মধুমিতা দেবনাথ

Romance Fantasy Inspirational

3  

মধুমিতা দেবনাথ

Romance Fantasy Inspirational

চোদ্দ বছর পর

চোদ্দ বছর পর

5 mins
272



আজ সকাল থেকেই বড্ড ধকল যাচ্ছে তিন্নির,সকাল থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা কাজের খোঁজে ।এই লকডাউন পরিস্থিতি যে কতটা বিপদের সামনে ফেলেছে মানুষ কে ,সে আর বলার কথা না ..কোথাও একটা পার্মানেন্ট কাজ হচ্ছে না!কোথাও তিন মাস..কোথাও ছয় মাস..কোথাও দু সপ্তাহ...লাস্ট যেখানে কাজ হচ্ছিল সেটাও ছয় সাত দিন হলো চলে গেছে । কিন্তু একটা কাজ তো পেতেই হবে তিন্নির । পাঁচ জনের সংসার ,তার মধ্যে তিন্নি সবার বড় , দায়িত্ব টাও বেশি ..।

বাড়ির সাইকেল টাও খারাপ,দু ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাঁটছে তিন্নি..অটো তে গেলে যেতে আসতে তিরিশ টাকা লাগবে ,ওই তিরিশ টাকাও যে অনেক এই কাজহীন জীবনে । 

হাঁটতে হাঁটতে পুরনো হাই স্কুলের সামনে কিছুক্ষণ থামলো তিন্নি , সেই স্কুল টা .. কতো প্রিয় ছিলো একসময়,আজ আট বছরের প্রাক্তন তিন্নি এই স্কুলের কাছে। পিছন ফিরে আবার চলতে গিয়ে একটু থতমত খেতে হলো তিন্নির,একটা বাইক ঝড়ো হাওয়ার বেগে একদম পাশ কাটিয়ে চলে গেল, আরেকটু অসাবধানতায় ধাক্কা লেগে বড়োসড়ো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতো..


ক্লাস এইট , সন্ধ্যেবেলা টিউশন থেকে ফেরার সময়..একটা সাইকেল হঠাৎ করেই পেছন থেকে এসে পথ আটকায় ...

- একটা কথা ছিলো,শোনো..

- দেখুন প্লিজ পথ ছাড়ুন,এভাবে পথ আটকাবেন না,কেউ দেখলে আমাকে খারাপ বলবে..সরে যান..

- না,না,দাড়াও দাড়াও ,আমি বেশি সময় নেবো না,আমি তোমাকে রোজ দেখি স্কুলে যাওয়া আসার সময়,আমি সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করি,আসলে কথা টা হলো আমি তোমাকে পছন্দ করি...

- প্লিজ সরে যান,আমি বাড়ি যাবো..

- ঠিক আছে,আমি কাল স্কুলের সামনে থাকবো , উত্তর টা কিন্তু তখন দিতেই হবে , না হলে আমি কাল কিন্তু ছাড়বো না...

মনে একরাশ ভয় নিয়ে আবার প্যাটেল ঘোরালো তিন্নি , ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে..একটা লোফার,৪২০ ছেলে,সারাদিন স্কুলের পাশের ক্লাব টায় ক্যারাম খেলে,আড্ডা মারে.. আর সেই ছেলেটা আজ পথ আটকেছে,কাল আবার আটকাবে ... ভাবতে ভাবতে ভয়ে ঘেন্নায় ভিতর টা কুকড়ে আসে ...কি করবো এখন।


না না কাল কিছুতেই স্কুলে যাব না,কিন্তু কতদিন ,সামনে পরীক্ষা স্কুল কোনো মতেই যে বাদ দেওয়া যাবে না, আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কেনো স্কুলে যাচ্ছি না ,কি বলবো তখন ,বাবা জানতে পারলে না জানি কি হবে...কি করি এখন , কি করি...!


- হ্যালো...জয় ..

 ( জয়,রং নাম্বার থেকে পরিচিত,খুব ভালো একজন বিশ্বাসী বন্ধু)- হুম বলুন..কি ব্যাপার..?

- আমাকে একটা হেল্প করুন না প্লিজ ,আমি খুব বিপদে আছি,আপনাদের ওখানে বাড়ি ..একটা ছেলে আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে,আজ রাস্তা আটকে ছিলো,কাল আবার আটকাবে স্কুলের সামনে বললো,প্লিজ কিছু করুন...

- ঠিক আছে,আমি দেখছি..

- হুম,আজকের মধ্যেই কিছু একটা করুন,নাহলে ওই লোফার ছেলেটার জন্য ......

সকাল সকাল রেডি হয়ে স্কুলের জন্য তৈরি তিন্নি,রাতে ভালো ঘুম হয় নি,সাথে একরাশ ভয় নিয়ে কোনমতে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে পৌঁছায় তিন্নি,স্কুলে ঢোকার আগে একবার চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নেয় ...না ওই ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না আজ ,একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তিন্নি,স্কুল ছুটির পরও বাইরে কোথাও কোনো অসুবিধে হয় নি, উফ্ কতটা যে নিশ্চিন্ত লাগছে। নিশ্চয় জয় কিছু বলেছে,বাড়ি ফিরে ফোন করে একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে জয় কে...

- হ্যালো জয়,অনেক ধন্যবাদ আপনাকে..

- হুম বুঝলাম, আর কখনো বিরক্ত করবে না আপনাকে..

- আচ্ছা,সে না হয় বুঝলাম,কিন্তু কি বলেছেন আপনি? যে ওই ৪২০ ছেলেটা মেনে নিল!

- বলেছি ..একটা কথা,আপনি হাসবেন না তো...

- না হাসবো না,আপনি যা উপকার করেছেন আমার তা বলে বোঝাতে পারবো না..

- আমি বলেছি..আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড, ও যেনো আপনাকে আর বিরক্ত না করে ..

- সত্যি,আপনি পারেন বটে,যাক গিয়ে ঝামেলা তো গেলো..হা হা হা...

তারপরও আরও চার বছর ওই স্কুল টাতে ছিলাম, নাহ্,আর কখনো বিরক্ত করেনি,কখনো সামনা সামনি পড়ে গেলে মাথা নিচু করে সরে গেছে...

উচ্চমধ্যমিক এর পর স্কুলের এই দিকটায় আর কখনো আসতে হয় নি...আজ এতো বছর পর আবার এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি কাজের খোঁজে...

- এই যে শোনো...

পুরনো স্মৃতিগুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই , পিছন থেকে আবার ডাক,তারপর সোজা বাইক থামিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে..

- বলছি , একটু দাঁড়াও, তিন মিনিট ,এর বেশি টাইম নেবো না...

আরে এ তো সেই ছেলেটা,চোখ মুখ এ একটু ভদ্রস্থ ভাব আসলেও পুরোপুরি লোফার নাম টা এখনও ঘোচে নি , তবে কথাবার্তায় এখন সেই কাঠিন্য ভাব টা নেই , অনেক গুলো বছর পার হয়ে গেছে,আমিও আর সেই ছোট্টটি নেই ,শারীরিক ,মানসিক দিক থেকে অনেক পরিবর্তিত আজকের তিন্নি,এখন আর আগের মতো একটু কিছুতেই ভয়ে কুকড়ে যায় না তিন্নি..

আমাকে কি এই ছেলেটা চিনতে পারলো! .....

না না এটা সম্ভব না, এইট এ পড়া মেয়েটার সাথে এই পঁচিশ বছরের মেয়েটার অনেক তফাৎ ... শারীরিক পরিবর্তন আছে অনেক ,তাছাড়া এই লকডাউন পরিস্থিতি তে মুখে মাস্ক আছে...

- বলছি শোনো, আমি চলেই যাচ্ছিলাম বাইক নিয়ে, কিন্তু আবার ফিরে আসতে হলো, তোমাকে কিছু বলার আছে, বলতে পারো কিছু জানার আছে..

নাহ্,তিন্নি এখন আর ভয় পায় না, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, তবুও কেন জানিনা কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না মুখ থেকে...

- এই যে হ্যালো, আমি বেশিক্ষণ সময় নেবো না,প্লিজ..

- সম্বিত ফিরল তিন্নির, হুম বলুন কি বলতে চান...

- না মানে, তোমার ওই দাস পাড়াতে বাড়ি না.?

- মানে!

- তুমি এই স্কুলেই পড়তে তো?

- (কিছুক্ষন চুপ থেকে তিন্নি জবাব দেয়) হুম, আমি এই স্কুলেই পড়তাম,

কথাটা বলার সাথে সাথেই ছেলেটার চোখ মুখ যেনো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তিন্নি সেটা লক্ষ্য করল..

- তুমিই কি সে...!

তিন্নি অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল..

- কি হলো বলো, তুমিই কি সে..?যাকে আমি সন্ধ্যে বেলায় রাস্তা আটকে....

- এরকম একটা পরিস্থিতি তে পরবে তিন্নি কখনো ভাবতেও পারেনি..জড়তা কাটিয়ে উত্তর দিলো.

হুম আমি সে..এ..ই...

ছেলেটার সর্বাঙ্গে যেন একটা খুশি, আনন্দ ঝড়ে পড়ছে...

- তুমি সেই.. আমি জানতাম তুমি সেই. ‌.আমার কিছুতেই ভুল হতে পারে না, আমি জানতাম.. আমি জানতাম.. ওহ্ গড...

- আমি চললাম, রাস্তা ছাড়ুন...

- কেমন আছো তুমি?

- ভালো.... এবার সরুন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে..

- আরেকটা কথা ছিল... তুমি কি এখান দিয়েই রোজ যাও..

- কেন বলুন তো... আর আপনি আমাকে চিনলেন কি করে... আমি তো এদিকে আসিনা কখনো.. অনেক বছর পর আসলাম...

- সত্যি বলতে, তোমার চোখ দেখে,এই চোদ্দ বছরেও ওই চোখ দুটো আমি ভুলতে পারি নি... শুধু একটু পরিবর্তন হয়েছে, আগে এই দুটোতে ভয় মেশানো থাকতো,এখন সেটা আর নেই... তবে সেই সারল্যতা এখনো আছে..

তিন্নি আর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না,পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগলো,

- এই যে শোনো, আরও কিছু বলার ছিলো যে...

নাহ্, তিন্নি আর থামবে না, আর পিছন ফিরেও তাকাতে চায় না, শুধু সামনে রাস্তার পাশের দোকানের কাঁচের দরজাটায় দেখতে পেলো.. ছেলেটা এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তিন্নি কে দেখে যাচ্ছে...

নাহ্ তিন্নির মনে আজ কোনো অনুভূতি জাগে না, শুধু অনেক গুলো প্রশ্ন মনে জমাট বেঁধে যাচ্ছে...কি করে সম্ভব এমনটা! চোদ্দ বছর আগে শুধু মাত্র পাঁচ ছয় বার দেখে এভাবে মনে রাখা... যেখানে তিন্নি এখন অনেক পরিনত ২৫বছরের একটা মেয়ে, দুবছরের সম্পর্কে যাকে তিন্নি নিজের সর্বস্ব উজাড় করে ভালো বেসেছে এক বছরের ছিন্নতায় তার মুখ ও এখন ঝাপসা... তাছাড়া এই মাস্ক পড়া অবস্থায় সামনে দাঁড়ালে হয়তো চিনতেও পারবে না.. তবে এই ছেলেটা কি করে চিনতে পারলো তিন্নিকে, শুধু চোখ দেখে এতটা... হয়তো ৪২০,লোফার ছেলেরা এমন‌ই হয়... তাদের আবেগ টা হয়তো এতটাই দৃঢ়...

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল তিন্নির মাথার ওপরে ওই নীল গভীর সমুদ্রটার উদ্দেশ্যে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance