Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

অন্য দুর্গা

অন্য দুর্গা

5 mins
2.5K


বোসেদের দোফলা আমগাছটায় ঝেঁপে আম এসেছে, দীর্ঘকালের ঐতিহ্য মেনেই বোসবাড়ির দুর্গাপুজোয় মায়ের ভোগে এই গাছেরই কাঁচা আমের অম্বল রেঁধে দেওয়া হয়। এই গাছটার এই আশনা আমগুলোকে গিন্নীমা আর তার খাস দাসী মানদাদি তাই একেবারে বউল ধরা থেকেই চোখে চোখে রাখে। একটা আমও যেন কোনো মতেই খোয়া না যায়। দেখাদেখি সব কাজের লোকেরাও, এমন কি বাচ্চা কাচ্চাগুলোও স্বতঃস্ফূর্ত পাহারাদারি করে আম গুলোর, মায়ের ভোগে দেবার আগে যেন একটা আমও কেউ কোনোভাবে খেয়ে না ফেলে।


সরমা বোসবাড়িতে কাজে ঢুকেছে সবে কয়েকমাস, কিন্তু এরমধ্যেই গিন্নীমায়ের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছে। সরমা বেশ চটপটে আর টিপটপ, দুঃস্থ বামুনের ঘরের আইবুড়ো মেয়ে, বিয়ের বয়স পার হয়েছে, কাজেই গতরে খেটে খাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বোসবাড়ির আগেকার বামুন ঠাকরুন আর একা পেরে ওঠে না তাই সরমা বোসবাড়ির কাজে বহাল। তারই কেমন চেনাশোনা সরমা, বাড়ীর সবাই সরমাকে পছন্দ করে। সরমার আরও একটা গুণ.....সরমা কোনো কাজে না করে না। পুজো যত এগিয়ে আসতে থাকলো বাড়ীতে কাজের চাপও বাড়তে থাকলো, গিন্নীমা সরমাকে রাতেও থেকে বাড়তি কাজের চাপ সামলানোর জন্য বহাল করে নিলেন। অনেক পুরোনো লোক মানদাদি নতুন লোকেদের একটু সন্দেহের নজরেই দেখে। তাই মানদাদি প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করলেও শেষ পর্যন্ত চুপ করে গেলো, সেও তো কাজের লোক বৈ অন্য কেউ নয় যে।


এই ব্যবস্থায় প্রথমে কিন্তু সরমা নিজেই একটু কিন্তু কিন্তু করেছিলো, সাত বছরের দুগ্গা আর মাকে একা রেখে কাজে আসে। এখন এতদিন এখানে টানা থাকলে ওদের সাথে দিনান্তে একবার দেখাও হবে না। একথাটা সে মুখ ফুটে গিন্নীমাকে বলতেও পারলো না, অভাবের তাড়নায় কাজে ঢুকেছিলো, যখন যেমন দরকার পড়বে তেমন করেই কাজ করবে এমন শর্ত করেই সরমা কাজে ঢুকেছে। এখন রাতে থাকতে পারবে না একথা জানালে যদি কাজ ছাড়িয়ে দেয়, তাই সরমা চুপচাপ রাজী হয়ে গেলো। একেবারে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত দিনে রাতে থেকে কাজ করতে।


মাঝে একদিন ঘন্টা কয়েকের ছুটি নিয়ে সরমা মাকে গিয়ে মাইনের টাকাটা দিয়ে এসেছে। দুগ্গাটা খুব বায়না করছিলো সরমার কাছে গিয়ে থাকবার জন্য। অনেক কষ্টে ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে কাজে ফিরে এসেছে সরমা। পুজো শুরু হতে আর মাত্র দু'দিন বাকী, বোসবাড়িতে কাজের ব্যস্ততা তুঙ্গে। দূর শহরে বাড়ীর যেসব ছেলেপুলেরা কাজের সুবাদে থিতু, তারাও সবাই সপরিবারে গ্রামের বাড়ীতে এসে পৌঁছেছে পারিবারিক সংস্কৃতি বজায় রেখে। পুজোবাড়ীর কাজে সামান্যও ফুরসৎ নেই।সরমা সবই করছে তবে মনটা ওর নিজের বাড়িতে পড়ে আছে, আর সরমার এই অন্যমনস্ক ভাব ঠিক গিন্নীমার নজরে পড়েছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে গিন্নীমা ডেকে পাঠালেন সরমাকে, সরমা তখন আনন্দনাড়ু গড়ার কাজে বাড়ির বউদেরকে সাহায্য করছিলো নিরামিষ রান্নাঘরে।


সরমা এলে গিন্নীমা জানতে চাইলেন,

---- সরমা অমন মুখ শুকিয়ে মনমরা হয়ে রয়েছে কেন?

সরমা 'কিছু না' এমনি বলে পাশ কাটাতে চাইছে দেখে গিন্নীমা ওর মনখারাপ বুঝলেন। আর ওকে নতুন কাজের দায়িত্ব দিলেন।


পরের দিন সকালে আমগাছ থেকে আরও ক'টা আম পাড়াতে হবে নিতাইকে দিয়ে। একদম হৃষ্টপুষ্ট নিখুঁত দেখে, আর সেই আম থেকে কতকগুলো আম মায়ের ভোগের শাকসবজি আর ফলমূলের সাথে রেখে দিতে হবে। আর কয়েকটা আম কেটে একটু গুড় দিয়ে জ্বাল দিয়ে ভাজা মশলা ছড়িয়ে আচার বানিয়ে ভোগের ঘরের ভাঁড়ারে কাঁচের বয়ামে রেখে দিতে হবে, দশমীর পান্তাভাত আর কচুর শাকের ভোগে দেবার জন্য। দু-চারদিন রাখা থাকলে আচারটা বেশ ভালো করে মজবে।

আসলে সরমার বেশি কথা বলতে বা হৈহৈ করতে মন চাইছিলো না। একটু একা থাকতে পারার সুযোগ পেয়ে সরমা যেন খানিকটা স্বস্তি পেলো। নিতাইয়ের সঙ্গে গিয়ে সরমা শাড়ির আঁচল গাছকোমর করে বেঁধে সাপটে সব আম গুছিয়ে ঝুড়িতে তুলছে যখন, শুনতে পেলো বড়দাবাবু চেঁচিয়ে মানদাদিকে বললো বামুন ঠাকরুনকে আসতে গিন্নীমার ঘরে।


এবার গিন্নীমার ঘরে সরমার ডাক পড়লো। সরমার বুকে যেন দমাদ্দম হাতুড়ি পিটছে কেউ, কু গাইছে মনটা, কাজটা বুঝি গেলো। মায়ের আর দুগ্গার মুখ ভেসে উঠলো সরমার চোখে ক্ষণেকের জন্য। ঘরে ঢুকে সরমা দেখে গিন্নীমা খাটের ওপর আসন কেটে বসে, আর বামুন ঠাকরুন খাটের বাজু ধরে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। গিন্নীমা সরমাকে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতে বললেন, পুজোবাড়ির হৈচৈ-তে কেউ আর খেয়াল করলো না গিন্নীমার ঘরে একটা গোপন বৈঠক চলছে। কোনোরকম ভণিতা না করে গিন্নীমা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন,


"তোর একটা পঙ্গু মেয়ে আছে তা বলিস নি কেন?"

সরমা মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে সব বললো গিন্নীমাকে....


