Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

উত্তরণ

উত্তরণ

5 mins
470


এটা একটি মেয়ের কথা বা গল্প বলতে পারেন। আমাদের সমাজে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকে যারা কখনও নিজেদের অবস্থাকে ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে না। পুরুষ শাসিত এই সমাজের থেকে নিজের প্রাপ্য সন্মানের অধিকার কেড়ে নিতে এরা প্রানপন করে পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে চলে। মেয়েটি যেহেতু ঐ প্রতিবাদী শক্তিকে উপস্থিত করছে সমাজের কাছে, তাই তার নাম হোক অনামিকা। অর্থাৎ যার কোন বিশেষ নাম নেই, কিন্তু অনামিকা হল সামাজিক বৈষম্যর একটি প্রতিবাদী নাম।

অনামিকার বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর। তখন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত তার চোখে জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন। সে স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা শেষ করে অনেক বড় চাকরি করবে। সে তার পরিবারকে সাহায্য করতে চায়, পাশে দাঁড়াতে চায় তার প্রিয়জনদের । অনামিকা চায় তার পরিবার সবসময়ই সুখে থাকুক। কিন্তু অনামিকার সকল স্বপ্নই মুকুলে ঝরে গেলো। হঠাৎ করে মেয়েটির বাবা একটি ছেলের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্হা করে। কারণ সমাজে বেশী বয়স অবধি অবিবাহিতা থাকাটা ছিল তখনকার গ্রাম্য সমাজের চোখে অপরাধ। অথচ অনামিকা তখন শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল না।কিন্তু সমাজ সে কথা শুনবে কেন? ঐ ছোট মেয়েটি সেদিন লড়াইটা হেরে গিয়েছিল সমাজের বিধানের কাছে। পাত্রটি ছিলো মেয়েটির চেয়ে 15 বছরের বড়। অনামিকা তার পরিবারকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে যে বাল্যবিবাহ খুবই মারাত্মক অপরাধ। সে আরো বলে এখন সে বিয়ে করতে চায় না। আগে পড়ালেখা শেষ হোক চাকরি করি নিজের পায়ে দাঁড়াই তারপর আমাকে বিয়ে দিও। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল যে শিক্ষাই পারে সুস্থ চিন্তা আর স্বাবলম্বনের পথ দেখাতে। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিলো না। মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার বাবা তাকে বিয়ে দেয়।আসলে তখন তার ক্ষমতাই বা কতটুকু, একটা সহায় সম্বলহীন দুঃস্থ পরিবারের সদস্য, তাতে আবার কন্যা সন্তান।


বিয়েটাকে সে তার দুর্ভাগ্য বলেই মেনে নেয়, মনে মনে ভাবে সেও চেষ্টা করবে একটা সুস্থ সুন্দর বিবাহিত জীবন যাপনের জন্য। যতই সে মনে মনে ঠিক করুক, কিন্তু তার বিধি বাম। এরপর বিয়ের দিন থেকেই অনামিকার জীবনে দুর্দশার শুরু হয়। অনামিকার স্বামী ছিলো একজন লোভী মানুষ, পৃথিবীর সব সম্পর্কের মূল্য তার কাছে অর্থ । সে প্রায়ই যৌতুকের জন্য অনামিকাকে মৌখিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। অনামিকার বাবা ছিল খুবই গরীব। সে অনামিকার সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে ছিল যে সংসারে একটা লোকের খরচ কমবে ভেবে, তাই ঐ অবস্থার একজন মানুষের পক্ষে যৌতুক দেয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে যত সময় যেতে লাগলো ততই অনামিকার স্বামীর নির্যাতন বাড়তে লাগলো। তারপর একদিন স্বামীর রোজকার এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিয়ের কয়েক মাস পরই অনামিকা তার স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। যদিও সেই আসাটাও তার পক্ষে খুব সহজ হয় নি, কিন্তু তার দুঃস্থ বাবা যখন দেখল যে অনামিকাকে নিজের কাছে এনে না রাখলে একদিন ভালো মন্দ কিছু একটা ঘটে যাবে। তাই অপত্য স্নেহের বশে অনামিকার বাপের বাড়িতে স্থান হল। এই অল্প বয়সে এতো ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে অনামিকার কৈশোর চুরি হয়ে গেছে, বদলে পড়ে আছে একটা লড়াই করার মন। আসার সময়েই অনামিকা মনে মনে শপথ করেছে যে সে স্বাবলম্বী হবে যাতে তার নিজের সব ভার সে নিজেই নিতে পারে। এছাড়াও অনামিকার ইচ্ছা আছে তার মতো যারা অসহায় মহিলা আছে তাদের জন্য সে কিছু করবে। সে চায় আত্মনির্ভরশীল হতে। সে চায় অসহায় মহিলাদের মুখে হাসি ফুটাতে। সে চায় প্রমাণ করতে নারীরাও পিছিয়ে নেই।


তার এখন একটাই স্বপ্ন সমাজে তার মতো হতভাগা মহিলাদের মুখে হাসি ফুটানো।এই সংকল্প মনে নিয়ে সে তার কাজের পরিকল্পনা করে বাস্তবায়িত করার পথে কাজ শুরু করে।


অনামিকার এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সে অসহায় মহিলাদেরকে খুঁজে বের করে চিহ্নিত করে, তাদের তার স্বপ্নের কথা শোনায় এবং একটা সংগঠন চালু করে। তার সংগঠনে সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০ জন। এদের সবাই তার মতো দুর্ভাগা। অনামিকা তার অঞ্চলের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে ও তাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজের প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর নিজেই তার সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং বিভিন্ন কাজ দেয়। যাতে সবাই আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সংগঠনে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনামিকাই এই সংগঠনটি পরিচালনা করে। এ সংগঠনের প্রধান কাজ হলো বিভিন্ন পোশাক তৈরী করা। সেগুলোর উপর রং করা, ডিজাইন করা ইত্যাদি। এখানে মেয়েদের জন্য থ্রী পিস এবং ছেলেদের জন্য ফতুয়া তৈরী করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শাড়ী তৈরী করা হয় ও শাড়ীর উপর প্রিন্টিং করা হয় । অনামিকা নিজেই শাড়ীর উপর রং বেরংয়ের ডিজাইন করে। এবার সমস্ত পণ্য তৈরী হয়ে যাবার পর পণ্যগুলো সংগঠনের নিজস্ব দোকানে বিক্রি করা হয়,এছাড়াও বাহিরেও সরবরাহ করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই এ সংগঠনের সদস্যরা তাদের নিজেদের জন্য একটা মাসিক আয়ের পথ খুঁজে পায় এবং ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এখন আর তারা কারোর উপর নির্ভরশীল নয়, তারা নিজেদের জীবন নিজেরাই চালিয়ে নিতে পারে। এখন তারা সবাই মন খুলে হাসতে পারে। সবাই এখন সুখেই জীবনযাপন করতেছে। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে একটি সাহসী মেয়ে অনামিকার সাহসী উদ্যোগের কারনে।


অনামিকা এখন তার অতীতের সব কষ্ট ভুলে গিয়েছে। তার জীবনে যা ঘটেছিলো তার জন্য এখন তার কোনো কষ্ট নেই, শোক নেই, অনুশোচনা নেই এবং কারো প্রতি কোনো অভিযোগও নেই। তার এখন একটাই স্বপ্ন সে সমাজের অসহায় মহিলাদের মুখে হাসি ফুটাবে । এ লক্ষ্যে সে সমাজের অসহায় মহিলাদের খুঁজে বের করে তার সংগঠনে নিয়ে আসে। এই সাহসী মেয়েটি অনামিকার ইচ্ছা সে একজন বিখ্যাত ডিজাইনার হবে।


ইচ্ছা শক্তি অদম্য হলে কোনো কিছুই কাউকে দমিয়ে রাখতে পারে না। যার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো এই সাহসী মেয়েটি। যে শত বাঁধা পেরিয়ে সর্বশেষ সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছে। সফলতা অর্জন করতে হলে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই সাহসী উদ্যোগ নিতে হবে। এই রকম অনেক অনামিকারা আমাদের আশে পাশে মা, কাকিমা, বোন, কন্যা,বান্ধবী হিসাবে ছড়িয়ে রয়েছে যারা একটু সাহায্য ও সমর্থন পেলে এরকম এক একটা অনামিকা হয়ে উঠতে পারে। দিন বদলাচ্ছে সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীর ক্ষমতায়নও হচ্ছে - অপেক্ষা শুধু সেই দিনের যেদিন নারী পুরুষ এই বিভাজন থাকবে না - সবাই পরিচিত হবে একটাই নামে " মানুষ "। সেটাই হবে আমাদের সমাজ জীবনের মানবতার উত্তরণ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational