Partha Pratim Guha Neogy

Romance

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance

অসময়ের বৃষ্টি

অসময়ের বৃষ্টি

10 mins
542


কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চলে শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গতিতে ঘন্টায় প্রায় ৪০ কিমি প্রতি ঘন্টায়, তাও কপাল ভালো থাকলে। এছাড়া সব সময় জ্যাম তো লেগেই রয়েছে, সেক্ষেত্রে এখানে ছোট্ট ভক্সওয়াগন গাড়িটা ছুটছে ঘণ্টায় সত্তর মাইল গতিতে, পঁচানব্বই নম্বর হাইওয়ে ধরে, নিউ জার্সির দিকে। রবিবারের বিকেল, রাস্তা ফাঁকা। গ্রীষ্মের দিনে অনেকক্ষণ আলো থাকে। সন্ধে হতে ন'টা বাজবে। ড্রাইভারের সিটে আমি, অর্থাৎ এই নিরীহ সাংবাদিক নিশানাথ। পাশে কবিতা । নিউ জার্সির নামকরা কবি। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। আজ ছিল ফিলাডেলফিয়ায় সাহিত্যসভা।

কবিতা আর আমি একসঙ্গে কলকাতার ইংরেজি অনার্স। আমার মত গুটিকয়েক ছেলে ছিল ইংরেজি ক্লাসের মাইনরিটি। ঝকঝকে, ফ্যাশনেবল মেয়েরা ওড়না উড়িয়ে, জিন্স-টিশার্টে হিল্লোল তুলে ঘুরে বেড়াত। আমরা ভেবলুর মত দেখতাম। সাহিত্য ভালোবেসে পড়তে আসার হ্যাপা কি কম? যখন অন্যান্য বন্ধুরা ব্যস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং আর ডাক্তারি পড়া নিয়ে, তখন সাহিত্যেকে ভালোবেসে ইংরাজি পড়া জীবিকার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় জুয়া খেলা বলা যায়।বাড়ি থেকে বলেই দিয়েছিল, "পড়াশুনোর শেষে চাকরি যদি জোটাতে না পারো, তাহলে বাড়ির হোটেলের দরজা বন্ধ।"

সেই ভয়ে ভীত আমরা কয়েকজন দিনরাত এক করে পড়াশোনা করি। নেট, স্লেটএর চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যায়।  

অন্যদিকে কবিতার মত সহপাঠিনীরা দেদার আড্ডা মারে, লেটেস্ট ফ্যাশন ট্রেন্ডের খবরাখবর রাখে, কফিহাউসে গিয়ে খায় ও খাওয়ায়। সেইসঙ্গে দুর্ধর্ষ রেজাল্টও করে। পড়ে কখন, সে এক রহস্য!

একদিন জিজ্ঞেস করতে ঝাড়া দু'মিনিট আমার দিকে চোখ সরু করে চেয়েছিল।

আমি তো ঘাবড়ে টাবড়ে একাকার! কী জানি বাবা, কী ভুল বলে ফেলেছি, ভগবান জানে!

আশ্বস্ত করে আমায় পিঠ চাপড়ে দিল, "ওই কফিহাউসেই তো আদ্ধেক পড়াশোনা হয়ে যায় রে, আসিস একদিন, বসিস আমাদের আড্ডায়।"

চমকে উঠি, "আমি? না না..."

সে আড্ডায় কলকাতা ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বল সব নক্ষত্ররা আলো ছড়ান।। কেউ ফিল্ম ডিরেক্টর হবেন, গুটিকয়েক ফিল্ম বানিয়ে ইতিমধ্যেই কলেজ ফেস্টে খ্যাতিলাভ করেছেন। কেউ বা বিজ্ঞাপন জগত আলো করবেন বলে এখন থেকেই কপিরাইটিং করেন। কেউ আবার আগুন-ঝরানো বিপ্লবী। কলেজ থেকে একবার বেরোনোর অপেক্ষা, তারপরেই বিপ্লব সংঘটিত হবে।

এঁদের জগতে আমার মত মফস্বলি বাঙাল যে একান্তই বেমানান, সে জ্ঞান আমার আছে। ওসব আড্ডায় ওই কবিতার মত মেয়েদেরই মানায়।

দূরে দূরেই ছিলাম। এবং কী আশ্চর্য, আমার মত ক্যাবলাকান্তর জন্যে কবিতার হৃদয়ে কোথাও একটুকু জায়গা ছিল। বন্ধুত্বের জায়গা, সহমর্মিতার জায়গা। ওই সব আলো-জ্বলা টেবিল ছেড়ে মাঝে মাঝেই আমায় টেনে নিয়ে যেত ক্যামপাসের মাঠে। সবুজ ঘাসে বসে চলত সাহিত্যের আলোচনা। দুজনের একটা ব্যাপারে খুব মিল - লেখালেখি। নতুন যা লেখা হল, তা একে অন্যকে শোনানো চাইই চাই। আমার লেখার প্রথম পাঠিকা কবিতা, কবিতার প্রথম পাঠক আমি। এ নিয়মের নড়চড় হত না। পড়া এবং কঠোর সমালোচনা। নিজেদের লেখাকে নির্দয় কাটাছেঁড়া না করলে শান্তি নেই।

কবিত্বশক্তি কবিতারই বেশি। শব্দ নিয়ে অনায়াসে খেলতে পারে, তাকে গেঁথে গেঁথে অনুপম ব্যঞ্জনায় গড়ে তোলে ভাবনার সৌধ। কবিতায় তাকে আমি কোনোদিন এঁটে উঠতে পারিনি। কিন্তু লেখার হাতটি আমারও মন্দ নয়। আমি গোল দিতাম নন-ফিকশন গদ্যে। প্রবন্ধ, প্রতিবেদনে আমি স্বচ্ছন্দ। রম্যরচনাতেও হাত পাকাচ্ছি তখন। কোনো লেখা পড়ে কবিতা হয়তো বলল, "দিব্যি হয়েছে, দশে দশ।"

আমি সন্দিহান, "কোনো কমেন্ট নেই? যাহ, তুই পড়িসনি ভালো করে।"           

তেড়েমেড়ে উঠত কবিতা , "ধুত্তেরি, ভালো হলে ভালো বলতেও পারবো না? কী জ্বালা!!"

তেমনি ওর কবিতার প্রশংসা করলেই খ্যাঁক করে উঠত, "মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবি না তো? পড়ে বল কোথায় খামতি আছে।"  

অন্ত্যমিল না গদ্যকবিতা, সাবলীলতা নাকি চমকে-দেওয়া শব্দবন্ধ - এসব নিয়েই কাটত অনেকটা সময়। এহেন কবিতা একদিন বেনারসি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ল। আমরা কব্জি ডুবিয়ে নেমন্তন্ন খেলাম।

কবিতার মনোহরণ করেছিল ঝিলের ওপারে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটি সুপাত্র। আমাদেরই ব্যাচ, আমরা সবাই চিনি তাকে। কাব্য অতি ভালোমানুষ। নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলেই বাঁচে। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপার্টমেন্টে বেশ ওপরের দিকেই থাকে তার নাম। ভারি বন্ধুবৎসল। প্রায়ই নিজের গাঁটের পয়সায় আমাদের খাওয়াত। বিয়ের পর ব্যাঙ্গালোরে ভাগলবা হল দুজনেই। ততদিনে আমি খবরের কাগজে চাকরি নিয়েছি, সাংবাদিক। রাতের শিফটে ডিউটি। দিনে ঘুমোই, রাত জেগে কাজ করি। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। কেই বা আর রাত জেগে জেগে আমার সঙ্গে গল্প করবে?

তারপর ভাগ্যই হঠাৎ একদিন আটলান্টিক পার করে দিল। কাগজের করেসপন্ডেন্ট হয়ে নিউ ইয়র্ক অফিসে ট্রান্সফারের কথা জেনে আগেই মনে হয়েছিল কবিতার কথা। সে যে নিউ জার্সিতে, সেটুকু খবর আমার কাছে ছিল।    

ফোনে ধরলাম একদিন। ওপাশ থেকে লাফিয়ে উঠল, "কী বললি? নিউ ইয়র্ক অফিস? এক্ষুনি আয়, এক্ষুনি আয়! উফ, কত্তোদিন বাদে তোকে দেখব বল তো?"

"কবে আসছিস? কতদিন থাকবি?" পাশ থেকে পরিচিত খুশি-খুশি গলা। কাব্য ।     

তারপর এই নিউ জার্সিতে আবার দেখা। কবিতা প্রতিষ্ঠিত কবি, নিউ জার্সিতে রীতিমতো পরিচিত মুখ। পুরোনো বন্ধুত্ব চাগাড় দিয়ে উঠতে দেরি হল না। বন্ধুবৎসল কাব্যর কোনোই পরিবর্তন হয়নি, বরং আতিথেয়তার বহর আরো বেড়েছে। বিদেশে বেশ কিছুকাল বসবাসের ফলে রান্নায় তার চমৎকার হাত পেকেছে। কারণে অকারণে ডাক পাঠায়। ফলে তাদের বাড়িতেই আমার সিংহভাগ সময় কাটে। কাব্যর কিচেনের চা ও সুস্বাদু 'টা' সহযোগে ঘণ্টার পর ঘন্টা কবিতা আর সাহিত্য আলোচনায় অতিবাহিত হয়। সেই কলকাতার কফি হাউসের দিনগুলিই ফিরে এল বুঝি বা।

কাব্য নিজের অফিসে তিনখানা মনিটর আর দুটো কিবোর্ড সাজিয়ে ইলেকট্রনের জগতে মশগুল থাকে। মাঝে মাঝে এসে একটু ফোড়ন কেটে যায়। টিপটে চা শেষ হলে ভর্তি করে দেয়। সত্যিই অতিথিবৎসল।    

নিউ জার্সি-নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্যবৈঠকে কবিতার নিয়মিত যাতায়াত। সেসব সভায় আমি খুব আনন্দের সঙ্গেই তার সঙ্গী হলাম। এ ব্যবস্থায় কাব্য যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাহিত্য বা কবিতা জিনিসগুলো সে তেমন ভালো বোঝে না। নেহাত অনিচ্ছায়ই মাঝে মাঝে কবিতার সঙ্গী হত। গৃহশান্তি বজায় রাখতে হবে তো? আমায় পেয়ে তার সে যন্ত্রণার অবসান হল।

তবে এত কষ্ট করেও শান্তি বোধহয় আর থাকছে না।

নিত্য যাতায়াতের পথে কবিতার গজগজানি। শুনে শুনে আমি ক্লান্ত। আজও চলছিল ধারাবিবরণী।

"কিচ্ছু করে না, জানিস? সারাক্ষণ নিজের অফিসঘরটায় তিনখানা মনিটর সাজিয়ে বসে থাকে!"

এতটা অনৃতভাষণ মেনে নিতে সত্যিই কষ্ট হল। "কেন, তোর বাড়িতে গেলে কাব্যই তো চা খাওয়ায়, স্ন্যাক্স এনে দেয়। কত যত্ন করে! তু্ই তো শুধু সোফায় বসে আড্ডা মারিস!"

তেড়েফুঁড়ে উঠল, "হ্যাঁ, তোদের সামনে তো ঐরকম একটা ইমেজ তৈরী করে রাখে। এদিকে যে বাড়ির সব কঠিন কাজ আমি করি?"

"সে না হয় একটু করলিই। ডিভিশন অফ লেবার বলে একটা কথা আছে তো? কাব্য যা যা করে তার সব কি তু্ই করিস? তোর বাড়ির নোংরা ফেলে কাব্য । গার্বেজ ব্যাগ হাতে তোকে তো একদিনও দেখিনি আমি?"

"ম্যাগো! আমার ঘেন্না করে!"

"তারপর দেখ, তোর পার্সোনাল ব্লগটা তো কাব্যই বানিয়ে দিল! যেখানে তু্ই কবিতা লিখিস আর লোকে আহা-উহু করে!"    

"হুঁহ, তোর তো চোখে শুধু ওগুলোই পড়ে! জানিস, সেদিন বললাম, বাগানে আগাছাগুলো উপড়ে দিতে। দিলই না!"

সর্বনাশ! কবিতা এবার খুবই বিপজ্জনক দিকে যাচ্ছে! বাগান তার প্রাণ। এই অভিযোগ থেকে কাব্যকে রক্ষা করার মত এলেম আমার নেই। ঝটপট কথা ঘোরাই, "তোর ডালিয়াগুলো ফুটল? সেদিন যে দেখলাম কুঁড়ি এসেছে?"

"হ্যাঁ রে, গাছ ঝেঁপে ফুল একেবারে! আর কী রং! একেকটা ফুলে একের বেশি শেড! ভাবতে পারবি না..." মনের মত বিষয় পেয়ে কলকলিয়ে উঠেছে।

রাস্তায় চোখ রেখে আমি ঘাড় নাড়ি। আড়ালে ডেকে কাব্যকে একটু ধমকে দিতে হবে। এতদিন ঘর করছিস, একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারিস না হাঁদা?

বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। কাব্য বেরিয়ে এসেছে, "চা খেয়ে যা। আড়াইঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এলি।"

"খাওয়া।" আরাম করে বসেছি সোফায়।

কবিতা মনে করাল, "পরের শনিবার কিন্তু নিউ জার্সিতেই। কবিতা ক্লাবের সেশন।"

মাথায় ঝটাকসে বুদ্ধি খেলে গেল, "পরের শনিবার তো হবে না রে, আমার ডিউটি আছে।"

"তাহলে আর কী, আমি একাই..." কবিতা নিমেষে নিবে যায়।  

"না না, একা যাবি কেন? কাব্যটা আছে কি করতে? কাব্য , এই ব্যাটা কাব্য !" হাঁক পাড়ি আমি।

"ষাঁড়ের মত চেঁচাতে হবে না। সব শুনতে পাচ্ছি আমি।" কাপ-প্লেট-টিপট নিয়ে গুছিয়ে বসল।

"শুনেছিস তো? যাক!" আমি নিশ্চিন্ত।

"কিন্তু আমি তো যাচ্ছি না? আমার অন্য কাজ আছে।"   

কবিতার মুখ আঁধার।

আমি তাড়াতাড়ি সামাল দিই, "কী এমন তোমার কাজ যে তুমি বৌকে সঙ্গ দিতে পারো না?"

"সঙ্গ দিলেও গালি খাবো, না দিলেও গালি।" কাব্য গোঁয়ারের মত বলে।

"কাউক্কে যেতে হবে না। একাই যাবো আমি।" কবিতা ফেটে পড়ে। "আমি চললাম ওপরে। মাথা ধরেছে।"

সত্যিই গটগটিয়ে চলে গেল নিজের শোবার ঘরে।

"এমন করে কেউ বলে?" আমার খারাপ লাগছে।

"ছাড় তো!" কাব্য কেমন নির্বিকার!

আমি একটু ধন্দে পড়ে যাই। উঠে পড়ি। কাল সোমবার। সকাল সকাল কাজে বেরোনো। সারাসপ্তাহ চূড়ান্ত ব্যস্ততা। প্রেশার কুকার জীবন। সপ্তাহান্তে একসঙ্গে সময় কাটানো, গল্প আর আড্ডার মধ্যেই তো বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়ে নেওয়া। সে রসদে কি টান পড়ছে কাব্য আর কবিতার সংসারে? কি জানি!

এমন করেই গড়িয়ে চলে দিন। কাজের চাপ বেড়েছে আমার। সবসময় নিউ জার্সি আসতেও পারি না। সব সাহিত্যসভায় যাওয়াও হয়ে ওঠে না।

কবিতার কবিখ্যাতি বেড়েছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন বন্ধু। ভক্তমণ্ডলী ঘিরে থাকে।

একদিন কাব্যকে ধরে বললাম, "বৌকে একটু মনোযোগ দে। যে রেটে বিখ্যাত হচ্ছে কবিতা,কেউ যদি ইলোপ করে?"

শুনে সে কী ঘর ফাটিয়ে হাসি! থামতেই চায় না। "ইলোপ? কে করবে?"

"কেন, আমিই যদি করি? তু্ই তোর গুহায় বসে থাকিস। আমিই তো কবিতার সঙ্গে এখানে ওখানে যাই!"

"আরে কর, কর! ক্ষতি কী? গো অ্যাহেড ম্যান!" আবার সেই গা-জ্বালানো হাসি।

মরুকগে, আমার কী? আমি কি ওদের সম্পর্কের জিম্মেদারি নিয়েছি?      

এই করে করেই কেটে যায় গ্রীষ্মের তিনটে মাস। ফসল উঠে গেছে ক্ষেত থেকে। হেমন্তের রং ধরেছে পাতায়। ফল কালার। উজ্জ্বল কমলা, হলুদ, লাল রঙের আগুন লেগেছে বনে বনে। ঝরে যাবার আগে রঙের খেলা।

কবিতাই সেদিন ফোন করল।     

"মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নেমন্তন্ন করেছেন। আমার কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্যে একটা স্পেশ্যাল সেশন রাখতে চান।"

"বলিস কী রে?" আমি উচ্ছ্বসিত। "দারুণ খবর! তোর তো দিকে দিকে জয়জয়কার!"  

"আমি সেই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি। আমার কবিতা নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেব।"

"বাঃ, বাঃ, বিরাট সম্মান। তু্ইই তাহলে সেদিন কবিদের মধ্যমণি" আমি সত্যি খুশি।

মেরিল্যান্ডের কবি-সম্মেলন উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী ও পুরোনো কবিতার আড্ডা। বাছাই করা কবিরা ডাক পান। সামনের মাসেই সেই সভা।  

"কাব্য আমার সঙ্গে যাবে না। কবি হিসেবে আমার এতবড় সম্মান, এমন দিনেও ওর নাকি কাজ আছে। আমায় বলেই দিল, অত কবিতা শুনলে ওর নাকি মাথা ধরবে!" কবিতার গলা ভেঙে আসে। "আমি তো ওকে সবজায়গায় যেতে বলছি না, বলছি কি? তা বলে এমন একটা বিশেষ দিনেও থাকবে না?"

আমি কীই বা বলি। খারাপ লাগছে। কবিতার সেন্টিমেন্টটা অযৌক্তিক নয়।

তবু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, "কাব্য ছেলেটা তো খুবই ভালো, তবে ওয়্যারলেস টেকনোলজি নিয়ে এমনই ডুবে আছে যে সামনাসামনি তারের মধ্যে দিয়ে আসা সিগন্যালগুলো ওর অ্যান্টেনায় আর ধরা পড়ে না।"

"থাম তো তুই, চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!" কবিতা দাবড়ে দেয়। "ঠিক আছে, আমিও দেখে নেব। মেরিল্যান্ড থেকে ফিরেই ডিভোর্স। এর আর নড়চড় নেই। তুই ল'য়ারের খোঁজ লাগাবি। তোদের মত জার্নালিস্টদের কত চেনাজানা। একটু জিজ্ঞেস করলেই খবর পেয়ে যাবি।"

ফোন নামিয়ে রাখল।  

অবশেষে এল সেই দিন। মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে সপ্তাহান্তের কবি-সম্মেলনে কবিতার কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হল। দেশ বিদেশ থেকে সুখ্যাত কবিরা মঞ্চে এসে তার কবিতার বিশ্লেষণ করলেন। কবিতার কবিতায় এক অদ্ভুত সাবলীলতা আছে। চরণ থেকে চরণে, পংক্তি থেকে পংক্তিতে অনায়াসে গড়িয়ে চলে কবিতার মূল সুরটি। সবাই প্রশংসা করলেন। কবিতা লজ্জা লজ্জা মুখে তার কবিতা লেখার গল্প বলল। কলকাতার কফি হাউসে আমাদের দুই বন্ধুর লেখালেখি, প্রথম পড়া আর কাটাছেঁড়ার কথাও বাদ গেল না।

বিকেল নাগাদ ফেরার পথ ধরেছি। মেরিল্যান্ড ছেড়ে পেনসিলভ্যানিয়াতে ঢুকছি, এমন সময় নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। কোন এক ঘূর্ণিঝড় তার পথ বদলে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত। সামনেটা বেবাক সাদা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছি। সামনে, পেছনে, ডাইনে বাঁয়ে - কোনদিকেই দৃষ্টি চলে না। যাকে বলে হোয়াইট আউট কন্ডিশন। খুব বিপজ্জনক।   

খুব সতর্ক হয়ে চালাচ্ছি। পাশে কবিতা চুপচাপ। আজ মুখে কুলুপ এঁটেছে। কলকলানি নেই। নিয়মমাফিক কাব্যর নিন্দেমন্দ নেই। বৃষ্টির যা দাপট, নিউ জার্সি পৌঁছতে ঢের সময় লাগবে।

কবিতাকে বলি, "কাব্যকে ফোন করে জানিয়ে দে, যেতে দেরি হচ্ছে। নইলে চিন্তা করবে।"  

জবাব দিল না।

আড়চোখে তাকাই। এ আবার কী ভাববিলাস?     

খানিক পরেই শুনি ফোন করছে।  

"বল, কেমন হল।" কাব্যর গলা।

"তোর সে খবরে দরকার কী? ফোন করেছিস একবারও?" অভিমান উথলে ওঠে।

"আরে, তুই সভার মুখ্য আকর্ষণ, ভি আই পি, তোকে কি যখন তখন ফোন করে বিরক্ত করা যায়?"

"মিথ্যে কথাগুলো একটু কম বলবি? শোন, আজ 'মাটির কাছাকাছি' কবিতাটা পড়লাম, বুঝলি?"          

"ও।"

"ও আবার কী?" কবিতা উত্তেজিত। "সেদিনই তো তোকে বললাম, অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। মনে নেই?"

"ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! সেটাই পড়লি?"

"সবাই ভালো বলল, জানিস? একদম নতুন রকমের কবিতা!"

"আচ্ছা, আচ্ছা, তু্ই বাড়ি আয় আগে। একটা সারপ্রাইজ আছে।“

“কী?"  

"সামনের বসন্তের জন্যে টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের বাল্ব কিনে আনলাম। ড্রাইভওয়ের ধারে সার দিয়ে বসিয়ে দেব।"

"সত্যি? টিউলিপ আর ড্যাফোডিল? আমার যে কতদিনের শখ..."

"সে তো জানিই। ভাবলাম তোদের তো ফিরতে দেরি আছে, যাই, কিনে নিয়ে আসি। হেমন্তেই তো ওদের বসাতে হয়, তাই না?"

"হ্যাঁ, এইসময় বসালে বসন্তে চারপাশ আলো করে ফুল ফুটবে।"

“যাক, আর কথা নয়। সাবধানে চালিয়ে আয়। যা বৃষ্টি, রাস্তার নিশ্চয়ই খুব খারাপ অবস্থা।"

"হ্যাঁ রে, ডাইনে বাঁয়ে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না।"

"বাড়ির কাছাকাছি এলে বরং একটা ফোন করিস। চা বসাব। তোর ফেভারিট আদা-এলাচের চা।"

ফোন রেখে দিল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। কবিতা সিটে মাথা রেখেছে। চোখ বোজা। অবশেষে বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে। আকাশ-ভাঙা থেকে কমে এখন ঝরঝর মুখর বাদর ধারা। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে।           

"ফোনটা কর।" আমি মনে করালাম।

"আবার কাকে?" খেঁকিয়ে উঠল।

"ওই যে, কাব্য চা বসাবে বলেছিল? তোর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি।"

"ছিঃ নিশানাথ!" কবিতা এবার সত্যিই আহত হয়েছে। "সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কি আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে? কবিতা সম্মেলনে মন ভরল না তোর? কে কোথায় চা খাওয়াবে বলেছে, সেই আশায় বসে আছিস?" ব্যথিত নয়নে তাকাল আমার পানে।  

আমি চেপে গেলাম। কাব্যর বুদ্ধিশুদ্ধির ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। আমাদের ফেরার সময়টা ও ঠিকই আন্দাজ করে নেবে। রেডি রাখবে চা এবং অনবদ্য সব 'টা'। মনে মনে সেকথা ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু মুখে বলা চলবে না।

অবশেষে কবিতার বাড়ি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকল। বৃষ্টি পড়ছে, জলে থৈথৈ করছে লম্বা ড্রাইভওয়ে।

ছাতাটা এগিয়ে দিই, "এই নে, নাম।"

"তুই থাম!" দাবড়ে দিল আমায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা।

ফোন লাগিয়েছে, "অ্যাই শুনছিস?"

"হ্যাঁ, বল। চা বসিয়েছি।"

"এসে আমায় নিয়ে যা।"

"তার মানে? কোথায় তোরা?"

"এই তো, ড্রাইভওয়েতে।"

"তাহলে? বাড়ি ঢুকে পড়!"

"না, তুই আয় ছাতা নিয়ে। এত বৃষ্টিতে আমি নিজে নিজে যেতে পারব না।"

"ওহো, দাঁড়া, দাঁড়া, এক্ষুণি যাচ্ছি।"

আমি ছাতা হাতে করে বেকুবের মত গাড়িতে বসে আছি।

বাড়ির দরজা খুলে গেল। কাব্য বেরিয়ে এল। মাথায় একখানি ছাতা, হাতেও

একখানি। দু'পা এগিয়েছে কী এগোয়নি, পাশ থেকে চেঁচিয়ে সুমিতার সাবধানবাণী, "দাঁড়া, দাঁড়া, আর এগোসনি, পিছল হয়ে আছে সামনেটা। পড়ে যাবি। আমি যাচ্ছি, তুই দাঁড়া ওখানে।"

“দাঁড়াব? তুইই তো এসে নিয়ে যেতে বললি?” কাব্য থমকে গেছে।

"আঃ, যা বলছি শোন, ওখানেই দাঁড়া। পা পিছলে পড়বি শেষে, কেলেঙ্কারি হবে একটা।"

আমার হাত থেকে ছাতাটা একটানে নিয়ে নিল কবিতা, "কী তখন থেকে ধরে আছিস, দে না আমার হাতে।"

ছাতা মাথায় দিয়ে পা টিপেটিপে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। কাব্যও অবশ্য থেমে নেই, সেও আসছে সামনে। অবশেষে ড্রাইভওয়ের মাঝামাঝি দুজনের মিলন। বৃষ্টির সুবাসভরা সন্ধ্যায় এক ছাতার তলায় হাঁটছে দু'জন। অভিমান ধুয়ে যাচ্ছে। দুটি হৃদয় কাছাকাছি। হেমন্তের উজ্জ্বল রং ওদের ঘিরে আছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে এগোলাম। ছাতা নেই আমার। তাতে কী? বাড়ি ঢুকলেই গরমাগরম চা অপেক্ষা করে আছে। কাব্যর নিজের হাতে তৈরি। একটুখানি আদা, কয়েকটি এলাচ আর অনেকখানি ভালোবাসার সুগন্ধে ভরপুর - সবাই সুখ চায়, কেউ কষ্ট চায় না। তবে অসময়ের বৃষ্টি না থাকলে আপনার কাছে রংধনু থাকতে পারে না। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance