অস্পৃশ্য
অস্পৃশ্য


মোবাইল র অ্যালার্ম এ একটু কুঁকড়ে উঠে ঋতমা , চোখ না খুলেই বন্ধ করে অ্যালার্ম - গায়ের চাদর টা আরো একটু টেনে নিয়ে বালিশে আবার মাথা গুঁজে দেয় ঋতমা । কেমন একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে ?! আবার মিনিট দশেক পর বিরক্ত ভরা ঘুম চোখে মাথার ঠিক উপরে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়; কিন্তু অন্য দিনের থেকে খুব আবছা লাগছে ! " তাহলে কি অ্যালার্ম টা ভুল বাজলো ? ৭ টার সময় ঘর এতো অন্ধকার থাকার কথা নয় তো !" নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে - সাড়ে ৭ টা বাজে ! এতক্ষনে কানে এলো বৃষ্টির টুপ্ টুপ্ শব্দ . জানালার রঙিন পর্দাটা একটু আলগোছে সরিয়ে বাইরে তাকায় ঋতমা ।"রাস্তায় জল জমেছে! মানে কপালে আজ ও ভোগান্তি !" মনের অগোচরে ই ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় - বালিশের নীচ থেকে সারদা মায়ের বইটা বের করে প্রণাম করে , এটা তার বরাবরের অভ্যেস, আজ ও তাই । স্লাইডিং জানালার দিকে নিরাভরণ দৃষ্টি নিয়ে একটু বৃষ্টি ভেজা সকালের দিকে তাকায় । ওভার হেডের হাই টেনশন তারের উপর দুটো কাক - পুরো চুপচুপে ভেজা, একেই বলে বোধহয় কাকভেজা। সামনের বাড়ির সাদা কালো বেড়াল দুটোও , জানালার রেলিং এ ঘাপটি মেরে বসে ঘুমোচ্ছে , না চোখ ইচ্ছে করে বন্ধ আছে ; বোঝার উপায় নাই । অভ্যাসবশে ঋতমার বাম হাত টা বিছানার অন্য পাশে একটু হাতড়ে বেড়ায় - খালি , শুধু বিছানা নয় ; ঋতমা আজ পুরো একা!!
উঠে পরে ঋতমা - " মনে হয় ভোর রাত থেকেই বৃষ্টি পড়ছে! " আজ ঋতমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। ঘুম চোখেই ঘুমের সাথে রোজ লড়াই করে নিজেকে জাগায় সে। সারাটা দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও রাতে ঘুম আসতে চায় না !! কোনো মোবাইলের আসক্তিও ওর নেই । কিন্তু ঘুম আসে না , কত কষ্ট করে দু চোখের পাতা এক হলো কি - গভীর আতঙ্ক , ভয় ওকে আঁচড়াতে শুরু করে । খুব কম ঘুম হয় আজ কাল ওর আর তাই ঘুমের রেশ টা ঋতমার রয়েই যায় । বিছানায় শুয়ে অভ্র কে খুব মিস করে, তারপর খালি বালিশ এ অবরণহীন মাথা এদিক ওদিক করতে করতে বেশ খানিক্ষন ছোট ফট করে - তারপর কখন যে ঘুমের কোলে ঢোলে পরে নিজেই জানতে পারেনা । দীর্ঘ ছয় বছরের বিবাহিত জীবনের চড়াই উৎরাই , শত কষ্টেও এক সাথে থাকা , এতো টা পথ এক সাথে এসেও - অভ্র ওকে মাঝ রাস্তায় টুকি দিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে । ধরতে চাইলেও অভ্র ঋতমার নাগালের বাইরে ! অসময়ে অভ্র র চলে যাওয়াটা তাকে এখনো রক্তাক্ত করে । কত দিন রাতে ঘুম ভেঙে যায় - অভ্র কে খোঁজে ; শুধু শারীরিক ক্ষিদের তাড়নায় নয়, মনটা ও রাতের অন্ধকার টা বুঝতে পারে, বড্ড একা আর ফাঁকা লাগে ঋতমার । একরাশ একাকীত্ব ভিড় জমায় তার আসে পাশে ।
অন্ধকার কে বরাবরই ভয় পায় ঋতমা । পাওয়ার কাট হলে অভ্র কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো ; ক্যান্ডল ও জ্বালাতে দিতো না । অভ্র কিন্তু ব্যাপারটা খুব এনজয় করতো । রাগারাগির পারদ খুব বেশি চড়ে গেলে - অভ্র ওদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের মেন সুইচ অফ করে দিত । ব্যস ঝগড়া বন্ধ , প্রথম দিকে ঋতমা বুঝতে পারতোনা কিন্তু ২-৩ বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পর অভ্রর চুরি ধরা পড়তেই আবার ধুন্ধুমার কান্ড। আর আজ সেই ভীতু ঋতমা - পুরো ফ্ল্যাট'টায় একা । ছোট্ট ফ্ল্যাটের পরিসর বাড়েনি কিন্তু ঋতমার মনের পরিসরে ফ্ল্যাট টা এখনঅনেক বড় হয়ে গেছে।
ছয় বছরের বিবাহ বন্ধন আর তার ও আগে আরো পাঁচ বছরের প্রেম- অভ্র ঋতমার সব টুকু জুড়ে ছিল। আর তাই গত এক বছরে ঋতমা এক পা ও এগোতে পারেনি - শুধু নিজের চাকরিটাই মন দিয়ে করে চলেছে । বন্ধুদের সহযোগিতা , নিজেকে ভুলিয়ে রাখা - কাজে ব্যস্ত থাকার বাহানায় নিজের যন্ত্রনা গুলো কে মনের অন্ধকারে আটকে রাখার চেষ্টা । সত্যিই তাই - নিজের না বলা কষ্ট আর কান্নাকে আটকেই তো রেখে দিয়েছে ঋতমা মনের কোন এক গভীর সিন্দুকে। সব কিছু ভুলে ঋতমা নতুন পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে পারেনি - অভ্রর স্মৃতির সাথে পুরোনো বাসাতেই আটকে রয়ে গেছে । তারা দুজনেই একটা মিডিয়া হাউসে চাকরি করতো। তুখোড় , নির্ভীক সাংবাদিক অভ্রকে একটা নিউজ কভার করতে কাশ্মীর যেতে হয়েছিল , কিন্তু ফেরা আর তার হয়নি। তার পরিবর্তে একটা কফিনে এসেছিল ছিন্ন ভিন্ন কিছু দেহাবশেষ। সেদিন কি আকাশের রঙটা লাল ছিল ?! অফিসের লোকজনদের সহানুভূতি, সহমর্মিতা ঋতমাকে সেই দুঃসময়ে একটা মজবুত খুঁটির কাজ করেছিল, নতুন করে কাজের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল । আর কাজটাই এখন ওর লাইফ লাইন।
উঠে পরে ঋতমা . " নাহ, বেরোতে হবে !!!" . আজ আবার একটা ইন্টারভিউ আছে । সুতপা সেনগুপ্ত - এক NGO'র কর্নধার , দীর্ঘদিন ক্যান্সার পেশেন্টদের নিয়ে কাজ করছেন । ওদেরকে সঙ্গীত থেরাপির মাধ্যমে হিলিং পাওয়ার দিয়ে সুস্থ করার বিষয়ে কাজ করছেন । আজ উনি ওনার পেশেন্টদের সঙ্গে শহরের এক নামকরা ক্লাবে থাকবেন ; সেখানেই যাওয়ার কথা ঋতমার। পেসেন্টদের জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ ঘটনা , ওঁনার কাজের পদ্ধতি এসব নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে হবে। ব্রাশ করতে করতে একটু কফি বানিয়ে নেয় - বৃষ্টি হচ্ছে , তাই কফি খেতে খুব ইচ্ছে করলো । দেরি হয়ে গেছে , কিন্তু তাও কফি কাপটা নিয়ে ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় - চারিদিকটা কি সুন্দর ভেজা ভেজা সবুজ!! একটু একটু করে শুরু হয় ঋতমার প্রাত্যহিক কাজ - বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে গিজার টা চালিয়ে দেয় ; " আজ একটু হালকা গরম জল মিশিয়ে স্নান করতে হবে - নাতো ঠান্ডা লেগে যাবে " । চট জলদি রেডিমেড উপমা বানিয়ে ঢুকে পরে স্নানে । ঠাকুরকে একটু জল -বাতাসা আর প্রদীপ দিয়ে নিজে রেডি হয়ে নয় - আজ কাল আয়নাটাকে এড়িয়ে চলে ও - ভালো লাগে না আর নিজেকে আয়নায় দেখতে !
ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ে - প্যালাজো , কুর্তি আর একটা স্কার্ফ -এ ঋতমার ব্যক্তিত্ব আরো প্রখর হয়ে ধরা পড়ে যেন। অফিসের গাড়ি আসতেই উঠে পড়ে ঋতমা ; হোম পিক আপ এন্ড ড্রপ এর সুবিধা অফিসই করে দিয়েছে। ক্যামেরাম্যান তপন দাও সাথে আছে । ঋতমাকে দেখে তপনদা বলে " বাহ্ !! দারুন মানিয়েছে তোকে ড্রেস টাতে ; সুন্দর লাগছিস। " ঋতমা কোনো উত্তর না করে ,শুধু ম্লান হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে । সারাদিন বক বক করা মেয়েটা এখন সব সময় গুরু গম্ভীর !!! বৃষ্টির ছুটে আসা প্রতিটা জলবিন্দুকে উপেক্ষা করে তাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে । অন্য দিন ঋতমা স্টোরি কভার করা নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে , একটু ভালো করে কেস স্টাডি করে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নেয়। কিন্তু আজ ওসব কিছুই দরকার পড়লোনা । এক মনে বৃষ্টি দেখছে - বাম হাত টা গালের থেকে একটু উপরে উঠতে ই দেখে দু ফোঁটা জল - নিজের অগোচরে কখন বেরিয়ে এসেছে , বড্ড অবাধ্য এরা। মন খারাপ টা কে কমানোর জন্য ভাবে " এই পেশেন্টদের কত কষ্ট - এদের সঙ্গে আজ নিজেকে একটু ভাগ করে নেব। "
গাড়ি এসে থামে , ঋতমা তপনদা কে ইন্সট্রাকশন দিয়ে ভিতরে ঢোকে । সুতপা সেনগুপ্তের এসিস্টেন্ট জাগরী - শ্রীমতি সেনগুপ্ত নিজেই আলাপ করিয়ে দেন ঋতমার সঙ্গে।
শ্রীমতি সেনগুপ্ত : " জাগরী , ইনি ঋতমা রায় ; পেশায় রিপোর্টার । তোমাকে তো বলেই রেখেছিলাম , পেশেন্টদের নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা আছে। ওনাকে ভিতরে নিয়ে যাও; আর উনি যে ভাবে বলেন একটু সাহায্য করো প্লিজ। " ।
ঋতমা এক ঝলক দেখে জাগরীকে , খুব মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে । বয়েস কত হবে 23 কি 24। খুব আকর্ষণীয় চেহারা, "কিন্তু ওর ও বোধহয় ক্যান্সার , তা নাহলে মাথায় চুল নেই কেন ?" নিজের মনেই বলে ওঠে ঋতমা । কখন যে এই সব আবোল তাবোল সাত পাঁচ ভাবতে লেগে গেছিলো - শ্রীমতি সেনগুপ্ত'র কথায় বাস্তবে ফেরে ঋতমা ।
শ্রীমতি সেনগুপ্ত : "আপনি যান , জাগরী আপনাকে পুরো গাইড করে দেবে"।
ঋতমা : " আপনার থেকেও কিছু শোনার অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু ম্যাম"।
শ্রীমতি সেনগুপ্ত : "নিশ্চয়ই !! কিন্তু আগে এই মানুষ গুলোকে একটু কাছ থেকে দেখে নিন , আপনার মন ছুঁয়ে যাবে বিশ্বাস করুন "।
শ্রীমতি সেনগুপ্ত চলে যান সামনের লম্বা করিডোর দিয়ে , শেষ প্রান্তের বড়ো দরজার দিকে । জাগরী এগিয়ে এসে হেসে ঋতমাকে ভেতরে নিয়ে যায় । ঋতমা কিছু জিগ্যেস করতে গিয়ে ও ইতস্তত করে চুপ হয়ে যায়। "" নাহঃ !!! থাক "" নিজের মন কে শান্ত করে সে জাগরীকে অনুসরণ করে। জাগরী ওকে একটা বিশাল বড়ো হল ঘর এ নিয়ে ঢোকে -- ঋতমা অবাক হয়ে দেখে সেখানে প্রচুর পেশেন্ট , নানা রকমের বয়েসের , নানা ভাষাভাষীর । নিজেরা নিজেদের মতো করে আলাপ আলোচনার ব্যস্ত । খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবাই একটু অবাক দৃষ্টিতে ঋতমা কে দেখে। নতুন মুখ ওদের কাছে খুব একটা আসেনা - বাড়ির লোকগুলোই খোঁজ নেয়না !!!
ঋতমা ও ওদের চোখের দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা হাজার প্রশ্নকে বুঝতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে এগিয়ে যায় বছর নয়ের টুবলাই এর দিকে । এক মনে বসে ব্লক নিয়ে খেলছিল বাচ্চাটা , ঋতমা এগিয়ে গিয়ে আলাপ জমায় ।
ঋতমা : "কি নাম তোমার ?"
টুবলাই : "অনীক জানা , তবে তুমি টুবলাই বলতে পারো"।
এক গাল অনাবিল হাসির সঙ্গে উত্তর দেয় নিষ্পাপ শৈশব !! " এই ছোট্ট বাচ্ছাটা ও মারণ রোগের কবলে ; কত কষ্ট- যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে এইটুকু জীবনে- কোথায় সে দৌড়ে বেড়াবে রঙিন প্রজাপতি হয়ে , তা নয় হাসপাতাল আর ঘরের চার দেয়ালে আটকা পরে গেছে " - নিজের মনেই বলে ওঠে ঋতমা। নিজের ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে ওকে এগিয়ে দেয়, টুবলাই ঋতমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে " বাইরের খাবার এলাউড না আন্টি । আর এখানে বুন্টি , টুটু পিকলু সবাই আছে . ওদের কে ছাড়া ..." টুবলাই কথাটা শেষ করার আগেই জাগরী এগিয়ে এসে বলে " আজ নিতে পারো , বিগ সিস্টার বলেছেন। "
ঋতমা টুবলাই'র গল্ টিপে একটু আদর করে বলে " সবার জন্য আছে রে , তুই এটা নে !! সব্বাই কে আজ তুই দিয়ে আয় " , ঋতমা একটা বড় চকলেটের প্যাকেট বের করে ওর হাতে দেয় , একবার জাগরীর দিকে তাকিয়ে পারমিশন নিয়ে নেয় । চকলেট পেয়ে সবাই বেজায় খুশি , খুশি ঋতমার মতো অজানা অতিথিকে পেয়েও। তারপর শুরু হল ওদের ক্লাস । শ্রীমতি সেনগুপ্ত এসে এক এক করে সবাইকে যেন নিজের ভালোবাসা ও স্নেহাশীষ এ ভরিয়ে দেন - নিজের কাছে টেনে নিয়ে কাজে মন লাগাতে বলেন ; NGO র হয়ে ছোট ছোট হাতের কাজ করে ওরা । ছোট বাচ্চারা অবশ্য পড়াশুনা আর আঁকা শেখে । জাগরী ম্যাডাম সেনগুপ্তর নির্দেশে মিউজিক চালু করে।
ঋতমা দেখে মিউজিক চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই খুব খুশি হয় , তাদের সেই আনন্দ তাদের মন ও শরীর উভয়কেই যে উজ্জীবিত করছে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এক একটা সেশন প্রায় আধা ঘণ্টার হয় । তারপর ঋতমা সবার সাথে কথা বলা শুরু করে । একজন নতুন বন্ধু পেয়ে সবাই উচ্ছসিত হয় , ও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে নিজেদের পরিধিতে সামিল করে নেয়। ঋতমা ও খুব আনন্দ পায় আজ , সবাইকে এত কাছ থেকে পেয়ে, জানতে পেরে তার মনের কত জানলা যে খুলে যায় , তার খবর হয়তো ঋতমারও জানা ছিল না। একজন ঠাকুমা তো ঋতমাকে নাতনি স্নেহে খাইয়েও দিলেন । কতদিন এরকম আদর পায়নি ঋতমা -বারবার কান্না গুলো তার গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছিল। অনেক কিছু জানতেও পারলো - গান , সুর-তাল-লয় কি করে মানুষ কে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়, লড়াই করতে করতেও জীবনের মূলস্রোতে ভেসে থাকার আনন্দ জাগায় ওদের মনে।
অনেকের সাথে কথা বলে ঋতমা তার প্রতিবেদনের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য পেয়ে যায় , তবু তার মন যেন আরো কিছু জানার অপেক্ষায় থাকে। এবার তাকে উঠতে হবে ..আরো একটা ফিল্মের শুটিং কভার করার আছে , তার আগে সুতপা সেনগুপ্তের থেকে আর কিছু জানার আছে । জাগরীকে কথাটা বলতেই , জাগরী ওকে একটা রুমের সামনে অপেক্ষা করতে বলে রুমের ভিতরে চলে যায়। মিনিট খানেক পর বেরিয়ে এসে বলে "ম্যাডাম একটু ব্যস্ত আছেন ; মিনিট পাঁচেক পরে ভেতরে যেতে বললেন "। জাগরী কথাটা বলে পেশেন্ট রুমের দিকে পা বাড়ায় , ঋতমা হঠাৎ বলে ওঠে " আপনার কোন স্টেজে ধরা পড়েছিল ? এখন আপনি কি পুরোপুরি সুস্থ ? "
জাগরী একটু ও অবাক না হয়ে হেসে বলে " আপনি, ভুল করছেন .আমি পেশেন্ট না , মানে আমার ক্যান্সার হয়নি "।
ঋতমা খুব অবাক হয়ে , নিজেকে সামলে নিয়ে বলে " না !!! মানে আপনার চুল নেই ,,,, তাই !? "
জাগরী: আসলে এদের সাথে সারাদিন রাত থাকি , খুব ভালো বাসি এদের । তাই ওদের কষ্ট হয় , এরকম কারণ গুলোকে আপ্রান চেষ্টা করি এড়িয়ে যেতে। চুল না থাকার জন্য ওরা খুব কস্ট পায়, আর দেখুন - এখন আমরা সবাই এক রকম । চুল নেই মানে, ধরেই নিলাম ক্যান্সার ; খুব অদ্ভুত ভাবে সত্যি , তাই না !!! একটু থেমে জাগরী আবার বলে , " তাই আমি , নিজের চুলটাই রাখিনি। "
ঋতমা এক মুহুর্ত সময় নয় , তারপর নিজের স্কার্ফটা সরিয়ে দেয় ; জাগরীর দিকে হাতটা বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে । জাগরী অবাক হয়ে দেখে - ঋতমার মাথায় অল্প অল্প চুল হতে শুরু করেছে !!!! ঋতমা আনন্দে, কান্নায় বলে চলে " ক্যান্সার, আমাকে পুরো নিঃস্ব করে দিয়েছে । অভ্র'ও খবরটা মেনে নিতে পারেনি । খুব কষ্ট পেয়েছিলো । কিন্তু আমাকে কোনভাবেই ভেঙে পড়তে দেয়নি ও। এক মাত্র ওই আমার এই লড়াই এ পাশে ছিল। কিন্তু , ভগবান ওকে ও কেড়ে নিলো যে। অভ্র - আমার লাঠি টাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল । নিজের ভাই বৌদিরা ও জানার পর কোনোদিন দেখা ও করতে আসেনি !!! ফোনে এ লৌকিকতা ও সহানুভূতি দেখিয়েই খালাস !!! জানো , এখন ও রাতে বালিশ এ মাথা রাখলে অনুভব হয় কিছু একটা নেই ; খুব খালি খালি লাগে। মাথাটা খসখস করে, ঘুমোতে পারিনা । তারপর অভ্র আসে - আমি বুঝতে পারি । সযত্নে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় । চাকরি করি , বন্ধুরা সঙ্গে আছে, তবু কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম কোথাও। আজ তোমার জন্য আবার নিজেকে মেলে ধরার সাহস পেলাম । ফিরে পেলাম আবার আমার আমিকে। "
জাগরী হেসে ফেলে , আর ঋতমা স্কার্ফ টা গলায় কায়দা করে জড়িয়ে নিয়ে আভরণ হীন মাথা উঁচু করে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে শ্রীমতি সেনগুপ্তের রুমে ঢোকে , ঠোঁটের কোন লেগে থাকে অনেক শান্তির হাসি !!!!