কুও ওয়েন আন
কুও ওয়েন আন
২০২১ সালের প্রথমার্ধে চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১১০তম বার্ষিকীতে ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তখন তিনি বলেছিলেন, শিক্ষকরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। উচ্চমানের শিক্ষকের অভাব হলে শিক্ষার্থীরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। শিক্ষকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলোর অন্যতম। কারণ, তাদের মর্যাদা ও মানের সঙ্গে দেশের নাগরিকদের গুণগত মানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে হবে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনীতি ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এর শিক্ষাব্যবস্থা ও সেরা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। তাই বলা যায়, শিক্ষা একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্কিত। চীনের অন্যতম একজন সেরা শিক্ষকের কথা তুলে ধরবো, যিনি টানা ৬৯ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করে আসছেন; তাঁর নাম কুও ওয়েন আন।
১৯৮২ সালের শেষ দিকে তাঁর স্কুলে আবার নতুন ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বই রচনার কাজ শুরু হয়। তবে এবারের রচনা কেবল সংশোধনের কাজ নয়, বরং আধুনিক শিক্ষার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা ছিল।
বহু বছর আগের কথা। কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারেন। এ সম্পর্কে কুও বলেন, “আমি নৈতিকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে দুটি অধ্যায় লিখেছি এবং পরে ‘ক্লাসের প্রধান শিক্ষক’ অধ্যায়টি লিখেছি। মোট এক বছরেরও বেশি সময় দিয়ে তিনটি অধ্যায় সম্পন্ন করেছি। পরে ‘শিক্ষাদান’ বিষয়ক তিনটি অধ্যায় লেখার কাজও আমার হাতে পৌঁছায়। সংস্করণ রচনার কাজ অনেক বেশি ও কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই আমি অনেক বই পড়েছি এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোর শিক্ষাবিজ্ঞানের বই পড়েছি। পড়ার পর আমার অনুভূতি বইয়ে শেয়ার করেছি, নতুন তত্ত্ব দিয়েছি। নতুন সংস্করণের বইটিতে শিক্ষাদানের উদাহারণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের সংমিশ্রণের কারণে পাঠকদের জন্য বইটি আরও উপযোগী ও আকষর্ণীয় হয়েছে, যা এ বইয়ের বৈশিষ্ট্য।”
তত্ত্বের পাশাপাশি উপযুক্ত উদাহরণও দিতে হবে, সাথে সাথে নিয়মিত শিক্ষাদানের কাজও থাকে; ফলে তাঁর লেখার গতি একটু ধীর ছিল। দুই বছর পরও লেখার কাজ সম্পন্ন হয়নি। তখন বইয়ের প্রধান সম্পাদক ওয়াং তাও জুন নিজে কুও’র বাড়িতে যান। তিনি লেখাগুলো পড়ার পর বলেন, ‘আপনি মনোযোগ দিয়ে লেখেন, হুড়াহুড়ি করতে হবে না।’ ফলে, ৭ বছর পর এ বই প্রকাশিত হয়। তখন প্রকাশনালয়ের সম্পাদক কুও’র লেখা পেয়ে বলেন যে, বই কোনো ভুল নেই বললেই চলে, বইয়ের মানও অনেক ভালো। ১৯৮৯ সালে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ বইটি টানা ৭ বারের মতো সংশোধিত হয়েছে। অধ্যাপক কুও শিক্ষাদানের কাজ করার সাথে সাথে মনোযোগ দিয়ে বই সংশোধনের কাজ করে গেছেন। নতুন মেজরের বিষয় ও শিক্ষা উন্নয়নের পরিবর্তন তুলে ধরতে প্রচেষ্টা চালান তিনি।
ব্যক্তিগত বই রচনার তুলনায় পাঠ্যপুস্তকের বই লেখাকে অনেকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেন যে, এতো বেশি সময় দিয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখার দরকার নেই; এ সময় বিজ্ঞান-গবেষণা করা আরও ভালো। এ সম্পর্কে অধ্যাপক কুও বলেন, পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে মূল বিষয়ের বৈশিষ্ট্য, শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও মানসহ অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সর্বশেষ বিজ্ঞান গবেষণার সাফল্য, বিষয়ের উন্নয়নের সম্ভাবনাসহ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনা সহজ ব্যাপার নয়, বরং এটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জের বিষয়।
যদিও একে ‘কঠিন’ কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি, তবে দীর্ঘকাল ধরে এ কাজই করে এসেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে একটি সেরা পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষাবিজ্ঞানের দুটি ভুমিকা রয়েছে। একদিকে শিক্ষক হওয়ার ভিত্তি স্থাপন করা এবং আরেকটি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করা। শিক্ষাবিজ্ঞানে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে মৌলিক ধারণা ও তত্ত্ব যুক্ত করা হয়েছে; লেখাপড়ার ভিত্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরের গবেষণাকাজও এতে যোগ করার সুযোগ থাকবে।
কেবল ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইটি রচনায় মনোযোগ দিয়েছেন তিনি এমন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে দায়িত্ব পালন করে গেছেন অধ্যাপক কুও। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের জন্য আমার অনেক আবেগ রয়েছে। মাঝে মাঝে তারা লিখিত প্রবন্ধ নিয়ে আমার কাছে পরামর্শ চায়, তখন আমি অবশ্যই সাহায্য করি। আমার পরামর্শ ও প্রস্তাব দেই, তাদের প্রবন্ধের সংশোধনে সহায়তা দেই। আমার চরিত্র নরম, তাই শিক্ষার্থীরা আমাকে পছন্দ করে।” কেন এতো ব্যস্ততার মধ্যে এতো বেশি কাজ করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি হাসিমুখে বলেন, যদি এ কাজকে আপনি নিজের দায়িত্ব হিসেবে নেন, আর ক্লান্তির ভয় থাকে না। তা ছাড়া, শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষক নিজেও অনেক কিছু শিখতে পারেন।
২০২১ সাল চীনের রেনমিন প্রকাশনালয় প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। তখন অধ্যাপক কুও ওয়েন আনসহ ৭০ জন লেখককে সেরা লেখকের পুরস্কার দেওয়া হয়। চীনের শিক্ষাদান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনায় চমত্কার অবদানের জন্য তিনিও পুরস্কার পান। চলতি বছরে তিনি ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইয়ের অষ্টম সংস্করণের কাজ শুরু করেছেন। যদিও তাঁর বয়স ৯০ বছরেরও বেশি, তবে তিনি বলেন, শরীর ঠিক থাকলে এ কাজের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
