STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

মিথ ভেঙে মুক্তি

মিথ ভেঙে মুক্তি

9 mins
345

কিছু বছর আগের জানুয়ারি-সন্ধ্যার সেই ফোনটা বোধহয় এই জীবনে ভুলতে পারবেন না মাধবী কোলহৎকর। ফোনের ও পার থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে আসা অনুরোধটাও।


‘‘আজ রাতে আমার কাছে থেকে যাও।’’


পুণেবাসী সংস্কৃতজ্ঞ মাধবীকে এই অনুরোধটি করেছিলেন তাঁর বন্ধু এবং প্রতিবেশী মীরা কোসাম্বি। লেখিকা ও সমাজতাত্ত্বিক মীরাকে দীর্ঘ দিন কাছ থেকে দেখেছেন মাধবী। তাঁর এহেন অনুরোধে কিছুটা বিস্মিতই হয়েছিলেন তাই। একে তো মীরা গুরুতর অসুস্থ। রাত জাগার প্রশ্ন নেই। সর্বদাই নির্জনতাপ্রিয় তিনি। হাতে গোনা কিছু বন্ধু তাঁর আছে ঠিকই, কিন্তু নিজে থেকে তাঁদের রাতে ডেকে পাঠানোর মানুষ তো তিনি নন! তা হলে কি হঠাৎই শরীরটা বেশি খারাপ হল? কিন্তু এটাও মনে হয়েছিল সে দিন মাধবীর, হয়তো কিছু বলতে চাইছেন মীরা। দুরারোগ্য ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে তখন লড়াই করছেন তিনি। সে রাতে তাই একটু দ্রুতই মীরার ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছিলেন মাধবী। সামান্য কিছু কথাবার্তাও হয়েছিল দুজনের মধ্যে। ঘটনাচক্রে সেটাই নিজের বাড়িতে ছিল মীরার শেষ রাত।


তার পর দিনই অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় মীরা কোসাম্বিকে। নিকটাত্মীয়ের অভাবে হাতে গোনা ক’জন বন্ধুই দৌড়াদৌড়ি করছিলেন হাসপাতালে সে সময়। যাঁদের মধ্যে মাধবী ছাড়াও ছিলেন আর এক বন্ধু, ইতিহাসবিদ ও লেখিকা, মুম্বই নিবাসী অবন মুখোপাধ্যায়।


মাসখানেক পর মাধবী আবার একটি ফোন পান। এ বার অবনের কাছে থেকে। অবন জানান, ‘‘জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ছটফট করছে মীরা। ওর কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না। কিছু একটা ওকে আটকে রেখেছে।’’ সে দিনই তাঁরা কথা বলেন মীরার শেষ ইচ্ছা নিয়ে, যা সেই রাতে মাধবীকে বলেছিলেন মীরা। উভয়েই সিদ্ধান্ত নেন যে প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার আনন্দীবাই জোশীর জীবনী লেখার যে কাজটি প্রায় শেষ করে এনেছেন মীরা, সেটি সম্পূর্ণ করে সম্পাদনা সেরে প্রকাশ করতে হবে। আর ফেলে রাখা চলবে না। এবং সে ব্যাপারে রোগশয্যায় শুয়ে থাকা মীরাকে জানিয়ে আশ্বস্তও করতে হবে। কথামতো তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল মীরাকে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই চিরঘুমের দেশে চলে যান মীরা। আশ্চর্যজনক ভাবে সেই তারিখটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫)। যা কিনা আনন্দীবাই জোশীর মৃত্যুবার্ষিকীও বটে!


পঁচাত্তর বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে জন্মানো এই দুই নারীর মধ্যে (আনন্দীবাই এবং মীরা কোসাম্বি) ছিল সময়-ভাসানিয়া এক আত্মিক যোগ। মীরার বন্ধুরা মৃত্যুশয্যায় বন্ধুকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন। মাধবী কোলহৎকর, অবন মুখোপাধ্যায় এবং বিজ্ঞান গবেষক রামকৃষ্ণ রামস্বামী— এই তিন জনের বন্ধুকৃত্যে অবশেষে সম্পাদিত হল মীরার লেখা আনন্দীর জীবনভিত্তিক গ্রন্থটি। সম্প্রতি যা প্রকাশিতও হয়েছে। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তারকে (বিলেত-ফেরতও বটে) নিয়ে লেখা এই বইটির নাম ‘আ ফ্র্যাগমেন্টেড ফেমিনিজ়ম: দ্য লাইফ অ্যান্ড লেটার্স অব আনন্দীবাই জোশী’। এতে রয়েছে অন্য চোখে দেখা আনন্দীবাই জোশীর জীবন এবং এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে না আসা তাঁর চিঠিপত্র। তাঁর দাম্পত্যের অন্তর্লীন টেনশন। আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের মধ্যে চিরকালীন দোলাচলে ভোগা আনন্দীর ভিতরকার দ্বন্দ্ব। যা এত দিন অপ্রকাশ্যই থেকে গিয়েছিল।


আসলে আনন্দীবাই জোশীকে নিয়ে গ্রন্থ তো এই প্রথম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া-র ‘উওম্যান্স মেডিক্যাল কলেজ’ থেকে যে ভারতীয় মহিলা প্রথম ডিগ্রি লাভ করেছিলেন, তাঁকে নিয়ে এত দিনে বহু লেখালিখি হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু তাঁর জীবনী বা তাঁর উপর বই কেন, আনন্দীবাইকে নিয়ে হয়েছে মরাঠি চলচ্চিত্র, তাঁর চরিত্রের ছায়া নিয়ে লেখা হয়েছে মরাঠি উপন্যাস। ফলে তাঁকে নিয়ে মীরা কোসাম্বির নতুন এই বইটি হাতে নেওয়ার আগে পাঠকের কাছে প্রথমেই যে প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে, তা হল, জীবন পণ করে লিখে ফেলা বইটিতে এমন কী রয়েছে যা অন্য এক আনন্দীর খোঁজ দিতে পারে?


বইয়ের সম্পাদকত্রয় বলছেন, মীরার নতুন বইটিতে একটি প্রচলিত মিথ ভেঙে দেওয়া হয়েছে আনন্দী সম্পর্কে। যে মিথের জন্ম দিয়েছিল মরাঠি উপন্যাস এবং ফিল্ম। আনন্দীর এই অবিশ্বাস্য এবং বিস্ময়কর অভ্যুত্থানের কারিগর তাঁর স্বামী গোপালরাও জোশী— নথি দিয়ে এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন মীরা কোসাম্বি। অবন মুখোপাধ্যায় এবং কোলহৎকরের বক্তব্যের নির্যাস, আনন্দবাইয়ের জীবনকথা এত দিন বলা হয়েছে এক পিতৃতান্ত্রিকতার মোড়কে। এর ফলে যথেষ্ট অন্যায় করা হয়েছে আনন্দীর প্রতি। তাঁকে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর আজ্ঞাবহ পুতুল। মীরার গ্রন্থে গোটা বিষয়টিতে নতুন আলো পড়ছে। বিশেষ করে দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে আনন্দীর যে চিঠিগুলি সংগ্রহ করে তাঁর বইয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন মীরা, তা থেকেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে— কতটা স্বাধীনচেতা এবং দৃঢ় মনের অধিকারী ছিলেন আনন্দী। স্বামীর সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে মতবিরোধের সাক্ষ্য বহন করছে ওই দুষ্প্রাপ্য চিঠিগুলি। স্বামী তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এবং বিদেশযাত্রার জন্য সাহায্য করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা করেছিলেন নিজের ‘ইগো’ চরিতার্থ করার জন্য, সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্যও। তাঁকে স্বামীর হাতে নিয়মিত প্রহৃত হতে হত, এ কথা মীরার সংগ্রহ করা আনন্দীর চিঠিতে (যা এই বইয়ে রয়েছে) স্পষ্ট ভাষায় বলা রয়েছে।


যুগের সমাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে বাবা গণপতরাও অবশ্য মাত্র ন’বছর বয়সে তার চেয়ে সতেরো বছরের বড় এক ব্যক্তির (গোপালরাও জোশী) সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি মেয়ের। ব্যাপারটা ঘটেছিল বিড়াল পার করার মতো করেই, সে যুগে সেটাই ছিল রীতি। বছর ছাব্বিশের পোস্টম্যান গোপালরাও সে সময় মহারাষ্ট্রের উচ্চবর্ণের মানুষের সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ইংরেজি আদৌ জানতেন না বলে তাঁকে নিয়ে চলত ঠাট্টা-মস্করা। এটা ঠিক যে জেদবশত হোক বা অন্য কোনও কারণে, শিশু কন্যাকে বিবাহ করতে গোপালরাও একটা শর্তেই রাজি হয়েছিলেন— বিবাহের পর তাঁকে পড়াবেন। আনন্দীর বাবা-মা তাতে মত দেন। গোপালরাও নিজের সামাজিক অপমানের জ্বালা ভুলতে এই শিশু কন্যাটিকে পড়াশোনা করাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। যতটা না ভালবেসে নিজের স্ত্রীকে আলোর দুনিয়ায় নিয়ে আসার জন্য, তার চেয়েও বেশি উচ্চবর্গের কাছে সামাজিক সম্মান এবং আর্থিক নিরাপত্তার লোভে— মীরার এই গ্রন্থ সেটাই তুলে ধরছে।


মীরা লিখছেন যে আনন্দীবাই-গোপালরাওয়ের দাম্পত্য ছিল জটিলতায় ভরা। 


আনন্দীবাই আমেরিকায় থাকার সময় (১৮৮৫ নাগাদ) স্বামীকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছেন। সেগুলি সংগ্রহ করেছিলেন মীরা। একটি চিঠিতে আনন্দী বলছেন, এক গ্রামীণ ভারত থেকে প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার হয়ে ওঠার পিছনে গোপালরাওয়ের অবদান রয়েছে ঠিকই। কিন্তু যে অত্যাচার করা হয়েছে তাঁর উপরে, সে কথাও অকপটে লিখতে পিছপা হননি আনন্দী। মীরা কোসাম্বি তাঁর বইতে এই চিঠিটি তুলে দিয়েছেন। যেখানে আনন্দী লিখছেন, ‘আমার প্রতি আপনার ব্যবহার ভাল ছিল না মন্দ, এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আমায় যদি প্রশ্ন করেন, আমি বলব দু’টোই। আপনার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে হয়তো এটাই ঠিক ছিল। কিন্তু সব দিক বিচার করে বলতেই হবে আপনি ঠিক করেননি। আপনার অত্যাচার একটা বাচ্চার মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে সেটা ভাবেননি। ভাঙা কাঠের টুকরো দিয়ে আমাকে আঘাত করেছেন, চেয়ার বইপত্র আমার দিকে ছুড়ে মেরেছেন, তখন আমার দশ বছর বয়স মাত্র।’

'আমাকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন যখন আমি বারো। আরও কত না নতুন রকম শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন, তখন আমি চোদ্দো। এই প্রতিটি বয়সে ধাপে ধাপে শরীর এবং মনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমার।’ আনন্দী লিখছেন, ‘এক জন হিন্দু নারীর কোনও অধিকার নেই তাঁর স্বামীর সামনে একটি কথাও বলার। অন্য দিকে স্বামী যা ইচ্ছে করে চললে, মুখ বুজে বসে থাকাটাই বিধান। প্রত্যেক হিন্দু স্বামীর উচিত তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ধৈর্যশীলতার প্রশিক্ষণ নেওয়া। আমি অবশ্য এটাও বিশ্বাস করি যে আপনি না থাকলে আজ যে জায়গায় পৌঁছেছি সেখানে হয়তো পৌঁছতে পারতাম না। সে জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞও থাকব। তবে আপনিও অস্বীকার করতে পারবেন না যে আপনার অত্যাচারের, ক্রোধের মুখে আমি সব সময়ই শান্ত থেকেছি।’

এই ‘শান্ত’ থাকার মধ্যে যে এক ধরনের মেনে নেওয়াও কাজ করেছে, সেটা এই বইয়ের অন্যতম উপজীব্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দীবাই হয়ে উঠেছেন এক স্বাধীন চিন্তক। স্বামীকে লেখা তাঁর চিঠিগুলোতেও সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু মীরার পর্যবেক্ষণ, শেষ পর্যন্ত তাঁর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে গিয়েছে। স্বামীকে চিঠিতে তাঁর উপর করা অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু খোলাখুলি ভাবে, প্রকাশ্যে একটি শব্দও বলেলনি। নিজে পেশাদার হওয়া সত্ত্বেও গোপালরাওকে ছেড়ে যাননি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রবণতা, এবং যে সংস্কৃতি থেকে তিনি উঠে এসেছেন তার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথাকেও আমেরিকার বন্ধুদের কাছে কার্যত ডিফেন্ডই করেছেন ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে।

সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই গ্রন্থনাম হিসাবে মীরা কোসাম্বি বেছে নিয়েছেন ‘ফ্র্যাগমেন্টেড ফেমিনিজম’ শব্দদ্বয়কে। বোঝাতে চেয়েছেন আনন্দীর অস্তিত্বের টানাপড়েনকে। এক দিকে সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা মনন, অন্য দিকে মান্ধাতার আমলের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ না করতে পারা— এই দুইয়ের সংমিশ্রণ থেকেই তৈরি হয়েছিল তাঁর নারীবাদ। সম্ভবত জাতীয়তাবাদের আদর্শে সে সময়ে অনুপ্রাণিত ছিলেন আনন্দী। যা থেকে এই ঐতিহ্যের বীজবপন হয়েছিল তার মধ্যে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকায় থাকেননি তিনি (গোপালরাও তাঁকে অনুরোধও করেন আমেরিকায় থেকে যাওয়ার জন্য। সেখানকার অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধায় আনন্দীর স্বামী প্রলুব্ধ হয়ছিলেন বেশি)। দেশজ সংস্কৃতির গর্বে উদ্বেল আনন্দী ফিরে এসেছিলেন। পাশাপাশি স্বদেশের সেবার ইচ্ছাটিও তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল।


বইটির তৃতীয় সম্পাদক রামস্বামীর কথায়, ‘‘গোপালরাওয়ের নীতিবোধ খুব একটা সুবিধার ছিল না। মীরার বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন, আনন্দীবাইকে পড়ানোর পিছনে তাঁর নিজের স্বার্থসিদ্ধির বিষয় ছিল। পরস্পরবিরোধিতাও ছিল তাঁর মধ্যে। যে লোকটি সমাজের সঙ্গে লড়াই করে স্ত্রীকে একা আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পড়ার জন্য, সেই তিনিই সে দেশের তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও ন’গজের শাড়ি পরে থাকতে প্রায় বাধ্য করেছেন আনন্দীকে।’’ মীরা কোসাম্বি নিজেই বইয়ের মুখবন্ধে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘গোপালরাওয়ের আত্মগর্ব, সংস্কারপন্থী কিছু ধারণা, জীবন নিয়ে জুয়া লড়ার প্রবণতা, এক পা সব সময়ই গোঁড়া শিবিরে রেখে দেওয়া— তাঁর স্ত্রীর কাছে অত্যাচারের মতো হয়ে উঠেছিল।’ আমেরিকায় গিয়ে যখন আনন্দীবাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন, তখন সে দেশের রীতিনীতি, সংস্কারকে গালি দিয়েছেন। কিন্তু স্বপ্রচারিত জাতীয়তাবাদ ছেড়ে অর্থলোভে আমেরিকাতেই পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে চেয়েছিলেন গোপালরাও। প্রচার-কাঙাল, অকৃতজ্ঞ, অগভীর এক ব্যক্তির মুখোশ খুলে দিয়েছেন মীরা কোসাম্বি তাঁর বইতে। এর আগে আনন্দীবাইয়ের কোনও জীবনীকার যা পারেননি।এই বই আনন্দীবাই জোশীর অসামান্য কৃতিত্বকে গোপালরাওয়ের ছায়া থেকে মুক্ত করল।


আনন্দীবাঈ গোপালরাও জোশী (মারাঠি: आनंदीबाई गोपाळराव जोशी) (জন্ম : ৩১ মার্চ, ১৮৬৫- মৃত্যু : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৭) ভারতের প্রথম নারী চিকিৎসক। তিনি ছিলেন প্রথম হিন্দু নারী, যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষার্জনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা করেন।


আনন্দীবাই ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে মার্চ ব্রিটিশ ভারতের থানে জেলার অন্তর্গত কল্যাণ গ্রামের এক রক্ষণশীল সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গণপতরাও অম্রুতেশ্বর জোশী। শৈশবে তার নাম ছিল যমুনা। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র নয় বছর বয়সে ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক বিপত্নীক ডাকবিভাগে কর্মরত গোপালরাও বিনায়ক জোশীর সাথে তার বিবাহ দেওয়া হয়। বিয়ের পর তার নাম রাখা হয় আনন্দী। কোলাপুরে থাকাকালীন তিনি একটি সন্তানের জন্ম দিলেও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়।


গোপালরাও একজন নারী শিক্ষার সমর্থক প্রগতিশীল ব্যক্তি ছিলেন, যা তৎকালীন যুগে ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজে খুব একটা সুলভ ব্যাপার ছিল না। গোপাল হরি দেশমুখের শত পত্রে নামক রচনা দ্বারা প্রভাবিত গোপালরাও সংস্কৃত অপেক্ষা ইংরেজি শিক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হন। স্বামীর তত্ত্বাবধানে আনন্দীর শিক্ষালাভ শুরু হয়। কোলাপুরে আনন্দী কিছুদিনের জন্য মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেও সামাজিক বাধায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। চৌদ্দ বছর বয়সে আনন্দী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু মাত্র দশ দিনের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার ফলে আনন্দীর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র পাঠের ব্যাপারে আগ্রহের সৃষ্টি হয়।


তাদের সন্তানের মৃত্যু হলে গোপাল বিদেশের সংবাদপত্রে তার স্ত্রীর চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আবেদন শুরু করেন। প্রায় দুই বছর পরে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারকে লেখা তার চিঠি ক্রিশ্চিয়ান রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হলে থিওডোরা কার্পেন্টার নামে এক মার্কিন মহিলার নজরে আসে। শিক্ষালাভের ব্যাপারে আনন্দীর আগ্রহ এবং স্ত্রীকে গোপালরাওয়ের উৎসাহ তাকে মুগ্ধ করে। থিওডোরা পত্রে আনন্দীবাঈকে আমেরিকায় শিক্ষালাভের ব্যাপারে সব রকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। থিওডোরা ও আনন্দীর মধ্যে পত্রালাপে হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের ব্যাপারেও আলোচনা হত। কলকাতা শহরে থাকার সময় আনন্দীবাঈয়ের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। থিওডোরা তাকে আমেরিকা থেকে ঔষধ প্রেরণের ব্যবস্থা করলেও তা খুব একটা ফলপ্রদ হয়নি। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে গোপালরাও কার্যসূত্রে শ্রীরামপুর শহরে বদলি হলে তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য আনন্দীবাঈকে একা আমেরিকা পাঠিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের ব্যাপারে রাজি করান। থরবর্ন নামক এক চিকিৎসক দম্পতি তাকে উইমেন'স মেডিক্যাল কলেজ অব পেনসিলভ্যানিয়াতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আনন্দীর বিদেশযাত্রার বিরোধিতা করে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তার সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকলেও আনন্দীকে তারা ধর্মান্তরিত করতে উৎসাহী ছিলেন। আনন্দীবাঈ শ্রীরামপুর কলেজে একটি সভায় তার আমেরিকা যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ভারতে একজন হিন্দু মহিলা চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি এই সভায় খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত না হওয়ার শপথও নেন। তিনি ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই এপ্রিল চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হন।


১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে আনন্দী নিউ ইয়র্ক পৌঁছন। সেখানে থিওডোরার সাহায্যে তিনি উইমেন'স মেডিক্যাল কলেজ অব পেনসিলভ্যানিয়াতে ভর্তি হন[৪] এবং ঐ কলেজের অধ্যক্ষা র‍্যাচেল বডলের সাহায্যে একটি বৃত্তি পেয়ে যান। আমেরিকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে, শীতের প্রকোপে ও অপুষ্টিতে কঠিন পরিশ্রম করে আনন্দী যক্ষ্মা রোগের কবলে পড়েন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ আনন্দীবাঈ এমডি ডিগ্রী লাভ করেন।


ডিগ্রী লাভের পর কোলাপুর রাজ্যের কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ পেলে তিনি দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পরে অসুস্থ অবস্থায় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর বোম্বাই ফিরে এসে হাসপাতালে কাজে যোগদান করেন। কাজে যোগদান করার কিছু দিনের মধ্যেই আনন্দী পুনরায় অসুস্থ হয়ে কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিন্তু কালাপানি পেরিয়ে আসা জাতিচ্যুত আনন্দীকে তার সহকর্মী এবং অন্যন্য চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন। বিনা চিকিৎসায় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি রাত দশটায় আনন্দীবাঈয়ের মৃত্যু হয়। তার ভস্মাবশেষ থিওদোরার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা তিনি তার পারিবারিক সমাধিতে স্থাপন করেন।


ক্যারোলিন হেলী ডাল ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দীবাঈয়ের জীবনী রচনা করেন। শ্রীকৃষ্ণ জনার্দন জোশী আনন্দীবাঈয়ের জীবন নিয়ে আনন্দী গোপাল নামক মারাঠি ভাষায় একটি কাল্পনিক উপন্যাস রচনা করেন, যা আশা দামলে পরবর্তীকালেন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। রাম জোগলেকর এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন দূরদর্শন আনন্দীবাঈয়ের জীবনের ওপর আধারিত আনন্দী গোপাল নামক একটি হিন্দি ধারাবাহিক সম্প্রচার করে।


তথ্য : আন্তর্জাল, উইকিপেডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা ও আরো বিভিন্ন পত্রিকা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational