অমৃতের সন্তান
অমৃতের সন্তান
ডিসেম্বর মাস রাত ১২টা রামপুর হাট স্টেশনে বসে আছি ট্রেনের অপেক্ষায় । আমার ট্রেন ২ঘন্টা লেট ।
তারাপিঠ থেকে তারামার দর্শন করে ফিরছি । দু নম্বর প্লাটফর্মে বসে ভালাে করে মাফলারটা জড়িয়ে নিলাম।
পাছে ঠান্ডা লেগে যায়। বসে-বসে ঝিমুনি ধরে যাছে, অনেক্ষন ধরে লক্ষ করেছি এক নম্বর প্লেটফর্মে প্রায় নগ্ন
এক পাগলী গুটিশুটি মেরে প্লাটফর্মের মাঝামাঝি শুয়ে আছে । অল্প বয়সিরা আড় চেয়ে দেখছে, মাঝবয়সিরা
মাঝে মধ্যে একবার তাকিয়ে নিচ্ছে, বুড়াে হাবড়া গুলাে হাঁ করে গিলছে, আর মেয়েছেলেরা নিজেদের আরাে
বেশি আড়াল করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ।
হঠাৎ হই-হই শব্দ, কিনা প্লাটফর্মে, সাফাই কর্মীরা জল ফোয়ারা মেশিন দিয়ে প্লাটফর্ম বােয়া-মােছা শুরু করছে ।
পাগলীটা যেখানে শুয়ে আছে সেখানে জল স্প্রে করার জন্য এক সাফাইবালা পাগলী কে ওখান থেকে উঠে
যাবার জন্য বকাবকি করছে, বিরক্ত হয়ে ঝাটার ডান্ডা দিয়ে দু-একবার খোচা মারছে । খোচা খেয়ে পাগলী উঠে
দাড়াতেই ওর গায়ের এক চিলতে কাপড়টুকু খসে পড়লাে । অসংখ্য মানুষের মাঝে মাঝবয়সি এক নারী সম্পর্ণ
নগ্ন অবস্থায় দাড়িয়ে আছে । ঐ দৃশ্য দেখা যায় না, কিন্তু কি করবাে আমাদের শিক্ষা-মান-সম্মান-লজ্জা
আমাদের এমন ভাবে বেঁধে রেখেছে যে ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার মত মন বা সাহােস নেই । পারবােনা আমিও
কিছু করতে পারবাে না, শুধু লজ্জায় মাথা নিচু করা ছাড়া। আসে-পাসের মহিলারা লজ্জায় মরমে মরে গিয়ে
চোখে কাপড় চাপা দিয়ে নিজদের লজ্জা ঢাকতে ব্যাস্ত, দ্রুত ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।
এরি মধ্যে রেল পুলিস কোথ্যেকে একটা ছেড়া কম্বল এনে পাগলীর গায়ে ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে আদেশ
করতে লাগলাে ঐ কম্বল গায়ে জড়িয়ে এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু হায় যে এই সংসারে তার
সবচেয়ে বড় সম্পদ লজ্জাকে বিসর্জন দিয়ে জগৎএর সামনে উলঙ্গ হয়ে দাড়িয়ে আছে সে কার আদেশ মানবে
কেনােই বা মানবে ? যে পরিবার, সমাজ, মনুষ্যজাতী তাকে উপেক্ষা করেছে, সে কেন গ্রহণ করবে দান ?
কেনই বা পালন করবে আদেশ ?
ব্যাস্ত প্লাটফর্ম মধ্যরাতে স্তব্ধ হয়ে গেছে, আমি আমার বুকের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি । হঠাৎ করে চোখের
সামনে ভেসে উঠলাে আর এক অর্ধনগ্ন নারীর ছবি- তিনি মহামায়া, মহাশক্তি, লােলজিহ্বা মহামাতৃকা। “হে
মা একোন ছলনা তােমার ? তােমায় দর্শন করে ফেরার পথে এ কোন দৃশ্য তুমি দেখালে ? আমি অক্ষম সন্তান,
ক্ষমা কোরাে, ক্ষমা করে দাও আমাকে। হঠাৎ দেখি একটা ছেলে বয়স সতেরাে-আঠারাে হবে একটা বড় চাদর
নিয়ে পাগলীর দিকে ছুটে গেলাে, কিছু বােঝার আগেই দেখি ছেলেটা ঐ চাদরটা পাগলীর গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছে ।
পাগলী কিছুতেই তার গায়ে চাদরটা জড়াতে দেবে না, ছেলেটাকে আঁচড়ে, কামড়ে জেরবার করে দিচ্ছে, তবু
ছেলেটা হার মানতে নারাজ । সারা স্টেশন ময় তােক উদগ্রিব হয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। অবশেষে কি জানি।
কোন মন্ত্র বলে পাগলী একবারে শান্ত হয়ে গেলাে। ছেলেটা পরম মমতায় পাগলীর গায়ে ভালাে করে চাদর
জড়িয়ে বেঁধে দিলাে তারপর হাত ধরে প্লাটফর্মের এক কোনায় যেখানে একটু আড়াল আছে, ঠান্ডা কম লাগবে।
নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলাে। পাগল বাধ্য শিশুর মত ছেলেটার কথা শুনলাে, গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাে।
ক্রমে সব কিছু সাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলাে এবং প্লাটফর্মের এপার থেকে ওপার এবার ছেলেটাকে নিয়ে ব্যাস্ত।
হয়ে পড়লাে, কারাে মতে ঐ পাগলী ছলেটার মা বা কোন আপােনজন, কারাে মতে ঐ সবটাই লােক দেখানাে
আবার কারাে মতে ছেলেটা সত্যি ভালাে, ওর শরিরে দয়া-মায়া, পরপকারিতা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি । যে
ছেলেটাকে নিয়ে আসাের গুলজার সে তার ক্ষত-বিক্ষত হাতে চা-কফির কেটলি নিয়ে ছুটলাে প্লাটফর্মে সদ্য ঢাকা।
আপ বনাঞ্চল এক্সপ্রেসে তার মাল বেচতে । পাশের স্টলের বৃদ্ধ মালিক আমাকে উদ্ধেশ্য করে বললাে - এই
ছেলেটা এই প্লাটফর্মেই জন্মেছে, ওর মায়ের মাথাতেও ছিট ছিলাে, একদিন কোথায় চলে গলাে আর এলাে না ।
ছােড়াটার মাথাতেও একটু ছিট আছে, তবে মনটা খুব ভালাে । আমার চোখদুটো কেমন জ্বালা করছে, গলার
কাছে কিছু জমাট বেঁধে আসছে । আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে - তােমাদের মত ছিটগ্রস্ত সন্তানেরা
আছে বলেই এ পৃথিবী আজো এতাে সুন্দর ।