভাস ফিরে যান তার ঘরে...
আজও
মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথি বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে পালন করা হয়, এইদিনে ভীষ্ম পিতামহ তার দেহত্যাগ করেছিলেন। বলা হয় যে তিনি মোক্ষ লাভ করে স্বর্গের উপরে মাতৃলোকে স্থান পেয়েছিলেন সেই দিনটি ছিল শুক্লা দ্বাদশীর দিন...
তাই মাঘ মাসের শুক্লা অষ্টমীর দিন থেকে শুক্লা দ্বাদশীর দিন পর্যন্ত নদীর ধারে স্নান করে উপবাস সহকারে ভক্তিভরে পালন করা হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে ভীষ্মর সমান গুণাবলী প্রকাশ পায়...