ভালোবাসার স্বর্গসুখ
ভালোবাসার স্বর্গসুখ
প্রতিদিন সকালবেলাটা নন্দিনীর খুব চাপ থাকে - স্বামীর অফিস, ছেলে মেয়ের পড়াশোনা, ননদের কলেজ যাওয়া। এদের একদমে তৈরী করে দিতে হয়। তার সাথে বাকিদের সকালের জলখাবারও। আর এর মধ্যে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ফাঁকি ধরা, মারামারি সামলানো তো আছেই। একটু আগে বাবাই ও মা বলে পড়ার ঘর থেকে এমন ভাবে চিৎকার করে উঠলো যে নন্দিনীর হাতে গরম চাটুর ছ্যাঁকাই লেগে গেলো।
আবার শুরু করেছে পড়তে বসে দুই ভাইবোনে ঝগড়া,
রাগে নন্দিনী রুটি ভাজার খুন্তি নিয়েই ছুটে যায় বাবাই আর মুন্নির পড়ার ঘরে।
গিয়েই খুন্তি দিয়েই দুজনকে দুঘা দিয়ে বলল,আবার তোরা পড়তে বসে ঝগড়া শুরু করেছিস,
তোদের না একশোবার না করেছি পড়তে বসে ঝগড়া করবি না। জানোয়ার, জীবনটাকে একেবারে নরক করে দিলো।
বকবক করতে করতে নন্দিনী আবার রান্নাঘরে ফিরে যায়।
রানাঘরে ঢুকতেই দেওর জিজ্ঞাসা করে বৌদি আমার খাবার হয়ে গেছে?
দুমিনিট দাঁড়াও ঠাকুরপো, আর একটা রুটি ভাজা বাকি আছে,তারপরই দিচ্ছি,
মিমি মানে নন্দিনীর ননদ কলেজে যাবে, তাই ভাত খেতে চলে এসেছে।
সকাল ৮ টার মধ্যে নিলয়কে, মানে তার স্বামীকে খাইয়ে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ঘরে অসুস্থ শ্বশুর, এরপর শ্বশুরেরটা করতে হবে।
এটাই নন্দিনীর বারো বছরের সুখের জীবন।
জীবনটা একেবারে ভাজাভাজা হয়ে গেলো এই সংসারে এসে ।
এর মধ্যে ছেলেমেয়ে দুটো যদি মানুষ হোত।
সারাদিন শুধু ঝগড়া আর নিজেদের মধ্যে মারামারি, এই নিয়েই চলছে নন্দিনীর জীবন।
এক এক সময় কান্নায় গলা বুজে আসে।
তবুও বুকে পাথর চাপা দিয়ে নন্দিনী এক ভাবে সংসার চালিয়ে যায়।
নিলয়ই সংসারের বড় ছেলে। তাই নিলয়কেই সংসারের বেশী দায়িত্ব সামলাতে হয়।
শ্বশুর মশাই অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারী স্কুল টিচার, সামান্য পেনশন পায়, নিলয় রাজ্য সরকারের সাস্থ্য দপ্তরের একজন সামান্য কেরানি।
দেওর অনেক পড়াশুনা করেও চাকুরী পায়নি।তাই টিউশানি করে বাড়ীতেই বসে।একমাত্র ননদ মিমি এম,এ,পড়ছে।
হাজার কষ্টের মধ্যেও নিলয় হাসি মুখে সব সামলে নিচ্ছে যে কি ভাবে তা ভেবেই কূলকিনারা করতে পারে না নন্দিনী।
আজ বাবার ওষুধ, তো কাল মায়ের ডাক্তার, পরশু বোনের কলেজের মাইনে ।
তারপর নিজের ছেলেমেয়ের বায়না,এই ভাবেই নিলয়ের জীবন এগিয়ে চলে।
নিলয়কে কোন সময় ভাইবোনের উপর কখনো রাগ করতে দেখেননি নন্দিনী।পরিবারই যেন তার ধ্যান জ্ঞান।
নন্দিনী আর নিলয়ের এক ছেলে আর এক মেয়ে।
মেয়ে বড়,বয়স দশ,ছেলে ছোট বয়স সাত।
কিন্তু নন্দিনী আর পেরে ওঠে না।
একঘেয়ে জীবন। সারাদিন সংসার ঠেলতে ঠেলতেই জীবন শেষ।
নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই কোনদিন এই সংসার ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা করেনি নন্দিনী।
শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ সবাই নিলয়ের উপর ভরসা করে। তাই শত কষ্ট হলেও নন্দিনী মুখ বুজে সংসার সামলে যায়।
এহেন নন্দিনীর কদিন ধরে খুব শুঁটকি মাছ খেতে ইচ্ছে করছে।আত্মাটা একবারে ছুটে গেছে। কিন্ত কিভাবে খাবে, এই বাড়ীতে শুঁটকি মাছ নিষিদ্ধ।
এবাড়ীর কেউ শুঁটকি মাছ খাওয়াতো দূরে থাক, গন্ধ পর্যন্ত শুকতে পারে না।
নন্দিনীর মা বাবার দেশ ছিল ছিল ঢাকা,মায়ের কাছে জেনেছে ঢাকার মানুষেরা শুঁটকিমাছ খায় না।
মা এত সুন্দর শুঁটকিমাছ মাছ রান্না করতো, যে বিয়ের আগে নন্দিনী সেই মায়ের হাতের রান্না করা শুঁটকিমাছ দিয়ে পুরোটা ভাত খেয়ে উঠতো।
কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ী এসে জানতে পারলো তার শ্বশুর শাশুড়ি ফরিদপুরের লোক,আর ফরিদপুরের লোকেরা নাকি শুঁটকিমাছ খায় না।
ব্যস নন্দিনীর শুঁটকিমাছও খাওয়া একেবারে ঘুচে গেলো।
কিন্তু কদিন ধরে নন্দিনীর ভীষণ শুঁটকিমাছ খেতে ইচ্ছে করছে।
সংসারে প্রতিদিনই রান্না হয় একেকজনের পছন্দের রান্না।
তাই নন্দিনীর ইচ্ছে মত রান্না আর হয়ে ওঠে না।
সেদিন রাতের বেলা নিলয় ঘুমিয়ে পড়লে নন্দিনী মাকে ফোন করে।
সে মায়ের সঙ্গে অনেক কথা বলার পর,মাকে বলে, মা জানো আমার না খুব শুঁটকিমাছ খেতে ইচ্ছে করছে।
তোমার হাতের শুঁটকিমাছ কতদিন খাইনা।
এবার গেলে একদিন আমাকে একটু শুঁটকিমাছ রান্না করে খায়িও।
ও প্রান্ত থেকে মা বলছে, তুই আসিস, আমি তোকে শুঁটকি মাছ রান্না করে খাওয়াবো।
কতদিনতো আসিসনা। একদিন আয়না।
আর যাবো! এই সংসার ঠেলতে ঠেলতেই জীবন শেষ।কি করে যাই বল তো ? তোমার দুই নাতি নাতনির পড়াশুনা, অসুস্থ শ্বশুর, ননদের কলেজ,তোমার জামাইএর অফিস,এই করতে করতেই আমার দিন শেষ।
আর কি করে যাবো বল?
নিলয় চোখ বুজে শুয়ে ছিল।
সে তখনো ঘুমায়নি, সে শুয়ে শুয়ে নন্দিনীর সব কথা গুলি শুনলো।
সত্যি নন্দিনীর জন্য নিলয়ের খুব কষ্ট হয়, কিন্তু পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে, ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু করতে পারেনা।
আর একটা মেয়ে যে এতটা ধৈর্য ধরে সংসার সামলাতে পারে, নন্দিনীকে না দেখলে বোঝা যায় না।
যাইহোক নন্দিনীর সব কথাগুলি নিলয় শুনে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে।
ঠিকই ওদের বাড়ীতে কেউ শুঁটকিমাছ খায়না।
এমনকি রান্নার সময় যে গন্ধটা বেরহয় সেটাও কেউ সহ্য করতে পারেনা।
তাই পরেরদিন শনিবার।
নিলয়ের অফিস ছুটি। সে বাজারে গিয়ে কিছুটা শুঁটকিমাছ কিনে এনে লুকিয়ে রাখে।
আর একমাত্র রবিবারই নন্দিনী দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে।
শুধু নন্দিনী নয়, রবিবারটা মোটামুটি সবাই একটু দেরী করেই ঘুম থেকে ওঠে। ছুটির দিন বলে।
নিলয় রান্নায় এক্সপার্ট। সব রকম রান্নাই করতে ভালোবাসে ও পারে।
তাই রবিবার খুব ভোরবেলা সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, সে চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকে বেশ জমিয়ে শুঁটকিমাছের তরকারিটা রান্না করে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
যথারীতি একটু বেলার দিকে আস্তে আস্তে সবাই ঘুম থেকে উঠে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
নন্দিনীও রান্নাঘরে গিয়ে চা করে সবাইকে চা দিলো।
নিলয়কেও ডেকে নন্দিনী চা দেয়।
নিলয় চা খেয়ে বাজারে চলে গেলো।
বাজার থেকে নিলয় সবার পছন্দের কই মাছ নিয়ে এলো।
কিন্তু কইমাছ আবার নন্দিনী ভালো খায় না।
তাই কই মাছ দেখেই নন্দিনীর মুখটা ভার হয়ে যায়।
সে মুখে নিলয়কে কিছু বলল না ঠিকই,কিন্ত মনটা তার খারাপ হয়ে গেলো বোঝা গেলো।
নিলয় মাছটা নন্দিনীর হাতে দিয়ে নন্দিনীকে বলল, অনেকদিন তেলকই খাইনা, আজ বেশ জমিয়ে একটু তেল কই রান্না কর।
নন্দিনী নিলয়ের কথামত খুব সুন্দর করে তেলকই রান্না করলো।
রবিবার দুপুরে মোটামুটি সবাই একসঙ্গেই বসে খায়।
কিন্তু আজ নিলয় একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছে করেই দেরী করলো খাওয়ার সময়টায়।
সে নন্দিনীকে বলল, নন্দিনী তুমি সবাইকে আজ খাইয়ে দিয়ে আমার আর তোমার খাবারটা আমাদের ঘরে নিয়ে এসো। আমার তো দেরী হচ্ছে,আজ না হয় তুমি আর আমি এক সঙ্গে আমাদের ঘরে বসে খেয়ে নেবো।
সেই মত সবার খাওয়া হয়ে গেলে,নন্দিনী তার আর নিলয়ের খাবার নিজেদের ঘরে নিয়ে আসে।
নন্দিনী যখন নিজেদের খাবার ঘরে আনতে ব্যস্ত,ঠিক সেই সময় নিলয় শুঁটকিমাছের বাটিটা খাওয়ার জায়গার একপাশে ঢেকে রাখে।
সব কিছু নিয়ে আসার পর ওরা দুজনে খেতে বসলো।
নিলয় দেখলো একটা বাটিতে তাকে দুটি কইমাছ দিয়েছে।
সে নন্দিনীকে জিজ্ঞাসা করলো, একি তোমার মাছ কই,তুমি মাছ খাবে না?
নন্দিনী বলল,না আমি কইমাছ ভালো খাই না তুমি জানো না।তুমি ভালো খাও, তাই তোমাকে দুটো দিলাম।
নিলয় এবার আস্তে করে শুঁটকিমাছের বাটিটা ঢাকা দেওয়া অবস্থায় নন্দিনীর সামনে রাখলো।
নন্দিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি এটা?
নিলয় বলল,খুলেই দেখোনা,কি আছে।
নন্দিনী বাটির ঢাকাটা খুলতেই নাকে এলো সেই সুপরিচিত শুঁটকিমাছের গন্ধ।
সে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ সেই বাটিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
রান্না মাছটা দেখেই তার জিভে জল চলে এলো।
মুহুর্তের মধ্যে তার চোখদুটি আনন্দে চকচক করে উঠলো।
সে তার বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে নিলয়কে জিজ্ঞাসা করলো, এই শুঁটকি মাছ তুমি কোথায় পেলে?
কেন তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমিই রান্না করেছি।
গতকালই আমি তোমার জন্য লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
তুমি এত ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার জন্য শুঁটকিমাছ রান্না করেছো? নন্দিনী চোখে এখনো ঘোর।
কেন নন্দিনী, তুমি যদি রোজ ভোরবেলা উঠে আমার অফিসের রান্না করে দিতে পারো,তাহলে আমি কেন একদিন তোমার পছন্দের রান্না করে খাওয়াতে পারবোনা ? তোমার মা ছাড়াও তোমাকে আরেকজন তোমার প্রিয় মাছটা রান্না করে খাওয়াতে পারে, বুঝলে।
আনন্দে আবেগে নন্দিনীর চোখে জল চলে আসে।
নিলয়ের এই ভালোবাসায় সংসারের এই যাঁতাকলের সব যন্ত্রনা কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়ে এক অজানা অব্যক্ত স্বর্গ সুখে হারিয়ে যায় নন্দিনী।

