অবাক স্বাধীনতা
অবাক স্বাধীনতা
প্রতিবারের মতো এবারও স্বাধীনতা দিবসের সকালে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার আয়োজন চলছিল আমাদের। তিরঙ্গা পতাকা আকাশে উড়লে মনের ভিতর এক আবেগ মেশানো ভালোলাগার ঢেউ ওঠে, ঠিক যেমন অনুভব হয় মেরিট লিস্টে নিজের নাম সবার উপরে দেখলে, অনেকটা সেই রকম। আয়োজন যখন শেষ হয়ে এলো তখন বন্ধুরা মিলে গেলাম রামু কাকার চায়ের দোকানে, চা খাব বলে। চার কাপ চায়ের অর্ডার দিতে চা নিয়ে এলো বছর দশকের একটা ছেলে। তাকে আগে কখনো দেখি নি। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম সে নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। মাথাটা গেল গরম হয়ে। রামু কাকাকে ডেকে বললাম, "তুমি জানো না শিশুশ্রম অপরাধ ? এই বাচ্চা ছেলেটাকে কাজে নিয়ে তুমি ঠিক করো নি। ওর তো স্কুল যাবার বয়স।" এই কথাগুলো বলা শেষ হওয়া মাত্রই এমন এক কাণ্ড ঘটল যার জন্য আমি একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম। বাচ্চাটা আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। জানতে পারলাম, ও কাজ না করলে খাওয়া জুটবে না এমনকি বাপমরা ছেলেটার অসুস্থ মায়ের অপারেশনের খরচও জোগাড় হবে না । হায় রে পোঁড়া কপাল, স্বর্ণপদক নিয়ে এমএসসি পাস করেও নিজে ভুগছি বেকারত্বের জ্বালায়, পকেটে একটা পয়সাও নেই তাকে সাহায্য করাবার মত, এমনকি চায়ের টাকাটাও ধারে রাখি । একটা সাংঘাতিক অপরাধবোধ নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।
মনের ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগলো অনেকগুলো ভাবনা।
পঞ্চপাণ্ডবদের দুনিয়াতে দৌপ্রদী কি সত্যি স্বাধীন ছিলেন ? মহাভারতের ধর্মযুদ্ধেও কি অর্জুনের মন ছিল জাগতিক মায়ার থেকে স্বাধীন ? এই স্বাধীনতা কি ? আকাশে সাদা পায়রা ওড়ানো কি স্বাধীনতা? নাকি দেশ ভাগ করে, দেশের মাটিতে রক্তগঙ্গা ভাসানো হলো স্বাধীনতা ? নাকি স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ লুকিয়ে আছে রাম-রহিমের বন্ধুত্বে ? স্বাধীনতা কি সকলের পেটে ভাত আর পরনে কাপড়ের অধিকার? নাকি স্বাধীনতা হলো ভাইয়ের হাতে ভাইকে খুন করিয়ে নিজের গদি বাঁচানোর লড়াই ? নাকি অবলা মেয়েদের সুরক্ষাকে সুনিশ্চত করার নাম স্বাধীনতা?
আসলে স্বাধীনতা একটি আপেক্ষিক শব্দ। কারো কাছে "জিহাদ" এর নামে নিরস্ত্র নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হল
ো স্বাধীনতা। আবার কারো কাছে নিজের মরণোত্তর অঙ্গদান করে অন্য একটি প্রাণ বাঁচানোর নাম স্বাধীনতা।
১৫ ই আগস্ট এর স্বাধীনতাও কি তবে এক আপেক্ষিক স্বাধীনতা? টাকা, রাজনীতি আর ধর্ম কি তবে স্বাধীনতার অবস্থানকে মাপার তিনটে cartesian coordinate ? যার দিকে পাল্লা ভারী তার স্বাধীনতাও বেশী । অনেকটা "হীরক রাজার দেশ" এর মত, যত স্বাধীনতা সব হীরকরাজের !!!
কিন্তু ভারতবর্ষের এই স্বাধীনতা হলো অসংখ্য বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের ফসল। তবে সেই মহাত্মারা জানতেন না, এই স্বাধীনতা লাভের সত্তর বছর পরেও, এই স্বাধীনতা হবে ভীষণ দামী। গরীব মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই স্বাধীনতা বড়োলোকের মার্সিডিজ ছাড়া চড়ে না।
অবলা মেয়ের আর্তনাদে সাড়া দেয় না। গরীব চাষীর আত্মহত্যাতে তার কিছু এসে যায় না।
ধর্মের নামে মানুষ মরলেও, স্বাধীনতা তার অট্টালিকা থেকে বেরোয় না। স্বাধীনতা বড়োলোকের ডাইনিং টেবিলে বসে, ক্ষুধার্ত আর অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের আর্তনাদ শোনে। সেই আর্তনাদের মধুর ধ্বনি স্বাধীনতাকে দেয় অনাবিল সুখ। স্বাধীনতা সংবিধানের পাতা ছেড়ে, টেবিলের তলা থেকে কোরাপশনের চমচাগীরি করে। ডেমোক্রেসি আর আইন নিয়ে ব্যবসা করে। শিশুশ্রম দেখেও নিশ্চুপ থাকে স্বাধীনতা। শিক্ষার অধিকার সেইসব শিশুদের নেই। স্বাধীনতার সখ্যতা জাতিভেদ আর বর্ণবিদ্বেষের সাথে। পনের দাঁড়িপাল্লাতে মেপে বলে দেয় মেয়েদের গুরুত্ব। স্বাধীনতা, বেকারত্বের তবেদারি করে বেড়ায়, শিক্ষিত বেকারদের হাত পেতে ভিক্ষা করতে শেখায়। স্বাধীনতা সেই বৃদ্ধাশ্রমের ত্রিসীমানায় আসে না, যেখানে বাস সেই অভাগিনী মায়ের। স্বাধীনতা, ওয়েষ্ট্রান কালচার আর অত্যাধুনিকতার নামে অশ্লীলতা এবং নিজের সংস্কৃতিকে অপমান করার ফন্দি।
এই কি সেই আকাঙ্খিত স্বাধীনতা !!!!
এ শুধু গোরারাজের হাত থেকে স্বাধীনতা, দেশ এখনো দেশবাসীর হাতে পরাধীন। এই ভুখানাঙ্গার দেশে, বিশ্বের প্রথমশ্রেনির আমির লোকেদের বাড়ি। এত অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন? এত ধর্মের নামে হিংসা কেন? জাতীয় সংহতি কি তবে ডুমুরের ফুল? কবে আসবে আসল স্বাধীনতা ? কবে মুছবে আমার মায়ের চোখের জল?