STORYMIRROR

মোঃ ফখরুল ইসলাম সাগর।

Inspirational

4  

মোঃ ফখরুল ইসলাম সাগর।

Inspirational

বিস্ফোরণ!

বিস্ফোরণ!

4 mins
10

গল্পের বর্ণনা:-

লোভ ও ক্ষমতার দ্বারা ছিন্নভিন্ন এক গ্রামে, যেখানে ঘরবাড়ি ছাই হয়ে যায় এবং স্বপ্নগুলো ধুলোয় মিশে যায়, সেখানে একজন মানুষের নীরব দুঃখ এক জ্বলন্ত সংকল্পের জন্ম দেয়। “বিস্ফোরণ!” হলো স্থিতিস্থাপকতা, ঐক্য এবং মানুষের নিজেদের জমি ও মর্যাদার জন্য লড়াই করার অদম্য চেতনার এক শক্তিশালী গল্প। হতাশা থেকে সম্মিলিত গর্জন পর্যন্ত রূপান্তর প্রত্যক্ষ করুন, যেখানে একটি একক কণ্ঠস্বর একটি বিপ্লবকে প্রজ্বলিত করে তোলে। এই গল্পটি অনুসন্ধান করে কীভাবে ধ্বংসের ছাই এক অপ্রতিরোধ্য উত্থানের উর্বর ভূমিতে পরিণত হতে পারে।

অধ্যায় ১: ধ্বংসের ছায়া।

সূর্য যখন রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখনও গাঁয়ের প্রতিটি উঠোনে চাপা দীর্ঘশ্বাস আর ভয়ের হিমশীতল বাতাস বইছিল। সন্ধ্যা নামতেই চারদিক থেকে ভেসে আসছিল পোড়া কাঠের গন্ধ, আর দূরে দেখা যাচ্ছিল কিছু জ্বলন্ত ঘরের কালো ধোঁয়া। রতন মিস্ত্রির চোখ দুটো ছিল শুকনো, কিন্তু তার অন্তরাত্মা যেন এক অজানা যন্ত্রণায় ফুঁসে উঠছিল। হাতে লাঠি নিয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল তার ভাঙা ঘরের সামনে। পাশে তার স্ত্রী রাধা, কোলে তাদের ছোট ছেলে, আর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরেক ছেলে মিঠুন। তাদের চোখে ছিল শুধুই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা।

কয়েক মাস আগে, এই গাঁয়ে এসেছিল একদল লোক, যারা নিজেদের ক্ষমতাবান বলে দাবি করত। তাদের চোখ ছিল গাঁয়ের উর্বর জমি আর সহজ সরল মানুষের শান্তির ওপর। তারা চেয়েছিল এই মাটিকে কেড়ে নিতে, এই ঘরগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে। প্রথমে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে, তারপর হুমকি দিয়ে, আর শেষে রাতের আঁধারে জ্বালিয়ে দিয়েছিল একের পর এক কুঁড়েঘর। রতন মিস্ত্রির ঘরও তাদের রোষানল থেকে বাঁচেনি। তার সারা জীবনের স্বপ্ন, তার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি, সব এক মুহূর্তে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

রতন আজও স্পষ্ট দেখতে পায় সেই রাতের বিভীষিকা। অগ্নিশিখা গ্রাস করছিল তার ঘরকে, আর সে অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখছিল তার স্বপ্নগুলো পুড়ে ছারখার হচ্ছে। তার কানে বাজছিল সেই সময়ের আর্তনাদ, শিশুদের কান্না, আর মানুষের অসহায় চিৎকার। রাধা আজও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠে। মিঠুন বারবার জিজ্ঞেস করে, “বাবা, আমাদের ঘরটা কারা ভাঙলো?”

রতন কোনো উত্তর দিতে পারে না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিন্তু তার নীরবতা দুর্বলতা ছিল না। তার বুকে জমছিল এক স্ফুলিঙ্গ, যা ধীরে ধীরে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছিল। সে জানত, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। এই নীরবতা ভাঙতে হবে। এই ভাঙা ঘরের পেছনে যে শক্তি কাজ করেছে, তাকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তার রক্তে তখন বাজছিল এক অস্ফুট সুর, এক প্রতিবাদের গান, যা এখন তার রক্তে মিশে গেছে।

অধ্যায় ২: অভ্যুত্থান।

সেই রাতের পর থেকে রতন মিস্ত্রির ঘুম উধাও। সে দিনের পর দিন গাঁয়ের অন্য মানুষদের সাথে কথা বলে, তাদের মনে সাহস জোগায়। ধীরে ধীরে, তার কথায় একজোট হতে শুরু করে গাঁয়ের মানুষ। তাদের চোখেও এখন শুধু ভয় নয়, প্রতিবাদের এক দৃঢ় সংকল্প দেখা যায়। তারা বুঝতে পারে, একা থাকলে সবাই ধ্বংস হবে, কিন্তু একজোট হলে তারা যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

একদিন গাঁয়ের বটতলায় সবাই জড়ো হয়। সেখানে রতন মিস্ত্রি তার সব বেদনা, তার সব ক্ষোভ উজাড় করে দেয়। তার প্রতিটি শব্দে ছিল প্রতিবাদের আগুন, যা শুনে উপস্থিত সকলের মনেও জ্বলে ওঠে দ্রোহের শিখা। রতন শুরু করে তার সেই কবিতা, যা তার মনের গভীরে এতদিন ধরে লুকিয়ে ছিল:

বিস্ফোরণ!

“কারা মোর ঘর ভেঙেছে, স্মরণ আছে সেই দিন,
জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, পুড়েছে সব ঋণ।
তোমরা যারা কেড়েছ সব, ভাঙতে চেয়েছ স্বপ্ন,
জেনে রেখো প্রতিবাদের আগুন, তা হবে না ম্রিয়মাণ।
বুকের গভীরে জমেছে ক্ষোভ, ক্রোধের আগুন জ্বলে,
অন্যায়ের প্রতিবাদে আজ, পৃথিবী প্রকম্পিত করে।

ছিঁড়ে ফেলেছি শিকল যত, ভয়কে করেছি জয়,
নতুন দিনের সূর্য উঠবে, ভাঙব সব সংশয়।
কারাগারে রেখেছ যত, স্তব্ধ করতে চেয়েছ কণ্ঠ,
প্রতিটা কণ্ঠস্বর আজ, হয়ে উঠেছে দিগন্ত।
মিথ্যার বেড়া ভেঙে, সত্যের হবে জয়,
গণতন্ত্রের হবে জয়, আর হবে না ক্ষয়।

এই যে দেখছ নীরবতা, ভেবো না দুর্বলতা,
এ নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস, আসবেই ক্ষমতা।
তোমাদের ঔদ্ধত্য, তোমাদের ছলনা,
আর নয় সহ্য করা, থামবে না এ রোনা।
প্রতারণার জালে যতই বাঁধতে চাও,
মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ততই বেড়ে যাবে, যতই আঘাত দাও।

কৃষকের ঘামে ভেজা মাটি, শ্রমিকের ভাঙা হাত,
শিক্ষার্থীর স্বপ্নগুলো, সব হয়েছে আঘাত।
জাগো হে জনতা, আর ভয় নয়, রুখে দাঁড়াও আজ,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বালো, প্রতিবাদের মশাল।
এই যে দেখছ ক্ষুদ্র আমি, নই আমি একা,
আমার পেছনে আছে, লক্ষ মানুষের রেখা।

রক্তে রঞ্জিত পথ, আজ হবে নতুন ইতিহাস,
শোষকের সিংহাসন হবে চূর্ণ, ভাঙবে সব অবিশ্বাস।
আমার কণ্ঠস্বর আজ, সবার কণ্ঠের সুর,
ভবিষ্যতের পথে আমরা, যাব বহুদূর।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর, এই শিখা জ্বলবে,
মুক্তি আর ন্যায়ের তরে, আমরা লড়ব।
সত্যের জয় হবেই, আঁধার হবে বিলীন,
প্রতিবাদের পতাকা উড়বে, আসবেই সুদিন।”

রতন মিস্ত্রির কবিতা শেষ হতেই পুরো বটতলা জুড়ে এক অন্যরকম নীরবতা নেমে আসে। নীরবতা নয়, যেন এক নতুন প্রতিবাদের জন্ম। প্রতিটি মুখেই তখন দৃঢ় সংকল্পের ছাপ। সেই দিন থেকে গাঁয়ের মানুষ আর ভয় পায়নি। তারা হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে শুরু করে। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এক বজ্রধ্বনি হয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের ঘর তারা নিজেরাই গড়বে, আর কোনো শোষণকারী তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। তাদের এই জাগরণই ছিল সত্যিকারের বিস্ফোরণ!, যা কেবল একটি গাঁয়ের নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational