Siddhartha Singha

Classics

4.5  

Siddhartha Singha

Classics

আমি শঙ্খ ঘোষ বলছি

আমি শঙ্খ ঘোষ বলছি

4 mins
499


--- আপনি এই রাধাদাসের খবরটা কোত্থেকে পেলেন?

রাধাদাস! ষোড়শ শতাব্দীর এই রাধাদাসের কথা তো বৈষ্ণব সাহিত্য রসিকরাও জানেন না। জানেন না তাঁর লেখা কাব্য 'কৃষ্ণলীলামৃত গীত'-এর কথাও। আমি তো সবেমাত্র একটি প্রবন্ধে প্রথম লিখেছি তাঁর কথা! সে প্রবন্ধ তো এখনও আলোর মুখই দেখেনি। তা হলে ইনি জানলেন কী করে! ইনি কে?

তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে বলছেন?

ফোনের ও প্রান্ত থেকে উনি বললেন, আমি শঙ্খ ঘোষ।

বুঝতে পারলাম কেউ মজা করছে। যেমন আমিও অনেক সময় করি। সদ্য বিয়ে করা কোনও বন্ধুকে আচমকা ‌মধ্যরাত্রে ফোন করে বলি, তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি? কী করছিস? 

কিংবা অন্য কোনও বন্ধুকে খুব গম্ভীর গলায় ফোন করে বলি, আমি লালবাজার থেকে বলছি...

অথবা ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য বলি, আপনি যা করছেন ঠিক করছেন না। আপনি যা করেছেন, যা করছেন এবং আপনি যা করবেন, আমরা সব জানি। খুব সাবধান। এখনই সতর্ক হোন। না হলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবেন...

আমার অনেক বন্ধু আছে, যারা আমার মতো তারাও মাঝে মাঝে ফোন করে এমন এমন কথা বলে, যা চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

ফলে আমি বুঝতে পারলাম কেউ না কেউ ইয়ার্কি মারছে। কারণ শঙ্খ ঘোষ আমাকে ফোন করার লোক নন। আমি বহুবার তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। কখনও মল্লিকা সেনগুপ্ত আমাকে পাঠিয়েছেন সানন্দা পত্রিকার কোনও লেখা আনার জন্য। কখনও গিয়েছি 'বাবু বিবি সংবাদ'-এ তাঁর সঙ্গে কথা বলে কিছু লেখার জন্য। অথবা অন্য কেউ পাঠিয়েছে আমাকে ওঁর একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য।

যত বারই গিয়েছি এবং যতটা তাঁকে দেখেছি এবং চিনেছি তাতে আমার একবারও মনে হয়নি উনি আমাকে ফোন করতে পারেন এবং তার থেকেও বড় কথা, ফোন করতে হলে তো আমার ফোন নম্বর ওঁর কাছে থাকতে হবে! আমার নম্বর উনি খামোখা সেভ করে রাখতে যাবেন কেন! সুতরাং উনি আমাকে ফোন করেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

আর উনি যখন ফোন করেননি, তার মানে কেউ না কেউ আমার সঙ্গে চ্যাংরামো মারছে। তো, আমার সঙ্গে যদি কেউ চ্যাংরামো মারে, আমি কেন তার সঙ্গে চ্যাংরামো মারব না?

তাই উনি যখন আমাকে বললেন আমি শঙ্খ ঘোষ, আমিও সঙ্গে সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ বলুন, আমি অমিতাভ বচ্চন বলছি।

আমি এই কথাটা বললাম ঠিকই, কিন্তু ফোনের ও প্রান্ত হঠাৎ করেই একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম, ফোনের ও প্রান্তে যিনি রয়েছেন, তিনি এটা নিতে পারেননি। কিংবা ভেবেছেন আমি হয়তো ওঁর কথাটা শুনতে পাইনি। তাই কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে খুব আস্তে আস্তে করে কেটে কেটে খুব গম্ভীর গলায় উনি বললেন, আমি শঙ্খ ঘোষ বলছি।

ওঁর বলার ধরণ দেখে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। না, কেউ চ্যাংরামো করছে না। ইনি শঙ্খ ঘোষই। তাই বললাম, হ্যাঁ বলুন।

উনি বললেন, আপনি যে প্রবন্ধটা লিখেছেন, 'কৃষ্ণকীর্তনে নতুন সংযোজন--- রাধাদাস' এই লেখাটির তথ্য আপনি কোথা থেকে পেলেন? কোন বইতে?

আমি তাঁকে বললাম, পুরুলিয়ার যুধিষ্ঠির মাজীর বড় ছেলে শিবপ্রসাদ মাজী একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেছিলেন। সেই গীতিকাব্যটির নাম--- কৃষ্ণলীলামৃত গীত। লিখেছিলেন রাধাদাস। না, রাধা দাস নয়, কারণ তখনও নামের শেষাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পদবির সৃষ্টি হয়নি।

ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তে যে রাধানাথ দাসের কথা উল্লেখ করেছেন, ইনি কিন্তু তিনি নন। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি এবং অতি দুর্বল পদকর্তা। তাঁর সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক নেই।

ডা. ক্ষুদিরাম দাস এই পাণ্ডুলিপিটিকে অতি মূল্যবান বলে জানালেও, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কিন্তু এই কাব্যটিকে গ্রন্থাগারে প্রকাশ করার ন্যূনতম আগ্রহও দেখায়নি। ফলে ১৯৯৮ সালের ২১ জুন তিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁর বাবা যুধিষ্ঠির মাজী নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বইটি ঠিকঠাক মতো সাজিয়ে, সম্পাদনা করে শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অধ্যাপক ড. দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় যে 'রাধাদাস প্রণীত কৃষ্ণলীলামৃত গীত' প্রকাশ করেছেন, সেই বইটি থেকেই আমি এই তথ্যগুলো পেয়েছি।

বুঝতে পারলাম, আমার বাড়ির খুব কাছেই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র 'আরেক রকম' নামে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধের পত্রিকা বের করছেন, যে পত্রিকায় আমি মাঝে মাঝেই লিখি, সেই পত্রিকাতেই আমি যে প্রবন্ধটি দিয়েছি, যেহেতু শঙ্খ ঘোষ নিজেও ওই পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, সেই সুবাদে আমার এই গদ্যটি হয়তো তাঁর হাতে গিয়ে পড়েছে এবং উনি সেটা পড়েছেন। এবং ওটা পড়ার পরেই তাঁর মনে খটকা লেগেছে, যে তথ্য কেউ জানেন না, সেই তথ্য আমি জানলাম কোথা থেকে! তাই হয়তো উনি এই ফোনটি করেছেন।

কোন বই থেকে আমি এই তথ্য পেয়েছি জানার পরেই উনি বললেন, সেই প্রকাশকের নাম এবং ঠিকানাটা আমাকে একটু দেবেন?

আমি বললাম, আপনি চাইলে আমি আপনার মেয়ে সেমন্তীর হাতে এই বইটি পাঠিয়ে দিতে পারি। ও তো আমাদের নীচের ফ্লোরেই বসে!

উনি বললেন, না না, পাঠানোর দরকার নেই। আপনি শুধু প্রকাশকের নাম আর ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিন। আমি ঠিক সংগ্রহ করে নেব।

এর ঠিক পরের রবিবার আমি যখন আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার 'পঞ্চাশটি গল্প' বইটি তাঁকে দিতে গেলাম, সেখানে আরও অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ। তিনি মজা করে বললেন, সিদ্ধার্থ, এটা তোমার কত নম্বর বই? চারশো? না, সাড়ে চারশো?

আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, না না, অত না। এটা আমার দুশো চুয়ান্নতম বই।

আমার কথা শুনে শঙ্খ ঘোষ আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েছিলেন। সে দৃষ্টি আমি এখনও ভুলিনি। কোনও দিন ভুলব না। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics