প্রযুক্তির অভিশাপ
প্রযুক্তির অভিশাপ
তখনও আমাদের ছাত্র জীবন শেষ হয়নি,আমি BSC শেষ করে ডিপ্লোমা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছি । আর আমার গার্লফ্রেন্ড নন্দিনী তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। একদিন নন্দিনীর ডিপার্টমেন্টের এক স্যার নন্দিনীকে ডেকে বললেন যে ওনার ছেলেকে যেন নন্দিনী পড়ায়। আর নন্দিনীও এতকিছু না ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো যেহেতু নন্দিনীর হোস্টেলের পাশেই স্যারের বাসা ছিলো। ছেলেটার নাম অমর আর সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রথমদিন ছেলেটাকে পড়িয়ে নন্দিনী আমায় ফোন করে কথায় কথায় বললো,
-“জানো , আমায় যদি কোন টাকা না দেয় তবুও আমি এই ছেলেকে টিউশানি করাবো”।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কেন?
নন্দিনী হাসতে হাসতে বললো,
– ” প্রথমত ছেলেটা দেখতে অনেক কিউট আর নাদুস নুদুস( মোটা টাইপের) আর দ্বিতীয়ত ও দেখতে অনেকটা নন্দনের ( নন্দিনী ছোট ভাই) মত”।
নন্দিনী প্রতিবার যখন অমরকে পড়াতে যেতো তখন ওর জন্য হয় চকলেট নয়তো চিপস কিছু না কিছু একটা কিনে নিয়ে যেত। আমি প্রায় সময় নন্দিনীকে মজা করে বলতাম,
— প্রতিদিন একসব চকলেট কিনে নিয়ে গেলে দেখা যাবে তোমার টিউশানির অর্ধেক টাকা চলে গেছে
নন্দিনী তখন হেসে বলতো,
-“অর্ধেক টাকা গেলেও সমস্যা নেই। নিজের ভাইয়ের মতই তো কাউকে দিচ্ছি”।
অমর পড়ায় ফাঁকি দিলে নন্দিনী ওকে যেমন কানমলা দিতো তেমনি পড়া পারলে নন্দিনী ওর গাল টেনে আদরও করতো।
একদিন বিকালের দিকে নন্দিনী আমায় ফোন করলো। আর ফোন করে এত বেশী কান্নাকাটি করছিলো যে ওর মুখ দিয়ে তখন কান্না বাদে আর কিছু বের হচ্ছিলো না। আমি বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম কি হয়েছে আমায় বলো কিন্তু ও শুধু বলে ওর কিছু হয় নি ও এমনিতেই কাঁদছে।
পরদিন সকালে আমি যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব নন্দিনীর সাথে দেখা করার জন্য গেলাম । নন্দিনীর সাথে দেখা করে ওর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, ও তখন আমায় সবটা খুলে বলল । প্রথম প্রথম নন্দিনী কিছু বলতে চাইছিলো না,কিন্তু আমি যখন খুব জোর করলাম তখন ও ওর ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলো। আমি যখন কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ছিলাম নন্দিনী তখন মাথা নীচু করে নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। লেখাটা নন্দিনীর স্টুডেন্ট অমর নন্দিনীকে নিয়ে লিখেছে। এই লেখাতে ওর স্টুডেন্ট অমর নন্দিনীর শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গার বর্ণনা দিয়েছে। নন্দিনীকে দেখলে, নন্দিনী ওর মাথায় হাত রাখলে ওর কেমন লাগে সেটা লেখা। আর একটা মেয়ের উলঙ্গ ছবি আঁকা। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো ছবিটার নিচে লেখা নন্দিনী ম্যাডাম।
লেখাটা পড়ে আমি যখন ওর হাতটা ধরলাম,ও তখন বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-” যে ছেলেকে নিজের ছোট ভাইয়ের চোখে দেখেছি সেই ছেলে আমায় নিয়ে এতটা নোংরা ধারণা করে।গতকাল ভুল করে আমার খাতাটা রেখে ওর খাতাটা নিয়ে এসেছিলাম। তাই তো এইসব জানতে পেরেছি”
এমন সময় নন্দিনীর ফোনটা বেজে উঠলো। নন্দিনী তখন চোখের জলটা মুছতে মুছতে আমায় বললো,
-“স্যার( অমরের বাবা) ফোন করেছে । কি বলি বলো তো? আমি তো স্যারকে কাল বলেছি ওনার ছেলেকে আর পড়াতে পারবো না। কাল থেকে বারবার স্যার আমায় ফোন দিয়ে জানতে চাইছে আমি কেন পড়াতে পারবো না”।
আমি তখন নন্দিনীকে সাথে নিয়ে ওর স্যারের বাসায় গেলাম। ওর স্যার ওর সাথে আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলো তারপর আমি যখন বললাম আমি নন্দিনীর বাগদত্ত তখন তিনি আমাকে ভিতরে আসতে বললেন। আমি ভিতরে গিয়ে নন্দিনীকে বললাম, তুমি একটু অন্য রুমে যাও আমি স্যারের সাথে কথা বলছি
নন্দিনী অন্য রুমে চলে গেলো আর ওর স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ” কি হয়েছে বলো তো? হুট করেই নন্দিনী বলছে ও আমার ছেলেকে আর পড়াবে না ”।
আমি তখন একটু হেসে স্যারকে বললাম,
— আপনাদের বাসায় দেখলাম ওয়াইফাই আছে কিন্তু কম্পিউটার কোথাও দেখছি না
স্যার তখন বললো,
-” আজকাল স্মার্ট ফোন থাকলে কম্পিউটারের প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও কম্পিউটার কিনবো অমর এসএসসি পাশ করলে। এখন কম্পিউটার কিনে দিলে সারাক্ষণ ও গেইম খেলবে”
আমি বললাম,
— অমরও কি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে?
স্যার হেসে বললো,
-” দিলাম কিনে। কি আর করবো, ছেলেকেও তো প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে”
আমি তখন মুচকি হেসে স্যারকে বললাম,
— আপনার কি চটি বইয়ের কথা মনে আছে?
স্যার কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,
-“মানে!”
আমি তখন বললাম,
— আমাদের সময় চটি বই ছিলো। ক্লাসের কিছু ছেলে সেই বই গুলো সংগ্রহ করতো আর দলবেঁধে পড়তো। সেইসব বইয়ে এমন কিছু গল্প থাকতো যা দেখে মাথা ঘুরতো। ভাই-বোনকে নিয়ে নোংরা কাহিনি, চাচা- ভাতিজিকে নিয়ে, শালী- দুলাভাই, ম্যাডাম- ছাত্র এমন কি আরো কিছু নিচু পর্যায়ের কাহিনী লেখা থাকতো যা আমার মুখ দিয়ে বের হবে না। আপনার - আমাদের সময়ে সেই বই গুলো সংগ্রহ করা অনেক দুষ্কর ছিলো। তাই যেকেউ সংগ্রহ করতে পারতো না। কিন্তু বর্তমান স্মার্ট ফোনের যুগে এইগল্প গুলো খুঁজে বের করা কোন বিষয় না। ৫ সেকেন্ডের ভিতরেই সেইসব গল্পগুলো খুজে বের করা যায়। শুধু গল্প না পর্ণ ওয়েবসাইটে ঢুকে অনেক কিছু দেখাও যায়।
স্যার অবাক হয়ে বললো,
-“এইসব কথা তুমি আমায় বলছো কেন?”
আমি বললাম,
— আমি বলছি তার কারণ হলো আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও অল্প বয়সে ছেলের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছেন। অল্প বয়সী ছেলে থাকার পরেও বাসায় লাগিয়েছেন ওয়াইফাই আর যে কারণে আপনার ছেলে যেকোন সময় চাইলেই বিভিন্ন ১৮ ওয়েবসাইটে সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারে। আমি মানছি সন্তান যেন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য অবিভাবকের সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে তারমানে এই না যে ক্লাস সেভেনে পড়ে বাচ্চার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিবেন। আপনার উচিত ছিলো ফোন না দিয়ে ছেলের হাতে কম্পিউটার তুলে দেওয়া। গেইমস খেলবে বলে ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেন না অথচ আজকাল ছেলে মেয়েরা কম্পিউটারের চেয়ে ফোনেই গেইমস খেলে বেশি। কম্পিউটারে গেইমস খেলে তবুও উপকারিতা আছে কি-বোর্ডে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু মোবাইলে গেইমস খেলে কোন উপকারিতা নেই
আমার কথাতে স্যার কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
-” এইসব জ্ঞান মূলক কথা আমায় বলছো কেন?”
আমি বললাম,
— বলছি তার কারণ হলো আপনি একজন অসচেতন বাবা। আর আপনার ভুলের কারণেই আপনার ছেলে প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে..
আমি আমার পকেটে রাখা কাগজটা স্যারের হাতে দিলাম। উনি কাগজটা ভালো করে দেখলে আমি ওনার থেকে কাগজটা নিয়ে ওনাকে বললাম,
— এটা আপনার ছেলে ওর ম্যাডামের সম্পর্কে লিখেছে। আপনার ছেলে যদি ১৮ সাইটে ঘুরাঘুরি না করতো তাহলে সে ম্যাডামকে বোনের চোখেই দেখতো। তাকে নিয়ে এইসব ভাবনা আসতো না। এর জন্য আপনার সন্তানের দোষ নেই আপনি দায়ী। এক কাজ করবেন আপনার ছেলেকে পড়ানোর জন্য কোন ছেলে স্টুডেন্ট রাখবেন কারণ আপনার ছেলে দৈহিক ভাবে ছোট থাকলেও প্রযুক্তির অপব্যবহারে মানসিক ভাবে বড় হয়ে গেছে…
স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে যখন আমি আর নন্দিনী রাস্তায় হাটছি তখন খেয়াল করি নন্দিনী আনমনে কি যেন ভাবছে। আমি নন্দিনীকে বললাম,
— কি হলো! কি ভাবছো?
নন্দিনী বললো,
-” ভাবছি আমাদের সন্তান হলে ওর আশে পাশে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে দিবো না”
আমি তখন মুচকি হেসে বললাম,
— প্রযুক্তির ছোঁয়া না পেলে আমাদের সন্তান একটা রাম ছাগলে পরিণত হবে
সন্তানের শরীরে প্রযুক্তি ছোঁয়া লাগুক কিন্তু সেই ছোঁয়ার অপব্যবহার যেন কোন সন্তান না করে সেদিকে প্রতিটা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।
এরপর শান্ত মনে দুজন দুজনের হাত ধরাধরি করে ভালোবাসার জগতে হারিয়ে পথ চলতে লাগলাম।
