অভিশপ্ত ভালোবাসা
অভিশপ্ত ভালোবাসা
সময়টা নব্বইয়ের দশকের, কলকাতা শহর তখন রাজনীতির টানা পোড়েনে উত্তাল। রাতে মহিলারা বিশেষ কেউ বের হতেন না। আমি তখন টিউশনি ছাড়াও কোর্টে বসতাম টাইপ মেশিন নিয়ে। প্রথম মহিলা টাইপিস্ট। তাই কৌতুহল উঁকিঝুঁকি দিত আড়াল থেকে।
কোর্ট মানেই আসামী, পুলিশ, উকিল মোক্তারদের পীঠস্থান। আর হ্যাঁ, সেইসময় কোর্ট মানেই ছিল অপরকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনের ঠেক।
প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হোত। টেবিলে টাইপ মেশিন রেখে চেয়ারে বসে সাদা কাগজে asdf ;lkjh অনবরত টাইপ করতাম, অন্যের দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য, যাতে তারা এক দুটো কাজ দেয়। এভাবেও কাজ পেতাম। অবসর সময়ে গল্প করতাম উকিল ও আসামীদের সাথে। তেমন এক আসামী ছিল রাজু (নামটা খুব সামান্য পরিবর্তন করেছি)। রাজু ছিল নির্মলদার ভাই।আমার দাদার সাথে কলেজে পড়েছে।
রাজু ছোটবেলা থেকেই কুসঙ্গে পড়ে যায়। ফলে, জুয়া মদ মারপিট ওর রোজ নামচা।প্রায় শ’খানেক কেস ওর বিরুদ্ধে। রাজু কোর্ট চত্বরে এলেই সবাই বোবা হয়ে যেত, কারন ও সব সময় নেশার ঘোরে থাকত আর অশ্রাব্য কুশ্রাব্য ভাষায় অশ্লীল গালিগালাজ করত। আমি তো চিনতাম না। একদিন সকালে কেবল আমার মেশিন নিয়ে বসেছি, এমন সময় রাজুদা এসে বলল, এই যে একটু জল হবে? ব্যাগ থেকে বোতল দিয়ে বললাম এই যে নিন।
পাশের টুলে বসে জল খেয়ে শুরু করল খেজুরে আলাপ। বিরক্ত আমি। সকাল বেলায় বউনী না করলে সারাদিন আয় হবে না। তার মধ্যে রাজুদার মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ আমার নাকে লেগে বমির উদ্রেক হচ্ছে।
কি করি!! যতোটা সম্ভব কম কথায় উত্তর দিচ্ছি। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা আমাদের সময় কলেজের জিএস অনুপম গুপ্ত তোমার কে হয়? আমি চমকে উঠলাম উত্তর দিলাম, কেন?
– আরে বলো না। অনুপমের চেহারার সাথে তোমার চেহারার অদ্ভুত মিল, তার উপর পদবীও এক।
– আমার ছোড়দা।
ব্যাস, তিড়িং করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এতোদিন বলোনি কেন? আমি নিশ্চুপ!!
রাজুদা এবার চিৎকার করা শুরু করল।
-আমার চোখকে ফাঁকি দেবার তাল? শালা আমি ক্রিমিনাল বলে কি আমার ইজ্জত নেই? বোনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি গালি দিয়ে গেছি কেউ থামায়নি। সব শালাকে দেখে নেবো। অনুপম আমাদের বস।
প্রচন্ড রেগে টলতে টলতে সেদিন চলে গেল। আমিও অবাক হলাম ঘটনার আকস্মিকতায়।
মনে আছে, সেদিন শুক্রবার ছিল। খুব ভীড়। আমার টেবিলের সামনে জনা চারেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, বেঞ্চে জনা তিনেক। সবাই বলছে আমারটা আগে টাইপ করে দিন। চাকরির দরখাস্ত টাইপ করতে হবে। মাথা নীচু করে দুহাতে ঝড় চালাচ্ছি। একটা ছেলে খুব বাজে মন্তব্য করলো। উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখলাম প্রচুর ভীড় জমে গেছে, কোর্টের মাঠে যা হয় আর কি!!
হঠাৎ দেখি লিকপিকে শরীরের রাজুদা টলতে টলতে এসে ছেলেটির কলার ধরে গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিল। আমি হতভম্ব!! চিৎকার করে বলছে – আমার বোনকে কিছু বললে এখানে পুঁতে রেখে দেবো। কোর্ট পুলিশ এসে দুজনকেই নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে রাজুদা বলে গেল, বোন আমি আছি রে।
সেদিন থেকে আমি অলিখিতভাবে রাজুর বোন হয়ে গেলাম।
এই রাজুদা পাশে বসে বলেছিল ছোটবেলায় ওর চেহারা নিয়ে বন্ধুদের বক্রোক্তি, পড়াশোনায় মন না থাকার জন্য বাবা মা’র বকুনির কথা। দাদা ওকে খুব ভালোবাসতো। মারপিট করে ব্যাথা পেলে দাদার কাছেই ছুটে যেত। রাজুদার দাদা খুব নিরীহ মানুষ ছিলেন। রাজুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন করো মারপিট? খুব উদাস হয়ে বলেছিল আগে করতাম অস্থিরতায়, এখন করি হুকুমে। ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সুন্দর একটা জীবন কাটাই। শালা বৌটাও ঘরে জায়গা দেয় না বোন। – তাহলে কোথায় থাকো দাদা? – কেনো? ষ্টেশনে!! – আচ্ছা বোন কোনদিন যদি শুনিস তোর এই কুলাঙ্গার দাদা মরে গেছে সেদিন তোর চোখে জল আসবে? – দেখো রাজুদা, এসব কথা যদি বলবে তাহলে এখান থেকে কেটে পড়ো। রাজুদা চলে গিয়েছিল মাথা নীচু করে। তবে যাওয়ার আগে বলেছিল, জানিস কেউ জন্মেই ক্রিমিনাল হয় না রে। পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে ক্রিমিনাল বানায়। আমার ছেলেটাকে কতদিন কোলে নেই না। রাতের অন্ধকারে বাড়ি গেলেও ওকে স্পর্শ করার অধিকার আমার নেই। আমার বৌ বলে দিয়েছে ছেলে যেন কোনদিন জানতে না পারে ওর বাবা ক্রিমিনাল। জেল হাজতে বছরের বেশীদিন কাটে। আর কতো লুকিয়ে থাকবো বলতে পারিস।
এরপর সময় গড়িয়েছে আপন তালে। কখনো মাসে একদিন কখনো ছয়মাসে একদিন এসে দেখা করে চা খাইয়ে বলেছে আজ মামার বাড়ি থেকে ছাড়া পেলাম। জেলে থাকাটা ওর কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম রাজুদার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। মদ খেয়ে আর কোর্টে আসতো না। ও জীবনে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু বিধাতা তা মেনে নেবে কেন? ওর বিরোধী দল তো ছিল।
একদিন সকালে শুনতে পেলাম বাসস্ট্যান্ডের সামনে ড্রেনের মধ্যে রাসু ডুবে আছে। এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় গলার কাছটা আটকে আসছে। নরকের কীট কে নরক যন্ত্রনা দেবার জন্যই নর্দমাকে বেছে নিল বিধাতা। কেউ বলে অত্যধিক মদ্যপানের জন্য মৃত্যু, কেউ বলে সুপরিকল্পিত খুন। জানি না। শুধু জানি এক কুলাঙ্গার দাদার স্নেহের পরশ আমি হারিয়েছিলাম সেদিন। সমাজবিরোধীরাও সম্মান দিতে জানে, শুধু সম্মান পায় না।কারণ সমাজবিরোধীরাও তো মানুষ - কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না, এদের তৈরী করা হয়।