পরিনতি
পরিনতি
রেণুকার গায়ের রং যেমন উজ্জল তেমনি রুপের অধিকারী।
এ রুপ গ্ৰামের আর কোনো মেয়েমানুষের আছে কিনা তা নিয়ে সারাগায়ে সকলের সন্দেহ।
কিন্তু বয়স পনেরো পেরিয়ে গেয়েও মেয়ের জন্য একটিও উপযুক্ত পাএ না পেয়ে,
অবশেষে রেণুকার বাবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন।
রেণুকার মা ছোটবেলায় মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন; মেয়ে আমার লক্ষী প্রতিমা, কিন্তু অভাগির ঘরে জন্ম নিয়েছে সে, তাই যেনো তার বিয়ে উপযুক্ত পাএের সাথে হয় যার ঘরে অর্থের অভাব নেই।
এরপর বছর পেরিয়ে যাবার পর রেণুকার দাদা অবশেষে বেশ খোঁজখবর করে একজন জমিদারের সাথে তার বিয়ে ঠিক করলেন।
জমিদার বয়সে ছাপ্পান্ন পেড়িয়ে গেছে কবে তার হিসাব এই বাড়ির চল্লিশটি চাকর বাকরের মধ্যে একজনেও রাখেনি।
এর আগেও তিনি একজন একুশ বয়সী সুন্দরি মেয়েকে বিয়ে করেছেন।
প্রথম স্ত্রী তার শিক্ষাতা হলেও বিয়ে করে সে বৃদ্ধ বড়কে ছেড়ে নিজের বাপের বাড়ি পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বড়কে দেখতে আসে টাকা নেয় আর ফিরে যায়। তাই এই শেষ বয়সে নিজের দেখভালের জন্য একজন দাসি চাই দেখে বিয়ে করতে চাইছেন জমিদার।
যদিও সেই বিসয়ে তার প্রথমা স্ত্রী অনুপমার কোনো আপত্তি নেই।
বৃদ্ধ বড় কার সাথে ঠিক কিভাবে আছে তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই বললেই চলে।
রেণুকার প্রথমে বিয়েতে বেশ আপত্তি থাকলেও পরে সে যখন নিজের দাদা বৌদির ঘাড়ে বসে খাবার খোঁটা পেতে থাকে
আর পাড়াগাঁয়ে দিনরাত নিজের নিন্দে শুনতে থাকে
তখন সে বিয়েতে রাজি হয়।
দাদা, বৌঠান -এর অভাবের সংসার, মেয়ের জন্য বাবার জমানো কিছু অর্থ দিয়ে কোনোমতে বিয়ের যাএা সম্পুর্ন করা হলো।
বিয়ে করে নিজের চেনা গ্ৰাম ছেড়ে রেণুকা অচেনা অজানা এক গ্ৰামে অচেনা মানুষের ভীড়ে এসে পড়লো।
সেখানে তাকে কেউ অপমান তো দুরের কথা মুখ তুলে কথা বলারও সাহস পেতো না।
মাএ কয়েক মাসেই রেণুকা সেখানের জমিদার গিন্নি হিসেবে বেশ ভালো খ্যাতি অর্জন করলো।
চাকর-এ ভরা বাড়িতে তাকে চিরুনিটাও হাত দিয়ে তুলতে হতো না, তার সাজগোজের জন্য একটি বার্তি চাকর রাখা হয়েছে।
রেণুকা সাজতে ভালোবাসে দেখে জমিদার বাবু তাকে বেশি দড়ে গয়না এনে দিয়েছেন।
রেণুকা লাল শাড়ি, খোপায় সোনার কাঁটা, সোনার চুড়ি, সোনার তোরা পড়ে সারাবাড়ি অলংকারের ঝংকারে মেতে উঠতো।
এবার যেনো তার রুপের সাথে টাকার সংযোগে একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষী প্রতিমার মতো দেখাতো।
রেণুকা নিজেকে সাজিয়ে তোলার ব্যস্ততার জমিদারের কথা ভুলেই যেতো।
জমিদার যখন রাতে তার খাটের পাশে এসে তার হাত ধরে টানতো তখন তার ভারী কান্না পেতো।
সে মনে মনে ভাবতো 'এর চাইতে গরীব ঘরের রংচটা শাড়িটাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ’।
কিন্তু ভোরের আলো ফোটার পরমুহুর্তেই যখন গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে তুলতো তখন তার কাছে যেনো বর্তমানটাই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হতো।
…
একদিন দুপুরে বাড়ির চাকর এসে রেণুকাকে বললো;
গিন্নিমা জমিদার বাবু কেরম জানি করছেন, একবারটি চলুন তো, রেণুকা অবাক হয়ে ছুটে যায় জমিদারের ঘরে,
ঘর ভর্তি চাকর, সকলকে সড়িয়ে রেণুকা ঘরে ঢোকা মাএই জমিদার নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রেনুকার মন খারাপ হয়ে ওঠে, চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ে জল।
এরপর রেনুকার গা থেকে এক এক করে সব সোনার গয়নাগুলো খুলে ফেলা হয়।
মাথায় রাঙানো সিঁদুর, কাপড় দিয়ে বেশ ভালো ভাবে ঠিক যতটা সম্ভব ততটা মুছে ফেলা হয়। পড়নের লাল শাড়ি খুলে পড়ানো হলো সাদা শাড়ি।
বাংলা জুড়ে তখন সতীদাহ প্রথার চল ভীষণ রকম, কিন্তু গ্ৰামে কানাঘুষো শোনা যায় কোন এক রাজা নাকি সেই সতীদাহ প্রথাকে মানুষের মনের কুসংস্কার বলে বিবেচিত করছেন। এবং সতীদাহ হতে দিচ্ছেন না।
কিজানি তা সত্যি কিনা ?
এসব প্রথা তো আর ছেলেখেলা না, যাকে বলে সতীদাহ প্রথা।
জমিদার নাকি মরার আগে তার এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা হিসেবে তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রেনুকাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
তাই দাহ প্রথা থেকে রেনুকা রেহাই পেলো। তাকে আর কোনো রাজার প্রয়োজন হলো না।
…
বিকেলে রেনুকা দোতলার বারান্দার একেবারে শেষ মেঝেতে মাদুর পেতে বসে কিছু একটা ভাবছিল।
কিন্তু সেই ভাবনা যে আসলে কি ভাবনা তা আসলে সে নিজেও জানে না।
আসলে কিছু মানুষ ভাবতে ভালোবাসে,
সেটা কোনো বিশেষ কারনেই হোক বা অকারনেই
আসলে ভাবনা মানুষকে নতুন কিছু উপহার দেয় খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়না।
ঠিক এমনি সময় জুতোর শব্দে রেনুকার হুঁশ ফিরল,
কেউ একজন সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে আসছে,
রেনুকা সিঁড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,
বাড়ির চাকর নাকি ?
না… বরং অনুপমা, জমিদারের প্রথমা স্ত্রী,
তার সাজ সজ্জা দেখে রেনুকা আরুকটু হলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছিল প্রায়।
পরনে নীল শাড়ি, কালো জুতো, চোখের কালো চশমাটা মাথার দিকে তুলে রাখা, হাতে একখানি থলি।
অনুপমা চশমাটা খুলে রেনুকার দিকে এগিয়ে এসে বললেন;
মন খারাপ নাকি রেনুকা ?
তা… সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়, এই খবরটা শোনার পরে আমারো মনটা একটু খারাপ হলো বইকি,
যাই হোক যা হয় মঙ্গলের জন্যই হয়।
কথাটা বলে হাতের থলিটা রেনুকার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন;
এই নাও এতে কিছু ফল আছে, ভাবলাম তোমার জন্য নিয়ে আসি।
রেনুকা একটু ইতস্তত করে ফলের থলিটা নিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক এমনি সময়
অনুপমা বললেন; আজ আশি বোনটি আবার নাহয় দেখা হবে,
বলে ধীরর গতিতে উঠে নিজের কালো জুতোর কটকট শব্দ করতে করতে ঠিক যেমনি করে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠেছিলেন,
ঠিক তেমনি করেই নিচে নেমে গেলেন।
রেনুকা ফলের থলি নিয়ে মেঝেতে বসে রইলো…!
…
বেশ কিছু সপ্তাহ এভাবেই কেটে যায়
রেনুকার আর এই বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না।
তাই সে ঠিক করে সে বাপের বাড়ি ফিরবে, তাই বাড়ির চাকরকে বলে সব গোছগাছ করে ফেলে সে।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে রেনুকা নিজের কিছু সোনার গয়না ও রঙ বেরঙের শাড়ি গুছিয়ে নেয় নিজের সাথে।
এসবের আর প্রয়োজন নেই তার
তাই সে ঠিক করে তার বৌদিকে এসব দিয়ে আসবে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘোড়ার গাড়িতে রওনা হয় রেনুকা,
বাপের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সূর্য তখন প্রায় মাথার উপড়ে।
অবশেষে সে বাপের বাড়ি পৌঁছাল,
বাড়িতে ফিরে সে প্রথমেই দর্শন পায় তার দাদার।
দাদা তাকে দেখতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে
প্রায় তখনই খুশিতে কেঁদেই ফেলে সে।
রেনুকার চোখেও তখন জল, রেনুকা বলে;
দাদা একবারটি দেখতেও গেলিনা, তোর বোনটি বেচে না মরে,
রেনুকার দাদা নিজেকে একটু সামলে বলে,
বোনরে আমি কাজের চোটে যাবার সময় পাইনি
জানিস তো ধানপানের সময় জমিতে দেখাশোনা করতে হয়,
তবে তোর সব খবর আমি কিন্তু রেখেছি।
রেনুকা ঘরে এসে জিজ্ঞেস করে বৌদি কোথায় রে দাদা?
রেনুকার দাদা উওর দেয় তোর বৌদি কদিনের জন্য বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে, চলে আসবে আর কিছুদিনের মধ্যেই।
এরপর রেনুকার দাদা ঘরের একোন থেকে ওকোন ঘুরে ফিরে
দুচারটে বাতাশা জোগাড় করে গ্লাস ভর্তি জল এনে রেনুকার হাতে দিলো।
তারপর রেনুকার মুখের দিকে চেয়ে বললো;
আসলে দোষ তো আমারি রে রেনু, তোর জন্য একজন উপযুক্ত পাএ খুজে দিতে পারলাম না।
এরপর একটু আপসোস করে বললো; আর ওবেলা কি খাবি?
তোর তো এখন নিরামিষ, আমি নাহয় সেদ্ধ আলু মাখানো ভাত করে দেব নাহয় ওবেলা।
তা একাদশী মানছিস তো?
যাই হোক তুই থাক আমি একটু জমির দিক থেকে ঘুরে আসি।
আজকাল আবার গরু মোষের অত্যাচার বেড়েছে।
আমি আশি রে… বলে রেনুকার দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রেনুকা ঘরটা বেশ করে চেয়ে দেখে, যেনো এই ঘরে সে এই প্রথম এলো।
ঘরের ওপরে খর, ঝাড়বাতি নেই…!
পোড়া জানালার কাঠ, তাতে শিক নেই…!
মাটির শেতশেতে মেঝে তাতে রঙিন মাদুর নেই…!
রেনুকা অজান্তেই কি মনে হতে সে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়,
এরপর বৌদির জন্য আনা থলিটা থেকে বের করে সমস্ত গয়না, ও শাড়ি।
এরপর সেখান থেকে সুন্দর দেখতে একটা লাল বেনারসি শাড়ি বেড় করে পড়ে
আর তার সাথে সোনার গয়না গুলো মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে লাগে।
ঠিক সেই মূহূর্তেই তাদের ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে গ্ৰামের কিছু লোক যাচ্ছিল-
তারা রেনুকার গায়ে লাল শাড়ি ও গায়ে গয়না দেখে প্রায় হা…
তারা বলাবলি করে আরে এতো রেনুকা না… আরে রেনু… রেনু…!
রেনুকা যে বিধবা সে খবরটা গ্ৰামের সবাই জানে, আসলে গ্ৰামে এসব খবর খুব তাড়াতাড়ি রটে যায়।
আর অন্য দিকে দোতলার ঘরে থাকার অভ্যাসের কারণে রেনুকা ঘরের জানালা বন্ধ করার কথাটা মাথায় আসেনি।
আর সেই করা ছোট্ট একটা ভুলের পরিনতি যে এতটা বিশ্রী ও খারাপ হবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
…
গ্ৰামের লোকগুলো রেনুকার ঘরের দরজা ভেঙে ভেরতে ঢুকে তার সোনার চুড়ি ভর্তি হাতটা টানতে টানতে ঘরের বাইড়ে গ্ৰামের লোকের সম্মুখে এনে দাড় করায়।
এরপর জোট বেঁধে ডাকা হলো পুরোহিতদের, এই পাপ ও তুখোড় অন্যায়ের বিচার করার জন্য।
গ্ৰামের লোকেরা রেনুকার চারপাশে গোল করে ঘিরে দাঁড়ালো তামাশা দেখতে,
বিধবার পরনে লাল বেনারসি, গা ভর্তি সোনার গয়না,
তা দেখে গ্ৰামের ভিন্ন মানুষের মুখে শোনা গেলো ভিন্ন কথা:
ছিঃ ছিঃ ছিঃ… কি নোংরা মেয়েমানুষ বাবাগো।
বেধবার গায়ে গয়না বলি এসব কথা যে মুখে আনাও পাপ।
আবার টেনে লাল শাড়ি খান পড়েছে দেখো।
বলি ধম্মে সইবে না… নরগেও ঠাই হবেনা।
ঠিক এমনি সময় ভিড়ের থেকে একজন ভদ্রলোক জোর গলায় বলে উঠলো;
বিধবা মানে তো আর বিসর্জন নয়,
যে নিজের সুখ, স্বপ্ন সব ত্যাগ করতে হবে।
সেই কথা শুনে রেগে পুরোহিতের দল থেকে একজন বলে উঠলো, তা সেসব কথা বলার তুমি কে বাপু ?
ভদ্র লোকটি বললেন; আমি কে, তার পরিচয়টা আপনাকে দেবার প্রয়োজন আমি মনে করিনা।
শুধু এটা জেনে রাখুন আপনারা যেটা করছেন সেটা অন্যায় এবং কুসংস্কার।
আর আমি একজন কুসংস্কার বিরোধী…
এই বলে তিনি রেনুকার কাছে এসে রেনুকা একটা হাত ধরে ভীড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলেন।
সবাই চেয়ে রইলো, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না।
ভদ্রলোকটির গলার এই গর্জন এবং সাহসী চোখ দেখে সবাই তখন চুপ।
একটু একটু করে ভীড়ের মাঝে একটা রাস্তা তৈরি হলো,
ভদ্রলোকটি রেনুকার একটি হাত ধরে ভীড়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলো।
বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর…
রেনুকা বলে উঠলো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে ?
ভদ্র লোকটি নম্ন ও ভদ্র স্বরে বলে উঠলো, ভর্সা রাখো বোন, আমি তোমার কিছু হতে দেবোনা।
এই মূহুর্তে কলিকাতার রেলগাড়ি আসবে তাই স্টেশানে যাচ্ছি।
…
এরপর অনেকটা রাস্তা পেড়িয়ে আর কোনো প্রশ্ন না করে একেবারে স্টেশনে পৌঁছে রেনুকা বললো; কেনো কলকাতায় ঔনকি আছে, আর আপনার নাম কি ?
রেল আসছে তাই রেল গাড়ির আওয়াজে মূহুর্তেই তখন শোরগোলে স্টেশন ভরে গেলো।
নিজের করা প্রশ্নের, উত্তরটা আর ঠিক করে শোনা হলোনা রেনুকার।
ভদ্রলোকটি রেনুকার হাত ধরে তরিঘরি ট্রনে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনই আচমকা লোকটির বুকপকেট অ একটা কাগজ স্টেশনে পড়ে গেলো,
খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও রেনুকা সেই কাগজের ওপর চোখ পড়লো
তাতে লেখা; প্রমান পএ !
নাম: রাজা রামমোহন রায়।
কাগজের টুকরোটি তোলার সময় হলোনা, তাই সেটা আর তোলা হলো না রেনুকার।
কোনরকমে টেনে উঠে পড়লো দুজনে। এরপর ট্রেন হর্ন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে রওনা হলো কলিকাতার উদ্দেশ্যে।
চলন্ত ট্রেনের হাওয়ায় স্টেশনে পড়ে থাকা সেই কাগজের টুকরোটি আঁচড়ে পড়লো সমাজের সমস্ত কুসংস্কারের ওপড়ে।

