কুট্টুন ৭
কুট্টুন ৭


আজ স্কুলে ছুটি। কুট্টুন আর নির্মলা আজ স্কুলে যাবে না, কিন্তু শেখরকে বেরোতে হবে। তাই আজকে সকালে ছুটোছুটিটা কম। নইলে এই সময় কুট্টুনকে মুখ ধুইয়ে, স্নান করিয়ে, স্কুল ড্রেস পরিয়ে তৈরি করে শেখর আর নির্মলা ততক্ষণে সকলের টিফিন আর ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলে।
আজ মেজাজটা একটু আলাদা। দু কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসে নির্মলা। শেখর আর ও আজ বারান্দায় বসে চা খাবে। কুট্টুন এখনও ঘুমোচ্ছে। আজ আর ডাকেনি ওকে। রোজ বেচারাকে ভোরবেলায় উঠে যেতে হয়। তাই ছুটির দিনগুলো ও যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুমায়। এতে অবশ্য নির্মলা আর শেখরেও স্বার্থ আছে। ওরা দুজনে খানিকটা সময় নিজেদের মত কাটাতে পারে।
এখন কুট্টুন নার্সারিতে পড়ে। প্রায় দেড় বছর হল ও স্কুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায় তাদের রোজকার জীবনে। আজকাল কুট্টুন আগের চেয়ে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। বেশ গম্ভীর হয়ে ভাবে মাঝে মাঝে। আজকাল ক্লাসে নিজের কাজ করে। আগের মত সারা ক্লাস ঘুরে ঘুরে দেখে না সবাই ঠিক মত কাজ করছে কিনা। বাড়ীতেও নির্মলাকে অনেক কাজে সাহায্য করতে চেষ্টা করে (তাতে কাজের চেয়ে অকাজই বেশী হয়, সে কথা আলাদা)। দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এই সব নানা কথা ভাবছিল নির্মলা।
“ কি এতো ভাবছ?” শেখরের গলার স্বরে সম্বিত ফিরে পায় নির্মলা। শেখর দাড়ি কামিয়ে অফিস যাবার জন্য রেডি।
“ নাহ, ভাবছি দেখতে দেখতে ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে......”
“হুম ...... সেটাই তো স্বাভাবিক! যত বড় হবে তত ইন্ডিপেনডেন্ট হবে......”
“ জানো সেদিন ওর ড্রইং ক্লাসে, ও আকাশের রঙ কালো বানিয়েছে।“
“তো ?”
“আরে সেই নিয়ে বিশাল হাঙ্গামা।“
“কেন?”
“ আমাদের ড্রইং টিচার ওকে জিজ্ঞাসা করেছে, আকাশে কালো রঙ করছ কেন? ও নাকি কোন উত্তর দেয় নি। তখন সে আমাদের স্কুলে চাইল্ড সাইকোলজিস্টকে ডেকে আনে। ছেলে তাকেও কোন জবাব দেয় না। তখন সবাই মিলে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে গিয়ে উপস্থিত। “
“তারপর?”
“ তারপর আর কি? আমায় ডেকে নিয়ে গেলো। আমি ভাবছি নিশ্চই কিছু করেছে কুট্টুন । ওমা! আমায় ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন অশান্তি চলছে কি? আমি তো অবাক! তখন উনি বললেন, না মানে, তোমার ছেলে এরকম ডার্ক শেড ব্যবহার করছে কেন? সবাই তো আকাশ নীল আঁকে, ও কি খুব দুঃখী ?”
“তুমি কি বললে?”
“ আমি কুট্টুন কে জিজ্ঞাসা করলাম , কেন আকাশটাকে কালো করেছিস? ও কি বলল জানো?”
“কি?”
“ এটা নাইট স্কাই মাম্মা।“ বলে নির্মলা হো হো করে হেসে উঠলো, সঙ্গে শেখরও।
ওদের হাসির আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে ওখানে এসে উপস্থিত হল কুটুন, “তোমলা এতো হাসচ কেন?”
“উঠে পড়েছিস? চল শিগগির তোর দাঁতটা মাজিয়ে দিই। তারপর তুই আমাদের চায়ে ‘ভিজি ভিজি’ করে বিস্কুট খাবি। কেমন?” বলে নির্মলা উঠে দাঁড়ালো।
“ বাবা, চা টা থেথ কোলও না কিন্তু, আমি এক্ষুনি আসচি।“ বলে মায়ের পিছন পিছন ছুট্টে চলে গেলো।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা আবার ফেরত চলে এলো। কুট্টুন শেখরের কোলে গুছিয়ে বসে কৌটো থেকে বিস্কুট বার করে চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেতে লাগলো। নির্মলা গেলো সেকন্ড রাউন্ড চা আনতে।
“ তা আজ কি প্ল্যান কুট্টুন বাবুর ?“ জিজ্ঞাসা করলো শেখর।
“ নাভিন আসবে খেলতে। আমলা আমার ট্রেনতা নিয়ে খেলবো।“ গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো কুট্টুন ।
“ তোমার ছেলে তো ‘বিগ বয়’ হয়ে গেলো গো!” হেসে নির্মলার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো শেখর। নির্মলা চা নিয়ে সবে বারান্দায় পৌঁছেচে।
“ না আমি বলো হতে চাই না। আমি বেবি থাকবো।“ বলে শেখরের গলাটা জড়িয়ে ধরল কুট্টুন।
“সেটা আর কে চায় ? “ বলে কুট্টুনকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলো শেখর।
শেখর অফিস বেরিয়ে যাবার পরই পাশের ফ্ল্যাট থেকে নাভিন এলো খেলতে। কুট্টুনের চেয়ে এক ক্লাস উপরে পড়ে ছেলেটা। কুট্টুনের একটা ছোট খেলনা
ট্রেন আছে, যেটা ‘ঝিক ঝিক’ আওয়াজ করে চলে আর ধোঁয়া ছাড়ে। সেইটা নিয়ে খেলবে দুজনে।
ওরা দুজন খেলা শুরু করতেই নির্মলা তাড়াতাড়ি ঘরের কাজগুলো শেষ করতে গেলো। কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যেই একটা ‘ধপাস’ করে আওয়াজ। নির্মলা ছুটে গিয়ে দেখে ঘরের মেঝের ওপর দুই মক্কেল চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে আর ট্রেনটা ভেঙ্গে দু টুকরো।
“ভাঙলি কি করে ট্রেনটা?” চেঁচিয়ে উঠলো নির্মলা।
বেগতিক দেখে নাভিন পালিয়েছে। চোর দায়ে ধরা পড়েছে কুট্টুন ।
“ কি রে বল, উত্তর দে...”
“আমলা দুজনে চড়েছিলাম ট্রেনে...” মিনমিন করে বলে উঠলো কুট্টুন ।
“ তা এই বুদ্ধিটা কার? তোমার?”
“ নাভিন বলল, ‘চল ট্রেনমে চড়কে ঘুমনে চলতে হ্যাঁয়’ , তাই......”
ভাঙ্গা ট্রেনের টুকরোগুলো কুড়োতে কুড়োতে নির্মলা গজগজ করতে লাগলো,” কি সেয়ানা ছেলে বাবা, নিজের খেলনাগুলো গুছিয়ে তুলে রেখে দেবে, আর এখানে এসে...দাঁড়া আজ আমি ওর মাকে ......”
হঠাৎ কুট্টুন বলে উঠলো,” মাম্মা তুমি ওর মাকে কিতু বোলো না , উও দোস্ত হ্যায় মেলা...... দোস্তি মে ইয়ে সব চলতা হ্যায়।“
ওর কথা শুনে একটু থমকে গেলো নির্মলা, সত্যি ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে!
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নেবে ঠিক করেছে নির্মলা। এই দিবানিদ্রাটা বড়ই সুখের। স্কুল জয়েন করার পর থেকে এই জিনিষটিকে বড় মিস করে নির্মলা।
কুট্টুনকে পাশে শুইয়ে, বেডরুমের টিভিটা অন করে নির্মলা বলে উঠলো,” তুই টিভি দ্যাখ, আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। এই একটা আধটা দিনই তো পাওয়া যায় দুপুরে ঘুমানোর জন্য......।“ বলে একটা হাই তোলে নির্মলা।
“ যখন তুমি স্কুলে কাজ করতে না তখন কি তুমি লোজ ঘুমোতে?” জিজ্ঞাসা করলো কুটুন।
“হ্যাঁ ... “
“এখন তুমি টিচাল , আল তুমি দদি স্কুল ছেড়ে দাও তাহলে তুমি কি হবে?”
“ হাউস ওয়াইফ।“
“ তালে তুমি লোজ ঘুমোতে পালবে।“ খুব গম্ভীরভাবে কি সব ভাবলো কুট্টুন, তারপর জিজ্ঞাসা করলো,” আচ্চা বাবা দদি অফিস না যায় তাহলে বাবাকে কি বলবে ?”
“তাহলে বোধহয় তোর বাবাকে ‘হাউস হাসব্যান্ড’ বলবে।“ বলে নির্মলা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন যথারীতি নির্মলা আর কুট্টুন স্কুলে গেছে। কুট্টুনকে মন্টেসরি সেকসনে পৌঁছে দিয়ে নির্মলা নিজের ক্লাসে চলে গেল। টিফিন টাইমে ছেলেকে আনতে গিয়েছে নির্মলা, কুট্টুনের ক্লাস টিচার ওকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। সবাই চলে যেতে উনি নির্মলাকে ভীষণ চিন্তিত ভাবে ডেকে বললেন,” ম্যায়নে আজ ক্লাসমে সভি বাচ্চোঁ সে পুছা কে বড়া হো কে তুম ক্যা বাননা চাহতে হো । To my surprise he said, he wants to become a ‘house husband’!”
নির্মলার প্রচণ্ড হাসি পেলো কিন্তু ও অনেক কষ্টে হাসি চেপে, কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞাসা করলো , “ কেন রে?”
“ নাঃ ভেবে দেখলাম , কাজ কলতে অনেক হাঙ্গামা... দুপুলে একটু আলাম কোলে ঘুমানোও যায় না ।“ খুব গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয় কুট্টুন।
নির্মলার reaction দেখে ক্লাস টিচার বেশ রেগে গিয়ে বলে উঠলেন,“ Which I think, is quite alarming. He doesn’t have an ambition in life!”
নির্মলা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে এসেই শেখরকে ফোন করলো,” আমরা কি ছেলেকে ঠিক মত গাইড করতে পারছি না?”
“নির্মলা! সবাইকেই কী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে? বাড়তে দাও ওকে ওর মত। না হয় ও হলই ব্যাতিক্রম। সবার মত ওর আকাশের রঙ নীল নাহয় নাই হল। আমাদের কাজ ভালোবাসা দিয়ে ওকে মানুষ করে তোলা। ব্যাস। আর আমরা সেটা করছি। তাই না?”
ফোনটা রেখে নির্মলার মনটা খুব হালকা লাগলো। কুট্টুনের দিকে তাকিয়ে দেখল অজানা অপরাধের ভয়ে বেচারা একদম গুটিয়ে গেছে। নির্মলা হেসে ওকে কোলে তুলে নিলো,” কিরে রঙ কিনবি না? কাল তো হোলি।“
কুট্টুন একগাল হেসে চেঁচিয়ে উঠলো,” হোলি হ্যায়!!! আমি ব্লু পিচকালি কিনব আল অনেক লঙ কিনব আল বেলুন কিনব আল......”
সমাপ্ত