আধো অবয়ব
আধো অবয়ব


সুনেত্রা বোঝেনা কেমন ভাষাচিত্রে সে হৃদয়ের আলপনা আঁকবে? এতোটা গভীর মর্মবেদনা ছেয়ে যাবে তার জীবনে, ভাবেনি সে একবারও। সকালের শিশির চোখ খোলার আগেই সে মুঠোফোনে ঋষভের ছবি জড়িয়ে ঘুম চোখে তাকে আদর করতো। ঋষভ হয়তো একটু বেশী বাস্তববাদী। কিন্তু বেশ লাগতো সুনেত্রার তাকে। এলোমেলো ঋষভের। সুনেত্রার যেন তাকে ঝোড়ো হাওয়া মনে করে অশেষ মুগ্ধতায় সাজিয়ে দেওয়া। মনে পড়ছিল বৃষ্টি থামার পর যে আবেশ ভরিয়ে তোলে শান্ত বা অশান্ত মনকে, তেমনই শিরশিরে অনুভূতি জাগাতো ঋষভের ভালোবাসা। তাহলে এমন কেনো টলোমলো হলো সুনেত্রার আকাশ? হলুদ খামের চিঠিটি বুকে জড়িয়ে সে অনুভব করলো- "হৃদয়ের এ কূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়, হায় সজনী.." দূরে তখন বিসমিল্লাহর সানাইয়ে অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় কার যেন শুভ পরিণয়ের সূচনা।
বেতার তরঙ্গে নিজের মনের অস্থিরতাকে মিশিয়ে সুনেত্রা ফোন করে ঋষভকে। পাখির আলগা পালক খসে পড়লো। ঋষভকে কিছু বোঝার আগেই সুনেত্রার বাক্যবাণে জর্জরিত হয়।
-" শোনো, সুইটহার্ট, আমি নিজেই ওই চিঠিটি পড়ি নি।"
-"না, অসম্ভব, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।"
এমন কষ্টের সংলাপে দুটি প্রাণ যেন অঝোরে কেঁদে চলেছে।
খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই একসাথে।
সৌরভ বসু ছেলেকে আড়চোখে দেখছেন। তার দুরন্ত, ছেলেমানুষি করা ছেলের চোখে গভীর বিষাদের ছায়া প্রত্যক্ষ করলেন। সুবর্ণার ডাকে সাড়া দিয়ে হতচকিত তিনি, -" কি গো, আরেকটু চিকেন স্টু দেবো? আর বললে না তো ভেজ মখমলিটা কেমন হলো?"
সৌরভ বসু ছেলের চিন্তায় মগ্ন। খাওয়া তার হয়ে গেছে।
এই প্রথমবার নৈশভোজন অর্ধসমাপ্ত রেখে তিনি ঋষভকে বললেন তার ঘরে দেখা করতে। বাইরে তখন অস্তমিত চাঁদের বুকে জোৎস্নার সুখের মরণ।
-"কি হয়েছে মাই ডিয়ার? তোমার চোখমুখ এমন থমথমে কেনো?"
ঋষভের মিনমিনে উত্তর-" সুনেত্রা আজ সন্দেহ করলো আমায়। বলছে সে নাকি আমার বইয়ের ভাঁজে একটি মেয়ের চিঠি পেয়েছে। যদিও মেয়েটি আমারপূর্বপরিচিতা।"
ডাক্তার সৌরভ বসুর মুখে গভীর চিন্তার ভাঁজ।
সে ভাঁজ খুলবে এমন সাধ্য কার?
সৌরভ বসু বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকিয়ে বলেন-
"ডোন্ট ওয়ারি মাই সন, এভরিবডি নিডস্ এ স্টোরি টু এক্সপ্লেন।"
" সুনেত্রা তোমায় ভুল বুঝেছে। তোমার দায় তাকে ঠিক বোঝানোর। এতদিনের সম্পর্ক তোমাদের। সেই স্কুলজীবন থেকে।"
ঋষভ নির্বিকার। সে তো জানেই না কীভাবে সে প্রেয়সীর অন্তর্বেদনার কারণ হয়ে উঠলো।"
এদিকে স্টাইলিশ ঐন্দ্রিলা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল সে ঋষভ বসুকে প্রেমের ঘায়ে কুপোকাত করবে। লুকিয়ে সে চিঠিটি রেখে দিয়েছিল ঋষভের বইতে। সুন্দরী ঐন্দ্রিলার রূপের গর্ব সাংঘাতিক। ঋষভ তার প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। মানতে পারেনি তার অহম স্বভাব।
সুনেত্রার সাথে একই স্কুলে পড়ায় ঐন্দ্রিলা।
তাই আঘাতটা সুনেত্রার বুকে বেশী বেজেছে।
আজ স্টাফরুম নিশ্চুপ। সবাই খাতা দেখতে ব্যস্ত।
হঠাৎ সুনেত্রা দেখে ঐন্দ্রিলা কার সাথে ফোনে কথা বলতে বাইরে গেল। সবার অলক্ষ্যে সে ঐন্দ্রিলার ব্যাগে একটি জিনিস রেখে দিল।
ঐন্দ্রিলা ফিরলে তাকে বললো-" ঐন্দ্রি, আজ বাপি মা দাদাভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যাবে। তোর কাছে আজকের রাতটা থাকবো। জমিয়ে গল্প করবো।"
আপত্তি করেনা ঐন্দ্রিলা।
<p>তবে ঋষভ কি চিঠিটা দেখেছে?- একমনে ভেবে চলে ঐন্দ্রিলা।
সন্ধ্যায় দুই বান্ধবী অতীত দিনের আলাপচারিতায় ঢলে পড়ে। সুনেত্রার শৈশব কেটেছিল কুচবিহারে। দুর্দান্ত মনোরম পরিবেশে। তারপর পড়াশোনা শেষ করে পাহাড় ঘেরা কালজানি নদীতীরে আলিপুরদুয়ারে স্কুলের চাকরি নিয়ে চলে আসা। বেশ লাগবে এখানে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে নিতে পারলে। ঋষভের মন ভুলানো শিশু মুখের হাসিতে সে তো মজেই গেছে। একটি স্কুল মিটিংয়ে দুজনের পরিচয়। দু একটি ওয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের পর পরিচয় গভীর হতে দেরী হয়নি।
আর ঐন্দ্রিলার হোম পোস্টিং।বড়োলোক বাবার তদ্বিরতায় সে নিজের শহরেই পোস্টেড।
-"কি রে, তোদের গল্প চলবে না বেয়ারাকে খাবার সাজাতে বলবো?"
-" মা, সুনেত্রা কিন্তু রাতে রিচ খায় না। আর হ্যাঁ, খাওয়ার পরে আমাদের ঘরে দুটো ব্ল্যাক কফি পাঠিয়ে দিও।
সুনেত্রার বই পড়ে শোওয়ার অভ্যেস তো। তাই।"
বেশ মুখরোচক অথচ সহজপাচ্য খাওয়ার ছিল ঐন্দ্রদের
বাড়িতে। সাবুদানার খিচুড়ি, কড়কড়ে আলুভাজা, ফুলকপির বড়া।
জম্পেশ খেয়ে রাতে টুকটাক গল্প সেরে দুজনেই শুতে গেল। ও হ্যাঁ, ব্ল্যাক কফি খাওয়ার পরপরই ঐন্দ্রিলার ঘুমে দুচোখ বুজে আসছিল। গল্পের রেশ আর ধরে রাখা গেল না। কে জানত পরেরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই চিরনিদ্রায় চলে যাবে আদুরে বাবার ছটফটে কণ্যা ঐন্দ্রিলা।
সকালে মোনালিসা চা দিতে এসে দেখে মেয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আর পাশের শয্যায় সুনেত্রা নেই।
একটু পরেই অবশ্য সুনেত্রার প্রত্যাগমন। সে নাকি প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছিল।
বিদীর্ণ কান্নায় তখন ঐন্দ্রিলার বাড়ি সরগরম।
কান্নার রোল একটু থামলে পারিবারিক ডাক্তার সুদেশ সেন বলেন-" বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে।"
ঐন্দ্রিলার ব্যাগ হাতড়ে সুনেত্রাই অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ বের করে সবাইকে দেখায়।
রীতিমতো হতভম্ব ও শোকে পাথর ঐন্দ্রিলার পরিবার।
কেউ ভাবতেও পারছে না গতরাতে বান্ধবী ও কলিগের আগমনে ঐন্দ্রিলার জীবনাবসান।
চারদিন কেটে গেলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়লো অতিরিক্ত ঘুমের ডোজে ঐন্দ্রিলার মৃত্যু।
তবে চমক এখনও বাকি।
ঐন্দ্রিলার শ্রাদ্ধ বাসরে এসে তার বাগদত্তা সংলাপ রায় জানায় সে আর কিছুদিনের মধ্যেই সুনেত্রাকে বিয়ে করবে। বোধহয় পিন পড়লেও এর থেকে বেশী শব্দ হতো।
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে অবশ্য সুনেত্রাই বললো-
" একটা খুনিকে কখনোই বিয়ে করতে পারবো না। মানছি সংলাপের কথাতেই আমি ঐন্দ্রির ব্ল্যাক কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলাম কিন্তু যে মানুষ তার বাগদত্তা পাত্রীকে এভাবে খুনের ষড়যন্ত্র করতে পারে, সে তো অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে আমাকেও একদিন...?"
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সুনেত্রা।
আর তার ঋষভকে শিক্ষা দিতে সুনেত্রার এই পদক্ষেপ বোধহয় বলছে প্রেমের দুয়ারে সবসময় আশঙ্কার প্রহেলিকা ঝুলছে। কে যে কখন কোন ইন্দ্রিয়র টানে প্রেমের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বলা মুশকিল।
সুনেত্রার এই ভয়াবহ পরিণতি কি পারবে আমাদের সকলের চোখ খুলে একটু সুস্থির হতে শেখাতে?
জীবনকে শিক্ষা নয়, সময় দিতে হয়- শিখিয়ে দিলো সুনেত্রার সংশোধনাগারের জীবনযাপন।
ঋষভ শুধু পাহাড়ের খাদে দাঁড়িয়ে মুঠো মুঠো বুনোফুল ছড়িয়ে তার প্রেমকে চিরবিদায় জানালো।