ভার্চুয়াল বিবাহ
ভার্চুয়াল বিবাহ
কিন্তু দু'পক্ষের বাবা-মা, মা-পিসিকে জানিয়ে এয়ার টিকিট কেটে ফেলার পর যে ভয়ানক কাণ্ডটা ঘটবে তা কে জানত!
পরাগ - বিহগী , দু'জনেরই বাড়ির লোক শান্তিতে ছিল। ‘‘বাঁচা গেছে, বউ খোঁজার দায় বাঁচল। আজকালকার ছেলে, এতদূর থেকে কী পছন্দ-অপছন্দ হবে, তা কি বোঝা সম্ভব?’’ বলেছিলেন সীমা ,পরাগের মা।
‘‘আরে গিন্নি, তা ছাড়া অদ্দুর গিয়ে বসবাসের জন্য কনেকে রাজি করানোটাও কি কম ঝামেলা হত!’’ নন্দবাবু, পরাগের বাবা দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে চান।
‘‘দূর! পাত্র আমাদের এলেবেলে নাকি! আই আই টি-র স্ট্যাম্প লাগানো এমবিএ ছেলে, কন্যাপক্ষদের কাছে লোভনীয় কম্বিনেশন! এবাড়িতে পরাগ ছাড়া কে আর বিদেশে চাকরিবাকরি পেয়েছে। তোমাদের বাঙাল-বাড়ির কেউ বাপের জম্মে সাগরপার করেছে নাকি! তবু আমার ছোটমামার মেজশালির ছেলে আইন পড়ে উকিল হতে আমেরিকা গিয়েছিল। নেহাত সে কথা বললে থুথু ছিটত বলে বেচারাকে ফিরে আসতে হল। তা এলাহাবাদে তো ভালই প্র্যাকটিস।’’
বেলা বাড়ছে, কথাও বাড়ছে। নন্দবাবু রণে ভঙ্গ দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন। পরাগটা ছোট থেকেই লেখাপড়ায় একটু বেশি ভাল। পড়তে যে ওর কী ভাল লাগে কে জানে! ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সবাইকে কি আর বাইরে যেতে হয়! এই যে ক’বছর পরেই নন্দবাবুর রিটায়ারমেন্ট ধেয়ে আসছে, এরপর বাজারঘাট-বিল-ব্যাঙ্ক-ট্যাক্স, এসবের জন্য দৌড়োদৌড়ি তো তাঁকেই করে মরতে হবে! একটা জোয়ান ছেলে বাড়িতে থাকলে বাপের যে কত সাহস বাড়ে তা সীমা কী করে বুঝবে! তা ছাড়া বৌমা বেশ ঘোমটা মাথায় সকালবেলা চায়ের কাপটি হাতে তুলে দেবে, বৃষ্টির দুপুরে খিচুড়ি রেঁধে বলবে, ‘আসুন বাবা, রোজই তো একরকম খান, আজ একটু মুখবদল হোক,’ এসব ভাবতেও কত ভাল লাগে। কিন্তু পরাগের চেষ্টা আর পরাগের মায়ের মানত-করে-কপালের চামড়া-খসিয়ে ফেলা কাজে লেগে গেল। ছেলে পাড়ি দিল একেবারে সেই লস এঞ্জেলেস।
শুধু তাই নয়! কলেজের সময় থেকে যে রোগা মেয়েটির সাথে বসে লেখাপড়া করত, কী করে যেন সে-ই হয়ে গেল পরাগের পছন্দের পাত্রী! ঘাসের ডগার মতো পাতলা মেয়েটা, পাখির মতো হালকা! নামখানা বিহগী , মানিয়েছে অবশ্য! পাখি কেন, প্রায় ফড়িঙের মতোই নেচে বেড়াত বাড়িতে এলে, ‘‘মাসিমা, কিচেনে এতক্ষণ কেন! মাইক্রোওয়েভে রান্নাটা শুরু করুন! মেসোর জন্য একটা এয়ার ফ্রাইয়ার কিনে নেবেন, মনে হয় ভাজাভুজি খেতে ভালবাসেন। আর কিনুন একটা ডিশ ওয়াশার। কফি মেকার পরাগ কিনে দেবে, আমি কিনে দেব ইলেকট্রিক কেটল! ব্যস, আপনি শুধু বোতাম টিপে রান্না চড়িয়ে টিভি-রিমোটটি হাতে নিয়ে বসবেন,’’ কী ভয়ংকর বুদ্ধি দিয়েছিল ফড়িং আর পাখির সংমিশ্রণ! কফিমেকার-কেটল এসে হাজির, পুরনো বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন আর ভোল্টেজের চাপ নেওয়ার ধুয়ো দিয়ে বাকি কেনাকাটা আটকানো গিয়েছিল।
যাই হোক, সেই বিহগীও দারুণ রেজাল্ট করে-টরে পরাগের একবছর পরেই উড়ে গিয়েছে লস এঞ্জেলেস থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে গ্লেন্ডেলে, তার অফিসের ফ্ল্যাটে। ট্রেন-বাস-ক্যাব-সাবওয়ে... পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ জারি রাখা সম্ভব বই কী! মুশকিল হল, দেখা শেষ হলেই মনখারাপ। কী আর করা, বিহগীর অফিসের ফ্ল্যাটে তার একটি গে ও একটি মেয়ে সহকর্মীর সঙ্গে রাত্রিবাস না-করে কাছাকাছি হোটেলে খরচা করে থেকে যেত পরাগ। বিহগী তার সঙ্গে দেখা করতে এসে সারাদিন লাফালাফি করলেও রাত কাটাতে একটু মিইয়ে যেত। সেই বাঙালির মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট! বেশি দেরি হলেও তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরতে হত পরাগকে। আরে বাবা, সব কি পরাগের বাবা-মার কানে পৌঁছবে, না বিহগীর মা জানতে পারবেন! কিন্তু বিহগীর বাবা নেই। পিসিমণি, মা তাকে ডানার তলায় ঢেকে একটু রক্ষণশীলভাবে মানুষ করেছেন। এই তো সেদিন সন্ধে পেরিয়েছে, ওয়াইনের গ্লাস ধরিয়ে বহু কষ্টে বাগদত্তাকে থাকতে রাজি করিয়েছে পরাগ। ফোন এসে হাজির বিহগীর পিসির।
‘‘কেমন আছ পিপি? আমি ভীষণ ভাল! খাওয়াদাওয়া? হ্যাঁ, তুমি বলে দিয়েছ না, দুধে সবসময় হরলিক্স গুলে খেতে! তা এখানে একটা প্রোটিন পাউডার কিনে এনেছে পরাগ, সেটার টেস্টটা বেশ! এই দেখো!’’ প্রশংসা করতে গিয়ে বিহগী ভুলে যায় যে একহাতে প্রোটিন-পাউডার আর অন্য হাতে ওয়াইন নিয়ে তূরীয় আনন্দে বসে থাকা পরাগকেই সে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিয়ো কলে দেখিয়ে চলেছে।
‘‘বিহু, আমাদের এখানে দুপুর হলেও তোর ওখানে তো বেশ রাত রে! কিন্তু তুই কোথায়? আর তোর হবু-বরের হাতে লাল-পানীয়টা তুইও সাঁটাচ্ছিস নিশ্চয়ই? হাজারবার করে বলে দিয়েছিলাম, বরাবর তোর লিভারটা কমজোর। সেই ছোটবেলা থেকে তোকে থানকুনির রস খাওয়াতে কম কষ্ট করেছি আমি! সব ভুলে গেলি! আর ঘি-আগুন পাশাপাশি থাকলে অঘটন ঘটতে কতক্ষণ! নাহ, তোদের চার-হাত একসঙ্গে না করলে শান্তি নেই।’’
পিসির কামান দাগা শেষ হলে বিহগী সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ওই রাতেই তাকে নিয়ে রেলস্টেশনে দৌড়য় পরাগ। মাঝরাতের পরে কী কারণে বিহগী তার ফ্ল্যাটে ফিরতে বাধ্য হয়েছে শুনে তার ফ্ল্যাটমেটরা কম হাসাহাসি করল না।
এভাবেই চলতে থাকে তাদের যুগ্ম জীবন। তবুও তো চলে। সপ্তাহের শেষে স্যান্টা বারবারায় সমুদ্রের ফেনায়-ফেনায় বাগদত্তা বধূর সুইমসুট পরা চেহারা দেখে পরাগ তো মুগ্ধ। ক্যাটালিনা দ্বীপ, পাম স্প্রিংস ঘুরতে-ঘুরতে দু'টিতে গুনগুন করে গান গায়, খুনসুটি করে, আর বিয়ের তারিখ ঠিক করার কথা ভাবে। হ্যাঁ, পরাগের এক বন্ধুর সাহায্যে বিহগীর চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে লস এঞ্জেলেসই। হোক না রাত্রিবাস বারণ, ওরা বিয়ে করবে খুব শিগগিরিই। তদ্দিন খানিকটা দৌড়োদৌড়ি কপালে আছে। শুরুতেই বলেছি যে
দু'পক্ষের বাবা-মা, মা-পিসিকে জানিয়ে এয়ার টিকিট কেটে ফেলার পর ঐ ভয়ানক কাণ্ডটা ঘটবে তা কে জানত! শত্রুর মতো তেড়ে এল করোনাভাইরাসটা! পরাগ-বিহগীর নিজেদের দেখা-সাক্ষাতের সুবিধে শুধু নয়, সুদূর ভারতে যাওয়ার পথও তো বন্ধ করে দিল! আর সময় পেল না!
‘‘ও পরাগ! আমি যে ভেবে রেখেছিলাম তোর ওখানে মাসখানেক থেকে একেবারে বৌমাকে রান্না-টান্না সব শিখিয়ে আসব, আর মেশিনে রান্নার পন্থাগুলোও নিজে শিখে আসব। রান্না-মেশিন কোথাও আটকালে তোর বাবা তো একটু কাগজপত্তরগুলো পড়ে-টড়ে ম্যানেজ করবে না!’’ ভেঙে পড়েন সীমা ।
গার্লস স্কুলের প্রিন্সিপাল, ম্যাডাম সোনিয়া পাল ফোন করে বসেন হবু জামাইকে। ঘাড়-ছাঁটা চুলে, ব্যক্তিত্বময়ী বলেন, ‘‘ছুটিছাটা যখন তখন আমি নিতে পারি না সে তো জানোই। গোটা একটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তুমি উপলব্ধি না-করতে পারলেও বিহু ছোট থেকে দেখে আসছে। নিজস্ব শিডিউল আমার প্ল্যান করতে হয়। এছাড়া বেনারসী, আর গয়নাগুলো অতদূর কীভাবে পাঠাব সে ব্যাপারেও একটা নির্ণয় করো। পণ্ডিতমশাই তো বলে দিয়েছেন আগামী মাসের পনেরোর মধ্যে বেশ ভাল তারিখ আছে।’’
শাশুড়ি-মাকে একটু আধটু জমিয়ে চলে না এমন জামাই কম। তবে সোনিয়া দেবীর মাথার পেছনে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মতো হ্যালো বা আলোর ছটা মানসচক্ষে বরাবরই দেখতে পায় পরাগ। সেদিক থেকে পিসিমণির সঙ্গে কথা বলাটা কম চাপের।
‘‘পরাগ রে! এককাঁড়ি টাকা খরচা করিয়ে তোর মা আমার কোট-প্যান্টুলুন কিনিয়ে তবে ছাড়ল। এখন এই কলকাতা শহরের প্যাচপেচে বর্ষায় সেসব পড়ে কি বাড়ি-অফিস করব! মিথ্যে বলব না, ক'টা দিন তোদের ওখানে স্টিক-বার্গার-বিফ আর বৌমার বানানো আইসক্রিম দু'বেলা খেয়ে জীবনে স্বর্গসুখ ভোগ করব ভেবেছিলাম! তা ছাড়া আমাদের এ বাড়িতে তো সর্দি-কাশি হলে ব্র্যান্ডি পর্যন্ত ঢোকে না। আসল রঙিন পানীয় দু'-একপাত্র চাখার শখ ছিল। তা কিসুই যখন হবে না তখন বিয়েটা তোরা চার্চের ফাদার-মাদারকে ডেকে সেরে ফ্যাল,’’ প্রচণ্ড হতাশায় নিরানন্দ নন্দবাবু।
‘‘এসব কী বুদ্ধি দিচ্ছ তুমি! হিন্দুর ছেলেপুলে, চার্চে গিয়ে বিয়ে সারবে! বিয়ে সঠিক তারিখেই দেব, আর এখান থেকেই দেব। যেমন করে আমরা হরদম কথাবার্তা বলি ওদের সঙ্গে, তেমন করেই পণ্ডিতমশাই মন্ত্র পড়বেন। ওখানে কি আর ফুল-টুল পাওয়া যাবে না? দিব্যি মালা গেঁথে নিতে পারবে আমার বিহগী -মা,’’ আহ্লাদে গদগদ কল্পনাবিলাসী সীমা।
নন্দবাবু জানতেও পারেননি কোন ফাঁকে বউ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জানলে কি আর মনের কথাগুলো বলতেন ছেলেকে! কিন্তু সীমা এখন ছেলের বিয়ের এমন একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছে যে চারপাশের পৃথিবী তার কাছে সম্পূর্ণ গৌণ। পরিকল্পনাটা কিন্তু মনে ধরেছে পরাগের। বিহগীকে বলতে সে-ও একপায়ে লাফিয়ে উঠেছে। শুধু একটু মনমরা হল বেনারসীটার অভাব বোধ করে কি? না, ঠিক তা নয়। প্রাথমিক দুশ্চিন্তা, সোনিয়াদেবীকে প্ল্যানের কথা কে বলবে সেই নিয়ে। তারপর ঠিক হল তারা কেউই বলবে না। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য বিহগীর ‘পিপি’ ছাড়া উপায় নেই।
‘‘কী যা তা বলছিস বিহু? ইন্টারনেটে বিয়ে? এরপর শুনব ইন্টারনেটেই তোর ছেলের মুখেভাত হবে, আমরা এখান থেকে চামচে-চামচে বাটি থেকে পায়েস তুলে তা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ঢালব!’’
‘‘ব্যাপারটা ভেবে দেখো পিপি, তোমরা যে তারিখ, যেমন সময় বলবে তাতেই আমরা রাজি। ফুল-মালার ব্যবস্থাও করে দেবে আমার বন্ধু জিনিয়া। ওকে তো আমরা এখন জিনি বলেই ডাকি! আর রেজিস্ট্রির জন্য সাক্ষী হিসেবে পরাগের বস, বসের বউ রাজি। আমার ফ্ল্যাটমেট মেক্সিকান মেয়ে মার্টিনা আর ওর নাইজেরিয়ান বয়ফ্রেন্ড জিম্মি তো আছেই! বেশ একটা আন্তর্জাতিক হবে ব্যাপারটা, তাই না? আর তোমরা তো রইলেই পিপি। কম্পিউটারের ওপর দিব্যি গাঁদা-গোলাপ-রজনীগন্ধা যা খুশি ছুড়তে পারো, যত খুশি!’’
পিপি ইমোশনাল হয়ে কেঁদেই ফেলল, ‘‘আমি তো আর বিয়ে-থা করলাম না রে, অঙ্ক-মাস্টারমশাই প্রতুলদাকে পছন্দ করেছিলাম বলে মা চ্যালাকাঠ মেরে পিঠে দাগ করে দিয়েছিল। সেই যে সে পাকিস্তান চলে গেল, আর হদিশ পাইনি। কিন্তু তোদের এ ব্যাপারটায় যাতে কেউ ব্যাগড়া না দেয়, তার ব্যবস্থা করব। তবে বিয়ের আগে পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ করার জন্য ভিড় ট্রেন-বাসে যাতায়াত করবি না। এখানে করোনা এত বেড়েছে যে পাশের ব্লকে রিঙ্কুর বাবার হয়েছে, পিউর মায়ের অবস্থা ভাল না, টিয়ার দিদিমা তো মরেই গেল। আমাদেরই বা কোনদিন কী হয়ে যাবে কে বলতে পারে! তোরা কিন্তু খুব সাবধানে থাকিস!’’
যাক বাবা, পিপি চেষ্টা করলে ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যাবে।
‘‘হিপ-হিপ-হুরররে!’’ স্প্রিং-বেডের ওপর লাফাচ্ছে পরাগ । বিহগীও তার সঙ্গে তিড়িংবিড়িং জুড়ে দিল। বন্ধুবান্ধবদের ফোনে জানানো হল প্ল্যান।
‘‘দিস ইজ সিমপ্লি ফ্যান্টাসটিক পরাগ - বিহগী ! উই আর গোয়িং টু বি অনলাইন টোট্যালি, অ্যাটেন্টিভ টু ইচ ডিটেল!’’ জিম্মি আশ্চর্যও, খুশিও।
‘‘ওয়েল, আই অ্যাম গোয়িং টু অ্যাটেন্ড দ্য সেরিমনি প্রপারলি ড্রেসড! আই মাস্ট বরো আ সারি ফ্রম ইউ বিহগী ডার্লিং,’’ জিনিয়ার আগেভাগে বায়নাক্কা।
পরাগের বস ও মিসেস বস রেজিস্ট্রি অফিসে খবর দিয়ে রাখলেন।
‘‘দেখো বৌমণি, তোমার কাছে এ জীবনে আমি প্রায় কিছুই চাইনি, কিন্তু এবার আমার দু'হাত পেতে চাওয়ার সময় এসেছে। আর তোমায় দিতেও হবে,’’ রোববার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর খাটে সোনিয়ার পাশে শুয়ে তাকে বলে বিহগীর পিসি, মিত্রা।
‘‘চাসনি মানে! তোর দাদাকে যবে থেকে চিনতাম তখন থেকে আমার আইসক্রিমের ভাগ, চুলের শ্যাম্পু, টিপের পাতা, কম দিয়েছি তোকে! এখন সব ভুলে গেলি মিতু!’’ সোনিয়া মৌরি চিবোতে-চিবোতে দুপুরের ভাতঘুমের পরিকল্পনা করেন। ননদটিকে যে তিনি বড় ভালবাসেন সেটা সে নিজেও জানে। এতগুলো বছর একরত্তি মেয়েটাকে মানুষ করা, লেখাপড়া করানো, এমনকি হারমোনিয়মের রিড টিপে-টিপে ‘বড় আশা করে এসেছি গো’ শেখানোর জন্যও তো মিত্রার কাছে তার কৃতজ্ঞ থাকার কথা। তিনি যখন সকাল-সকাল উপার্জনের জন্য স্কুলের চাকরিতে ছুটেছেন, মিত্রাই বিহগীর টিফিন গুছিয়ে, চুল বেঁধে, ইউনিফর্ম পরিয়ে স্কুলবাসে তুলে দিত। যেদিন বিহগী প্রথম শরীর খারাপের পর কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি এসেছিল, বিহগীর পিসিই তো তাকে সব বুঝিয়ে ব্যবস্থা করলেন। বোর্ডের খাতা দেখতে-দেখতে যখন রাত জেগেছেন সোনিয়া , এই মিত্রাই তো জলপটি দিয়েছে বিহুর জ্বরে-পুড়ে-যাওয়া কপালে। সেই মিতু আজ যদি কিছু চেয়েই বসে, তা একেবারে অগ্রাহ্য তিনি করতে পারবেন না। কী-ই বা দিতে পেরেছেন ওকে। বিহুর বাবা বাড়ির সবার অমতে প্রতুল আনোয়ারের সঙ্গে বোনের বিয়েটা দিতে পারেননি বলে সোনিয়ার কাছে কত দুঃখ করেছেন।
বিহগী -পরাগের কথা এবার খোলসা করে বলতে হল মিত্রার। সোনিয়া সব শুনে চোখ বুজে এমন চুপ করে রইলেন যে মনে হল ঘুমোলেন বুঝি!
‘‘কী বিপদ, আরও একবার এসব বলা মুশকিল!’’ অল্প উঠে বসে বৌদির নাক ডাকে কিনা শোনার চেষ্টা করে মিত্রা। পরিবর্তে তার কানটি টেনে ধরেন সোনিয়া , ‘‘বলি, এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম চলছে, তা আমাকে কেউ বলেনি কেন শুনি? আমি ব্যস্ত থাকি বটে, তা বলে কি আমি জানব না, শুনব না, ব্যবস্থা করব না, একটু আনন্দ করব না!’’ বৌদির গলায় রাগ রয়েছে, কিন্তু মুখে প্রশ্রয়ের হাসি!
দুই বাড়ির মধ্যে ফোনাফুনি চলল জোরদার। ‘‘বেয়ান, আমরা তো আশীর্বাদের হারখানা কিনে তৈরি রেখেছিলাম। কিন্তু পাঠাই কী করে!’’ সীমা নাকে কাঁদেন একটু।
‘‘আরে বাবা অত ওল্ড ফ্যাশন্ড হলে আমাদের চলবে নাকি! একটা ভাল দেখে ডায়মন্ড সেট কিনে নেবে ওরা, ব্যস!’’ আশ্বাস দেন সোনিয়া।
‘‘সন্ধ্যালগ্নেই যখন আংটি-বদল করতে বলেছেন পণ্ডিতমশাই, তা-ই মানব। সেসময়ে ওদের সাতসকালই হল না হয়, কী বলেন!’’ নন্দবাবু আনন্দে ভরপুর।
‘‘একদম ঠিক। তবে ছোট থেকে বিহুকে সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করা শিখিয়েছি। আমি চাইব ‘ওঁ যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম’ মন্ত্রটা যেন অন্তত বারতিনেক পাঠ হয়। যদি আপনাদের ছেলে এ-ক'দিনে সেটা শিখে নিতে পারে তা হলে যারপরনাই খুশি হব। এ দেশেও লকডাউন। আপনারা, আমরা, আমাদের আত্মীয়স্বজনরা কেউই যাওয়া-আসা করতে পারব না। তা বলে কি ওদের জীবনটাকে আটকে রাখব! তবে শুনুন, পরাগের এবার না হয় সুট-প্যান্ট পরা অ্যালাউড। সব ঠিকঠাক হলে এখানে রিসেপশনে ধুতি-পাঞ্জাবি না পড়িয়ে ছাড়ব না,’’ ঘাড় নেড়ে সায় দেন নন্দ-সীমা ।
‘‘ওরে বিহু, ব্যাপারটা যে সামলাতে পারব তা ভাবতেই পারিনি! কিন্তু একটা কথা। জানি তুই অফিসে ইস্তফা দিয়ে পরাগের ওখানেই আছিস। ভিডিয়ো কলে হলুদ দেওয়ালে রোনাল্ডোর ছবি দেখেই বুঝেছি। তবে বাপু কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলের ব্যবস্থা করে রেখো। এই বিচ্ছিরি করোনার হাত থেকে পৃথিবীটা মুক্তি পেলে তবেই ছানাপোনা হওয়া ভাল, তাই না!’’
পিপির কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে উঠতে পারে না বিহগী।
নির্ধারিত দিনে সাতসকালে উঠে দাঁত মেজেই বন্ধুদের ফোন করে জাগায় ওরা। পরাগের বসের মিসেস তার চেনা ইন্ডিয়ান বুটিকে অর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছে বরের শেরওয়ানি-চুড়িদার! নববধূর জন্য এসে পৌঁছেছে কচি কলাপাতা রঙের লেহেঙ্গা, হালকা-গোলাপি চোলি আর চুমকি-জরি বসানো ওড়না! ফুলের মালা পৌঁছে গেছে যথাসময়ে। ওদের দু'জনকে কম্পিউটার-স্ক্রিনে দেখে বাড়ির লোকজন এত খুশি যে কে কী বলছে বেশ কিছুক্ষণ বোঝা গেল না। তবে ফোকলা দাঁতে পরাগের ঠাকুমা একফাঁকে জোরে-জোরে বলে বসলেন, ‘‘অ নাতবউ, খাওয়াদাওয়া কইরবা। আমার নাতিরে বিয়ার খাটে শুইবার সময় সুখ দিবা তো!’’
পুরো কথাটার ট্রান্সলেশন শোনার জন্য জিনিয়া জেদ করলেও তাকে কোনওমতে থামানো হল। দু'পক্ষের আত্মীয়স্বজন যাঁরা পেরেছেন স্কাইপে যোগ দিয়েছেন। বেশ কয়েকবার গলাখাঁকারি দিয়ে বিয়ে শুরু করলেন পণ্ডিতমশাই। মালাবদল হল। সবাইকে অবাক করে মাঝখানে রাখা বড়সড় মোমবাতির চারপাশে একসময় সাতপাক ঘুরতে শুরু করল পরাগ -বিহগী । ‘ওঁ যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম...’’ হ্যাঁ, বিহগী মন দিয়ে বলছে। ফিরিঙ্গিদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পরাগও প্রস্তুত। সঙ্গে-সঙ্গে সে-ও বলছে, ‘‘হোয়্যার লাইজ ইয়োর হার্ট, মাই হার্ট উইল বি দেয়ার, মাই ব্রাইড/ হোয়ার মাই হার্ট এগজিস্টস মে ইয়োর হার্ট বি দেয়ার, সাইড-বাই-সাইড।’’
বলা বাহুল্য, গোলাপ, রজনীগন্ধা, ওদিকে ডেইসি-লিলি-ল্যাভেন্ডারে অনেকগুলো কম্পিউটার স্ক্রিন ঢাকা পড়ল। এদেশ থেকে উলুধ্বনির শব্দ আর শঙ্খের মাঙ্গলিক আওয়াজে আনন্দ-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। পরাগ -বিহগী বেনারসী, বিয়ের-জোড় পড়ে আবার প্রসন্নমুখে দেশে সবার কাছে আশীর্বাদ চাইতে আসবে বই কী। করোনার দৌলতে বিয়েটাও অনলাইনে ভার্চুয়ালি হয়ে গেল, হবেবাই না কেন, গোটা পৃথিবী আন্তর্জালের কল্যানে এখন তো একটা দেশ।

