Partha Pratim Guha Neogy

Romance Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Classics

ভার্চুয়াল পরকীয়া

ভার্চুয়াল পরকীয়া

4 mins
434


এখন আমাদের জলবায়ু - আবহাওয়া সব কেমন বদলে গেছে। আগে এতো গরম পড়ত না। আর এখন জুন মাস পড়ে গেল, তবুও গরম কমবার নাম নেই, সারাক্ষন একটা গুমোট, ভ্যাপসা ভাব। এই আবহাওয়ার সাথে শ্রীমতীর এখনকার জীবনযাত্রার খুব মিল, সবকিছুই কেমন দম বন্ধ করা, বিরক্তিকর। অবশ্য আগে তবু শ্রীমতীর হাতে নিজের জন্য কিছুটা সময় থাকতো, থাকতো নিভৃতে নিজের সঙ্গে কাটাবার জন্য সামান্য অবসর। কিন্তু অতিমারী এসে সে সব কেড়ে নিয়েছে। লকডাউনের জন্য সবকিছুর সাথে স্কুল-কলেজও বন্ধ। শ্রীমতীর স্কুল শিক্ষক স্বামী আর স্কুল পড়ুয়া কিশোরী মেয়ে দু’জনেই সারাক্ষন বাড়িতে। বিধবা শাশুড়ির ফাই-ফরমাস খাটতে খাটতে শ্রীমতীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে স্বামী আর কন্যা। তাই এখন সারাদিনে ওর দম ফেলার সময় নেই। ওকে বসে থাকতে দেখলেই শুরু হয়ে যাবে আবদার, হয় চা করে দাও নয়তো ভালো ভালো জলখাবার বানিয়ে দাও। আগে তবু রান্নাবান্না শেষ করে স্নান করা বা বিকেলে গা ধোওয়ার জন্য ও কিছুটা সময় পেতো। আর এখন, সব সময় একটা তাড়া, সব সময় একটা তটস্থ ভাব।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জরিপ করতে করতে এ সবই ভাবছিল চল্লিশোর্ধ শ্রীমতী। ঘরকন্নার কাজ সারতে সারতে নিজের দিকে দেখার সময় নেই; এই বছর খানেকেই অনেকটা বুড়িয়ে গিয়েছে ও। সময়মত বিউটি পার্লার যাওয়া নেই, নিয়ম করে মর্নিংওয়াক নেই; যত্নের অভাবে শ্রীমতীর ফর্সা মুখের বাদামী ছোপগুলো এখন আরও স্পষ্ট। পরিপাটী করে সাজগোজ করার সময় নেই তাই স্লিম শরীরটাও কেমন বেঢপ লাগছে। শ্রীমতীর স্বামীর অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। সময়মতো সবকিছু হাতের কাছে পেলেই হল; দিনেরবেলা দরকারি দৈনন্দিন জিনিসপত্র আর রাতের বেলা দরকার পড়লে শ্রীমতীর শরীর।

স্বামীর কিছু এসে না গেলেও শ্রীমতীর আসে যায়। নিজেকে এমন আটপৌরে আধবুড়ি টিপিকাল হাউসওয়াইফ হিসেবে দেখতে ওর একেবারেই ভালো লাগে না। আলমারি খুলে একটা ইস্ত্রি করা শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজ বের করল শ্রীমতী; পরিপাটি করে জড়িয়ে নিল শরীরে। ঘাড়ে, গলায় আর বুকের মাঝখানে ঢেলে দিল ফুলের গন্ধওয়ালা ট্যালকম পাউডার। চোখে হালকা করে কাজল পরে মুখে বুলিয়ে নিল পাউডারের পাফ। এবার একটু ভালো দেখাচ্ছে ওকে। সাজগোজ সেরে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল শ্রীমতী। স্বামী আর শাশুড়ি বিকেলের খাওয়াদাওয়া সেরে টিভির সামনে বসে পড়েছে; শাশুড়ির একঘেয়ে বস্তাপচা সিরিয়ালগুলোয় যখন ব্রেক হয় তখন স্বামী নিউজ চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পছন্দসই খবর দেখে। মেয়ে এখন নিজের ঘরে, হোমওয়ার্ক করার নাম করে বন্ধুবান্ধবদের সাথে চ্যাট করছে। এরা এখন আর নিজেদের কাজ ফেলে শ্রীমতীকে বিরক্ত করবে না। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে শ্রীমতী ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। এই সময়টা ও চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে কাটায়। নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে।


ছোটবেলা মানে কৈশোরে পা দেওয়ার পর থেকেই শ্রীমতী বেশ রোম্যান্টিক। সুন্দর দেখতে সহপাঠীই হোক বা সুদর্শন মাষ্টারমশাই, শ্রীমতী সবাইকেই মন দিতে চাইতো। কিন্তু শ্রীমতীর পরিবার ছিল রক্ষনশীল, ওর পরিচিত পুংলিঙ্গের প্রাণীরা ওর বাবার দাপটের সাথে বেশ ভালোরকম পরিচিত ছিল। তাই উটকো ঝামেলার ভয়ে সুন্দরী শ্রীমতীর সাথে কেউ তেমন খোলাখুলিভাবে মিশতো না।

প্রেমিকের অভাবে রোম্যান্টিক রূপসী শ্রীমতীর জীবন ছিল মরুভূমির মতো; সেখানে মাঝে মাঝে ভালোলাগার মরীচিকা দেখা দিলেও তাতে ভালোবাসার জল একেবারেই থাকতো না। তখন থেকেই শ্রীমতীর স্বপ্ন দেখার শুরু। যে সব পুরুষদেরও দিনেরবেলা মনে মনে কামনা করতো তাদের নিয়েই রাতে দেখতো সুখস্বপ্ন। আর অপেক্ষা করতো কবে ওর জীবনেও আসবে স্বপ্নের রাজকুমার।

শ্রীমতী পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না তাই উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর ওর বাবা-মা ওর জন্য পাত্র দেখতে শুরু করলো। শ্রীমতীর অবশ্য তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। ও তো প্রেমিক পুরুষের অপেক্ষায় হা-পিত্তেশ করে বসেই আছে। তবে উচ্চশিক্ষিত পাত্রের কেউই উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ শ্রীমতীকে বিয়ে করতে রাজি হল না। তাই আরও বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে হল। কোনোক্রমে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর শ্রীমতীর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। এক খিটখিটে বিধবার স্কুলমাষ্টার পুত্রকে শ্রীমতীর বাবা ওর উপযুক্ত পাত্র হিসাবে মনোনীত করলো। আসন্ন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিল শ্রীমতী। কোথায় হানিমুন করতে যাবে, কেমন ভাবে সাজগোজ করবে, কিভাবে ফটো তুলবে, সবকিছু।

দিবাস্বপ্ন খুব কম সময়েই সত্যি হয়। শ্রীমতীর স্বপ্নভঙ্গ হতেও খুব বেশি সময় লাগলো না। ওর বিয়ে হয়েছিল মাঘ মাসে, ভরা শীতে। স্বামী জানালো মধুচন্দ্রিমার জন্য ভরা গ্রীষ্ম অবধি অপেক্ষা করতে হবে। স্কুলে ছুটি না পড়লে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যাবে না। স্বামীর বন্ধুরা আসতো বিয়ের পর, নতুন বৌদিকে দেখতে, একটু গল্পগুজব করতে। শাশুড়ি ফরমান জারি করলো, মাষ্টারের বৌ-কে একটু গম্ভীর হয়ে থাকতে হয়, প্রগলভ হলে স্বামীর সন্মান থাকে না। অগত্যা, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। অথচ ওর নিজের মেয়ের বেলায় শাশুড়ির এই নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আন-রোম্যান্টিক গতানুগতিক জীবন কাটতে লাগলো প্রকৃতির নিয়ম মেনে।


ঠাকুরঘরে ঢুকে একটা ধূপ জ্বালিয়ে দিল শ্রীমতী। তারপর আসন পেতে বসে পড়ল ঠাকুরের সামনে। হাতে তুলে নিল মোবাইল ফোন। প্রবেশ করলো ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে। দেখতে লাগলো মনপসন্দ পুরুষদের ছবি। মন ভরে গেল আমেজে। চোখ জুড়ে এল সুখস্বপ্নে। এখন এভাবেই কাটবে ঘণ্টাখানেক।

স্বামী, শাশুড়ির মনোভাব বুঝতে পারার পর থেকে সকাল-বিকেল বেশ খানিকক্ষন বাথরুমে কাটাতো অনুসূয়া। সেখানেই দেখে নিতো নিজস্ব স্বপ্নদের। কিন্তু লকডাউন হওয়ার পর থেকে সবাই বাড়িতে, তাই এখন আর বাথরুমে বেশি সময় কাটানো যায় না। তাই এখন এই ঠাকুরঘরই ভরসা। শাশুড়ি নি-রিপ্লেসমেন্টের পর থেকে ঠাকুরঘরে আসা ছেড়ে দিয়েছে। পুজোপাঠের দায়িত্ব এখন শ্রীমতীর সবাই ভাবে শ্রীমতী এখন খুব মন দিয়ে পুজো করে, এই অতিমারীতে যাতে পরিবারের কারও কোনো বিপদ-আপদ না হয় তাই এতক্ষন ধরে ঠাকুরকে ডাকে। ঠাকুরঘরে বেশি সময় কাটানোর জন্য ওকে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।

কলেজে পড়ার সময় প্লেটোনিক লাভ বা প্রেমের কথা শুনেছিল অনুসূয়া; শরীরবিহীন প্রেম। এটা তাহলে কি? প্লেটোনিক পাপ? শ্রীমতী এখন বিবাহিত, সন্তানের জননী। প্রেম নয়, এখন সবই পরকীয়া। আর সবার চোখে পরকীয়া মানেই পাপ।

কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য, স্বামী, সন্তান, পরিবারকে সুখে রাখার জন্য দিনের শেষে এটুকু পাপ তো করতেই হবে শ্রীমতীকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance