Sukumar Roy

Classics

0  

Sukumar Roy

Classics

সূদন ওঝা

সূদন ওঝা

6 mins
2.5K


সূদন ছিল ভারি গরীব, তার একমুঠা অন্নেরও সংস্থান নাই। রোজ জুয়া খেলে লোককে ঠকিয়ে যা পায়, তাই দিয়ে কোনরকমে তার চলে যায়। যেদিন যা উপায় করে, সেইদিনই তা খরচ করে ফেলে, একটি পয়সাও হাতে রাখে না। এইরকমে কয়েক বছর কেটে গেল; ক্রমে সূদনের জ্বালায় গ্রামের লোক অস্থির হয়ে পড়ল, পথে তাকে দেখলেই সকলে ছুটে গিয়ে ঘরে দরজা দেয়। সে এমন পাকা খেলোয়াড় যে কেউ তার সঙ্গে বাজি রেখে খেলতে চায় না।

একদিন সূদন সকাল থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু গ্রামময় ঘুরেও কাউকে দেখতে পেল না। ঘুরে ঘুরে নিরাশ হয়ে সূদন ভাবল—"শিবমন্দিরের পুরুত ঠাকুর ত মন্দিরেই থাকে—যাই, তার সঙ্গেই আজ খেলব।" এই ভেবে সূদন সেই মন্দিরে চলল। দূর থেকে সূদনকে দেখেই পুরুতঠাকুর ব্যাপার বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মন্দিরের মধ্যে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল।

মন্দিরের পুরুতকে না দেখতে পেয়ে সূদন একটু দমে গেল বটে, কিন্তু তখনই স্থির করল—'যাঃ—তবে আজ মহাদেবের সঙ্গেই খেলব।' তখন মূর্তির সামনে গিয়ে বলল—"ঠাকুর! সারাদিন ঘুরে ঘুরে এমন একজনকেও পেলাম না, যার সঙ্গে খেলি। রোজগারের আর কোন উপায়ও আমি জানি না, তাই এখন তোমার সঙ্গেই খেলব। আমি যদি হারি, তোমার মন্দিরের জন্য খুব ভাল একটি দাসী এনে দিব; আর তুমি যদি হার, তবে তুমি আমাকে একটি সুন্দরী মেয়ে দিবে—আমি তাকে বিয়ে করব।" এই বলে সূদন মন্দিরের মধ্যেই ঘুঁটি পেতে খেলতে বসে গেল। খেলার দান ন্যায়মত দুই পক্ষেই সূদন দিচ্ছে— একবার নিজের হয়ে, একবার দেবতার হয়ে খেলছে। অনেকক্ষণ খেলার পর সূদনেরই জিত হল। তখন সে বলল—"ঠাকুর! এখন ত আমি বাজি জিতেছি, এবারে পণ দাও।" পাথরের মহাদেব কোন উত্তর দিলেন না, একেবারে নির্বাক রইলেন। তা দেখে সূদনের হল রাগ। "বটে! কথার উত্তর দাও না কেমন দেখে নেব"—এই বলেই সে করল কি, মহাদেবের সম্মুখে যে দেবীমূর্তি ছিল সেটি তুলে নিয়েই উঠে দৌড়।

সূদনের স্পর্ধা দেখে মহাদেব ত একেবারে অবাক! তখনি ডেকে বললেন—"আরে, আরে, করিস কি? শীগগির দেবীকে রেখে যা। কাল ভোরবেলা যখন মন্দিরে কেউ থাকবে না, তখন আসিস, তোকে পণ দিব।" এ-কথায় সূদন দেবীকে ঠিক জায়গায় রেখে চলে গেল।

এখন হয়েছে কি, সেই রাতে একদল স্বর্গের অপ্সরা এল মন্দিরে পুজো করতে। পুজোর পর সকলে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি চাইলে, মহাদেব রম্ভা ছাড়া অন্য সকলকে যেতে বললেন, সকলেই চলে গেল, রইল শুধু রম্ভা। ক্রমে রাত্রি প্রভাত না হতেই সূদন এসে হাজির। মহাদেব রম্ভাকে পণস্বরূপ দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন।

সূদনের আহ্লাদ দেখে কে! অপ্সরা স্ত্রীকে নিয়ে অহঙ্কারে বুক ফুলিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল। সূদনের বাড়ি ছিল একটা ভাঙা কুঁড়ে, অপ্সরা মায়াবলে আশ্চর্য সুন্দর এক বাড়ি তৈরী করল। সেই বাড়িতে তারা পরম সুখে থাকতে লাগল। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল।

সপ্তাহে একদিন, রাত্রে, অপ্সরাদের সকলকে ইন্দ্রের সভায় হাজির থাকতে হয়। সেই দিন উপস্থিত হলে, রম্ভা যখন ইন্দ্রের সভায় যেতে চাইল, তখন সূদন বললে—"আমাকে সঙ্গে না নিলে কিছুতেই যেতে দিব না।" মহা মুশকিল! ইন্দ্রের সভায় না গেলেও সর্বনাশ—দেবতাদের নাচ গান সব বন্ধ হবে—আবার সূদনও কিছুতেই ছাড়ছে না। তখন রম্ভা মায়াবলে সূদনকে একটা মালা বানিয়ে গলায় পরে নিয়ে ইন্দ্রের সভায় চলল। সভায় নিয়ে সূদনকে মানুষ করে দিলে পর, সে সভার এক কোণে লুকিয়ে বসে সব দেখতে লাগল। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হলে, নাচগান সব থেমে গেল। রম্ভা সূদনকে আবার মালা বানিয়ে গলায় পরে চলল তার বাড়িতে। ক্রমে সূদনের বাড়ির কাছে একটা নদীর ধারে এসে রম্ভা যখন আবার তাকে মানুষ করে দিল, তখন সূদন বলল—"তুমি বাড়ি যাও, আমি এই নদীতে স্নান আহ্নিক ক'রে, পরে যাচ্ছি।"

এই নদীর ধারে ছিল ত্রিভুবন তীর্থ। এখানে দেবতারা পর্যন্ত স্নান করতে আসতেন। সেদিন সকালেও ছোটখাটো অনেক দেবতা নদীর ঘাটে স্নান করছিলেন। তাঁদের কাউকে কাউকে দেখে সূদন চিনতে পারল—তাঁরা রাত্রে ইন্দ্রের সভায় রম্ভাকে খুব খাতির করেছিলেন। সূদন ভাবল—'আমার স্ত্রীকে এরা এত সম্মান করে তাহলে আমাকে কেন করবে না?' এই ভেবে সে খুব গম্ভীর ভাবে তাঁদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল—যেন সেও ভারি একজন দেবতা! কিন্তু দেবতারা তাকে দেখে অত্যন্ত অবজ্ঞা ক'রে তার দিকে ফিরেও চাইলেন না—তাঁরা তাঁদের স্নান আহ্নিকেই মন দিলেন। এ তাচ্ছিল্য সূদনের সহ্য হল না। সে করল কি, একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে দেবতাদের বেদম প্রহার দিয়ে বলল—"এতবড় আস্পর্ধা! আমি রম্ভার স্বামী, আমাকে তোরা জানিস নে?" দেবতারা মার খেয়ে ভাবলেন—'কি আশ্চর্য! রম্ভা কি তবে মানুষ বিয়ে করেছে?' তাঁরা তখনই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের কাছে সব কথা বললেন।

এদিকে সূদন বাড়ি গিয়েই হাসতে হাসতে স্ত্রীর কাছে তার বাহাদুরির কথা বলল। শুনে রম্ভার ত চক্ষুস্থির! স্বামীর নির্বুদ্ধিতা দেখে লজ্জায় সে মরে গেল, আর বলল—"তুমি সর্বনাশ করেছ! এখনি আমাকে ইন্দ্রের সভায় যেতে হবে।"

দেবতারা ইন্দ্রের কাছে গিয়ে নালিশ করলে পর ইন্দ্রের যা রাগ! "এতবড় স্পর্ধা! স্বর্গের অপ্সরা হয়ে রম্ভা পৃথিবীর মানুষ বিয়ে করেছে?" ঠিক এই সময়ে রম্ভাও গিয়ে সেখানে উপস্থিত! তাকে দেখেই ইন্দ্রের রাগ শতগুণ বেড়ে উঠল। আর তিনি তৎক্ষণাৎ শাপ দিলেন, "তুমি স্বর্গের অপ্সরা হয়ে মানুষ বিয়ে করেছ, আবার তাকে লুকিয়ে এনে আমার সভায় নাচ দেখিয়েছ এবং স্পর্ধা করে সেই লোক আবার দেবতাদের গায়ে হাত তুলেছে—অতএব, আমার শাপে তুমি আজ হতে দানবী হও। বারাণসীতে বিশ্বশ্বরের যে সাতটি মন্দির আছে, সেই মন্দির চুরমার করে আবার যতদিন কেউ নূতন করে গড়িয়ে না দিবে, ততদিন তোমার শাপ দূর হবে না।"

রম্ভা তখন পৃথিবীতে এসে সূদনকে শাপের কথা জানিয়ে বলল—"আমি এখন দানবী হয়ে বারাণসী যাব। সেখানে বারাণসীর রাজকুমারীর শরীরে ঢুকব, আর লোকে বলবে রাজকুমারীকে ভূতে পেয়েছে। রাজা নিশ্চয়ই যত ওঝা কবিরাজ ডেকে চিকিৎসা করাবেন; কিন্তু আমি তাকে ছাড়ব না, তাই কেউ রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে না। এদিকে তুমি বারাণসী গিয়ে বলবে যে, তুমি রাজকুমারীকে আরাম করতে পার। তারপর তুমি বুদ্ধি ক'রে ভূত ঝাড়ানর চিকিৎসা আরম্ভ করলে আমি একটু একটু করে রাজকুমারীকে ছাড়তে থাকব। তারপর তুমি রাজাকে বলবে যে, তিনি বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চূর্ণ ক'রে, আবার যদি নূতন করে গড়িয়ে দেন, তবেই রাজকুমারী সম্পূর্ণ আরাম হবেন। রাজা অবিশ্যি তাই করবেন আর তাহলেই আমার শাপ দূর হবে। তুমিও অগাধ টাকা পুরস্কার পেয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে।" এই কথা বলতে বলতেই রম্ভা হঠাৎ দানবী হয়ে, তখনই চক্ষের নিমেষে বারাণসী গিয়ে একেবারে রাজকুমারীকে আশ্রয় ক'রে বসল।

রাজকুমারী একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে, বিড় বিড় ক'রে বক্‌তে বক্‌তে, সেই যে ছুটে বেরুলেন, আর বাড়তে ঢুকলেনই না। তিনি শহরের কাছেই একটা গুহার মধ্যে থাকেন, আর রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা চলে তাদের গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারেন! রাজা কত ওঝা বদ্যি ডাকালেন, রাজকুমারীর কোন উপকারই হল না। শেষে রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন—"যে রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিব—রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিব।"

রাজবাড়ীর দরজার সামনে ঘণ্টা ঝুলান আছে, নূতন ওঝা এলেই ঘণ্টায় ঘা দেয়, আর তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকুমারীর চিকিৎসা করান হয়। সূদন রম্ভার উপদেশমত বারাণসী গিয়ে রাজকুমারীর পাগল হওয়ার কথা শুনে ঘণ্টায় ঘা দিল। রাজা তাকে ডেকে বললেন—"ওঝার জ্বালায় অস্থির হয়েছি বাপু! তুমি যদি রাজকুমারীকে ভাল করতে না পার, তবে কিন্তু তোমার মাথাটি কাটা যাবে।" এ-কথায় সূদন রাজী হয়ে তখনই রাজকন্যার চিকিৎসা আরম্ভ করে দিল।

ভূতের ওঝারা ভড়ংটা করে খুব বেশী, সূদনও সেসব করতে কসুর করল না। ঘি, চাল, ধূপ, ধুনা দিয়ে প্রকাণ্ড যজ্ঞ আরম্ভ করে দিল, সঙ্গে সঙ্গে বিড়্‌ বিড়্‌ করে হিজিবিজি মন্ত্র পড়াও বাদ দিল না। যজ্ঞ শেষ করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই পর্বতের গুহায় চলল, যেখানে রাজকন্যা থাকে। সেখানে গিয়েও বিড়্‌ বিড়্‌ ক'রে খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ল—"ভূতের বাপ-ভূতের মা-ভূতের ঝি, ভূতের ছা—দূর দূর দূর, পালিয়ে যা।" ক্রমে সকলে দেখল যে, ওঝার ওষুধে একটু একটু করে কাজ দিচ্ছে। কিন্তু ভূত রাজকুমারীকে একেবারে ছাড়ল না। তিনি তখনও গুহার ভিতরেই থাকেন, কিছুতেই বাইরে আসলেন না। যা হোক, রাজা সূদনকে খুব আদর যত্ন করলেন, আর, যাতে ভূত একেবারে ছেড়ে যায়, সেরূপ ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। দুদিন পর্যন্ত সূদন আরো কত কিছু ভড়ং করল। তৃতীয় দিনে সে রাজার কাছে এসে বলল—"মহারাজ! রাজকুমারীর ভূত বড় সহজ নয়—এ হচ্ছে দৈবী ভূত। মহারাজ যদি এক অসম্ভব কাজ করতে পারেন—বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুরমার ক'রে, আবার নূতন ক'রে ঠিক আগের মত গড়িয়ে দিতে পারেন,—তবেই আমি রাজকন্যাকে আরাম করতে পারি।"

রাজা বললেন—"এ আর অসম্ভব কি?" রাজার হুকুমে তখনই হাজার হাজার লোক লেগে গেল। দেখতে দেখতে মন্দিরগুলি চুরমার হয়ে গেল। তারপর এক মাসের মধ্যে আবার সেই সাতটি মন্দির ঠিক যেমন ছিল তেমনটি করে নূতন মন্দির গড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও সেরে উঠলেন, অপ্সরাও শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল। তারপর খুব ঘটা ক'রে সূদনের সঙ্গে রাজকুমারীর নিয়ে হল আর রাজা বিয়ের যৌতুক দিলেন তাঁর অর্ধেক রাজত্ব।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics