আমার রবিঠাকুর
আমার রবিঠাকুর


রবিঠাকুর মানে তো শুধু কবিতা, গান,গল্প বা নাটকই নয়- জীবনের ওঠাপড়া ,বড় হয়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ সবেতেই মিশে গিয়ে আমার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যিনি জড়িয়ে আছেন,তিনিই রবীন্দ্রনাথ। এ আমার চিরকালের বন্ধন , আমার অন্তরের পরিচয় ।
মনে পড়ে ছোটবেলায়, স্কুলে 'সহজ পাঠ' বইতে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম পেয়েছিলাম, তারপর বড় হবার সঙ্গে,ক্রমশঃ আরও গভীরে প্রবেশ করলাম । বাবারই অফিসের প্রতিযোগিতায়, আবৃত্তি করলাম 'দামোদর শেঠ'। পুরস্কার হিসেবে পেলাম রবীন্দ্রনাথের প্লাস্টার অফ প্যারিসে বাঁধানো ছবি,যা আজও যত্ন করে তুলে রাখা আছে।
বাবার একটা সঞ্চয়িতা ছিল, মাঝে মাঝে পড়তাম ,বাবা নিজেও পড়ে শোনাতেন। কখনও শীতের দুপুরে মিঠে রোদে ,ছাদে বসে বা সন্ধ্যাবেলায় লোডশেডিংয়ের সময় , বাবার রেডিওতে বাজত রবীন্দ্রনাথ । বাবা বুঝিয়ে দিতেন গানের এক একটা কথার মানে। তখন কতটা বুঝতাম জানিনা,কিন্তু আজ ছেচল্লিশ বছর বয়সেও, দেখি রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার এক একটা লাইন জীবনের পরম দুঃখ , আনন্দ বা যেকোন আবেগময় অনুভবে স্রোতের মতো গলায় নেমে আসছে। তার অর্থ তখন জীবন দিয়ে বুঝতে পারি,আর তার রেশ হৃদয়ের গভীরে ঢুকে গিয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। এক মহানুভব আর জীবনবোধের ব্যাপ্তি তখন আমায় ঘিরে ধরে, আর বুঝতে পারি মানুষের জীবনে, শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মনেপ্রাণে ,রন্ধ্রে রন্ধ্রে থেকে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
বাবা আবৃত্তি করতেন 'দুই বিঘা জমি' বা 'পুরাতন ভৃত্য'। দেখতাম বাবার চোখে জল। মেঘ ডাকলে আকাশ কালো করে বিদ্যুতের চমক দেখা গেলে ,বাবা গুন গুন করে গাইতেন " গগনে গরজে মেঘ,ঘন বরষা "বা "ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে "। বাবা বলতেন "দেখবি সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন"। বাবা লেখালেখি করতেন ।বলতেন, "লিখতে গেলে, ঠিক কোথাও না কোথাও ওনার প্রভাব এসে পড়বেই।যাই লিখতে যাই ,দেখি তিনি আগেভাগেই তা অনেক সুন্দর করে লিখে বসে আছেন।" বাবার অসংখ্য বই ছিল,তার মধ্যে রবিঠাকুরের গল্পগুচ্ছ আর পত্রাবলী খুব টানল,আর গান। শুরু হলো গুনগুন করে গান গাওয়া।
একদিন সেই সময়েই হাতে এলো প্রথম প্রেমপত্র । তাতেও রবীন্দ্রনাথ। দুটি লাইন "আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজি হোক না হারা।" তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানের বা কবিতার এক একটা লাইন শুনে এক এক সময় খুব কষ্ট হত, গলায় আটকে থাকত সেই কষ্ট । চোখের জল হয়ে তা কখনও বা নেমে আসত, আর তার সঙ্গে সেই সমস্ত অনুভূতিগুলোকে নিয়ে জড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ।মনে হত পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ বুঝতে বোধহয়,আরও কয়েকবার জন্ম নিতে হবে।
তারপর বড় হয়েছি , কেরিয়ারের লড়াই চলছে, আবার নতুন করে রবীন্দ্রনাথ পড়তে ,ওনাকে জানতে শুরু করলাম, ঘুরে এলাম জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকিতন থেকে।মনে আছে, সেবার শান্তিনিকেতনের একটা গাছের নীচে ,ভাঙা ইঁটের পাঁজায় ,নিঝুম দুপুরে বসে থাকতে থাকতে মনে হল,আমি যেখানে বসে আছি,সেখানে কি কবিও কখনও এসেছিলেন?আমার জন্য কি তাঁর একটুকু ছোঁয়া এখনও বেঁচে আছে? তিঁনি কি জানলেন, আমি এসেছিলাম, নিবিড়ভাবে তাঁর লেখা ভালবেসেছিলাম? আবেগবশে,বাবা সারাজীবনে যা পারেননি,আমি তাই করে ফেললাম।সব জমানো টাকাগুলো দিয়ে কিনে ফেললাম সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির কোন শেষ নেই। আজও মনে পড়ে, সেদিন বিকেল, আমার প্রেম ভেঙে গেছে ।শেষমেশ দেখা, সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা আমারই উপহার দেওয়া 'শেষের কবিতা' বইটা। সে বলল, "এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।" সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? শেষ প্রেমিকা বাস ধরে চলে গেল। আমার হাতে থেকে গেল "শেষের কবিতা"। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান ,"তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম"।