মধুমিতা দেবনাথ

Drama Tragedy Others

4.0  

মধুমিতা দেবনাথ

Drama Tragedy Others

কালী

কালী

4 mins
250


আজ কালী পুজো, পড়ার সবাই ব্যস্ত ক্লাবের প্যান্ডেল এ .... ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলো ...সবাই ক্যাপ বন্দুক, তারা বাজি,বেলুন নিয়ে ছুটোছুটি করছে পুজো মণ্ডপ থেকে বাড়ি..সারা পাড়াময় ... কিন্তু দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে তিন্নি ...ঘরের এক কোনায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ছোট্ট তিন্নি এখন থেকেই যেন সব বোঝে এই মেয়েটা, বাড়ির কারোর সামনে কান্নাকাটি করে না,পাছে মা কষ্ট পায়। শুধু যখন খুউব খুব কষ্ট হয়.. তখন মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দেয়...


- তিন্নি.. তিন্নি কি করছিস ঘরে,কি রে ..কি হয়েছে সোনা কাঁদছিস কেন?

- মা,কালী ঠাকুর খুব খারাপ তাই না!

- কি বলছিস এসব, এরকম বলতে নেই সোনা, ঠাকুর পাপ দেবে...

- তাহলে, কালী ঠাকুর কি বাবার ওই তাসের জোকার!যাকে দেখলে হাসি পায়...

- তিন্নি.. এবার কিন্তু মার খাবি, ঠাকুরের সম্বন্ধে কেউ এমন বলে...!

- তুমি শুধু আমাকেই বকো মা, কিন্তু আমার বুঝি খারাপ লাগে না, আমার বুঝি কান্না পায় না..যখন ওরা সবাই আমাকে বলে আর হাসে..

- কে বলে, কি বলে তোকে সবাই?

- সবাই আমাকে কালী বলে হাসে কেন মা?ওরা বলে আমার সাথে মিশলে নাকি ওরাও কালী হয়ে যাবে, মাসি বাড়ি গেলে ওরাও বলে...মা কালী চলে এসেছে, শুধু জিভটা বের করলেই হলো..আর সবাই মিলে হাসে...দিদিরা আমাকে কোথাও নিয়ে যায় না.. সবাইকে নিয়ে যায়, আমি যাবো বললেই..বলে.. তোকে আমাদের সাথে নিয়ে গেলে আমার মানসম্মান যাবে..সবাই বলবে এই কালো মেয়েটা তোর বোন...; 

এক নিঃশ্বাসে মাকে সবটা বলে সজোড়ে কাঁদতে থাকে তিন্নি...

- মা, আমার নিয়ে গেলে মানসম্মান যায়? মানসম্মান কি মা! 

- তিন্নিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মা, ভাবে.. এটুকু মেয়ের মনে এই সমাজ কতো কালো জঞ্জাল ভরে দিচ্ছে রোজ রোজ, শিশু মনটাকে পিষে মেরে ফেলছে.. আত্মীয় স্বজন, এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, সবাই মিলে... আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিলো তিন্নির মা.. তিন্নি সোনা তুই এসব নিয়ে ভাবিস না..যা প্যান্ডেলে ঠাকুর এসেছে..দেখ গিয়ে যা ...খেল গিয়ে,বাবা তোর জন্য‌ও ক্যাপ বন্দুক এনেছে , নিয়ে যা....

- আমি কোথাও যাবো না মা, আমি বাড়িতেই থাকবো..

- তিন্নির মাথায় একটা চুমু এঁকে দিলো ওর মা..যা সোনা... আমিও যাবো একটু পরে... কখনো এভাবে মন খারাপ করিস না একা একা, কালী নাম যে ভালো.. সবথেকে শুদ্ধ.. ওরা জানে না তাই বলে...

- ঠিক আছে মা, আমি যাচ্ছি.. তুমিও এসো তাড়াতাড়ি....

- ঠিক আছে মা, তুমি এসো তাড়াতাড়ি..

কি রে তিন্নি কোথায় যাচ্ছিস ?(প্রতিবেশী)

- ক্লাবে যাচ্ছি জ্যেঠি...

- হুম যা,দেখ গিয়ে এবার তোর মতো কালী ঠাকুর হয়েছে,আমাদের ক্লাবে. ..হা হা হা

তিন্নির মুখ থেকে আবার হাসি টুকু মিলিয়ে গেলো,আবার কান্না পাচ্ছে ওর,কেনো সবাই এরকম বলে..ক্লাবে এসে এক কোনায় বসে রইলো তিন্নি, আর একদৃষ্টিতে ঠাকুরের দিকে চেয়ে আছে, কোথায় মিল আছে কালী ঠাকুরের সাথে তার,অনেকক্ষণ দেখেও তিন্নি বুঝতে পারলো না..

সবাই ঠাকুর দেখতে আসছে,প্রণাম করছে, আর যাওয়ার সময় তিন্নিকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে যাচ্ছে....

ভর দুপুর বেলা এখন পুজোর জায়গাটা একদম ফাঁকা,তিন্নি আর কালী ঠাকুর ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে...

- ঠাকুর ,সবাই আমাকে নিয়ে হাসে কেনো ঠাকুর ,সবাই এমন বলে কেনো যে আমি কালী।

কালী ঠাকুর তো তুমি,কিন্তু কেউ তো তোমাকে নিয়ে হাসে না! সবাই তো তোমাকে পুজো করে,প্রণাম করে,কতো কিছু তোমার কাছ থেকে ওরা চায় চোখ বন্ধ করে, ওই যে আমার পিসি...দাদার শরীর খারাপ বলে..তোমাকে বলে গেলো...তুমি দাদাকে ঠিক করে দাও,তাহলে পিসি বাড়িতে তোমার পুজো হবে...,কোথায় যাওয়ার সময় তো তোমাকে নিয়ে কেউ হাসলো না। তাহলে তোমার নাম নিয়ে সবাই হাসে কেনো? তুমি তোমার মাকে বলো না.. যেনো তোমার নাম টা পাল্টে দেয়,তাহলে আমাকেও কেউ বলবে না কালী..। আমার তো নাম আছে তিন্নি,কিন্তু সবাই... পাড়ার সবাই, মাসি, জ্যেঠি,পিসি,দাদা,দিদি সবাই আমাকে শুধু কালী বলে আর হাসে...জানো ওরা আমাকে কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যায় না,আমার খুব কান্না পায়,খুব কষ্ট হয়...খুব কষ্ট...কেনো আমার সাথে এমন করে সবাই ঠাকুর ..কেনো?


ছোট্ট তিন্নির মনে যত অভিযোগ ছিলো সব জানিয়ে দিলো ঠাকুরকে,না কোনো প্রত্যুত্তর আসে নি তিন্নির কাছে ...

কেমন এই সমাজ, কেমন এই আত্মীয় যারা বোঝে না....একটা শৈশব কে তারা কিভাবে থেতলে দিচ্ছে, ওই বাচ্চাটার মনে কি প্রভাব পড়ছে এতো তাচ্ছিল্যের...ওই বাচ্চা গুলো তো এখনও বোঝেও না ডিপ্রেসন কি জিনিস, তবুও তারা ধীরে ধীরে একঘরে হয়ে যাচ্ছে,খেলতে পারে না মন খুলে,কোথাও যেতে পারে না ...হাসতে ভুলে যায়..একসময় একটা ঘরে বন্দী করে নেয় নিজেকে। এর প্রভাব এতটাই যে তার পরিবারের ওপর ও পরে...কোন বাবা মা পারে যেখানে তার সন্তান যেতে পারে না..সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে..

এই ডিপ্রেসন টা প্রেমের ব্রেকআপ এর থেকেও ভয়ানক, ছেলেদের জন্য তো একটা কথা চালু আছে "সোনার আংটি বাকা হলেও ভালো" ওদের গায়ের রং শুধু প্রেমের ক্ষেত্রেই একটু কাটা হয় কোনো কোনো মেয়েদের সামনে,কিন্তু আর কোথাও না । আর মেয়েদের ..? কালো মেয়েদের তো মেয়েরাও ঠাট্টা করে, আর এই পুরো সমাজ।আচ্ছা বলতো ,তোমরা কিভাবে বিচার করো সৌন্দর্যের ? যার পিছনে দশটা ছেলে লাইন দিচ্ছে,নাকি ওই গায়ের রং এর ? 

এরকম কতো কতো তিন্নি আজ মাথা নিচু করে কোনো এক কোনায় জায়গা করে নিয়েছে..তার হিসেব নেই,সেই যন্ত্রণার হিসেব নেই..

  সমাপ্ত 🙏


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama