জোছনার চিঠি।
জোছনার চিঠি।
এই শহরটা বড় বেশি যান্ত্রিক, কেবল রাতের জোছনাটুকু ছাড়া। আমি, নিলয়, পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। আমার জীবনটা সাদামাটা, প্রায় স্থির জলের মতো। আমার সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাস হলো পূর্ণিমার রাতে বারান্দায় বসে জোছনা দেখা। আমি বিশ্বাস করি, "মানুষের জীবনে যা কিছু হারানো—তা সময়ের কোনো ফাইলে জমা থাকে না, তারা কেবল জোছনার মতো এক টুকরো আলো হয়ে ফিরে আসে।"
আমার এই নির্জন বারান্দা থেকেই এক অদ্ভুত সম্পর্কের জন্ম হয়েছিল। ঠিক সাত বছর আগে। তখন আমার বয়স ছিল ৩৩। আমি পাশের পুরোনো, দেয়াল-শ্যাওলা ধরা বাড়িটার ছাদে এক তরুণীকে দেখতাম। সেও আমার মতোই একা বসে জোছনা দেখত। আমরা কেউ কারো নাম জানতাম না, কথা বলিনি কোনোদিন। কেবল নীরব চাহনির আদান-প্রদান চলত। আমি তার নাম দিয়েছিলাম 'ছাদ-জোছনা'।
একদিন, খুব সাহস করে, আমি তার জন্য একটি প্রেমপত্র লিখি। সেটি ছিল আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেমপত্র। তাতে আমার মনের সব অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো লিখেছিলাম। চিঠিটা ড্রয়ারে রেখে দিলাম। সাহস করে দেওয়া হলো না। আমি ভাবলাম, "হয়তো কিছু জিনিস না দেওয়ায়ই সৌন্দর্য। তাতে অপূর্ণতার একধরনের কাব্য থাকে।"
কিন্তু এই অপূর্ণতাতেই লুকিয়ে ছিল এক গভীর রহস্য।
মাসখানেক পরেই সেই মেয়েটি আর ছাদে এলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা, আমার জোছনা দেখা—সবকিছুই অর্থহীন মনে হতে লাগলো। আমি জানতাম না, সে কোথায় গেল।
ঠিক সাত বছর পর, গত পূর্ণিমার রাতে। যখন জোছনা সব কিছুকে মায়াবী করে তুলেছে, তখন হঠাৎ পাশের বাড়িটার ছাদ থেকে হালকা বাতাসে উড়ে এলো একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটা ভিজে গেছে, ঠিক যেন শিশিরে ভেজা। আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল।
আমি কাঁপতে কাঁপতে চিঠিটা তুলে নিলাম। কাগজটা পুরনো, তাতে বিবর্ণতার ছাপ। হাতের লেখাটা ছোট, টানা-টানা।
"জানেন নিলয়, আমি প্রতিরাতে আপনাকে দেখি। আপনার জোছনা দেখা দেখি। সাত বছর ধরে। আমার একটা জিনিস মনে হয়, 'অপেক্ষা জিনিসটা মানুষকে নষ্ট করে না, বরং বাঁচিয়ে রাখে।' কিন্তু আমি আর পারছি না। এই রাতে, যখন আপনি চিঠিটা পড়ছেন, তখন আমি হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় চলে গেছি। আপনি আমার জন্য একটা চিঠি লিখেছিলেন, মনে আছে? আমি সেই চিঠিটা সযত্নে রেখে দিয়েছি।"
— ইতি, শুধু আপনার জন্য
আমার শ্বাস আটকে এলো। সাত বছর আগের ঘটনা! আমার না দেওয়া চিঠির কথা! আমি দ্রুত আমার ড্রয়ারে গিয়ে পুরোনো চিঠিটা দেখলাম—ঠিক জায়গায় আছে। তাহলে এই মেয়ে কীভাবে জানলো? আর সে চলে গেল মানে?
আমি বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত পাশের বাড়িটার দরজায় কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ পর দরজা খুললেন এক বৃদ্ধা। চোখে গভীর শূন্যতা, পরনে পুরোনো শাড়ি।
আমি চিঠিটা প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "মা, এই চিঠি কে লিখেছে? আর এই ঘরে কি সাত বছর আগে কেউ..."
বৃদ্ধা শান্তভাবে আমার দিকে তাকালেন। তারপর মৃদু হাসলেন। সেই হাসিটা খুব শীতল। তিনি বললেন, "ও আমার মেয়ে ছিল, নাম দীপা। সাত বছর আগে এই জোছনার রাতেই সে আত্মহত্যা করেছিল। সে আপনার মতোই জোছনা ভালোবাসতো। আপনি যাকে 'ছাদ-জোছনা' বলে ডাকতেন।"
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি বললাম, "কিন্তু...কিন্তু এই চিঠিতে তো বলা হচ্ছে যে সে আমার লেখা চিঠির কথা জানে! আমি তো তাকে চিঠি দিইনি!"
বৃদ্ধা তার চোখের জল সামলে বললেন, "দীপা বিশ্বাস করতো, আপনি তাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে প্রতিদিন আপনার বারান্দার দিকে তাকিয়ে কল্পনা করতো, আপনি তাকে ভালোবাসার কথা লিখেছেন। সে জানতো যে আপনি লিখবেন। আপনি তাকে চিঠি দেননি, কিন্তু সে আপনার ড্রয়ারে রাখা চিঠিটার কথা কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিল। আপনি জানেন, 'কিছু মানুষ স্বপ্ন দিয়ে বাঁচে, আর স্বপ্ন দিয়েই মরে।'"
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার না দেওয়া চিঠিই তার জন্য যথেষ্ট ছিল।
তখনই আমি বৃদ্ধার হাতের কাছে একটা পুরোনো ছবির ফ্রেম দেখলাম। ফ্রেমে মেয়েটি—দীপা—বিষণ্ন চোখ, আর তার হাতে একটি হলুদ হয়ে যাওয়া ভাঁজ করা চিঠি। হুবহু আমার হাতের লেখায় লেখা চিঠিটার মতোই দেখতে!
আমার মনে হলো, হয়তো জোছনা, নিঃসঙ্গতা আর নীরব ভালোবাসার অদ্ভুত রসায়নে, সেই মেয়েটি আমার মনের চিঠিটি পড়তে পেরেছিল। কিংবা হয়তো তার বিশ্বাস আমার লেখাটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল।
আমি বৃদ্ধার অনুমতি নিয়ে মেয়েটির হাতে থাকা ফ্রেমের ছবিটি, আমার ড্রয়ারে রাখা না দেওয়া চিঠিটার ছবি এবং দীপার লেখা 'জোছনার চিঠি'-এর ছবি তুলে দ্রুত অনলাইনে পোস্ট করলাম। ক্যাপশনে লিখলাম:
"সাত বছর আগে আমি যাকে চিঠি দিইনি, সে কীভাবে জানলো? জোছনার রাতে আমার কাছে এলো সাত বছর আগের চিঠি, আর এই মেয়েটিকে চেনেন কেউ? জোছনা কি আজও চিঠি পৌঁছে দিতে পারে?"
পোস্টটি দেওয়ামাত্রই ভাইরাল হতে শুরু করলো। হাজার হাজার মানুষ জানতে চাইছে, এটি সত্যি কি না। এটি কি প্রেম? নাকি রহস্য?
আমি বারান্দায় ফিরে এলাম। জোছনা তখনও আছে। কিন্তু এখন তা আরও ভারী, আরও বিষণ্ণ। আমি কেবল বুঝলাম, "এই পৃথিবীতে কিছু অপূর্ণতা কখনও পূর্ণতা চায় না। তারা জোছনার মতো রহস্য হয়ে জীবনভর আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, আর সেই রহস্যই হয়ে ওঠে সবচেয়ে সুন্দর গল্প।"
আমি জানি, এই রহস্যের কোনো উত্তর নেই। কেবল এই জোছনার চিঠিই প্রমাণ করে দিল—মনের কথা লেখা হলে, তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে সময়ের বাঁধন মানে না।

