অসুরদলনী - শারদ সংখ্যা
অসুরদলনী - শারদ সংখ্যা


"সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবন ধারা"
কিশোর কুমারের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। টুবাইয়ের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে জানলার বাইরে তাকিয়ে সে দেখে এখনও সূর্যোদয় হয়নি । শরৎ এর আকাশে সাদা সাদা তুলোর মত মেঘ খেলা করে বেড়াচ্ছে। ঘন নীল আকাশ। মনটা ভালো হয়ে যায়। আজ ষষ্ঠী। গতকাল থেকেই তার স্কুলের ছুটি হয়েছে। এখন খালি মজা কদিন ধরে। ঠাকুর দেখা, নতুন জামা কাপর, ক্যাপ বন্দুক আরো কত কি! তার মা তাকে বলেছে এবার চারদিন ই বেড়াতে নিয়ে যাবে। তাদের পাড়াতেও তো পুজো হয়। সেখানেই সকাল থেকে গান বাজছে।
"টুবাই ওঠ বাবা। আর ঘুমোতে নেই। আজ পুজো শুরু হয়ে যাচ্ছে তো।"
"উঠছি মা।"
বাইরে এসে একটা বড় করে হাই তোলে সে। কুয়াশায় বাড়ির সামনের বাগানের ঘাস ভিজে। কোণের শিউলি গাছ টা থেকে কত ফুল ঝরে পড়েছে। তার মা এখন সেগুলি নিতে ব্যস্ত। শিউলি ফুল ই একমাত্র যা পুজোতে ব্যবহার করা যায়, মাটিতে পড়ে গেলেও। এও তার মার কাছেই শোনা।
"মা, আমিও তুলে দি কিছু ফুল?"
"হ্যাঁ আয়।"
সে এগিয়ে গিয়ে মাকে সাহায্য করে।
"মা আমরা এবার কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখবো?"
"আমরা সমস্ত প্যান্ডেলে যাবো বাবা, যেখানে যেখানে পুজো হয়।"
ছোট ছেলেটার মুখটা খুশিতে ভরে ওঠে।
"সত্যি?"
"হ্যাঁ বাবা।"
টুবাইয়ের কাছে তার মা ই সব।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে কোনো দিন বাবা কে দেখেনি। স্কুলের সব বন্ধু বান্ধব কি সুন্দর বাবার সাথে আসে, কিন্তু তার বাবা যে নেই। মা বলে তার বাবা সেই কবেই আকাশের তারা হয়ে গেছে।
মা ও ছেলের ছোট্ট সংসার। বাবা কে না পাওয়াতে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। কোনো মন খারাপ নেই। যাকে দেখলো না কোনো দিন চাক্ষুষ, তাকে নিয়ে আবার মন খারাপ কি? বাবা বলতে সে ওই ছবিটা বোঝে। কেমন একটা হাসি হাসি মুখ নিয়ে লোকটা তাকিয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনে তার মা ছবিতে মালা পরান। সে দিন মনে হয় লোকটা যেনো আরেকটু বেশি হাসছে। টুবাই মজা পায়।
"মা, দুর্গা মা ও তো একাই থাকে। গণেশ দাদা দের বাবা ও বুঝি তারা হয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ বাবা, গণেশ দাদা দের বাবা ও তারাদের দেশে থাকে।"
"ওহ্।"
টুবাই যেনো একটু আনমনা হয়ে পড়ে।
"কি রে, কি হলো?"
"নাহ্ কিছু না। আমি ভাবছিলাম মা দুর্গা তো দিব্যি সন্তান সন্ততি নিয়ে বাবার দেশে ফিরে যায়। আমরা কবে যাবো?"
টুবাইয়ের মা যেনো কথা টা শুনতে পেলো না। ফুলগুলো ডালিতে ফেলে রেখে এসে জড়িয়ে ধরলো ছেলে কে।
"অমন বলে না বাবা। বালাই সাঠ।"
"কেনো? বাবার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয়না বুঝি তোমার?"
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তার মা দিতে পারে না।
"চল তো। এই সব ছাড়। যত আজেবাজে প্রশ্ন। আজ আমরা কটা ঠাকুর দেখবো বল তো?"
"কটা?"
"হুম্ অন্তত পাঁচটা। আলো থাকতে থাকতে বেরোব আর সারা সন্ধ্যে ঘুরবো। ফুচকা খাবো, আলু কাবলি খাবো, আইস ক্রিম খাবো। খুব মজা হবে।"
টুবাইয়ের মনটা খুব খুশি হয়ে যায় নিমেষেই।
"আজকে পড়তে বসাবে না তো?"
"পাগল? এই চার - পাঁচ দিন কোনো পড়াশোনা নেই। খালি আনন্দ করবো তুই আর আমি!"
ছেলে গিয়ে মাকে আবার জড়িয়ে ধরে।
অঞ্জলী ভাবে, যাক ছেলেকে আবার ভোলানো গেছে। বড় না হওয়া অব্দি এভাবেই ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখবে। একা একা মানুষ করা যে কি কষ্ট তা আর কাকে বলবে। দু দিকেই অভিভাবকহীন। এই ক বছরে অনেক কিছু শিখেছে সে। অনেক কঠিন হতে হয়েছে। সে সব তো আর এই এক রত্তি ছেলেটাকে বলা যায় না। সে সব নিজেকেই মুখ বুজে সামলাতে হয়। এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়েই সব কিছু করা। যাতে ওর অন্তত কোনো কষ্ট, কোনো অভাব না থাকে। যাতে ও ওই লোকটার অভাব বোধ না করে।
লোকটা বেঁচে থাকতে প্রচুর জ্বালিয়েছে। সে সব দিন ভোলা যায়না। রাতের পর রাত অকথ্য অত্যাচার। স্বামী বলে কথা। সব সহ্য করতে হতো। কাউকে কিছু বলার যো ছিল না। কখনো কখনো বন্ধুদের নিয়ে আসত। তাদেরও যত্ন করার দায়িত্ত্ব বর্তাত তার ওপর। তবু যদি ভদ্র সভ্য লোকজন হত। এখনো ভাবলে শরীর বিষিয়ে ওঠে। ঘেন্না হতো। ভেবে পেত না সে এই নরক থেকে কবে মুক্তি পাবে।
লোকটা মারা যাওয়ার পর সেই বন্ধুগুলো এসেছিল সুযোগ নিতে। কোলে একরত্তি বাচ্চা। একা যুবতী মেয়ে মানুষ। জিভ লকলক করেছিলো নরকের কীট গুলোর। মাছ কাটার বটি নিয়ে সেদিন তেড়ে গিয়েছিল সে। কেটেও ফেলত যদি পাড়ার লোকজন এসে না আটকাত। যদিও এর পরেও লোকে নানা কথা বলেছে, অঞ্জলীর চরিত্র নিয়ে কুকথা রটেছে। এখনো বলে। অঞ্জলীর কিছু এসে যায়না।
"মা, এবার ইয়াং স্টার ক্লাবে নাকি দারুণ ঠাকুর হয়েছে?"
"তাই নাকি। জানিনা তো। আচ্ছা ওখানেই নিয়ে যাবো সবার আগে।"
"কি মজা!"
সত্যি কি নিষ্পাপ ওদের জগৎ টা। একসময় অঞ্জলীর জগৎ ও ঠিক এতটাই নিষ্পাপ ছিল। সে সবই করে, পুজো আচার। কিন্তু এই পাঁকের থেকে বেরোনোর উপায় তার জানা নেই। ছেলে বলে বাবার কাছে যাবে, কিন্তু তার মন চায় না। আবার ওই জঘন্য লোকটার কাছে সে কি করে যায় যাকে সে নিজে হাতে...
না না, কি সব ভাবছে সে। সে কথা ভাবা উচিৎ না। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে।
এই জায়গায় অনেক দিন হলো থাকা। পুজোর পর এখান থেকেও যেতে হবে। বেশি দিন এক জায়গায় থাকা ঠিক না। ছেলেটা কোনো ভাবে মানুষ হয়ে যাক। তারপর আর কোনো চিন্তা নেই, কোনো ভয় নেই। অসুর নিধন করলে যদি এ সমাজ শাস্তি দেয়, তো দেবে।