শেষ দেখা-অন্তিম পর্ব
শেষ দেখা-অন্তিম পর্ব
ঘুম থেকে উঠতে একটু বিলম্বই হয়ে যায় রাহুলের।এমনিতেই বিয়েটা তড়িঘড়িতে হচ্ছে ,তার উপরে মামার শারীরিক অসুস্থতার কারণে সমস্ত কাজ তাঁর কাঁধে এসে পড়েছে।সময়ের অপেক্ষায় কাজের ওজনটাই বেশি।এত অল্প সময়ের মাঝে সবকিছু একা সামলাতে সামলাতে সে ক্লান্ত।আজকেও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে,স্যাকরার কাছ থেকে গয়না আনতে হবে,প্যান্ডেল এর লোকদের সঙ্গে দেখা করা আবার বাজারের টুকিটাকি কাজ।হ্যাঁ,আজকে তো আবার ছায়ার সঙ্গেও দেখা করতে হবে!কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রাহুল,কালকে অনেক রাত অবধি ভেবেছিল।সমস্ত পুরোনো আবেগ যেন ফিরে আসছে,মনটা অস্থির হয়ে পড়ছে এক অন্যরকম চিন্তায়।এতদিন পর!তবে যখন এত করে বলেছে তাঁর যাওয়াটাই উচিৎ।স্নান সেরে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে রাহুল।ছায়ার দেওয়া এই রেস্টুরেন্টের ঠিকানায় সে আগেও এসেছে।রাহুল সেখানে ঢুকে দেখে ছায়া আগের পছন্দের মত সেই কোণের টেবিলটা দখল করে বসে আছে।তাঁকে দেখেই হাতের ইশারা করে ডেকে নেয়।
"বসো,বলো কেমন আছো!"ছায়া হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে।
"ভালো আছি,আর তুমি!"চেয়ারে বসতে বসতে উত্তর দেয় রাহুল।
"আমার তো দিব্যি চলে যাচ্ছে।বাবা,অনেক বদলে গিয়েছো দেখছি।"ছায়া বলে।
রাহুল ছায়ার দিকে তাকিয়ে রাহুল বলে,"কিরকম!চেহারার দিক দিয়ে বলছ!শুকিয়ে গেছি না!"
ছায়া হাঁসিমুখে উত্তর দেয়,"না,মোটা হয়ে গেছ।আর শুধু চেহারার কথা বলছি না অনেক রকম ভাবেই বদলে গেছো।"
রাহুল লক্ষ্য করে ছায়ার বরাবর কথার মাঝে কারণে হাঁসির অভ্যেসটা এখনো যায়নি।সবসময় যেন সে প্রাণবন্ত আর উচ্ছাসিত হাঁসি।কিন্তু সেই বহুপরিচিত হাঁসিটাও আজকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে।সেই পুরোনো ছায়ার মিষ্টি হাঁসির সঙ্গে বর্তমানের ছায়াকে মেলাতে কষ্ট হচ্ছে রাহুলের।সে কি এতটুকুও বদলায়নি! ছায়ার সেই সারল্যতা,ভাব সবকিছুই যেন তেমনই রয়ে গেছে।
"হয়তো,বদলে যাওয়াটাই তো নিয়ম।এই যেমন আমারও তাই মনে হচ্ছে তোমাকে।কিন্তু এগুলো কিছুই না।আসলে অনেকদিন পরে দেখা,তাই হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে।স্থিরভাবেই কথাগুলো বলে রাহুল।
কথা অন্যদিকে ফেরাতে ছায়া বলল,"যাকগে বাদ দাও,কি খাবে বলো।"
"আমার পছন্দ,অপছন্দগুলো কিন্তু বদলায়নি।যাইহোক একটা কিছু অর্ডার দাও।"বলে রাহুল মেনুকার্ডটা ছায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
ছায়া কিছু খাবারের অর্ডার দিলো।রাহুল একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
রাহুলের দিকে ফিরে ছায়া বলল,"আচ্ছা রাহুল কিছু মনে করোনি তুমি!এইযে তোমাকে হঠাৎ দেখা করতে চাইলাম।আসলে কি জানো!আমি কালকেই তোমার বিয়ের খবরটা শুনলাম।অবশ্য আনন্দও পেয়েছি!কিন্তু হঠাৎকরে সব পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসতে লাগলো।তাই,তোমার নম্বরটি জোগাড় করে তোমাকে ফোন করলাম।ভাবলাম বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।আর,কখনো তো এভাবে দেখা করা যাবে না।"
ইতস্ততঃভাবে রাহুল বলে,"না,এতে মনে করার কি আছে।অবশ্য তোমাকে জানানো প্রয়োজন ছিল।কিন্তু সবকিছু এমন হঠাৎ করে হয়ে গেল আর এত কাজের চাপের মাঝে মাথায় খেয়ালই ছিল না।"
একটি ছেলে এসে খাবার দিয়ে গেল,হাফ প্লেট করে চাউমিন।রাহুল সেগুলি নিয়ে একটা ছায়ার দিকে বাড়িয়ে দিল।দুজনেই নীরব।কাঁটা চামচ চাউমিনগুলোর উপর দিয়ে হাল্কাভাবে বেয়ে যাচ্ছে বা কখনো সেই চামচ চাউমিন গুলোকে গোল করে পাকিয়ে তুলছে।কিন্তু খাবারের প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ তেমন নেই।রাহুলের যথেষ্ঠ ক্ষিদে পেয়েছিল।কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি যেন তাঁর মনের মধ্যে অবিরত ঘুরপাক খাচ্ছে।
সেই নীরবতা ভেঙে রাহুল বলল,"জানো ছায়া সবটাই কেমন যেন হঠাৎ করে হয়ে গেল।বাড়ির সবাই দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলল।আমি না করতে পারলাম না।আমার জীবনে সবকিছুই যেন হঠাৎ করেই হয়।যেমন তোমার সঙ্গে সম্পর্ক!এক দেখাতেই হঠাৎ করে প্রেম তারপর ভালোবাসা।আবার,একদিন হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম আমরা একে-অপরের থেকে কত দূরে সরে এসেছি।"
চামচের আগালে একটুকরো খাবার নাড়তে নাড়তে ছায়া বলল,"না রাহুল,এর জন্য আমরা দুজনেই দায়ী।হয়তো সেই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখা যেত।কিন্তু আমরা দুজনেই ব্যর্থ হয়েছি।আসলে সময়টাও কারোর অনুকূল ছিলো না।ওসব নিয়ে আর ভেবে কি লাভ বলো!বিশ্বাস করো এসব আলোচনার জন্য কিন্তু তোমায় ডাকিনি।আমরা কি এখন বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনা!শুধু বন্ধু।বলে ছায়া হাত বাড়িয়ে দেয় রাহুলের দিকে।
রাহুল সেই হাতে হাত রেখে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গ্রহণ করে।সত্যি ছায়া সবকিছু পারে।তার সরল ভাব মনকে হালকা করে দেয় রাহুলের।এমন বন্ধু পাওয়াও সৌভাগ্য।
"আচ্ছা,তোমার বউ এর ছবি দেখাবে না আমাকে!মোবাইলে ছবি নেই!"বলে ছায়া রাহুলের দিকে হাত বাড়ায়।
"আচ্ছা দাঁড়াও।"রাহুল ছবিটা বার করে ছায়াকে দেয়।
সেই ছবি দেখতে দেখতে ছায়া বলে,বাহ: কি সুন্দর।দারুণ মানিয়েছে তোমার সঙ্গে।নিরন্তর শুভকামনা রইলো তোমাদের দুজনের জন্য।"
রাহুল সেই শুভকামনার উত্তরে হাঁসিমুখে বলল, "অনেক ধন্যবাদ তোমায়।আচ্ছা তোমার কথা কিছু বললে না!এতদিনে কাউকে তোমার পছন্দ হয়েছে!
স্বাভাবিক ভাবেই ছায়া বলে,"না সেরকম এখনো হয়নি।তবে প্রস্তাব দু একজন দিয়েছিল।আসলে পড়াশোনার চাপে ভেবে দেখিনি।আর এই বছরের পরীক্ষা শেষ হলেই বাবা-মা আমার পাত্র নিয়ে এবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে মনে হচ্ছে।তুমি তো জানো ওদের।"
তারপর আরও কিছুক্ষণ গল্প করে দুজন।রাহুলের বাজারে বেশ কাজ ছিল। তাই রাহুল বলল,
"আচ্ছা ছায়া,এবার ওঠা যাক চলো,আমার বাজারে অনেক কাজ রয়েছে।"
ছায়া উঠে একটু অভিমানী কণ্ঠে বলল,"আচ্ছা বিয়েতে আমায় নেমতন্ন করবে না!"
রাহুল বলল,"সরি।ভুল হয়ে গেছে।কিন্তু এভাবে তো নেমতন্ন করা যায়না।আমি তোমার বাড়ি গিয়ে নেমতন্ন করে আসব।তুমি আসবে তো!"
ছায়া হাসিমুখে বলল,"সে আমি বললাম বলে নেমতন্ন করলে।আচ্ছা থাক। তোমাকে তো বললাম কালকেই ফিরতে হবে কলেজে।অন্য একদিন তোমার থেকে ট্রিপ নিয়ে নেব,সঙ্গে তোমার বউকেও নিয়ে আসবে।"
"আচ্ছা,তাই হবে।"বলে রাহুল দোকানের বিলটা দিতে যাচ্ছিল।
ছায়া বাঁধা দিয়ে বলল,"সে হবে না।আজকে আমি তোমাকে ডেকেছি তাই বিলটা আমিই দেব।"
রাহুল ভালোভাবেই জানে এর প্রতিবাদ করে লাভ নেই।তাই বাঁধা দিলো না আর।
"বাজারের দিকে যাবে তুমি!আমার ওদিকে কাজ ছিল তোমাকে নামিয়ে দিতাম তাহলে।"রাহুল ছায়াকে বলল।
ছায়া বলল,"না,আমি বাড়ি যায়।মাকে বলে এসেছি তাড়াতাড়ি ফিরব।তুমি এসো।আবার দেখা হবে,ভালো থেকো।"
"আচ্ছা বেশ,তুমিও ভালো থেকো।বলে রাহুল বিদায় নেয়।
দুজন দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে থাকে দুজনের বিপরীত দিকে।যেন মনে হয় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দিকে।আজকের এই দেখা যেন তাঁদের ভালোবাসার সম্পর্কের শেষ দেখা।দুজনেরই হয়তো মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা অসম্পূর্ণ কিছু কথা অসম্পূর্ণ থেকেই গেল।চিরদিনের খামখেয়ালি,বন্ধুপ্রিয় রাহুল হয়তো বিয়ের পর সংসার জীবনে দায়িত্ব আর কর্তব্যের মাঝে ব্যস্তময় হয়ে উঠবে,আর সেই ব্যস্ততায় হয়তো ছায়াকে মনে রাখা সম্ভব হবে না।আর ছায়া,সেও হয়তো একদিন তাঁর স্বপ্নপূরণ করবে,নিজের জীবনসঙ্গীকে নিয়ে সংসারসাগরে ডুবে যাবে।সাংসারের এই চিরাচরিত নিয়ম।কিন্তু কোথাও মনের এক কোণেও জমা হয়ে থাকবে দুজনেই।অচেনা কোনো স্বরে কাউকে ছায়া বা রাহুল নামে ডাকতে শুনলে পলকে দুজনে ফিরে একবার তাকাবে,আর চোখ খুঁজবে সেই পুরোনো ছায়া বা রাহুলকে।বা কখনো হয়তো এই রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ে যাবে আজকের দিনটির কথা।