Anindya Biswas

Romance

2  

Anindya Biswas

Romance

ফিমেল বেস্টি-২

ফিমেল বেস্টি-২

12 mins
266



তারপর অনেকদিন কেটে যায়। সবাই নিজের সংসারে আস্তে আস্তে ব্যাস্ত হলে যায়। হওয়ারই কথা। এভাবেই তো জীবন চলে। আবির আর

তিয়াসা ও ব্যাস্ত, তাদের নতুন সংসার, নতুন জীবন। ব্যাস্ত হয়ে যায় রাহুল ও। সংসারের চাপে আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকে হৃদ্যতা, তাও বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট থাকে তাদের, যদিও যোগাযোগ কমে যায়।

এখন তন্ময় সম্পূর্ণ একা। মানে প্রকৃত অর্থে নিঃসঙ্গ। একা কেবিনে, একা ঘরে, একা পুরো। নিঃসঙ্গ জীবনে সঙ্গী তার কাজ আর কাজ, আর সখ তার কবিতা লেখা। অফিসের চাপে হাঁফিয়ে ওঠে সে, ভাবে ছুটি নেই, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, কী বা করবে, কই বা যাবে। তাই মাঝে মাঝে অফিসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে। দেখতে থাকে জগৎ সংসারটাকে। শুষে নিতে চায় সব জগৎ সংসারের মান অভিমানটা, নিতে চায় দুনিয়ার সব দুঃখ।

তন্ময় অফিসে বসে আজ সব ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। আজ আর্থিকবর্ষ শেষ। সব হিসেব শেষ করতে হবে।

"তন্ময়, বাড়ি যাবেনা?", বসের হটাৎ আগমন।

"না স্যার, কাজ আছে কিছুটা, এমনিতে কিছু বললেন হলে", তন্ময় ফাইলটা টেবিলের ওপর বন্ধ করলো।

"আমার মেয়ে দিয়া, মাস্টার্স কমপ্লিট করলো এইবার, বাড়ি আসছে, আমি চাই তার একটু কাজকর্মের অভিজ্ঞতা হউক, তো ভাবছি তোমার কাছেই পাঠাই, আফটার অল, শি শুড লার্ন ফ্রম বেস্ট,কি বলো", বসের হাসি।

তন্ময়:"লজ্জা দেবেন না স্যার।"

বস:" আমি লোক চিনি বুঝেছ, আর বেশি বিনয় দেখাতে হবেনা, কাল পরশু আসবে বাড়িতে, আসলেই পাঠিয়ে দেবো, আর হ্যাঁ, বসের মেয়ে বলে কিন্তু কোনো আবদার, বা ওজর আপত্তি মানবে না,বুঝলে।"

তন্ময়:"আচ্ছা স্যার, চেষ্টা করবো, আপনি পাঠিয়ে দেবেন স্যার।"

বস:"ওকে তাহলে, সী ইউ ।"

"এই দিয়া, উঠ ঘুম থেকে, উঠ, নাহলে মোবাইলেই চিৎকার করবো, আরে ৯ টাতে রিপোর্টিং , কনফারেন্স হলে, বাপরে বাপ,কি ঘোমায় রে মেয়ে, কলেজের শেষ দিনেও ঘোমাচ্ছে, হাতির বাচ্চা উঠ বলছি" মোবাইলে নীল একনাগাড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে।

দিয়া ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সপ্ন দেখছিল। সে বয়ফ্রেন্ডের বাইকে ঘুরতে বেরিয়েছে। কই যাচ্ছে, কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। পেরিয়ে যাচ্ছে ধু ধূ মাঠ, প্রান্তর, রাস্তা, হাওয়াতে ফুরফুর করে উড়ছে দিয়ার খোলা চুল। দিয়া দুহাত ছড়িয়ে পুরো বাতাস টাকে উপভোগ করছে। তার মন খালি ছুটে যেতেই চাইছে। আরও দূরে, বহু দূরে। হাসছে দিয়া, চিৎকার করছে খুশিতে। দিয়া ভাবলো এইবার দাঁড়াবে সে। এই কথা ভেবে যেইনা হাত খুলে দাড়াতে গেলো বাইকের পেছনে, হৈ হৈ করতে করতে ধুপ।

পড়ে গিয়েছে খাট থেকে, সোজা মেঝেতে।

"ওহ, আজও সেই সপনো, আবার বাইকে নাকি", মিতালি, তার রুমমেট, তাকে উঠাতে উঠাতে বললো।

"হ্যাঁ, আবার সে, ওমা আমি এখানে, কি করে, আমি না বাইকে ছিলাম, আরে, মোবাইল কোথায়, তুই কে" দিয়া ঘুমজড়ানো গলায় একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে।

"উঠ উঠ, এদিকে তোর বাইকবয় সকাল থেকে গার্লস হোস্টেল এর সামনে হাজির,রেডী হ, আজ সমাবর্তন মনে আছে তো"

"ওহ হ্যাঁ, নীল কোথায়?" বলে দিয়া ফোন খুলে দেখে নিলের ১০ টা মিসড কল।

ওপারে ফোন করতেই নীল একহাত নিল তাকে।

দিয়াও হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি আসছি করতে করতে তৈরি হয়ে বাইকের পেছনে গিয়ে বসলো।

নীল:"মাননীয় হাতিকুমার, এতোক্ষণ সময় লাগে, আংকেল কতক্ষন ধরে আমায় ফোন করে যাচ্ছেন, তোকে পাওয়া যায় না, বাপরে বাপ, এজন্যই বয়ফ্রেন্ড টেকে না একটাও, সারাদিন ঘুমের রাজ্যে বাস করিস, আর উল্টোপাল্টা কথা বলিস"।

দিয়া: "বারে, কই দেরি হলো, মাত্র দুঘন্টা এনা , আর আজ স্বপ্নে আবার ও এসেছিল রে, সেই বাইক অলা। কি সুন্দর আমরা ঘুরছিলাম, আজ ভাবছিলাম চেহারা দেখবোই, হটাৎ ধপাস করে পড়ে গিয়েছি দেখে এনা। আর কলেজের শেষ দিন আজ, আজও কথা শোনাবই। আমি না তোর ফিমেল বেষ্টি।" বলে আলতো করে নীলের গলাটা জড়িয়ে ধরলো বাইকের পেছন থেকে।

নীল:" হয়েছে হয়েছে , আর মাখন লাগাতে হবে না, সোজা হয়ে বস, বেস্টির গুষ্টি আমার"।

নীল আর দিয়া ছোটবেলার বন্ধু। যাকে বলে একদম চাদ্দি ইয়ারী। একই স্কুলে, একই কলেজে পড়াশুনা। দুজনেই দুজনের বিভিন্ন উথান পতনের সাক্ষী। একে অপরের হাড়ির খবর কারো অজানা নয়।

সমাবর্তন আজ। দুজনেরই কলেজ জীবন শেষ। মাস্টার্সের। দিয়া ভাবছিল এইবার ডক্টরেট করবে। আসল ইচ্ছা আরও কয়েকবছর ল্যাদ খেতে। এদিকে বাবাও বলছেন একটু কাজকর্মের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারপর কোথাও অ্যাডমিশন নিতে।

ওদিকে নীলের আবার দিয়ার যা ইচ্ছা, তাই। কারণ বন্ধুকে সবসময়ই পাবে যে। না, নীলের দিয়ার প্রতি কোনোদিন আলাদা টান অনুভব করেনি, বরঞ্চ দিয়াই ওকে ওর কিছু বন্ধুর সাথে ডেট করতে পাঠাতো। সে যাই হোক, দিনের শেষে নীল চায় আবার ফটোগ্রাফার হবে। তবুও ডিগ্রীর জন্য, আর দিয়ার পীড়াপিড়ির জন্য মাস্টার্স করেছে।

