Partha Pratim Guha Neogy

Romance

4.1  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance

আবেগের ভালোবাসা

আবেগের ভালোবাসা

4 mins
692


বর্ষাকালের একটা প্রচন্ড প্রভাব রয়েছে মানুষের মনের উপরে, এই বর্ষণ মুখর দিন গুলো মনের ভিতরকার সংবেদনশীল প্রেমানুভূতিকে যেন জাগিয়ে তোলে। স্বয়ং কবিগুরুও বলে গেছেন -


"হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।

শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ,

আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥............."


কিন্তু মনে হচ্ছিল আকাশটা আজ বড্ড অভিমানী। সে তার অভিমানের জানান দিচ্ছে দমকা হাওয়া আর অঝোর ধারার বর্ষণে। বহুদিন আগে অবসর প্রাপ্ত প্রায় ৭০ বছর বয়সী প্রিয় বাবুর মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচ বারবার সিক্ত হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়। কিন্ত, সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ঝাপসা কাঁচের আভাতে তার মনের কোণে জমা থাকা স্মৃতিগুলোতে যেন আরো একবার প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে৷ এরকম দিনগুলো একটা গভীর বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে প্রিয় বাবুকে। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শব্দজাল ওনার সম্বিত ফিরিয়ে আনলো।


“কি গো শুনছো, সেই কখন থেকে এমন বৃষ্টির মধ্যে বসে আছো। পরে যখন জ্বর বাঁধাবে তখন কার শরীরের ওপর ধকল যাবে শুনি। আমার হয়েছে যত জ্বালা। নাতি এতক্ষণ জ্বালিয়ে ছাড়লো তার বৃষ্টিতে ভেজার বায়না নিয়ে। তাকে তো বুঝিয়ে সুজিয়ে গল্প শোনাবো বলে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি । কিন্তু, নাতির দাদু এই বুড়ো খোকা দেখছি কোন কথা কানেই নিতে চাইনা৷মনে হয় একদিন সত্যি সব ছেড়ে বনবাসে চলে যাবো।”


মুক্তি দেবীর গলার স্বরে যেন প্রিয় বাবু অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসেছে। কিন্তু, আজ তার মুক্তি দেবীর চোখের দিকে তাকাতেও অপরাধবোধ হচ্ছে। যে মানুষটার সাথে প্রায় ৫০ বছরের সংসার নামক গাড়ি চলছে শুধু সেই মানুষটাকে তিনি শুধু দায়িত্ব হিসেবেই ভেবেছেন, কখনো তার মন বোঝার চেষ্টা করেন নি। সকল মানুষের যে তার জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে কিছু চাওয়া থাকতে পারে এই সহজ কথাটি তার মনে একবারের জন্যেও আসেনি!


“কি গো, ভিজেতো একাকার হয়ে গেলে। পাঞ্জাবী বিছানার উপর রাখা আছে। পাল্টে চা টা খেয়ে নিও। বৌমা তোমার টেবিলের উপর রেখে এসেছে। মশাইতো এই যে বই নিয়ে বসবে আর তাকে খুঁজে পায় কে “। প্রিয় বাবু মনে মনে ভাবছেন, ঠিক বলেছ মুক্তি । আজ বই নয় পড়বো তোমার ডায়েরি, যে ডায়েরিতে প্রতিটি পাতায় কলমের কালিতে জীবন্ত হয়ে তোমার সকল অব্যক্ত অভিমান।


প্রিয় বাবু পেশায় ছিলেন শিক্ষক। সময়ের নিয়মে কর্মজীবন থেকে অবসর হয়ে গেলেও বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। চাকরিরত অবস্থায় যেমন বইকে সাথে নিয়ে তার দিনের শুরু ও শেষ হতো চাকরি থেকে অবসরের পরেও সে নিয়মের কোন বদল ঘটেনি।


প্রিয় বাবুর বইয়ের তাকে কারো হাত দেওয়ার অনুমতি নেই৷ শুধুমাত্র মুক্তি দেবীর নয়। নিজের চেয়ে বেশি তিনি তার বইয়ের যত্ন নেন। তার আরকেটি অভ্যাস হচ্ছে বইয়ের কোন লাইন পছন্দ হলে বা কোন তথ্য থাকলে সেটি ডায়েরিতে নোট করে রাখা। গতকাল রাতে তার পুরনো একটি ডায়েরি তিনি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অন্যসময় কিছু খুঁজে পেতে তাকে এতোটা বেগ পোহাতে হতোনা। মুক্তি দেবীকে কিছু খুঁজে দিতে বললেই তার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই খুঁজে না পাওয়া জিনিসটি তার সামনে হাজির হয়ে যায়। কিন্তু অতো রাতে আর মুক্তি দেবীর ঘুম ভাঙ্গাতে প্রিয় বাবুর মন সায় দিলোনা। হয়তো পুরনো বই রাখার ড্রয়ারে থাকতে পারে, এই ভেবে প্রিয় বাবুর ড্রয়ার খুলে খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে আবিষ্কার হল একটি নীল মলাটের ডায়েরি। এটিতো তার ডায়েরি নয়। তবে কার!


ডায়েরির প্রথম দুই পাতার উল্টোনোর পর তিনি দেখতে পান খুব নৈপুণ্যের সাথে তার আর মুক্তি দেবীর নাম বড় বড় অক্ষরে লেখা। প্রিয় বাবু অবাক হয়ে বলেন “মুক্তি ডায়েরি লিখতো! আর আমি কিনা কখনো বুঝতেই পারিনি”! ডায়েরিতে মুক্তি দেবী তাদের প্রথম দেখা হওয়া, সাত পাকে বাঁধা, প্রথম সন্তানের মা হওয়ার অনুভূতি সব এক অব্যক্ত আবেগ মিশিয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। প্রিয় বাবুর পড়তে বেশ ভালোই লাগছিলো। পুরনো স্মৃতি গুলো তার সামনে আবার রঙ্গিন করে ধরা দিচ্ছে। কিন্ত, যতই ডায়েরির পাতা যতই ফুরিয়ে আসছে ততই এক টুকরো কালো মেঘ যেন প্রিয় বাবুর মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে।


” আজ তিনি কাজ শেষ করে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছেন। সাথে দেখছি একটি লাল রংয়ের শাড়ি। ভাবতে লাগলাম - আমার প্রিয় রং যে লাল সেটা তিনি কি করে জানলেন। তার মানে আমাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা তিনি ভুলেন নি। এমনই এক ভাবনার সাথে পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমায় ঘিরে ধরেছিলো। কিন্তু একটু পর যখন তিনি এসে বললো আজ তার বন্ধুর স্ত্রীর জন্মদিন, শাড়িটা তার জন্য। তখন বুঝলাম হঠাৎ পাওয়া সুখের চেয়ে হঠাৎ আসা কষ্টের বোঝা অনেক বেশি। ”


প্রিয় বাবুর চোখের নোনা জলে কয়েকটি শব্দ ঝাপসা হয়ে গেছে। তার ঠিক পরের পাতায় লেখা,


“লাল শাড়ি, নদীর তীরে হাত ধরে হাঁটা, তারা বিছানো আকাশের নীচে সারারাত ছাদে বসে গল্পের ইচ্ছেগুলো ডায়েরির শব্দের মতো মনের খাঁচায় বন্দী করে নিলাম”। প্রিয় বাবু আজ বুঝলেন পাশে থেকেও দুটো মানুষ কতটা দূরে থাকতে পারে।


” কি গো, দুপুরের খাবার যে ঠান্ডা হয়ে গেলো। এবার তো দরজাটা খুলো। ” প্রিয় বাবু দরজা খুলে মুক্তি দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত দুটো ঝাপটে নিজের বুকের মাঝে রাখলেন। “এই দ্যাখো,বউ ছেলের সামনে বুড়ো করছে কি”? মুক্তি দেবী স্বগতোক্তি করলেন। তারপর একি শুনছেন তিনি -

” লাল রংয়ের শাড়ি কিন্তু তোমাকে এখনো পড়লে বেশ লাগবে। নদীর পাড়ে ভীড় বেশি, বুড়োকে একটু সামলে রাখতে হবে। আর তারা গুলো কিন্তু দুজন একসাথে গুনবো। আমাদের না হয় শেষ থেকে শুরু হোক।”

মুক্তি দেবী যেন তার চেনা মানুষটাকে আজ আবার নতুন করে চিনলেন, আসলে ভালোবাসা কখনও হারিয়ে যায় না সংসারের বা জীবনের চাপে হয়ত সাময়িক বিবর্ণ হয়ে যায় প্রকৃত যত্ন বা রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে - আবার একটু যত্ন পেলে নিজের রূপে ফিরে আসে। এটাই তো জীবনের বৈচিত্র্য।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance