অভিমান
অভিমান
“ আমার তৃষ্ণা তোমার সুধা তোমার তৃপ্তি আমার সুধা ” ----------- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রতিদিনের মত গতকালও রজত একই সময় বাড়ি ফিরেছে, আবার সেই দেরি। সেজন্য রানীর মুখভার, রোজ রোজ এতো দেরি হয় কি কারণে - তার মাথায় আসেনা। অন্য সব স্বামীরা অফিসের শেষে ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরে - কিন্তু রজত এর ব্যতিক্রম। কি যে করে কে জানে? এসময় একটা কথাও বলে না, কোনোরকমে হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার চুপচাপ খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকাল থেকে আবার এক নিয়মে বাঁধা রুটিন তার।
গতকাল রজত একটা শাড়ি এনে টেবিলে রেখেছে। রানী রাতে শাড়িটা দেখেছে কিন্তু হাতে নেয়নি ।পরেরদিন সকালে ঘরের জিনিসপত্র ঠিক করতে গিয়ে রানী দেখে টেবিলের উপর শাড়ির পাশে একটা চিঠি। হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো।
" প্রিয় রানী,
প্রতিদিন ইচ্ছে করেই দেরীতে বাড়ি ফিরি, শুধু তোমার রাগ দেখার জন্য। এমনিতে তুমি এত রাগ করোনা। তবে আমি দেরী করে বাড়ি ফিরলে প্রতিদিন তুমি আমাকে তুলোধোনা করো। এটা আমার কাছে বেশ লাগে। তখন ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তুমি তো জানো! আমি অত রোমান্টিক না। আসলে রোমান্টিক হতে পারিনি। পড়ালেখা আর নিজের চাকরি নিয়েই ব্যস্ত। তুমি ইচ্ছে করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকো। বিশ্বাস করো , তোমাকে রাগলে এত সুন্দর লাগে যা বলা বাহুল্য। প্রতিটা মেয়েকেই হয়তো রাগলে বেশ লাগে। তা 'ত' আর আমার জানা নেই। তবে তোমাকে আমার জানা আছে। রাগলে তোমাকে এত সুন্দর লাগে যা বলে বোঝানো যাবেনা। ইচ্ছে করে প্রতিদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু অজানা একটা কারণে পারিনা।
প্রতিদিনই দেরী করে বাড়ি ফেরার এই একটাই কারন। তোমার গম্ভীর মুখখানা দেখার জন্য। যে গম্ভীর মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে অদেখা অজস্র ভালবাসা। খুব ভালবাসি তোমায়, তাই নিজের মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখি আমার ভালবাসা।
আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি, সকালে সূর্য তোমাকে দেখার আগে আমি দেখি।
আলো আমার ভালো লাগেনা। সারাক্ষণ তোমাকে দেখে। কিন্তু কি করবো বলো। আলো ছাড়া তোমাকে দেখা যায়না। তাই তো আমি সর্বদা আলোর কাছে মাথা নত করি।
বাদ দাও এসব কথা! গতকাল তোমার জন্য যে শাড়িটা এনে টেবিলে রেখেছিলাম। কিন্তু তোমার হাতে আর দেওয়া হয়নি। এখন এই চিরকুট'টা পড়লে হয়তো শাড়িটা হাতে নেবে। নিশ্চয়ই শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়নি বুঝি। এরজন্যই এনে তোমার হাতে দেইনি। আসলে কি জানো, আমি কখন একা শাড়ি কিনিনি। মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে গেলে মা'কে সাথে নিয়ে যেতাম। কখন নিজের পছন্দে শাড়ি কিনতে পরিনা। হয়তো তোমার পছন্দ মতো শাড়ি কিনতে পারিনি। তাই তোমার কাছে না দিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি।তবে কথা দিলাম, একদিন তোমার জন্য সত্যিই একটা সুন্দর শাড়ী কিনে দেবো। অভ্যাস হয়ে যাবে। তোমাকে চেনা হয়ে যাবে। তোমার পছন্দ অপছন্দের তালিকাও আমার হবে। তবে সেটা কখন হবে বলা যায়না।
রজত ।
চিঠিটা পড়ে মুচকি মুচকি হাসছে রানী। বেশ অবাক হচ্ছে রজতের এই চিঠিটা পড়ে।যে রজত তাঁর সামনে ভালোভাবে দাঁড়ায় না। সেও মনের কোণে বউয়ের জন্য ভালবাসা লুকিয়ে রাখে। রানীর স্বপ্ন ছিলো তাঁর একটা হ্যান্ডসাম, রোমান্টিক বর হবে। আর রজত ! যার ভিতরে কোনো রোমান্টিকতা বলতেই কিছু নাই। কিন্তু এখন দেখে রোমান্টিকতার সিন্ধুক রজতের ভিতরে। রানীও রজতকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সামনাসামনি কেউ প্রকাশ করেনা। এখন চিঠিটা পড়ে তাঁর হাতে করে আনা শাড়িটা পরার খুব ইচ্ছে হলো রানীর।
সন্ধে পেরিয়ে রাত্রি হয়েছে,দরজায় টকটক শব্দ করে কেউ নক করছে । রানী তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজা খুললো।রানীর দিকে তাকিয়ে রজত পুরো অবাক হয়ে গেলো। রজত ভাবলো হয়তো ভুল দরজায় টোকা দিয়েছে।একবার চোখ কচলিয়ে দেখলো। না! এটা তো রানীই।তবুও রানীকে উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে গেলো রজত । এরকম ভাব করলো যেন রানীকে সে এমন অবস্থায় প্রায়ই দেখে।রানীকে সে বুঝতে দেয়নি, যে তাকে দেখে সে অবাক হয়েছে । খাওয়া দাওয়া শেষ করে যথারীতি বিছানায় শুয়ে আছে রজত ।দরজা বন্ধের শব্দ পেলো। তাঁর মানে রানী ঘরে এসেছে।
রানী ঘরে এসে আয়নার সামনে বসে আছে চুপটি করে। আর বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে।কোথায় সাজের কোনো কমতি হলো নাকি।বিকাল থেকে কাজ শেষ করে নিজের ইচ্ছে মতো সেজেছে রানী। রজতের কিনে আনা শাড়িটাও সে পরেছে। শুধু মাত্র রজতের জন্য।আর এই রজত কিনা, একবারও কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না।প্রচন্ড অভিমানে রানীর বড্ড রাগ হলো তাঁর নিজের উপর।মাথা নীচু করে বসে আছে রানী। এদিকে আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছেনা রজত । রানী যেন রজতকে চুম্বকের মতো টানছে। বার বার বলছে, তুই রানীর কাছে যা। ওকে জড়িয়ে ধর। ও তো তোর জন্যই এমন করে সেজেছে।ধীরে পায়ে রজত রানীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রানী বুঝতেই পারেনি তাঁর পিছনে কেউ আছে।
রজতের খুব ইচ্ছে করছিল পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু একটা অজানা কারণে সে পারছে না।তবুও সকল বাধাকে ডিঙিয়ে রানীকে জড়িয়ে ধরলো।রানী চমকে উঠলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখে রজত তাকে জড়িয়ে ধরছে।বেশ অবাক হলো রানী।
কিন্তু রানীর মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা ভালবাসাটা লাফিয়ে উঠতে শুরু করলো। রানীও আবার রজতকে জড়িয়ে ধরলো।আসলে রাগ, অভিমান লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু ভালবাসা লুকিয়ে রাখা যায় না। ভালবাসা প্রতিদিন নতুন করে শুরু হয়।ভালো থাকুক ভালবাসা, ভালো থাকুক ভালবাসার প্রিয় মানুষগুলো।