আজ ওদের সমাবর্তন। পরশু টিকেট বাড়ি যাওয়ার। দুজনেই দুজনের বন্ধুদের সাথে শেষ দেখা করে নিচ্ছে। আর দিয়া তো আছেই ইচ্ছেমত পোজ দেবার জন্য। সবার সাথে শেষ দেখা করে রাত্রে ডিনার।

ডিনার টেবিলেই দেখা বিক্রমের সাথে। বিক্রম কলেজের নামকরা ছেলে। খেলাধুলা, পড়াশুনা, সবদিকেই অলরাউন্ডার। তো সেজন্য কলেজের হার্টথ্রব, সে বলাই বাহুল্য।

বিক্রম:"হাই, দিয়া চ্যাটার্জী, রাইট?আমি বিক্রম , বিক্রম সেনগুপ্ত, নাম তো শুনেছ নিশ্চয়ই।" বলে একটা অহংকারী হাসি।

দিয়া :"হ্যাঁ, আমি দিয়া, নাইস তো মিট ইউ, অ্যান্ড কংগ্রাটস , ইয়ের টপার তো তুমি।"

বিক্রম:"সে আর বলতে, স্টিল থ্যাংকস। তো কলেজ শেষ, ফিউচার প্ল্যান কী, চাকরি, না বিয়ে?"

দিয়া:"নানা, বিয়ে কেনো, ডক্টরেট করবো ভাবছি এখান থেকেই।"

বিক্রম:"আরে , সেম হিয়ার, বাহ আমাদের দুজনের ভাবনাচিন্তা বেশ মিল আছে , কি বলো?"

দিয়া হাল্কা হাসি দিল।

বিক্রম:"যদি এখানেই আস, তাহলে চলো নতুন করে কলেজ ক্যাম্পাস দেখবে, আমার চোখ দিয়ে, পাশে দাড়িয়ে, তার জন্য নম্বরটা পেতে পারি কি, অবশ্য যদি সুন্দরী সম্মত হন। সো, ক্যান আই হ্যাভ ইউর নম্বর, প্লিজ?" বলতে বলতে মোবাইলটা বের করলো।

"নম্বর পাবে, তার আগে নীলের পরীক্ষা পার হও বিক্রমবাবু", নীল এসে দিয়ার পাশে দাঁড়ালো।

"হু আর ইউ, লোফার?" বিক্রম বিরক্তি প্রকাশ করলো।

"এই এই, লোফার বলছো কাকে, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর তুমি প্রথম দেখাতেই আমার নম্বর নেবার কে শুনি, সরি নট ইন্টারেস্টেড, চল নীল।"বলে দিয়া নীলের হাত ধরে বাইরে চলে এলো। বিক্রম হাঁ করে দাড়িয়ে রইলো। এরকম রিজেকশন পায়নি কখনো।

নীল:" একই ,তুই বিক্রম সেনগুপ্তকে মানা করলি, দা হট গাই কে, আরে আমি তো জাস্ট টেস্ট করছিলাম।"

দিয়া:" না তোকে কেন লোফার বলবে শুনি, তাও আবার আমার সামনে, সাহস কত বড়ো, তোকে লোফার, গরু, হাঁদারাম আমি ডাকবো, আর কারুর সেই অধিকার নেই।"

নীল:"তোর দাড়া দেখচি কিসসু হবে না। কার সঙ্গে প্রেম করবি? দুর দুর।"

দিয়া:" ওসব জানিনা। কিন্তু তোকে আমার সামনে খারাপ কেউ বলবে, মেনে নেব না। আর কাউকে না পেলে তোকেই লাইন মারবো হাঁদারাম, বুঝলি?"

নীল:"দুর হ , দুর হ, বয়েই গেছে আমার।"

বলে দুজন দুজনের লেগপুল করতে করতে হোস্টেলে চলে গেলো।

কলেজ শেষে বাড়ি গেলে মিঃ চ্যাটার্জী দিয়াকে তন্ময়র সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

তন্ময়:"তাহলে আপনি কাল থেকে আসুন, সোজা প্লান্ট এ, ওখানেই বোঝাবো যতটুকু হয়।"

মিঃ চ্যাটার্জী:"হ্যাঁ সেটাই ভালো, একেবারে জায়গাই। শোনো দিয়া, মা আমার,তন্ময় আমাদের প্রথমসারির একজন ইঞ্জিনিয়ার। যদ্দুর পার শিখে নাও। আর তন্ময়, তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। আমার পুরো ভরসা তুমি।"বলে দুজনের থেকে বিদায় নিলেন।

তন্ময়:"আরে আমার নাম বলিনি, আমি তন্ময় বিশ্বাস, আর আপনি দিয়া চ্যাটার্জী, তাই তো?"

দিয়া হেসে হ্যাঁ করলো।

দিয়া:" আমি সকালের দিকে আসব। বিকালে আমার অন্য কাজ থাকে একটু। আপনি যদি এলাউ করেন আরকি?"

তন্ময়:" দেখাই যাক না, তবে যদ্দুর পার ওয়ার্কিং হাউর্স প্লান্ট এ কাটিয়, অনেককিছু শেখা যাবে।"

দিয়া:"ঠিক আছে স্যার, আসি তাহলে।"

ঘরে এসে নীল কে সব বললো। নীল বললো সেকিরে বিকেলেও ছাড় পাবিনা সবসময়ই মনে হচ্ছে। দিয়া আরে দেখন্যা, লোকটা খারাপ না মনে হচ্ছে, স্ট্রিক্ট না, তবে বেশ সিরিয়াস, কিউট ও আছে,আচ্ছা দেখি কি হয় বলে একচোট হাসাহাসি করে ফোন রেখে দিল।

পরেরদিন থেকে দিয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হলো। তন্ময় লক্ষ্য করে দিয়া এমনিতে দিয়া কাজেকর্মে খারাপ না হলেও কাজেকর্মে কেমন উদাসীন, মানে প্রায়ই আপণভোলা হয়ে কাজ করে। একটা কাজ করতে বল্লে আরেকটা করে, বা যা করার কথা পুরোটাই উল্টো করে। এমনিতে আবার শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে ঠিকঠাক চলে আবার। তবে যেটা তন্ময়ের ভালো লাগে হলো মেয়েটা কোনো অহংকারী না, বা বাবা যে বস সেটা ফলাও করেনা। সবার সাথে মিষ্টি ভাবে মেশে। সবার সাথেই বকবক করে। বেশ মিশুক, প্রাণোচ্ছল মেয়ে।সবার মন জয় করে নিয়ে নিয়েছে মুহূর্তে।

অফিসের কাজের পর নীলের সাথে সময় কাটালে দিয়ার অনেক হালকা লাগে। নীলের বকবকানি , তার বাজে সব জোকস, কলেজের স্মৃতি, এইসব নিয়ে দিয়ার বেশ সময় কেটে যায়।

দিয়া বলে নীলকে তন্ময়ের কথা। নীল তন্ময়ের নামকরণ করে রামগরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা। তাই শুনে দিয়া হো হো করে হেসে উঠে। বলে নারে লোকটা খুব পরিশ্রমী কিন্তু। আলাপ করিয়ে দেবো।

একদিন নীল হুট করে চলে আসে দিয়ার অফিসে। দিয়ার জন্মদিন।দিয়া আর তন্ময় তখন কাজে ব্যাস্ত। হটাৎ করে নীল হ্যাপি বার্থডে দিয়া, বলে পেছন থেকে কেক মাখিয়ে দিল।

তন্ময়:" অ্যারে জানতাম না তো ,সরি সরি, যাও ঘুরে এসো, আর এই নীল, তাইতঃ, যার কথা সবসময় শুনি?।"

দিয়া:"হ্যাঁ, এই আমার বেস্টফ্রেন্ড, নীল, আর নীল, এইই তোর রামগরুড়ের ছানা, আরে, এরাম, সরি, সরি" বলে অস্ফুটে জিভ কেটে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকে। নীল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

তন্ময়:"আমিই রামগরুড়ের ছানা?"

দিয়া, নীল দুজনেই মাথা নিচু।

হটাৎ তন্ময় হো হো করে ভীষণভাবে হেসে উঠে। বলে এমন হাসি অনেকদিন হাসি নি, থ্যাংকস।আর নো সরি। গো অ্যান্ড সেলিব্রেট।

দিয়া আর নীল দুজনেই বাইরে চলে এলো।

নীল:"বাব্বা, আরেকটু হলে তো গেলাম হলে, কি যে করিস?"

দিয়া:"হ্যাঁ রে। কি হলো বলত। কিন্তু লোকটা বহুদিন পরে হেসেছে বল, থ্যাংকস টু আস।"

নীল:"হ্যাঁ। তাতঃ ঠিক। আরে শোন আরেকটা খবর। আমার ডাক এসেছে ফটোগ্রাফি তে । ট্রেনিং ফর ১৫ দিন।"বলে হালকা চোখ টিপ দিল।

দিয়া:"অ্যারে বিন্দাস রে, কিন্তু তুই চলে যাবি ১৫ দিন, আমি, আমি কিভাবে থাকবো?"

নীল:"আরে জাস্ট ১৫দিন, এসে পড়বো , ভ্যালেন্টাইনস ডে তোর সঙ্গে কাটাব না?", বলে হা হা করে হাসতে লাগলো। দিয়া ও তবে রে বলে নীলের পিছনে দৌড়াতে লাগলো।

এর দুদিন পরের ঘটনা।

প্লান্ট এ খুব গুরুত্বপুর্ন একটা কাজ এসেছে। খুব সাবধানে করতে হবে। তন্ময় দিয়াকে নিয়ে পুরোটা দেখছে।বলা ভালো ,হাত লাগাচ্ছে।কারণ সামান্য ভুলচুক হলে কোনো মাপ নেই। বিশাল টাকার ক্ষতি।জীবন নিয়েও সংকট হতে পারে। তন্ময় দিয়াকে একটা সুইচ অন করতে বললো সিগন্যাল দিলে, কাজটার গুরুত্ব সম্বন্ধে বারবার বোঝালো। বুঝিয়ে তন্ময় সিগন্যাল দেবার জাগায় চলে গেলো। একটু পরে দিয়াকে সিগন্যাল দিতে বল্লে কোনো সাড়াশব্দ পেলনা।বারবার ফোন করলেও কোন আওয়াজ নেই স্যাটেলাইট ফোনে। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। লোক অস্থির হয়ে উঠছে। তন্ময় যেই না দিয়ার দিকে দেখতে গেলো গিয়ে দেখে দিয়া নেই। স্যুইচ অন না করে কই চলে গেছে স্যাটেলাইট ফোন ফেলে। তড়িঘড়ি তন্ময় অন করল সুইচ। এরই মধ্যে হইচই লেগে গেছে। কিছু মিস্ত্রি আরেকটু হলেই ফেঁসে গেছিলো টার্বাইনের ভেতর। চিৎকার, হইচই শুনে মিঃ চ্যাটার্জী ও দৌড়ে চলে এলেন।

মিঃ চ্যাটার্জী:"এটা আমি আশা করিনি তন্ময়। কি করলে?, এত দায়িত্বজ্ঞানহীন, এত লুজ, ছি:, হাউ কুড ইউ? "বলে যাচ্ছেতাই ভাবে গালিগালাজ করলেন।

তন্ময় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে।

মিস্ত্রি:"স্যার ওনাকে বলছেন কি, দায়িত্বে ছিল দিদিমণি, ওনাকে বলুন, স্যার তো উল্টো ছুটে এসে প্রাণ বাঁচালেন আমাদের।"

তন্ময় (হালকা করে):চুপ কর।

এরই মধ্যে দিয়া চলে এলো।

মিঃ চ্যাটার্জী:"ও তাই? অ্যাম ভেরি সরি তন্ময়। দিয়া, তোমাকে তন্ময় এখানে দায়িত্ব দেইনি? কই গিয়েছ কাজ ফেলে? এত দায়িত্বজ্ঞানহীন, এত উদাসীন, ফিট ফর নাথিং।"বলে বকা বকি করতে লাগলেন।

তন্ময়:"স্যার, আপনি আমার ইন্টার্ন কে কিছু বলবেন না। আমার না বুঝে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয় নি। দোষটা আমার। প্লিজ স্যার,ওকে কিছু বলবেন না।আর তোমরা তোমাদের কাজে চলে যাও। দিদিমণি নতুন , ভুল হবেই। যা হবার হয়েছে।"

মিঃ চ্যাটার্জী:"কিন্তু তন্ময়?"

তন্ময়:"না স্যার। চল দিয়া। বাকি কাজ সেরে ফেলি।" বলে দুজনে চলে এলো।

দিয়া(জলভরা চোখে):"সরি স্যার, আমার জন্য অনেক ক্ষতি হলো, অনেক কথা শুনতে হল।"

তন্ময়( অজান্তে দিয়ার হাত ধরে): "শোনো শিখতে হলে অত লাভ ক্ষতির হিসেব করো না। কিছু হইনি। একটু সাবধানে দেখ, চলো, তাহলেই হবে। তুমি খুব ভালো। আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। এখন একটা হাসি দাও তো। আর লাঞ্চ আমার সাথে করবে, তোমার পছন্দ রেস্টুরেন্টে। "বলে হটাৎ মনে হলো একই, কার হাত ধরে আছে, বলে ছেড়ে দিল। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা সলজ্জ হাসি দিল।

আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ হতে থাকে। স্যার আর আপনি বলার বেড়াজাল ছিড়ে আস্তে আস্তে তুমি, তুই লেভেলে নেমে আসে। হালকা খুনসুটি, হাসাহাসি চলতে থাকে। মাঝে মাঝে অনেক রাত অব্দি চ্যাট করে ওরা।

তবে তন্ময় বেশি ধরা দিতে চায় না, কেন, সেটা নাহৈ উজ্জ্যই থাক। তন্ময় জানে বেশি গভীর হওয়া, মানে আবার ক্ষতবিক্ষত হবার ভয়, আবার হাহাকার, আবার মানসিক চাপ, আবার পাওয়া না পাওয়ার প্রত্যাশা। তাই কিছু সম্পর্ক বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনদিকে যাতে না ঘুরে, সেদিকে করা নজর তার।কিন্তু মানুষের মন তো।তন্ময় ও আস্তে আস্তে খোলস ছেড়ে বেরোতে থাকে। হাসে আবার, লাফায় আবার খুশিতে।মনে মনে ভাবে তন্ময় না, এইবার আর ভুল করবেনা। সামনে ভ্যালেন্টাইনস ডে তার টার্গেট।

দিয়ার মনে হালকা হালকা তন্ময় জাগা নিতে থাকে। কেনো জানি মনে হয় যে ওর এই গুরুগম্ভীর ভাবমূর্তির পেছনে কিছু না কিছু লুকিয়ে আছে। চায় দিয়া তন্ময়কে আরো গভীর ভাবে পেতে, তাকে আরো জানতে, কিন্তু তন্ময় ধরা দিতে চায়না। কিন্তু কেনো জানি তন্ময়ের এই শান্ত নিরবতা তাকে আরো কাছে টানে। মনে মনে ভাবে প্রেম দিবসেই তাকে সব খুলে বলবে।তবুও মনে হয় নীলকে একটু বলে নেয়। আফটারাল, পার্টনার ইন ক্রাইম বলে কথা।

এরই মাঝে নীলের উথালপাথাল অবস্থা। দিয়া তার আগের মত ফোন উঠায় না, কথা বলেনা, এনগেজড থাকে। নীলের মনে হয় কোনোদিন দিয়াকে ছেড়ে থাকেনি সে, দিয়ার প্রত্যেক মনখারাপের দিনে, মন ভালর দিনে, তার প্রত্যেক ভালোলাগার দিনে, ভালোবাসার দিনে, নীল তার সর্বসময় সঙ্গী। সেই দিয়ার সঙ্গে আজ সে নেই। দিয়ার প্রত্যেক মুহূর্ত মনে হয়, আর মনে হয় তাকে জড়িয়ে ধরে, জাপটে ধরে বুকের মাঝে, বলে তুই শুধু আমার, তুই হাসি আমার, তুই কান্না আমার, তুই রাগ আমার, দুঃখ আমার। সে অধীর ভাবে অপেক্ষা করে ভ্যালেন্টাইনস ডের জন্য।

তিনটি প্রাণ অপেক্ষা করে প্রেম দিবসের দিকে তাকিয়ে, হয়তো খুশি হবে দুটি প্রাণ, মিলবে দুটি প্রাণ, আরেকজন তাকিয়েই থাকবে, দু-প্রানের মিলনে নিজের ভালোবাসা হারানোর খুশি ভুলে যাবে।

এসে পড়ে ভ্যালেন্টাইন ডে।

তন্ময় খুব গ্রুম করেছে নিজেকে। বেশ দামী দেখে একটা ডার্ক চকোলেট, রেড ভেলভেট কেক, অর্ডার দেয় আর রেড রোজ গুনে গুনে ২৭টা নেয়। বসে থাকে রেস্তোরাঁতে অধীর আগ্রহে, দিয়াকে ঠিকানা পাঠিয়ে।

দিয়া খুব সুন্দর একটা ফিগার হাগিং রেড গাউন এ সাজে। ঠোঁটে রেড লিপস্টিক , চোখে মাস্কারাতে একদম অসাধারন সুন্দরী। জাস্ট বেরোতে যাবে, এরই মাঝে নীলের ফোন।

দিয়া:"১০০ বছর বাচবি, তোকেই ফোন করলাম হলে, তন্ময়ে র সাথে ডেট এ যাবো, তোর রামগরুড়ের ছানা আর আগের মতো নেই রে"।

নীলের বুক ধড়াস করে উঠলো। সে কি, তার দিয়া তাকে কিছুই বললোনা। তাকে কোনোদিন অন্য নজরে দেখেইনি তাহলে। সেই ভুল,ভুল আর ভুল। সব ভালবাসা তার মাটি। তবুও দিয়াকে বেস্ট অফ লাক জানাতে ভুল্লনা।কাদছে নীল, জোরে জোরে , আছরে পড়ে। কেনো সে বলেনি আগে,কেনো? মনে হলো শেষ চেষ্টা করবে কি।

উঠে দাড়ালো নীল। অন করল ভিডিও রেকর্ডারের সুইচ। তার সব কথা, সব যন্ত্রণা, সব কান্না, সব ভালোবাসা, আদর, জীবন দিয়াকে সমর্পণ করলো। বললো আজকের পরে আর কোনোদিন দিয়ার সাথে দেখা করবেনা, খুশি থাকে যেনো দিয়া, ভালো থাকে যেনো দিয়া।তাতেই নীলের শান্তি। নীলের খুশি। করে পাঠিয়ে দিল দিয়াকে, আর ঘুমিয়ে পরলো, একরাশ দুঃখ পাথর চাপা দিয়ে বুকের মাঝে। সময় গড়িয়ে যায়।

হটাৎ দরজায় নক। ঘুমজরানো চোখে দরজা খুলে নীল, খুলেই চক্ষু চড়কগাছ। তন্ময় পিছনে গেটের বা সামনে , কান্না কান্না চোখে। হটাৎ ঠাস করে দিয়া চড় বসালো নীলের গালে।

দিয়া:" পাগল, বুদ্ধু, হাঁদারাম, কোনদিন মুখ খুলে বলতে পারিসনি ? ব্লক করবি আমায়, কেনো, আমি না করবো বলে, তন্ময় আর আমার মাঝে এসে পরবি ভেবে, বোকাচোদার মত বুদ্ধি, রক্ষা গাড়িতে যেতে যেতে মেসেজ পেয়েছি, জল খাওয়া, জল তেষ্টা পেয়েছে, তন্ময়কে খাওয়া, ওই নিয়ে এসেছে।"বলে ঢকঢক করে জল খেলো।


দিয়া:" হ্যাঁ, আমি সত্যি ভাবছিলাম তন্ময়কে প্রপোজ করবো আজকে। কিন্তু তোকে হারিয়ে , নারে ,সবার আগে তুই, জানিস রেস্তোরাঁ তে গিয়ে তন্ময়কে দেখালাম, জানিস কি বলে, বলে নাকি যদি ২ টো মানুষের মাঝে বাছতে হবে, তাহলে বেস্ট ফ্রেন্ডকে বাছ, কারণ ও তোমাকে সারাজীবন দেখেছে, পাশে থেকেছে, তোমার সব সুখ দুঃখের সাথী, তারই অধিকার তোমার ভালোবাসা পাওয়ার। নিজে এসেছে নামিয়ে দিতে বুঝলি। সত্যি, এমন মানুষ হয়।যা থ্যাংকস বলে অায়।আর শোন, আমার সেই স্বপ্নের বাইক টা তোরই, আজ বুঝলাম" বলে নীলকে জাপটে ধরে চুমো খেলো।



নীল:"থ্যাংকস স্যার, আপনি না থাকলে?"

তন্ময়:"নানা, ভালো থাকো দুজনে, দুজনেই চেন দুজনকে, জানো ,এখন জমিয়ে প্রেম করো, ভালো থেকো, আসি আমি তাহলে, বেস্ট অফ লাক, আর হ্যাঁ, কটা প্রেজেন্ট এনেছি, ভালো করে প্রপোজ করো দেখি",বলে সেই ডার্ক চকোলেট, রেড ভেলভেট কেক, অর্ডার দেয় আর ২৭টা রেড রোজ দিয়ে চলে এলো।

বাইরে আসতেই তন্ময় বলে দিয়ার ডাক।

দিয়া:"আমি জানি তন্ময় তোমার মনের কথা। কিন্তু সরি, পারলাম না জানতো, ওকে আর পাবনা সারাজীবন, ভাবতেই কেমন লাগলো, সরি হ্যাঁ, দেখবে তুমি খুব শিগগিরই পাবে তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা।"


তন্ময়:" যাও, অপেক্ষা করে আছে নীল, চললাম, বাই।"

ঘরে এসে তন্ময় বার করলো তার সেই কবিতার বই, তার সব জ্বালা যন্ত্রণার নিরব সাক্ষী।

লিখল

ভালোবাসা: এক নির্মম পরিহাস

"ভালোবাসা; সে এক নির্মম পরিহাস,

ভালোবাসা, না বলা প্রেমিকের উপহাস,

এক জটিল পরিণতি; এক জীবন্ত অভিশাপ,

পেলাম না; পাবও না; সেই শাপ মুক্তি,

তবু থাকি আশায় বসে; বিধাতার করাল গ্রাসের,

দেয় যদি দুটো প্রাণ মেলানোর ক্ষমতা; বাঁচতে চাই ইতিহাসে,

হতে চাই এক নির্বাক প্রেমী; মেলাতে চাই তাদের,

যাতে বলে তারা কোনদিন, এই সেই, মেলালো যে আমাদের"


বসে থাকে তন্ময় আবার, নিঃসঙ্গ কেবিনে, না জানি কিসের অপেক্ষায়?



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance