আগাম
আগাম
সামনে তাকিয়ে নাটুকে দেবু একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তার ছেলে এখানে কী করছে! ওই মৃতদেহের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ও ভাবে কাঁদছে কেন ও! কে মারা গেছে! ও ভাবে কাঁদছে মানে তো যে মারা গেছে, সে ওর অত্যন্ত কাছের কেউ। আর ওর কাছের মানে তো তারও কাছের! কিন্তু কে উনি!
খানিক আগে লেবু চা খেয়ে হেলতে দুলতে গুটিগুটি পায়ে কেওড়াতলা ইলেকট্রিক শ্মশানে ঢুকে পড়েছিল নাটুকে দেবু। না, ও কোনও দিন স্টেজে উঠে নাটক করেনি। কোনও নাটকের দলের সঙ্গেও ওর কোনও যোগাযোগ নেই। তবু সবাই ওকে নাটুকে দেবু বলেই ডাকে।
আসলে পাড়ায় দেবাশিস, দেবব্রত, দেবজিৎ, দেবাঞ্জন নামে অনেকেই আছে। আর তাদের প্রায় সবারই ডাক নাম দেবু। তাই সহজে চেনার জন্য কেউ যেমন শুধু লম্বা হওয়ার জন্য লম্বু দেবু, সারাক্ষণ সাইকেল নিয়ে ছোটে বলে কেউ যেমন সাইকেল দেবু, বাবা মিলিটারিতে কাজ করত বলে ছেলে হয়ে উঠেছে মিলিটারি দেবু, তেমনই যে কোনও ব্যাপার নিয়েই ও বড্ড বেশি নাটক করে বলে ওকে সবাই নাটুকে দেবু বলে ডাকে।
ইলেকট্রিক শ্মশানের ভিতরে ঢুকতেই ডান হাতে বাঁ হাতে দেওয়াল লাগোয়া লম্বা টানা সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চ। তখন সেখানে কেউ পাশাপাশি বসে আছে। কেউ কেউ ক'হাত দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেউ আবার বুক চাপড়ে হাউহাউ করে কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে দু'-চার জন মেয়ে-বউ।
মাঝে মাঝেই নাটুকে দেবু এখানে আসে। এ সব দৃশ্য হামেশাই দেখে। একবার দেখেছিল, স্বামী মারা যাওয়াতে তাদের পাড়ার প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব একটা বউ কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়ার জন্য প্রায় চুল্লির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর কী! তার সঙ্গে থাকা লোকেরা কোনও রকমে জোর করে তাকে প্রায় কোলপাঁজা করে এই চাতালে এনে বসিয়েছিল।
নাটুকে দেবুর মনে হয়েছিল, কেউ একটু শিথিল হলেই যে কোনও সময় এই বউটি ছুট্টে গিয়ে জলন্ত চুল্লিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাও বাঁচোয়া যে, এই ইলেকট্রিক চুল্লিগুলোর দরজা একমাত্র মরদেহ ঢোকানোর সময়ই কয়েক মুহূর্তের জন্য খোলে। বাকি সময়টা বন্ধই থাকে। ফলে সে ভয় নেই। তবে এমনও হতে পারে, পাশেই তো নদী, যদিও এখন আর নদী নেই, নালা হয়ে গেছে। তাই সবাই এখন ওটাকে টালি নালা বলে, তবু জোয়ার ভাঁটার সময় তো যথেষ্ট জল থাকে! আসার সময় ওর চোখে পড়েছিল টুপুটুপু জল। যদি যাওয়ার সময় এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দেয়! অবশ্য ঝাঁপ দিলেই যে ডুবে মরবে এমন নিশ্চয়তা নেই। সঙ্গে এত লোক রয়েছে, তারা নির্ঘাৎ লাফিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি ধরে উদ্ধার করে আনবে। আর স্বামীর শোকে দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ঝাঁপ দিলেও সে যদি সাঁতার জেনে থাকে, তা হলে তো হয়েই গেল। তার আর মরা হবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিকই হাত-পা ছুড়ে পাড়ে উঠে আসবে।
হ্যাঁ, তার বাড়ি যদি ছ'তলা আট তলা হত, বাড়ি ফিরে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে যদি ঝট করে ছাদে গিয়ে মারতে পারত এক লাফ, কিন্তু তার বাড়ি তো মোটে দোতলা! লাফ দিলে হয়তো খুব জোর হাত-পা ভাঙতে পারে, তার থেকে বেশি কিছু হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
হ্যাঁ, মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমে কাদা, সে চুপিচুপি উঠে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে পারে। কিংবা মুখে এক মুঠো ঘুমের ওষুধ পুরে এক গ্লাস জলের সঙ্গে ঢকঢক করে খেয়ে নিতে পারে। অথবা চুপিসাড়ে খেয়ে নিতে পারে মারাত্মক কোনও বিষ। নয়তো বাথরুমে গিয়ে ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতে পারে হাতের শিরা।
সে দিন এই বউটির কান্নাকাটি দেখে নাটুকে দেবুর এ সবই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, নাঃ, স্বামীর এমন শোক এর পক্ষে সহ্য করা সত্যিই অসম্ভব। হয়তো আজ কিংবা কাল, দুটো দিন কোনও রকমে কাটালেও তৃতীয় দিন বেঁচে থাকা এর পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু তৃতীয় দিন নয়, চতুর্থ দিন সে যা দেখেছিল এবং এর ওর ফিসফাস শুনে যা বুঝেছিল, তাতে সে একেবারে হতবাক। স্বামীর মৃত্যুর তৃতীয় দিনই পাড়ার অমলদা নাকি ওই বউটির জন্য তাঁর কাঁধ পেতে দিয়েছিলেন শোকার্ত মাথা রেখে হাঁপুস নয়নে কাঁদার জন্য। এবং সে দিনই ওই কাঁধে মাথা রেখে এই বউটি মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়েছিল স্বামীর যাবতীয় শোক।
শুধু শ্মশানেই নয়, নাটুকে দেবু মাঝে মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় কালীঘাটে। মায়ের মন্দিরে। পাঁঠা বলি দেখে। লোকজনের পুজো দেওয়ার ধুম দেখে। ভিখিরিদের নিশ্চিন্ত জীবন দেখে।
কখনও চলে যায় চেতলা ব্রিজের ওপরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টালিনালার এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া দেখে। পাড় দখল করে গজিয়ে ওঠা এ মন্দির ও মন্দির দেখে। লালবাবা, নীলবাবার আখড়া দেখে। এই আশ্রম ওই আশ্রম দেখে। ঝুপড়ি দেখে।
কোনও দিন হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় যে দিকে দু'চোখ যায়। অন্যান্য দিনের মতো আজও সে এসেছিল কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। না, সেই শ্মশান আর নেই। একেবারে আপাদমস্তক পালটে গেছে। একেবারে ঝাঁ-চকচকে। ছানাপোনা নিয়ে কোনও শুয়োরের ঘোরাঘুরি নেই। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নেই। এখানে এলে নাকে আর রুমাল চাপা দিতে হয় না। কাঠের চুল্লিগুলোরও আধুনিকীকরণ হয়েছে। ধুলো আর ছাই ফিল্টার হয়ে পরিবেশ এখন একেবারে পরিবেশ-বন্ধু। সামনের মনোরম বিশাল চাতালে ডোমদের ছেলেমেয়েরা ফ্লাড লাইটের আলোয় ফুটবল খেলে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এটা এখন প্রেম করার নতুন জায়গা হয়ে উঠেছে। এখানে যেহেতু খুব কম মরা দাহ করা হয়, ফলে জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। শুধু কালীপুজোর ক'টা দিন ভিড় উপচে পড়ে এখানে। সামনের বেদিতে বিশাল করে পুজো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে নেতা-মন্ত্রীরা এসে হাজির হন। সব কিছু পাল্টে গেলেও এখানে এখনও কালীপুজোর রাতে দু'-চার জন তান্ত্রিক লাল জোব্বাটোব্বা পরে, গলায় দশ-বিশটা রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে চিতার ওপরে বসে পড়েন। আর এখানে এলে নাটুকে দেবু বাড়ি যাওয়ার সময় মাত্র কয়েক হাত দূরের ইলেকট্রিক শ্মশানটাও ঘুরে যায়। কিন্তু এ কী!
সে তো খানিক আগেই তার ছেলেকে বাড়িতে দেখে এসেছে। হ্যাঁ, সে তো এই জামাপ্যান্ট পরেই ছিল! এটা পরে তো ও সচরাচর বাড়ি থেকে বেরোয় না। তা হলে! এইটুকু সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটল যে তার ছেলে ওই জামাপ্যান্ট পরেই এখানে চলে এল! তা হলে কি ওর কোনও বন্ধুবান্ধবের মা কিংবা বাবা মারা গেছে। ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি এখানে ছুটে এসেছে! হতে পারে! কারণ, তার কোনও আত্মীয়স্বজন মারা গেলে, সে না জানলেও তার বাড়ির কেউ না কেউ তো ঠিকই খবর পেত। আর তার বাড়ির লোক জানলে, আর কেউ না হোক, অন্তত তার বউ তো এতক্ষণে তার মোবাইলে ফোন করে খবরটা জানাত। তা হলে কে মারা গেল! কে!
এক সময় মড়া পোড়ানোর খুব ধুম ছিল। পাড়ার বা বেপাড়ার, এমনকী অন্য গ্রামের কেউ মারা গেলেও পাড়ার ছেলেছোকরারা কোমরে গামছা বেঁধে সেখানে ছুটে যেত। নিজে থেকে যেচে চার বেয়ারার একজন হয়ে উঠত। যাতে পরে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, আমি একশোটা মড়া পুড়িয়েছি। আমি দুশোটা মড়া পুড়িয়েছি। তখন অনেকেই মনে করত, মড়া দাহ করাটা বড় পুণ্যির কাজ।
শবযাত্রার সঙ্গী হলে যে শুধু শ্রাদ্ধর নিমন্ত্রণই পাওয়া যেত, তা-ই নয়, মড়া চিতায় তুলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখের ব্যাপারও ছিল। শহরতলি বা গ্রামের দিকে ছিল জোর জুলুম। এক দিকে মড়া পুড়ত, অার অন্য দিকে শোক ভোলার নাম করে শবযাত্রীরা গলায় দেশি পানীয় ঢালত।
কিন্তু না। শহরে তো এ সব হয় না। এখন পাড়ায় পাড়ায় শুধু এম এল এ, এম পি-রাই নন, স্থানীয় কাউন্সিলর পর্যন্ত তাঁদের তহবিল থেকে স্থানীয় ক্লাবের নামে কিনে দেন অ্যাম্বুলেন্সের মতো অন্তত একটা শববাহী-গাড়ি। আর সত্যি বলতে কি, কাঁধে বয়ে মড়া নিয়ে যাওয়াটাও এখন প্রায় উঠে গেছে। কেন নিয়ে যাবে? একটা ফোন করলেই যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়ে যাচ্ছে--- শববাহী গাড়ি।
আর দল বেঁধে হইহই করে মড়া নিয়ে যাওয়ার চার্মটাই নেই দেখে, পাড়ার ছেলেরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন শবযাত্রী হয় শুধু বাড়ির লোকজন এবং হাতে গোনা অত্যন্ত নিকট কিছু আত্মীয়স্বজন।
তাদের আলোচনার বিষয় হয়, নার্সিংহোমে কত টাকার বিল হয়েছে। কারা রোজ দেখতে যেত। আর কার চোখের সামনে সে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সঙ্গে চলে এর-তার নানা পরামর্শ--- যত তাড়াতাড়ি পারিস, মানে কাজ মিটে গেলেই কিন্তু এল আই সি-টা কী ভাবে পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে তদ্বির করিস। আচ্ছা, গ্যাসটা কি ওর নামে ছিল? তা হলে কিন্তু ওটার নাম চেঞ্জ করতে হবে। ব্যাঙ্কের দিকটাও খেয়াল রাখিস। কোনও দেনাটেনা নেই তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানে খানিকক্ষণ থাকলেই বোঝা যায় মানুষ কত বিচিত্র জীব। আজ সকালেও যারা একান্নবর্তী পরিবার ছিল, একজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবার কী রকম টুকরো টুকরো হয়ে যায়! এক বিঘত জমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কেমন লাঠালাঠি শুরু হয়ে যায়! চলে চোরাগোপ্তা আক্রমণ!
কিন্তু তার ছেলে কাকে দেখে কাঁদছে! কে মারা গেছে! কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ওই বেদিটার ওপরে উঠলেই দেখা যায় কে মারা গেছে। এ রকম জায়গায় চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে 'কে মারা গেছে' জানতে চাওয়াটা ভাল দেখায় না। কিন্তু সে যে যাবে, তার উপায় নেই। আজ মড়ার একেবারে লাইন পড়ে গেছে। তেমনই শবযাত্রীদের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে যেতে গেলে আর গা বাঁচিয়ে যাওয়া যাবে না। ছোঁয়াছুঁয়ি হবেই। তখন আজই পাট ভেঙে পরা এই জামাপ্যান্টগুলো ধোওয়ার জন্য খুলে দিতে হবে। স্নান না করে ঘরে ঢোকা যাবে না। তার চেয়ে বরং বউকে ফোন করে জেনে নেওয়া অনেক সহজ, কে মারা গেছে!
এটা ভাবামাত্রই নাটুকে দেবু সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল বউকে, কে মারা গেছে গো?
বউ আকাশ থেকে পড়ল, কে মারা যাবে?
ও বলল, না, ছেলেকে শ্মশানে দেখছি তো, তাই...
বউ বলল, তুমি ডাক্তার দেখাও। তোমার চোখটা গেছে।
--- মানে?
--- ছেলে তো বাড়িতে।
নাটুকে দেবু অবাক। বাড়িতে? কী বলছ!
--- এই তো আমার সামনে।
--- মানে? বলেই, যেখানে ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, ও সেখানে তাকাল। দেখল, কোথায় তার ছেলে! তার ছেলে তো ওখানে নেই। তা হলে কি ও অন্য কোথাও গেল! গেলেও এত ভিড় ঠেলে বেরোতেও তো সময় লাগে! এই এক মুহূর্তের মধ্যে ও কোথায় গেল! তা হলে কি সে ভুল দেখেছিল! তার এত ভুল হওয়ার তো কথা নয়! তা হলে!
যা হয় হবে। লাগুক ছোঁয়াছুঁয়ি। সে ফোন কেটে দিয়ে ঝটপট সিঁড়ি ভেঙে ঠেলেঠুলে ওপরে উঠল। আর তখনই... যে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলে কাঁদছিল, নীচে শোয়ানো সেই দেহটার দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল ও। দেখল, মৃতদেহটা আর কারও নয়, তার নিজেরই!
ওটা দেখেই সে পড়ি কি মড়ি করে সবাইকে ধাক্কাটাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। না, সে মরেনি। সে ভূতও নয়। তা হলে ওটা কে! তার কোনও যমজ ভাইটাই ছিল কি! যে ছোটবেলাতেই রথের মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল!
নাটুকে দেবু ছুটতে ছুটতে বাসরাস্তায় এসে দাঁড়াল। আসতেই দেখল, একটা এ সি বাস আসছে। সে পারতপক্ষে কখনও এ সি বাসে ওঠে না। তবু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসটা চলতে শুরু করে দিলেও ও লাফ মেরে বাসটায় উঠতে গেল। কিন্তু ও এত টেনশনে ছিল যে ওর পা-টা আর পাদানিতে পড়ল না। ফসকে গেল নীচে। একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল নাটুকে দেবু। না, ওই এ সি বাসটা নয়, এ সি বাসটাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটে আসা একটা মাল বোঝাই ম্যাটাডর এমন ভাবে তার ওপর দিয়ে চলে গেল... আশপাশ থেকে সবাই চিৎকার করে উঠল। কেউ কেউ বলল, গেল গেল...
হ্যাঁ, সে সত্যিই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় তার চোখে পড়ল, সে শুয়ে আছে। আর তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে। যে ভাবে একটু আগে ইলেকট্রিক শ্মশানে সে তার ছেলেকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিল, ঠিক সেই ভাবে। ঠিক সেই ভাবে।
সিদ্ধার্থ সিংহের পরিচিতি২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন মৌচাক, শিশুমেলা, সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা। বেশ কয়েকটি বিশ্বরেকর্ড তাঁর দখলে।