গরীব ঘরের আইবুড়ো মেয়ে, বয়স বেড়েছে, মাথার ওপর বাপ ভাই কেউ নেই, মা ঝিয়ের অভাবী সংসারে কে তাকে বসিয়ে খাওয়াবে? অনেক কাল ধরেই তাই লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করেই চলে তাদের। তাদের গ্রামের পাশের নদীতে যখন পাকাসেতু তৈরীর কাজ চলছিলো তখন সেখানে এক অফিসারবাবুর ভাড়া করা বাসায় সরমা রান্না করতে গিয়ে বাবুর মিষ্টি ব্যবহারে ভুলে সংসার করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো। আর ভেসে গিয়েছিলো সে, সব খুইয়ে ফেলেছিলো, আব্রু লজ্জা মান সম্মান সব, মুখ ফুটে বাবুকে জানিয়েও ছিলো বিয়ে করার কথা। সব শুনে বাবু কেমন আগুনজ্বলা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে তিনমাসের মাইনে আর বাড়তি পাঁচশো টাকা দিয়ে শহরে গিয়ে ও পাপ খসিয়ে আসতে বলেছিলো। আর কিছু বলতে ইচ্ছে হয় নি সরমার, শহরে কাজ পেয়েছে বলে পরদিনই সরমা শহরের হাসপাতালে গিয়েছিলো, কিন্তু বাচ্চা নষ্ট করা হয় নি মাস বেড়ে যাওয়ায়। তবে সব শুনে ওখান থেকে ডাক্তার দিদি ওকে আয়ার কাজে ঢুকিয়ে দিলেন ওনারই চেনাশোনা এক নার্সিংহোমে। দুগ্গা জন্মালো ওখানেই পঙ্গু হয়ে। থেকে যেতো ওখানেই। অসুস্থ বুড়ি মায়ের কথা ভেবে ফিরেছিলো গ্রামে, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাপ মা মরা পঙ্গু মেয়ে হিসেবে দুগ্গার পরিচয় দিয়ে। গাঁ ঘরের লোকেরা গল্পটা বিশ্বাসও করে নি, আবার মুখের ওপর কিছু বলেও নি, তবে আড়ালে কানাঘুষো চালু আছে একথাটা সরমা নিজেও জানে। তার ততটা রোজগার করার ক্ষমতা থাকলে সে মা আর মেয়েকে নিয়ে দূরে কোথাও গিয়েই থাকতো। কিন্তু ঘরভাড়া করে অসুস্থ মা আর মেয়েকে নিয়ে গ্রামে নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার ক্ষমতা ওর নেই।


একদমে এতগুলো কথা বলে থামলো সরমা, বললো,

"গিন্নীমা আমায় ছুটি দিয়ে দেন, আপনাকে মিথ্যে বলে কাজে ঢুকেছি, মা দুর্গার সহ্য হয় নি এই অনাচার। আর নিজের পাপের বোঝা বাড়াতে চাই না।"


গিন্নীমা ওর চোখে চোখ রেখে বললেন,


"হ্যাঁ, পাপ তো করেইছিস, এত কষ্ট করে সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে পালন পোষন করে তারপর এতদিন ধরে তার পরিচয় গোপন করে রেখে। ভাগ্যিস লাইট লাগাতে এসে মানদার জামাই তোকে চিনতে পেরেছে, তাই তো এতো কঠিন সত্যটা জানা হোলো! আজ বিকেলে গিয়ে তুই নিতাইকে সঙ্গে নিয়ে তোর মা আর মেয়েকে নিয়ে আসবি। পুজো আচ্চা মিটলে নিতাইয়ের সঙ্গে তোর ঘর বেঁধে দেবো, নিতাই একটু হাবাগোবা বোবা হলে কি হবে কালা নয়! সাতকুলে কেউ না থাকা ঐ বামুনের ছেলেটার মনটা কিন্তু খাঁটি সোনা, তোকে ওর খুব পছন্দ। একমুখ হেসে ইশারায় নিজেই জানিয়েছে আমাকে ক'দিন আগেই!"


মা দুর্গার বোধন শুরু হয়েছে বোসবাড়ীর দুর্গাদালানে। সরমার পঙ্গু মেয়ে দুগ্গাকে কাঁধে বসিয়ে ঢাকের তালে তালে নিতাইয়ের সে কি নাচ! গিন্নীমার মনে হোলো দুগ্গার মুখের আদলটায় বড্ড মিল যেন এবারের বোসবাড়ির দুর্গা প্রতিমার মুখের আদলে! আর সরমা জানে না মাটির প্রতিমায় প্রাণ আছে কিনা, তবে ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ভরা দুর্গাদালানে পাটের কাপড় পরে বসা গিন্নীমার কপালে যেন ত্রিনয়ন ফুটে উঠেছে সরমা স্পষ্ট দেখলো।


Rate this content
Log in